বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের কৃতিত্ব শেখ মুজিবের
১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে ভায়া লন্ডন ও দিল্লী হয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন। ১২ জানুয়ারি শপথ নিলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসাবে চারদিকে এক নাজুক পরিস্থিতি। তাহলে তাে প্রায় দুই দশকের ব্যবধানে আজকের নতুন প্রজনের জন্য সেদিনের ঘটনা প্রবাহ গুছিয়ে বলতেই হচ্ছে। একথা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সফল নেতৃত্বের জন্যই এক রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাঝ দিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম। উপরন্তু তাঁরই প্রচেষ্টায় এদেশের জনগােষ্ঠী বাঙালি জাতিসত্ত্বার পরিচয় লাভে সক্ষম হয়েছে। এক্ষণে পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু আর একটি দুরূহ দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের মাটি থেকে বিদেশী ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার। ধুমাত্র আলােচনার মাধ্যমে এদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করার একক কৃতিত্ব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। অবশ্য এক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আতরিক সহযােগিতা ছিল তুলনাহীন। আমার স্থির বিশ্বাস বাংলাদেশের অন্য কোনাে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষে এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন অসম্ভব ছিল।
স্বাধীনতা অর্জনের ঠিক ৯০ দিনের মাথায় কীভাবে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার হলাে, সে আমলের একজন পদস্থ সরকারি কর্মচারী হিসাবে আমি নিজেই সেই ঐতিহাসিক ঘটনার অন্যতম সাক্ষী। কলিকাতায় আমি বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সফরসঙ্গী ছিলাম। ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। আমি তখন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মহাপরিচালক (পরবর্তীকালে এই পদের বিলুপ্তি ঘটে)। দিন দুই আগে ঢাকা থেকে ৩৫ জন সাংবাদিক নিয়ে কোলকাতায় এসেছি। এসব সাংবাদিকরা কোলকাতায় এসেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর প্রথম বিদেশ সফর সংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহের জন্য। এদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে কোলকাতার বিখ্যাত গ্রেট ইস্টার্ন হােটেলে। আমি ছিলাম রাজভবনে। দুপুরে খাওয়ার পর এই রাজভবনেই আমরা জনাকয়েক উচ্চ পদস্থ কর্মচারী। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের সঙ্গে একান্তে আলাপ করছিলাম। আমার মনে তখন দারুণ কৌতূহল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বুকে সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘স্যার, বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে আলােচনা হতে যাচ্ছে, তাতে কোন এজেন্ডা’ তাে দেখলাম না? তাহলে আপনারা কী কী বিষয় আলােচনা করবেন?”
শেখ সাহেব তার পাইপটাতে ঠিকমতাে আগুন ধরিয়ে এরিনমাের তামাকের গন্ধওয়ালা এক গাদা ধোয়া ছেড়ে কথা বলতে শুরু করলেন। ‘পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনে গেলাম। সেখান থেকে ঢাকায় আসার পথে দিল্লী বিমান বন্দরে জীবনের প্রথম এই মহিলাকে (ইন্দিরা গান্ধী) দেখলাম। এর আগে তাে এর সঙ্গে আমার কোনাে পরিচয়ই ছিল না।’ সঙ্গে সঙ্গে বললাম, স্যার মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দারুণভাবে সাহায্য করা ছাড়াও আপনার জীবন বাঁচাবার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন।” বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে আবার কথা শুরু করলেন। “তােদের বন্ধু-বান্ধবরা তাে আমাকে অর্ধশিক্ষিত বলে। তাহলে ইতিহাস থেকে একটা কথার জবাব দে? আজ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদ কিংবা কম্যুনিস্ট কিংবা অন্য কেউ, যারাই অন্যদেশে সৈন্য পাঠিয়েছে, তারা কি স্বেচ্ছায় সৈন্য প্রত্যাহার করেছে? তাের কি দেখাতে পারি যে এমন কোনও দেশ আছে? হঠাৎ করে আলােচনার পরিবেশ খুবই গুরুগম্ভীর হয়ে উঠলাে। আমরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। উনি পাইপে পরপর কয়েকটা টান দিয়ে হালকা মেজাজে কথা আরম্ভ করলেন। কানের মাঝ থাইক্যা পাকা চুল বাইরাইয়া আছে ভারতে এমন সব ঝানু পুরানাে আইসিএস অফিসার দেখছােস? এরা সব ইন্দিরা গান্ধীরে বুদ্ধি দেওনের আগেই আজ আলােচনার সময় মাদামের হাত ধইর্যা কথা লমু। জানােস কী কথা? কথাটা হইতাছে, মাদাম, তুমি বাংলাদেশ থাইক্যা কবে ইন্ডিয়ান সােলজার ফেরত আনৰা?”। বঙ্গবন্ধু তার দেয়া প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। কোলকাতার রাজভবনে ফাস্ট রাউন্ড আলােচনার শুরুতে দুজনে পরস্পরের কুশলাদি বিনিময় করলেন। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার জন্য ভারতের জনগণ, ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে আসল কথাটা উত্থাপন করলেন।
শেখ মুজিব : মাদাম, আপনে কবে নাগাদ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করবেন? ইন্দিরা গান্ধী : বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি তাে এখনও পর্যন্ত নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। পুরাে সিচুয়েশন বাংলাদেশ সরকারের কন্ট্রোলে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা কি বাঞ্ছনীয় নয়? অবশ্য আপনি যেভাবে বলবেন সেটাই করা হবে। শেখ মুজিব : মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রায় ৩০ লাখ লোেক আত্মাহুতি দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আইন ও শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির জন্য আরও যদি লাখ দশেক লােকের মৃত্যু হয়, আমি সে অবস্থাটা বরদাশত করতে রাজি আছি। কিন্তু আপনারা অকৃত্রিম বন্ধু বলেই বলছি, বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব। ইন্দিরা গান্ধী : এক্সেলেনসি, কারণটা আর একটু ব্যাখ্যা করলে খুশি হব।
শেখ মুজিব : এখন হচ্ছে বাংলাদেশে পুনর্গঠনের সময়। তাই এই মুহূর্তে দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক বিরােধিতা আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিকে অছিলা করে আমাদের বিরােধী পক্ষ দ্রুত সংগঠিত হতে সক্ষম হবে বলে মনে হয়। মাদাম, আপনেও বােধ হয় এই অবস্থা চাইতে পারেন । তাহলে কবে নাগাদ ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করছেন? ইন্দিরা গান্ধী : (ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করলেন) এক্সেলেনসি, আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী ১৭ মার্চ বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে। শেখ মুজিব : মাদাম কেন এই বিশেষ দিন ১৭ মার্চের কথা বললেন?
ইন্দিরা গান্ধী : এক্সেলেন্সি প্রাইম মিনিস্টার, ১৭ মার্চ হচ্ছে আপনার . জন্মদিন। এই বিশেষ দিনের মধ্যে আমাদের সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে আসবে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ভারত সরকারের ব্যুরােক্রেসি এবং দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মহলের বিরােধিতাকে অগ্রাহ্য করে ইন্দিরা গান্ধীর সুস্পষ্ট নির্দেশে যেদিন ভারতীয় সৈন্যদের শেষ দলটি বাংলার মাটি ত্যাগ করলাে, সেদিনের তারিখটি হচ্ছে ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মদিন। ইতিহাসের নির্মম পরিহাসই বলতে হয়। উপমহাদেশের শান্তি স্থাপনের জন্য নিবেদিত এই দুই মহান নেতাই পরবর্তীকালে আততায়ীর হস্তে নিহত হলেন। এরপরেও কথার পিঠে কথা থেকে যায়। সেই কথাগুলাের সারবত্তা নিম্নরূপ :
ক. ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার মােকাবেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। এজন্যই বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন বাংলাদেশের স্রষ্টা এবং জাতির পিতা।
খ.বঙ্গবন্ধুর উচ্চারিত ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্যেই আমাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয়। অতএব এই জয় বাংলা স্লোগানের সূত্র থেকে আমাদের আত্মপরিচয় সন্ধান করতেই হবে। কেননা বাংলাদেশের বাঙালিরাই হচ্ছে প্রকৃত বাঙালি। একদিকে ভারতীয় বঙ্গভাষীদের বাঙালিত্বের উদৃত দাবি এবং অন্যদিকে পাকিস্তানি মনােভাবাপন্ন মৌলবাদীদের বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ভ্রমাত্মক ব্যাখ্যা। ভারতীয় বঙ্গভাষীরা নেশন শব্দের অর্থ দ্ব্যর্থবােধক করে বসেছেন এবং বাংলাদেশের মুসলিম মৌলবাদীরা নেশন ও রিলিজিয়ান শব্দ দুটির একই অর্থ বােঝাতে চাচ্ছেন। দুটি গােষ্ঠীর চিন্তাধারা নিশ্চিতভাবে বিভ্রান্তিকর।
গ.বঙ্গবন্ধুর সফল নেতৃত্বে একদিকে যেমন একটা রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিতাড়িত হয়েছে; অন্যদিকে তেমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার দরুন শুধুমাত্র আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মাটি থেকে মিত্রবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার সম্ভব হয়েছে। এসবই হচ্ছে বাস্তব ইতিহাস।
সূত্র : জয় বাংলা – এম আর আখতার মুকুল