You dont have javascript enabled! Please enable it!
আত্মসমর্পণের উষালগ্নে ৭ জন সাংবাদিককে ওরা হত্যা করল
‘সারেন্ডার করুংগা-মগর মুক্তি কো পাস নেহী, হিন্দুস্তানী ফৌজকা পাস করুংগা’। ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরের গােড়ার দিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে পলায়নপর তৎকালীন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শিবিরে প্রায় সবারই মুখে এই-ই ছিল সর্বশেষ স্লোগান। এত দম্ভোক্তি এত হত্যা, এত ধ্বংসের পর অবশিষ্ট হানাদারদের এই হচ্ছে শেষ পরিণতি। এ-সময় আমরা জনাকয়েক মুজিবনগরে বসে প্রাপ্ত যুদ্ধের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে একটা খতিয়ান করলাম। বাংলাদেশের বিরাট এলাকা মুক্তি বাহিনীর সম্পূর্ণ দখলে। অনেক জায়গায় মুজিবনগর সরকারের উদ্যোগে এর মধ্যেই বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা পর্যন্ত চালু হয়েছে। খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের মাঝদিয়ে গােপালগঞ্জ ও বরিশাল এবং ঢাকা এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপিত হয়েছে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের উপকণ্ঠে গেরিলাদের হামলার তীব্রতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কসবা-আখাউড়া সেক্টরের ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে আমাদের বিপুল সাফল্য অর্জিত হয়েছে। কিশােরগঞ্জের হাওর এলাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী পশ্চাদপসরণ করেছে। টাঙ্গাইল-এর বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত হওয়ার পর বেসামরিক প্রশাসন চালু হয়েছে। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের তীরবর্তী সমস্ত চঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে। সিলেট জেলার ছাতক, হকির ও জকিগঞ্জসহ চা-বাগানগুলাে শক্রমুক্ত। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পচাগড় এখন মুজিবনগর সরকারের নিয়ন্ত্রণে। যশাের, কুষ্টিয়া ও রাজশাহীর হু এলাকা থেকে হানাদার বাহিনী এখন পলাতক।
এছাড়া পাবনা, বগুড়া, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম থেকে প্রতিনিয়তই সংঘর্ষের খবর এসে পৌঁছাচ্ছে। অবশ্য এর আগেই মার্কিনী সংবাদ সংস্থা অ্যাসােসিয়েটে প্রেসের সঙ্গে এক বিশেষ সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তব্যে সমগ্র বিশ্বে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশে রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড ধরনের মার খাওয়ার পর এই যুদ্ধটাকে পাক-ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বললেন, “আর দশদিনের মধ্যে আমি এই রাওয়ালপিন্ডিতে নাও থাকতে পারি। আমি তখন যুদ্ধ করব।” জেনারেল ইয়াহিয়া তার কথা রেখেছিলেন। ৩ ডিসেম্বর বিকাল পৌনে দু’টা নাগাদ পাকিস্তান বিমান বাহিনী আকস্মিকভাবে অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তীপুর, উত্তরলাই, যােধপুর, আম্বালা ও আগ্রার বিমান বন্দরগুলােতে বােমাবর্ষণ করলাে। উপমহাদেশে যুদ্ধের বিস্তৃতি ঘটল।
পনের ডিসেম্বরের মুজিবনগর
সেদিনের তারিখটা ছিল ১৫ ডিসেম্বর। শহর কোলকাতার থিয়েটার রােডস্থ মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী সচিবালয়ে আমরা দারুণ উত্তেজনায় সবাই হাজির হয়েছি সর্বশেষ পরিস্থিতি জানার জন্য। লে. জেনারেল নিয়াজীর অধীনে ঢাকার ইস্টার্ন কমান্ড থেকে যাতে সরাসরি কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে আত্মসমর্পণ সম্পর্কিত কথাবার্তা বলা যায়, এজন্য বিশেষ রেডিও ফ্রিকুয়েন্সিতে মাইক্রোওয়েভ’ যােগাযােগ চালু করায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র এবং আকাশবাণী কোলকাতা কেন্দ্রের সন্ধ্যার অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ রাখা হয়েছে। অবশ্য সকাল ও দুপুরের অনুষ্ঠান যথারীতি চালু রয়েছে। ওদিকে বােমা বর্ষণের দরুন দিন কয়েক আগে থেকেই ঢাকা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে এবং গভর্নর মালেকের পদত্যাগ ও সদলবলে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলের আন্তর্জাতিক রেডক্রস জোনে আশ্রয় নেয়ায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শেষ সিভিলিয়ান সরকারের বিলুপ্তি হয়ে গেছে। এদিকে আমরা যখন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী সচিবালয়ে গিয়ে পৌছলাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে আর চারদিকে ব্ল্যাক আউট’-এর ঘন অন্ধকার। একটু পরেই এল সেই প্রতীক্ষিত খবর। বিকেল পাঁচটা থেকেই অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি আরম্ভ হয়ে গেছে। মিত্র বাহিনীর বক্তব্য হচ্ছে : এই যুদ্ধবিরতি ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এবং এই সময়ের মধ্যেই ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে আত্মসমর্পণের জন্য চূড়ান্ত ভাবেই মনস্থির করতে হবে। পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী এতে অপারগ হলে আবার হামলা শুরু হবে।
মুজিবনগরে তখন তুমুল উত্তেজনা। প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ-এর কাছ থেকেই জানতে পারলাম যে, রাওয়ালপিন্ডি থেকে এক প্রেরিত বার্তায় লে, জেনারেল নিয়াজীকে অস্ত্র সংবরুণ-এর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এখন নিয়াজীর পক্ষে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণে রাজি আছি’ কথাগুলাে উচ্চারণ করা আর হানাদার বাহিনীকে হাতিয়ার ডাল দাও নির্দেশ জারি করার ব্যাপার দুটো বাকী রয়েছে। একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে আর কোনাে উল্লেখযােগ্য খবর পাওয়া গেল না। তবে সবার মুখে একই আলােচনা, “আমাদের বঙ্গবন্ধু কি জীবিত আছেন? আমাদের প্রিয় ঢাকা নগরী কি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে?” বাংলাদেশ স্বাধীন হতে চলেছে এই খবরটাতেই সবার চোখে আনন্দাশ্রু। এ-সময় মুজিবনগরে আমাদের মানসিক অবস্থা কী রকম হয়েছিল তার সঠিক বর্ণনা দেয়া দুরূহ। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে হারানাে প্রিয়জনদের কথা স্মরণ করে ক্রন্দন করছেন আবার কেউবা বসতবাটি ও সহায়সম্পত্তি নিশ্চিহ্ন হওয়ায় বিলাপ করছেন। ১৬ ডিসেম্বর ভাের রাতে ঢাকা থেকে জেনারেল নিয়াজীর অনুরােধ বার্তা এল, অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়সীমা বাড়িয়ে দেয়ার জন্য। সকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর কাছ থেকে জানতে পারলাম যে, এই সময়সীমা বিকেল তিনটা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
রাও ফরমানের নকশা
এত সব হৈ চৈ, উত্তেজনা আর ডামাডােলের মধ্যে ঢাকায় ক্রমাগত কারফিউ-এর মধ্যে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী অন্তিম মুহুর্ত সমাগত বুঝতে পেরে ইতিহাসের জঘন্যতম ও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের নীল নকশা তৈরি করে সবার অলক্ষে তা কার্যকরী করে চলেছেন। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাও ফরমান যে জল্লাদ বাহিনীর মাধ্যমে এইসব ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড সমাধা করেছেন, সেই বাহিনীর নাম ‘আল-বদর’। এদের হাতে শিকার হচ্ছেন ঢাকার সাংবাদিক, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলীর দল। এসব নৃশংস আর বীভৎস এবং কাপুরুষােচিত হত্যাকাণ্ডের কথা তাে কোনােদিনই ভুলবার নয়। ৮৫-র বিজয় দিবস উপলক্ষে রচিত আজকের নিবন্ধে আমাদের জন্য কয়েকজন শ্রেষ্ঠ সাংবাদিকের নির্মম ও করুণ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা উপস্থাপিত করব। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং পুস্তক থেকে এসব তথ্য সগ্রহ করেছি। এদের মধ্যে একজনকে আগস্টের শেষ নাগাদ এবং বাকী ৬ জনকে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী সময়ে হত্যা করা হয়েছে।
তরুণ ও উদীয়মান সাংবাদিক আবুল বাশার চৌধুরী। ১৯৭১ সালে স্টাফ রিপাের্টার হিসাবে চাকুরি করতেন অধুনালুপ্ত ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকায়। জীবনে সক্রিয় রাজনীতি করেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তাে শুধু রাজনীতি নয়; এ যুদ্ধ তাে বাঙালিদের জন্য জীবননীতি। তাই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, অবাঙালি প্রধান মর্নিং নিউজ এ চাকুরি করা সত্ত্বেও বাশার গােপনে যােগাযােগ রেখেছিলেন গেরিলাদের সঙ্গে। এজন্যই তাকে নিজের অমূল্য জীবন উৎসর্গ করতে হলাে। সাংবাদিক মনজুর আহমদ-এর ভাষায় বলতে হলে, ‘ওর হােট ভাই ছুটে এসে খবর দিয়ে ছিল বাশারকে হানাদার খানসেনারা ধরে নিয়ে গেছে। বাশার তার দুইবন্ধুকে নিয়ে থাকতেন মগবাজারের এক বাসায়। মগবাজারে এই সময় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ছিল খুবই জোরদার। ২৯ আগস্ট গভীর রাতে খান সেনারা অতর্কিতে হানা দেয় তার বাসায়। তাদের কাছে গােপন খবর গিয়ে ছিল বাসাটা নাকি মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি। দরজা খুলে দেবার আগেই হানাদার দস্যুরা দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়েছিল। আর ঢুকেই তাদের নজর পড়েছিল টেবিলের উপর রাখা একটি রিভলবারের ওপর। তল্লাশী চালিয়েছিল সারা বাড়ি। প্রকাশ হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে তার গােপন যােগাযােগের কথা। আর তাদের জন্য কিছুর দরকারও ছিল না। ধরে নিয়ে গিয়েছিল বাশার আর তার দুই বন্ধুকে।”  সে আমলে ঢাকার সংবাদপত্র মহল থেকে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে অনুরােধ করা হয়েছিল বাশারের ব্যাপারে। কিন্তু তাতে কোনােই ফল হয়নি। সদা হাস্যময় আর তারুণ্যে ভরপুর সাংবাদিক আবুল বাশার চৌধুরী চিরদিনের জন্য এই ধরাধাম থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে সিরাজউদ্দিন হােসেন একটি অবিনশ্বর নাম। তিনি ছিলেন যশােরের সন্তান। বি,এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ১৯৪৬ সালে কোলকাতায় দৈনিক আজাদে সাংবাদিকতায় তার হাতেখড়ি। এরপর সিরাজউদ্দিন নিরবচ্ছিন্নভাবে একটানা ২৫ বছর ধরে সাংবাদিক। সাংবাদিকের পরিচয় নিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সময় এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তি আত্মাহুতি দিলেন স্বাধীনতার বেদীমূলে। যুদ্ধের মধ্যেই ঢাকায় সিরাজউদ্দীন হােসেনকে আমি একটা খবর পাঠিয়েছিলাম মুজিবনগরে চলে আসার জন্য। সিরাজ সাহেব একটা জবাবও দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকব কি-না জানি না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এতগুলাে বাচ্চা নিয়ে আমার পক্ষে ওপারে যাওয়া সম্ভব হবে না। সবার মঙ্গল কামনা করছি।” দেশবিদেশের সমস্ত খবরাখবর পুংখানুপুংখভাবে রাখলেও সিরাজউদ্দীন হােসেন বাস্তব জীবনে নিজের সাংবাদিকতা পেশা আর সুখী পরিবারের বাইরে কোথাও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন না। ৫ ডিসেম্বর পলায়নপর হানাদার বাহিনী কর্তৃক ব্রাহ্মণবাড়িয়া বুদ্ধিজীবী হত্যার রােমহর্ষক কাহিনী বিদেশী বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হবার পর ঢাকায় অনেক বুদ্ধিজীবীই স্বগৃহ ত্যাগ করে দিন কয়েকের জন্য অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারাও বেশ কয়েকবার গােপনে তাঁকে হুঁশিয়ারি জানিয়ে অন্যত্র সরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু তার ছিল একটাই চিন্তা: তার অনুপস্থিতিতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তান-সন্ততিদের উপর ওরা অত্যাচার করতে পারে।
বড় ছেলে শামিম মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের জন্য সীমান্তের ওপারে চলে গেছে। তাই শেষ পর্যন্ত সিরাজ সাহেব তার ৫ নং চামেলীবাগের ভাড়াটে বাসাতেই থেকে গেলেন। দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজউদ্দীন হােসেনের পৈশাচিক হত্যার যে ঘটনাটুকু সগ্রহ করতে পেরেছি, তা হচ্ছে নিম্নরূপ : ১০ ডিসেম্বর। রাত তখন প্রায় ১০টা। টেলিভিশনের সামনে বসে থাকতে ভালাে লাগছিল না তার (সম্ভবত সেদিনই টিভির শেষ অনুষ্ঠান।) সরে এলেন তিনি টিভি সেটের সামনে থেকে। হারিকেনের অস্পষ্ট আলােতে লুডু খেলতে বসলেন ছেলেদের সাথে। একমনে খেলছেন। স্ত্রী নূরজাহান বেগমের শরীর সে রাতে ভালাে ছিল না। ছােট ছােট বাচ্চা তিনটিও ঘুমিয়ে পড়ল। খেলা রেখে কোলে করে তিনি ওদের শুইয়ে বসলেন লুডুর সামনে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাইরে থেকে কে যেন দরজায় মৃদু আঘাত করল। ঘরের প্রতিটি প্রাণী সচকিত হলাে। আঘাতের শব্দে ওরা কিন্তু কেউ সাহস করে খুলে দিলাে না দরজা। দেখতে চেষ্টা করল না যে, এত রাতে এভাবে কে এল। পাঁচ মিনিট পর দরজাতে আবার আঘাত এল। পাঁচ মিনিট পর আবার। কিন্তু হতবিহ্বল ওরা শুধু অসহায়ভাবে বসে থাকল। সিরাজ উদ্দীন সাহেব কি শেষবারের আঘাতের সাথে উঠে দাঁড়ালেন।
পিতার সাথেই উঠে দাঁড়িয়েছিল দ্বিতীয় পুত্র শাহিন। এগিয়ে গেল সে দরজার কাছে। কি কাছে কোথাও গুলি ছোঁড়ার শব্দে দরজা না খুলেই দাড়িয়ে থাকল সে। কেটে গেল আরও পাঁচ মিনিট। দরজাটা খুলে দিলেন। বারান্দাটা তখন ফাঁকা। হয়তাে নিঃশব্দ আঁধারে গা ডুবিয়ে তাঁকে সাবধান করতে আরও কেউ এসেছিল। ব্যর্থ হয়েই ফিরে গেছে সে।  ‘দরজাতে শেষবার আঘাত পড়েছিল রাত সাড়ে তিনটার কাছাকাছি। ভারি বুটের লাথি। ভেতরে ঢুকে আল-বদররা দেরি করল না। অবকাশ দিলে না কাউকে কিছু বলবার। একটা গামছা এনে শক্ত করে বেঁধে দিলাে সিরাজ সাহেবের চোখ দুটি। তারপর শুধু লুঙ্গি আর গেঞ্জি সম্বল প্রচণ্ড শীতের মাঝে থর থর কম্পমান তার শীর্ণ দেহটি মিলিয়ে গেল ওদের সাথে ব্ল্যাক আউটের কালাে আঁধারের মাঝে। যে সিরাজউদ্দিন হােসেনের প্রচেষ্টায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছেলে হারানাে সম্পর্কিত একটার পর একটা রিপাের্ট সংগ্রহের পর সিরিজ আকারে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত হওয়ায় এক দিন পুলিশ কর্তৃপক্ষের টনক নড়েছিল এবং ইত্তেফাকে প্রকাশিত রিপাের্টের সূত্র ধরে গফরগাঁও, সিলেট, নােয়াখালি প্রভৃতি অঞ্চলে হামলা চালিয়ে শত শত বালক উদ্ধার সম্ভব হয়েছিল, সেই সিরাজউদ্দিন হােসেন নিজেই এখন একাত্তরে দেশ স্বাধীন হওয়ার উষালগ্নে হারিয়ে গেলেন। আল-বদরের জল্লাদ বাহিনী তাকে বীভৎসভাবে হত্যা করল। আর তার এতগুলাে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে হঠাৎ করে এতিম হয়ে গেল। এর কোনাে বিচার পর্যন্ত হলাে না। গত চৌদ্দ বছর ধরে নূরী ভাবীর মুখ থেকে সেই মিষ্টি হাসিটাও কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।
সৈয়দ নজমুল হক ছিলেন পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (করাচী) নামক বার্তা সংস্থার ঢাকা অফিসের চিফ রিপাের্টার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিস-এর ঢাকাস্থ প্রতিনিধি। সম্ভবত বিদেশে প্রেরিত বেশ কটি ডেসপ্যাচ-এর বক্তব্য হানাদার বাহিনীর মনঃপুত ছিল না। আর সেজন্যই আলবদরের জল্লাদ বাহিনীকে লেলিয়ে দেয়া হয়েছিল এই তরুণ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে। সিরাজউদ্দিনকে ওরা অপহরণ করেছিল চামেলীবাগ থেকে আর সৈয়দ নজমুল হককে তার স্ত্রীপুত্রের সামনে থেকে ওরা উঠিয়ে নিয়ে গেল পুরানা পল্টন থেকে। সিরাজকে নিয়েছিল ১১ ডিসেম্বর ভাের ৩ টায়; নজমুলকে নিল ভাের চারটায়। সৈয়দ নজমুল হকের অপহরণ ও হত্যার সংগৃহীত কাহিনী হচ্ছে নিম্নরূপ :
“…তখন তাঁর ছােট ছােট বাচ্চা ও অন্যান্য মহিলা জলছাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ছাদটা তত মজুবত না থাকায় ভেঙে পড়ে। তখন নজমুল হক বাচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করেছিলেন। আজও সেই করুণ মর্মভেদী চিৎকার আমার কানে বাজছে। চিরদিন এ হৃদয়ভেদী চিৎকার আমি শুনতে পাব।” এই কথাগুলাে হচ্ছে নজমুল হক-এর প্রতিবেশী সাংবাদিক আতাউস সামাদের। নজমুলের সম্পর্কে অন্য এক প্রতিবেদনে আরও যেটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তা হচ্ছে—হানাদার বাহিনী তাকে অপহরণ করতে গিয়েও অপমান করেছিল ঘরের মধ্যে। মাথার উপরে হাত উঠানাে অবস্থাতেও উঠ-বস করিয়ে ছিল অনেকবার। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তাকে বাড়ির সামনে চত্বরে বসিয়ে রেখেছিল। এভাবে শাস্তি দিতে দিতেই অবশেষে ঘৃণিত নরপিশাচেরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর সৈয়দ নজমুল হককে আর কেউই দেখতে পায়নি।
তরুণ সাংবাদিক আ.ন.ম গােলাম মােস্তফা। প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আ.ন.ম গােলাম মােস্তফার বাড়ি দিনাজপুরে। অধুনালুপ্ত দৈনিক পূর্বদেশ-এর জন্মলগ্নে এর ব্যবস্থাপনার সঙ্গে আমি কিছুদিন জড়িত ছিলাম এবং বলতে গেলে মােস্তফাকে আমিই এনেছিলাম পূর্বদেশ পত্রিকায়। এখানে যােগ দেয়ার কিছুদিনের মধ্যে মােস্তফা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলাে। তার লেখার হাত বড়ই মিষ্টি আর অসম্ভব নিষ্ঠার সঙ্গে সে পরিশ্রম করত। তখন পূর্বদেশের সহকারী সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে আবদুল গাফফার চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, নূরুল ইসলাম পাটোয়ারী আর রাজশাহী থেকে আগত কবি মহাদেব সাহা। বার্তা সম্পাদক এহতেশাম হায়দার চৌধুরী আর চিফ রিপাের্টার ছিলেন ফয়েজ আহমদ। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের আগেই কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরােধ হওয়ায় প্রথমে ফয়েজ এবং পরে আমি পূর্বদেশ থেকে পদত্যাগ করি। ফয়েজ সাহেবের পদত্যাগের পরবর্তী সময়ে রিপাের্টিং-এ কাজ করত এক তরুণ যুবক। নাম চৌধুরী মঈন উদ্দীন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে প্রকাশ পেলাে যে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই চৌধুরী মঈনউদ্দীন ছিল ঢাকায় আল-বদর বাহিনীর অপারেশনাল ইনচার্জ। হত্যাকাণ্ড সমাধা করে ১৬ ডিসেম্বরের দিকে পালিয়ে যায় লন্ডনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় গােলাম মােস্তফা পূর্বদেশের সিনিয়র সাব-এডিটর আর মঈনউদ্দিন রিপাের্টার। তাই মােস্তফার চিন্তাধারা সম্পর্কে হত্যাকারীরা বেশ ভালােভাবেই ওয়াকেফহাল ছিল। ১১ ডিসেম্বর রাত তিনটায় সিরাজউদ্দিন হােসেন এবং রাত ৪টায় সৈয়দ নজমুল হককে উঠাবার পর জল্লাদ আল-বদর বাহিনীর লােকেরা যখন মােস্তাফার গােপীবাগের বাসায় এল, তখন সময় হচ্ছে সকাল ৯টা।
এ ব্যাপারে ঝর্ণার বক্তব্য হচ্ছে : বদর বাহিনীর তিনজন জল্লাদ বাসায় এসেছিল। বলেছিল, ‘আপনার সাথে কিছু কথা আছে। একটু বাইরে আসুন।’ মােস্তফা তখন তার নয়মাসের শিশু সন্তান অভীকে কোলে নিয়ে পায়চারী করছিল। বাচ্চাকে নামিয়ে রেখে সে ওই জল্লাদদের সাথে বেরিয়ে যায়। বেরিয়ে যাবার পর মুহূর্ত থেকেই ওর খোজ খবর শুরু হয়। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই ওর খােজে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু আকস্মিকভাবে কারফিউ জারি করায় সেদিনের মতাে অনুসন্ধানের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এবং একটানা কারফিউ চলতে থাকায় এই অনুসন্ধান কাজ আর শুরু করা যায়নি….পূর্বদেশের স্টাফ রিপাের্টার চৌধুরী মঈনউদ্দিনের শরণাপন্ন হয়েছিল অনুসন্ধানকারীরা। হায়, তখনও কে জানত এই চৌধুরী মঈনউদ্দিনই ছিল আল-বদর বাহিনীর অপারেশনাল ইনচার্জ।
নিজামউদ্দিন আহমদ-এর বাড়ি মুন্সীগঞ্জে। মাঝবয়সী কিছুটা রাসভারী গােহ্নের চরিত্র। অনেকগুলাে বছর ধরেই সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত। ১৯৭১ সালে জনাব আহমদ ছিলেন বিবিসি ও অ্যাসােসিয়েটস প্রেসের ঢাকাস্থ সংবাদদাতা। নিজামউদ্দিন আহমদ, এর হত্যার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া সব হয়নি। তবে এটুকু বলা যায় যে, তখন সময়টা ছিল খুবই নাজুক। ৭ ডিসেম্বর নাগাদ যশােরে কোনােরকম যুদ্ধ না করেই মেজর জেনারেল এম, এইচ, আনসারী নবম ডিভিশন নিয়ে পলাতক। ৯ ডিসেম্বর উত্তরবঙ্গ সেক্টরে মেজর জেনারেল নজরহােসেন শাহ-এর ১৬তম ডিভিশন দ্বিধাবিভক্ত, ১০ ডিসেম্বর চাঁদপুর সেক্টরে পশ্চাদপসরণরত ৩৯তম ডিভিশনের ৫৩তম আর ৯১তম ব্রিগেড নারায়ণগজের কাছে একেবারে ভিন্ন-বিচ্ছিন্ন ও অতিকঃ মেজর জেনারেল রহিম খানের আহত অবস্থায় ঢাকায় প্রত্যাবর্তন, সিলেট সেক্টরে মেজর জেনারেল মজিদ কাজীর ১৪তম ডিভিশন প্রায় অবরুদ্ধ এবং জামালপুর-ময়মনসিংহ এলাকায় ব্রিগেডিয়ার কাদির-এর ৯৩তম ব্রিগেড নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। চারদিক থেকে যখন এ ধরনের শুধু পরাজয়ের খবর আসছে, তখন ১০ ডিসেম্বর বিবিসি বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত খবরে বলা হলাে যে, ‘জেনারেল নিয়াজী তার সৈন্য বাহিনীকে ফেলে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছে।’
উত্তেজিত অবস্থায় আকস্মিকভাবে জেনারেল নিয়াজী এসে হাজির হলেন একেবারে হােটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল-এর (বর্তমানে শেরাটন) লাউঞ্জে। আর চিৎকার করে বললেন, কোথায় গেল বিবিসির সংবাদদাতা? আমি তাকে বলতে চাই যে, আল্লার মেহেরবানিতে আমি এখনও পূর্ব পাকিস্তানে রয়েছি। আমি কখনােই আমার সৈন্যদের ফেলে যাবাে না।” এর পরের ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও নারকীয়। আল-বদরদের জল্লাদ বাহিনী নিজামউদ্দীনকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার পর আর কোনােই খবর পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তৎকালীন বােমা বিধ্বস্ত গভর্নর ভবনে প্রাপ্ত একটা নােটশিটে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর ইংরেজি হাতের লেখার চারটা পয়েন্টের প্রথম পয়েন্ট-এ লেখা ছিল, (১) নিজামউদ্দিন—উদ্দেশ্য প্রণােদিত সংবাদ (এপি)।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র ৫৬ ঘন্টা আগে সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারকে জল্লাদরা হত্যা করল। উনি আর স্বাধীনতার সূর্য দেখতে পেলেন না।

এস. এ. মান্নান ছিলেন ইংরেজি অবজারভার পত্রিকায় স্পাের্টস রিপাের্টার। ঢাকার সবারই প্রিয় লাডু ভাই। অসম্ভব ভদ্র ও মার্জিত রুচির ব্যক্তিত্ব। জীবনে খেলাধুলা ছাড়া আর কিছুই বুঝতেন না। সারাটা জীবন খেলাধুলা নিয়ে এতই মেতে ছিলেন যে, লাডু ভাই যৌবনের প্রান্তদেশে এসেও জীবন-সঙ্গিনী বেছে নেয়ার সময় পর্যন্ত পেলেন না। একাত্তর সালের ভয়ংকর ডিসেম্বরে খুনীর দল সবার অজান্তে কখন যে আমাদের প্রিয় শাড় ভাইকে নবাবপুরের গলির এক রুমওয়ালা বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল, তা পরিচিতজনেরা কেউ জানতেই পারলেন না। যখন ব্যাপারটা প্রকাশ পেলাে তখন অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। লাডু ভাই তখন জান্নাতবাসী হয়েছেন। প্রখ্যাত ইংরেজ সাংবাদিক পিটার হেজেল হাস্ট ঢাকা থেকে প্রেরিত ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার রিপাের্টে করুণ মন্তব্য করলেন। ‘একথা কেউ কোনােদিন বলতে পারবে না যে, সবসুদ্ধ কতজন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ডাক্তার ইত্যাদি হত্যা করা হয়েছে। এদের অধিকাংশ কোনােদিনই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবুও এঁদের আর কোনাে খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। এরা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছেন। … ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আনােয়ার পাশার স্ত্রী মােহসিনাকে রাজধানীর উপকণ্ঠে একটা বিরাট গর্তের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। এখানে অসংখ্য বাঙালি বুদ্ধিজীবীর গলিত ও দুর্গন্ধময় লাশ পড়ে আছে। মােহসিনা এই গলিত লাশগুলাের মধ্যে তার স্বামীর লাশটা শনাক্ত করার বৃথাই চেষ্টা করছে। [দি টাইমস লন্ডন :৩০শে ডিসেম্বর ১৯৭১ : পিটার হেজেল হাস্ট)।
এম, আর, আখতার মুকুল

সূত্র : জয় বাংলা – এম আর আখতার মুকুল

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!