কমরেড কবিয়াল আলতাফ মাহমুদ
সেই লােকটি, নামও তার জানি। কিন্তু সেততা এখন মস্ত বড় লোেক, সেই সময় মুক্তিযােদ্ধা সেজে দালালী করেছে, রাজসাক্ষীও হয়েছে। স্বাধীনতার পর আবার আমারই সামনে দাঁড়িয়ে বলেছে-ভাবী, আলতাফ ভাইয়ের নাম বলে দিয়েছি কারণ ওরা আমাকে মেরে ফেলতাে, আমার তাে বৌ বাচ্চা আছে।” কথাগুলাে মৃণা আর কোরে সাথে বলছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদের স্ত্রী সারা আরা মাহমুদ (ঝিনু)। কারণ ঐ লােকটা এখনও বেঁচে আছে এই স্বাধীন বাংলাদেশে তার ছেলেমেয়ে নিয়ে মহাসুখে। কি ঝিনু মাহমুদকে তার একমাত্র মেয়ে আড়াই বছরের শাওনকে নিয়ে সমাজ সংসারে জীবনের নতুন লড়াই শুরু করতে হয়েছিল সেদিন। আজও করছেন। শিল্পকলা একাডেমিতে তাকে আজ চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। আর যে এই পরিবারকে ধ্বংস করে নিজের পরিবারকে বাঁচাতে দ্বিধা করেনি সে আজ বিরাট ব্যবসায়ী। শিল্পপতি। তাদের সগােত্রীয় সমাজপতিদের সাথে সগৌরবে দিনাতিপাত করছে। অবশ্য তার নাম স্মরণ করছি ঘূণিত নরককীট হিসেবে আর আলতাফ মাহমুদের নাম লেখা আছে এদের অগণিত মানুষের প্রাণমনে, হৃদয়ের গভীর প্রান্তরে। সে নাম আজও জনগণের জন্য লড়বার প্রেরণা জোগায়। তার মহিমামণ্ডিত ত্যাগ আমাদের ইশিত জীবন প্রতিষ্ঠার সগ্রামে আলোকবর্তিকার মতন লড়াইয়ের মশাল হয়ে জ্বলছে। মার্কসবাদে বিশ্বাসী এই মহান শিল্পী আলতাফ মাহমুদ তাই বাঙালি জাতিসত্ত্বার ঐশ্বর্যে গর্বে মহিমান্বিত হয়ে আছে। তার সৃষ্ট একটি সুর বাংলার প্রান্তরে, তল্লাটে, নদীর কলতানে, ঝড়ে-বাতাসে আজও ডাক দিচেহ—জাগাে কমরেড, ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। ডাকবেও চিরটা কাল।
সমগ্র ভারতবর্ষে-অখণ্ডিত ভারতে একদিন গণ-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ঢেউ প্রচণ্ড গর্জনে আসমুদ্র হিমাচল উথিত করে দেশের সাধারণ মানুষকে নবজীবন প্রতিষ্ঠার সাহস দিয়েছিল যেমন, তেমনি পূর্ববাংলার প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনও এদেশের স্বৈরশাসন-বিরােধী লড়াইয়ে নিয়ােজিত কর্মীবাহিনীর সাথে নিজেদের মিলিয়ে নিয়েছিল, একাত্মতা ঘােষণা করেছিল। এই প্রাণপণ যুদ্ধের চিরসংঘর্ষে যারা নতুন জীবনের ইঙ্গিতে ক্ষোভকে ক্রোধের আগুনে ঝালিয়ে নিজ প্রত্যয়কে করতে পেরেছিলেন মহীয়ান-সেইসব স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে অবিস্মরণীয় চরিত্র গণশিল্পী আলতাফ মাহমুদ। আলতাফ মাহমুদ আকিয়ে শিল্পী ছিলেন। আলতাফ মাহমুদ বেহালা বাদক ছিলেন।
আলতাফ মাহমুদ অভিনয় করেছেন। আলতাফ মাহমুদ গান গাইতেন। সর্বোপরি আলতাফ মাহমুদ ছিলেন নিঃশঙ্কচিত্ত সচেতন রাজনৈতিক কর্মী। যার মরণে ছিল না কোনাে ভয়। যিনি প্রচলিত জীবন বিধানে ধারাবাহিকতা মানাতে গিয়ে বিশ্বাসকে মাঝে মধ্যে ক্ষগ্রিস্ত করে পিছলে পড়েছিলেন, শ্রেণী চরিত্র ঝেড়ে উঠতে পারেন নি বলে এ চরিত্র তাঁকে মাঝে মাঝে পিছু টানতাে। অথচ আলতাফ পিছুটান বলে কোনাে কিছুকেই প্রশ্রয় দিতে চাইতেন না (যা আজ আমাদের রাজনৈতিক জীবনের সবচাইতে বড় সংকট)। সেই সংকট সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে কাটিয়ে উঠেছিলেন আলতাফ মাহমুদ; কিন্তু তবুও ঐ চরিত্রের উপাদান থেকেই গিয়েছিল বলে তিনি রাজনৈতিকভাবে সংকট উত্তরণের পথে দ্বিধান্বিত হয়ে যেতেন। আর তাই তার সম্ভাবনায় উদ্ভাসিত, সফলতার উজ্জ্বল জীবনের বিশাল প্রান্তরে খাদ তাকে শঙ্কিত করতাে। অথচ মৌল আদর্শ থেকে তিনি কোনােদিন সরে দাঁড়াননি। একাত্তরে লড়াইয়ে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসক-শােষকদের তাবেদার সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি আলতাফ মাহমুদকে অকথ্য নির্যাতনের মাধ্যমে কাবু করতে চেয়েছিল। পিশাচেরা যতই যাতনা বাড়িয়েছে তার রক্তমাংসের দেহের উপর, ততই যেন ইস্পাতদৃঢ় আদর্শ মানুষ অনুকরণীয় চরিত্র আর অকুতােভয় সৈনিক হিসেবে দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন তিনি। তাই আলতাফ মাহমুদ আজ একটি জ্বলন্ত নাম বারুদের মতন জুড়িয়ে আছে। এদেশের পথে প্রান্তরে কোটি কোটি হৃদয়ের উষ্ণ আবাসে।
১৯৭১ , ৩০ আগস্ট। ভাের ৬টা আলাে ফুটেছে পূর্ব আকাশ লাল হয়ে সূর্য উঠেছে। সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা স্নিগ্ধ বাংলাকে সকালের নােণালী রােদূরে চমকে দেবে প্রকৃতিকে। আলতাফ মাহমুদ, বাড়ির সবাই তখনও ঘুমিয়ে। আচমকা দরজায় করাঘাত। আতঙ্কে কম্পিত মন অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে। দরজা খুলতেই চোখে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি জিপ দাঁড়িয়ে। হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলেছে তার আউটার সার্কুলার রােডের বাড়িটা। তাদের সাথে দুজন বাঙালি যুবককে নিয়ে এসেছে আলতাফ মাহমুদকে চিনিয়ে দেয়ার জন্য। দরজায় করাঘাত পড়বার সাথে সাথে উঠে পড়েছেন ঘুম থেকে। বৈঠকখানায় এসে দাঁড়িয়েছেন সবাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের বর্তমানে শিক্ষক সৈয়দ আবুল বারক আলভীও সে রাতে ছিলেন ওদের বাসায়। মুক্তিযুদ্ধের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে মেলাঘরে সে কাজ করছিল। সে ঢাকায় এসেছে খোঁজ খবর নিতে। পিশাচগুলাে লােলুপ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হুঙ্কার দিয়ে উঠল। জানতে চাইল আলতাফ মাহমুদ কে? সবাই স্তব্ধ। কারও গলায় কথা সরছে না। তেড়ে আসছে ওরা-শালালােগ বােলতা কিউ নাহি।” ছােট্ট শিমুল (আলতাফ মাহমুদের ছােটশালী) কেঁদে উঠলাে চিৎকার করে।
এরমধ্যে আলতাফ মাহমুদ ঘুম থেকে জেগে উঠে সােরগােল শুনে বৈঠকখানার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন দেখে ঝিনু টেনে ধরলেন-কোথায় যাচ্ছ, ওরা তােমাকে ধরতে এসেছে। আলতাফ শুধু বললেন—ভয় পাবার কী আছে? দেখি না ওরা কী চায়?”
স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আলতাফ মাহমুদ বেরিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন-কী চাই আপনাদের? পরিচয় পেয়ে পাঞ্জাবি খানসেনা দূজন এসে আলতাফ মাহমুদের দুবাহু জোরসে ধরে ফেলে। নিয়ে যায় সেই কাঠালগাছতলায়, ঢাকায় অপারেশন করার। জন্য গঠিত ক্র্যাক প্লাটুনের দুজন গেরিলা মুক্তিযােদ্ধা সেখানে অস্ত্রভর্তি একটি ট্রাক পুঁতে রেখে গিয়েছিল। কিন্তু গেরিলা যােদ্ধাদের একজন ধরা পড়ে যায় (!) খানসেনাদের হাতে। মার খেয়ে সে বলে দেয়-আলতাফ মাহমুদের বাড়িতে অস্ত্র রাখা আছে। সে বাড়িটা এবং আলতাফ মাহমুদকে চিনিয়ে দেবে। সেই গাছতলায় নিয়ে গেল অস্ত্রের মুখে। ভেতরে সবাই প্রহরারত গৃহবাসীদের থরহরিকম্প। বাইরে আলতাফের উপর হায়েনারা চড়াও হয়েছে। লাথি মারছে, যে যেভাবে পারে ঘুষি চালাচ্ছে। এমনি অবস্থায় তাকে দিয়ে গাহতলার মাটি খুঁড়িয়ে ট্রাক বের করল। এবারাে তারা ট্রান্ধসহ আলতাফ মাহমুদ এবং আলভী ও খনু, দীনু আরও তিনজনকে নিয়ে গেল গ্রেফতার করে।
খাঁচায় বন্দি হায়েনাদের হাতে। পস্তা মাংস পেলে যেমন খুবলে খুবলে খায়, তেমনি দিনমান নির্যাতন শুরু হলাে বন্দিদের ওপর। মাথা নিচের দিকে ঝুলিয়ে পা উপরে বাধা। ঝুলছে দেহখানা। দোল খাচ্ছে ধাক্কায় । আর তোচ্ছে রাইফেলের কুঁদো দিয়ে। কিন্তু যে কারণে এমন অকথ্য নিপীড়ন তার তিলমাত্র পারেনি বের করতে আলতাফ মাহমুদের কাছ থেকে। উহু, সেকি দুঃসাহস। দুরন্ত সহ্যশক্তি। এত যন্ত্রণা তবুও তার মুখ থেকে একটি নামও বের করতে পারেনি ঐ শয়তানগুলাে। | রাজনীতি সচেতন আলতাফ মাহমুদ মার্কসবাদী চেতনায় ছিলেন উদ্বুদ্ধ। সংগ্রাম, লড়াই আর প্রাণ বলিদান ছাড়া এ-সমাজটাকে পাল্টানাে যাবে না, এ বিশ্বাসে তিনি ছিলেন অবিচল। যার আন্তরিকতা আছে লড়াইয়ে, তাকেই এ লড়াই লড়তে হবে, নইলে বিজয় অর্থবহ হবে না। এটা তিনি শিক্ষা পেয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে। তাই দৃঢ় সংকল্প আলতাফ মাহমুদ যে জীবন শুরু করেছিলেন গণসংগ্রামের বৈভবে, সেই জীবন দান করে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের গৌরবে। বাঙালি জাত্যাভিমানই হােক আর ঔপনিবেশিক শাসকদের রক্তের পিপাসা নিবারণই হােক, এ লড়াইয়ে আমরা সার্বিক গণমুক্তির একধাপ যে এগিয়েছি তা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। রক্তের স্বাক্ষরে ইতিহাসের পাতা আমাদের অনাগত ভবিষ্যতকে সে কথা জানিয়ে দেবে। এমনি করেই আমরা এগিয়ে যাব।… রাজনীতিতে আস্থাবান বলেই আলতাফ মাহমুদের মুখ থেকে একটা কথা ওরা বার করতে পারেনি, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যেতে পারে।
প্রথম দু’রাত তাকে রমনা থানায় রাখা হয়েছিল। দিনের বেলায় নিয়ে যাওয়া হতাে তেজগাও ড্রাম ফ্যাক্টরির কাছে এমপিএ হােস্টেলে। সারাদিন চলতে অবর্ণনীয় নির্যাতন। রাতে রমনা থানায়… বিশ্বাসঘাতক ঐ গেরিলা ছেলেটি জানে বাঁচার জন্য নাকি বলেছিল—আলতাফ মাহমুদ গেরিলাদের নেতা। তাকে কজা করতে পারলেই সব খবর পাওয়া যাবে। তাই অত্যাচার বেধড়ক, বেরহম চলত। এমনি অত্যাচার নিপীড়নে বিধবস্ত দেহখানা ধারণ করে আলতাফ মাহমুদ রাজনীতির দীক্ষাকে সম্মান প্রদর্শন করে গেছেন শত্রুপক্ষকে কোনাে দেননি। জান দিয়েছেন। রমনা থানা থেকে এমপি হােস্টেলে আনা নেয়া চলেছিল কদিন। কিন্তু, তারপর তেসরা সেপ্টেম্বর (১৯৭১) চোখটা বেঁধে তাকে যে কোথায় নিয়ে যাওয়া হলাে এবং কেমন করে অত্যাচার করতে করতে তাঁকে পিশাচের হত্যা করেছিল, এতটুকুও জানা যায়নি। কবে মারা গেছেন তাও আমরা জানি না। আলতাফ মাহমুদের সাথে যাদের সেদিন ধরে আনা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনাত্মীয়রা সেদিন বিকেলেই ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল আর আলভী, দীনু, আৰু মুক্তি পেয়েছিল ক’দিন বাদে। আলভী ছবি আঁকতাে বলে আঙ্গুলগুলাে হেঁছে দিয়েছিল। …. আলতাফ মাহমুদ করাচীতে থাকতে খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন মন্ত্রী হাফিজের সাথে। আর হাফিজও তাঁর রাজনীতি সচেতনতার কারণে আলতাফ মাহমুদের নৈকট্য পেয়েছিলেন। দুজনেই এই মুক্তিযুদ্ধকালে রাজা হােসেন খানকে নিয়ে প্রখ্যাত গণগায়ক আব্দুল লতিফের লেখা গান সুর করতেন আর স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন, যা আমাদের হাতে পৌছেছিল সেপ্টেম্বরেই। যে সেপ্টেম্বরে তার অন্তর্ধান ঘটেছিল।
ছােটবেলা থেকে যে আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীতের প্রতি নিবেদিত প্রাণ, সেই লােকটি জান দিয়ে গেলেন দেশের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে। প্রতিভাদীপ্ত ছােঠ ঝিলু (আলতাফ মাহমুদের ডাক নাম) যেমন ছিলেন লেখাপড়ায়, তেমনি ছিলেন গানবাজনায়। চমৎকার আঁকার হাত ছিল তাঁর। স্কুলের যেকোনাে অনুষ্ঠানে মঞ্চসজ্জা, তােরণ তৈরি, কিংবা কোনাে সাময়িকীর প্রচ্ছদ অঙ্কন এসবই তাঁকে করতে হতাে। এমনকি কোরআন তেলাওয়া অথবা উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশনা কোনােটি থেকেই তাকে বাদ দেবার উপায় ছিল না। ফলে যতই মেধাবী হন না কেন ঝোক তার অনেক বেশি ছিল নন্দন শিল্পে। আলতাফ মাহমুদ বড়দের স্নেহ, হােটদের শ্রদ্ধা আর সমবয়সীদের বন্ধুত্ব এমনভাবে জয় করে নিতেন যে কেউ তাকে পরিহার করতে পারতেন না। তাকে ভােলা কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি ছিলেন ক্ষমতাধর সংগঠক। বরিশাল জেলা স্কুলে যে ছাত্র আলতাফ মাহমুদ (ঝিলু) সেই ছােট্টবেলায় কেরাত শেখার সবক নিতে গিয়ে চমৎকার সুরেলা কণ্ঠস্বর শুনিয়ে কারীসাহেবকে পর্যন্ত তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন, সে-ই পরবর্তী জীবনে স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক অবিনশ্বর ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। বরিশাল ফকিরবাড়ির তরুণ মহফিল তাকে দিয়েছিল যে মঞ্চ চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি, সেই মঞ্চই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল সারা বাংলায়। তাই আজও ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত তার বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর চেতনাপ্রদীপ্ত সুরে। ১৯৫০ সাল এবছরই রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে এপ্রিলের চব্বিশ তারিখে রাজনৈতিক বন্দিদের উপর ইংরেজ জেলসুপার বিল চালিয়েছেন গুলি। জান দিয়েছেন আনােয়ার, হানিফ, দেলােয়ার, কম্পম সিং, সুখেন, বিজন। এবছরই আলতাফ মাহমুদ এলেন ঢাকায়। ঢাকাতে তখন ধুমকেতু শিল্পী সংঘ বেশ সংগঠিত।
প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাকে বহন করে নিয়ে চলেছে পূর্ববঙ্গে। ধুমকেতুর সংগঠক বগুড়ার নিজামুল হক আর নওগীর মােমিনুল হক। এরই সাথে এসে জুটলেন আলতাফ। এমন সুরেলা উদাত্ত কণ্ঠস্বরই প্রয়ােজন গণসঙ্গীতের জন্য। প্রচণ্ড পরিশ্রমী আলতাফ। খুব তাড়াতাড়িই মিশে গেলেন সংগঠনের ধারায়। ১৯৫২ দিল ডাক রক্ত দেবার। ঝাপিয়ে পড়ল বাংলার তরুণ দামাল ছেলেরা। সালাম, বরকত, রফিকউদ্দিন, জব্বার, সালাহউদ্দিন-প্রাণ দিলেন মাতৃভাষার জন্য। আলতাফের শাণিত চেতনা আরাে ক্ষুরধার হলাে। এদিকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের রক্তক্ষয়ী সূচনা পর্বে অভূতপূর্ব প্রাণবলিদানের গাঁথা রচনা করতে লাগলেন আমাদের দেশের কবি-সাহিত্যিকেরা। তাই পঞ্চাশের প্রারম্ভিককাল আজও বাংলা সাহিত্যে এক নতুন ও অনন্য দিগন্ত উন্মোচন করে আছে, সচেতনতার আগুনে ঝলসানাে এই প্রান্তরে তখন যাদের জন্ম, তাঁরাই আজ পথপ্রদর্শক মহীরুহ। এদেরই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখলেন কবিতা আমার ভায়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি। কবিতাটি পেয়ে প্রখ্যাত গণগায়ক আব্দুল লতিফ এতে সুর বসালেন এবং গাইলেনও বেশকটি অনুষ্ঠানে। এদিকে আলতাফ মাহমুদ একদিন নতুন করে সুরারােপ করলেন এই গানেই। লতিফ ডাই শুনে অভিভূত হয়ে নিজের সুরারােপিত গান আর গাইলেন না। আলতাফকেই তিনি নতুন সুরে গাইতে বললেন। আর সেই সুর মানুষের মনকে এমনভাবে নাড়া দিয়েছে যে, বাঙালি জাতি যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন এই সুর অনুরণিত হতে থাকবে আমাদের মনে। যে গানটি আলতাফ মাহমুদের সুরে আজ শহীদ দিবস বা একুশে ফেব্রুয়ারি পালনের অনুষ্ঠানে কিংবা বাংলাভাষায় সাহিত্যে-সংস্কৃতির যে কোনও সভামঞ্চেই গীত হয়।
আবালবৃদ্ধবনিতা এ গানটি গাইতে জানেন। উন্মথিত এ সুর আমাদের প্রত্যয়কে রাজনীতি সচেতন করে, সংগ্রামকে সমৃদ্ধ করে। এগিয়ে চলার পথনির্দেশ দেয়। ভাষা আন্দোলনের পরপরই যে গানটি মানুষের হৃদয়কে মথিত করলাে তার মধ্যে “আমার ভায়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি সবচে বেশি জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযােগ্যতা অর্জন করে। তাই আজও শহীদ দিবসের প্রভাতফেরীতে কিংবা কোনাে অনুষ্ঠানের উদ্বোধনীতে এই গান সবাই গায়। কিন্তু এরপর সবচেয়ে বেশি হৃদয়কে কেড়ে নেয়, বাঙালিকে কাদায়, সেটি হলাে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি। রক্তচোষা বাইনার দল যখন বায়ান্নতে তরুণ তাজা প্রাণের কলজে উপড়ে নিয়ে উল্লাসে মত্ত, তখন ঢাকার মিছিলে গুলির খবর গিয়ে পৌছেছে বাংলার ঘরে ঘরে। কামার তার হাঁপর থামিয়ে দিয়েছে। মাঝি দাঁড় বাইছে না। কিষাণেরা। লাঙ্গল কাধে তােলেনি-এমনি এক মুহুর্তে খুলনা বাগেরহাটের মাঠে-ময়দানে, হাটেবাজারে গান গেয়ে বেড়ানাে সাধারণ মানুষের প্রিয় গায়ক শামসুদ্দিন আহমদ রচনা ও সুর করলেন এই গানটি। গলায় গলায় ঢাকায় এল। উঠলাে আলতাফের দরদী-দরাজ গলায়। এ-গান পেল এক নতুন রূপ ও রস। সত্যিকথা বলতে কি, আলতাফ মাহমুদের গলা ছাড়া এ-গান যেন মানায়ই না, তেমন হৃদয়গ্রাহী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত না। কিন্তু যখনই আলতাফ গেয়েছিলেন এ গান, তখনই যেন কেমন একটা শিহরণ সারাদেহ-মনে খেলে যেত এই গানের সুর।
এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আরেক দিকপাল সংগঠক বদরুল হাসান ১৯৫৯ সালে একটি গান রচনা করলেন ঘুমের দেশের ঘুম ভাঙাতে ঘুমিয়ে গেল যারা…। এই গানটির সুর করেছেন আলতাফ। মধুর আবাহনী সুরের মূর্ঘনায় হৃদয় নিংড়ানাে ব্যথা উপচে পড়েছে এতে। এ গানটি বহুল প্রচারিত না হলেও তার ছাত্রছাত্রীরা আজও প্রভাতফেরি বা ট্রাক-অনুষ্ঠানে, সড়কের মােড়ে দাঁড়িয়ে এ-গান পরিবেশন করে থাকেন। ১৯৫৩ সাল। কুমিল্লাতে অনুষ্ঠিত হলাে সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন। এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগিয়ে ছিল এই সম্মেলন। বিরােধী পরিবেশ, মুসলিম লীগ সরকারের নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে এই প্রতিবাদী সমাবেশ এদেশের প্রগতিমনা শিল্পী, সাহিত্যিকদের সম্মিলিত করেন। এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ অংশগ্রহণ করে গণসঙ্গীত ও দুটি নৃত্যনাট্য নিয়ে। এর নেতৃত্বে ছিলেন বগুড়ার নিজামুল হক, নওগাঁর মােমিনুল হক (ভূটিভাই) আর বরিশালের আলতাফ মাহমুদ। এরা উপস্থাপন করেছিলেন সমসাময়িক সমস্যা নিয়ে রচিত নৃত্যনাট্য। একটি কৃষকদের সমস্যা বর্ণিত ‘কিষাণের কাহিনী এবং অন্যটি শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার ও নিপীড়নবিরােধী শক্তি জাগ্রত করার লক্ষ্যে প্রযােজিত মজদুর।” দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল সম্মেলনে। সঙ্গীত পরিচালনা করার দায়িত্ব ছিল আলতাফ মাহমুদের।
৫৩’র সারা বছর আর ১৯৫৪ তে পূর্ব বাংলায় জনগণের চাপে দেয়া সাধারণ নির্বাচনের প্রচারাভিযানে সর্বদলীয় মাের্চা-যুফ্রন্টের পক্ষে আলতাফ মাহমুদের অবদান অবিস্মরণীয়। নিজাম, ভুটি, লাইজু এদের সাথে নিয়ে চারণের মতন
আলতাফ ঘুরে বেড়িয়েছেন মানুষকে জাগাবার জন্য। গ্রামেগঞ্জে, মাঠে-ময়দানে, নগরে-বন্দরে অসংখ্য জনসভা আর সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করে। মানুষের চেতনাকে শাণিত করেছেন। এ-সময় যে গান বাংলার গণমানুষকে উদ্বেলিত করেছে, সংগ্রামে জুগিয়েছে অনুপ্রেরণা, তাদের মধ্যে আলতাফ পরিবেশন করেছেন কীর্তন, কাওয়ালী কিংবা উর্দু হিন্দী বাংলা গণসঙ্গীত। যেমন
স্বর্গে যাব গাে স্বর্গে যাব গাে, স্বর্গে যাব গাে।
মােরা উজিরে নাজিরে বাঁচায়ে রাখিতে চিরউপবাসী হব মােরা কি দুখে বাঁচিয়া রবাে। কিংবা মরি হায়রে হায় দুঃখ বলি কারে। পাচশ টাকার বাগান খাইলাে পাঁচসিকার ছাগলে। হুনছনি ভাই দেখছনি, দেখছনি ভাই হনহনি স্বাধীনতার নামে আজব দেইখছনি অথবা ম্যায় ভূখা হু অনাথ হামারা লাড়কা লাড়কি রান্তে পে হ্যায় ঘর দুয়ার হ্যায় হাম মউতকা জিমঘদার। : ১৯৫৪’র সাধারণ নির্বাচনে আমরা বাংলার মানুষ মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করলাম। এ বিজয়ে আলতাফ মাহমুদ এক জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডের মতন ছুটে বেড়ালেন। তিনি গ্রামবাংলার মানুষের হৃদয়কে দিয়েছিলেন সূর্যতাপ। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তির লােলুপ দৃষ্টি আর তাবেদার পাকিস্তানি শাসকচক্রের সােষণের চক্রান্তে জনগণের রায় উপেক্ষিত হলাে। মাত্র কয়েকদিন পরেই যুক্তফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করে এল গভর্নরী শাসন। ৯২ ক ধারা জারি হলাে। পূর্ববঙ্গের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়া হলাে।
গ্রেফতার করা হলাে অগণিত রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাকে। হুলিয়া জারি করা হলাে আরাে অসংখ্য কর্মী ও নেতার বিরুদ্ধে। তাই রাজনীতি সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মী আলতাফ মাহমুদকেও আত্মগােপন করতে হলাে। কয়েকমাস পর যখন হুলিয়া তুলে নেয়া হলাে তখন পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংঘের নাম পাল্টে রাখা হলাে পাকিস্তান গণনাট্য সংঘ। এসময় পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ ছিল আদর্শ সমাজ গড়ার সুসংগঠিত সুশৃংখল সৈনিক সংগঠন। যুবকদের নতুন এই সংগঠন তখনই তাগিদ বােধ করেছিল।একটি সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট বা সংগঠনের। রাজনৈতিকভাবে নিজাম, আলতাফ ও মােমিনুলরা ছিলেন প্রগতিবাদী রাজনীতি সচেতন ও শ্রেণীসংগ্রামে বিশ্বাসী কর্মী। তারাই এ দায়িত্ব তুলে নিলেন কাঁধে। এই সাংস্কৃতিক সংগঠনকে পরিণত করলেন যুবলীগের সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট। ফ্রস্ট হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সরকারি রােষানলে পড়তে হয়েছে একে বহুবার। তাই নামটাকে পরিবর্তন করতে হয় কৌশলের জন্য। এ সময়ে আমাদের এই অঞ্চলে গণসঙ্গীত রচনা করবার মতন ছিলেন না। কেউ। ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছিল কেবল। তাই আমাদের পূর্ব বাংলার সমস্যা উপযােগী যে কোনাে গান আমরা তখন গেয়েছি। আই পি টি এর বহুগান একাত্তর অব্দি আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গীত হয়েছে। আরমানীটোলার ময়দানে, কারকুন লেনের ভেতরের মাজার, ঢাকা কলেজের মঞ্চ, প্যারাডাইস। সিনেমা হল, মাহবুব আলী ইনস্টিটিউট, পল্টন ময়দান, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তন থেকে গ্রামবাংলার পথঘাট প্রান্তরের জনসমাবেশ উচ্চকিত হয়েছে। অগণিত প্রাণমন আন্দোলিত করেছে। এর অধিকাংশ গানই পুনরুজ্জীবিত করেছেন শ্রণী শিল্পী সংসদ ও পাকিস্তান গণনাট্য সংঘ। আর গেয়েছেন আলতাফ মাহমুদ, মােমিনুল হক। অবশ্য নিজামুলও পরে গণসঙ্গীত গাইতে শুরু করেন।
আলতাফ মাহমুদ ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে যােগদানের জন্য আমন্ত্রিত হলেন সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫৬ সালে। তিনি গেলেন করাচী। কিন্তু পাসপাের্ট তার বাতিল করে দেয়া হলাে, তিনি শান্তি সম্মেলনে যেতে পারলেন না। চোট লাগলাে মনে। ক্ষুব্ধ হলেন তিনি। আর ঢাকা ফিরলেন না। সেখানেই থেকে তিমির বরণ ও তার সুযােগ্য সহযােগী দেবু ভট্টাচার্যের সান্নিধ্য পেলেন। দেবুদা’র ওখানে থাকলেও বহুদিন। ওস্তাদ কাদের খা’র কাছে নাড়া বেঁধে তালিম নিলেন উচ্চাংগ সঙ্গীতে। ওস্তাদ ওমরাও বান্দু খাঁ, তবলাবাদক ওস্তাদ আল্লাদিত্তা খাঁ, সেতারিয়া কবীর খা, বীনার হাবীর খার মতন গুণীজনের সাহচর্যে তিনি এসেছেন। তাদের আশীষ তাঁকে সমৃদ্ধ করেছে। ১৯৫৬ সালে আলতাফ মাহমুদ করাচীতে প্রথম আধুনিক গান গেয়ে বেতার শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। একটি বাংলা প্রেমের গান। লিখেছিলেন এদেশের অন্যতম একনিষ্ঠ সংস্কৃতিসেবী কেশব চ্যাটার্জী। সুর আলতাফেরই ছিল। তারপর সেই বেতারে আলতাফ অনেক অনুষ্ঠানও প্রযােজনা এবং পরিবেশনা করেছেন। ইস্ট পাকিস্তান অ্যাসােসিয়েশন কিংবা বুলবুল একাডেমি, নজরুল একাডেমির হয়ে কত যে অনুষ্ঠান করেছেন তার ইয়ত্তা নেই। এদের জন্য বহু ছায়ানাট্য, নৃত্যনাট্য সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়ােজন করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রে প্রথম তিনি কণ্ঠ দিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চিত্রনির্মাতা এ, জে কারদারের ছবি ‘জাগাে হুয়া সাবেরা।’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে চিত্রনাট্য রচিত হয়েছিল।
সাদেক খান (একসময়ের বামপন্থী ছাত্রনেতা, পরে সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার, বর্তমানে ব্যবসায়ী) এবং দিনাজপুরের মেয়ে পশ্চিমবাংলার যশস্বী নাট্য শিল্পী তৃপ্তি মিত্র অভিনীত এ ছবিতে আলতাফ গাইলেন-হাম হর নদীকা রাজা। গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল আলতাফের গাওয়ার গুণে, গলার মাধুর্যে ও প্রকাশের বলিষ্ঠতায়। এছাড়া করাচীতে প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্যের প্রধান সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। করাচীতে তাকে জীবন জীবিকা নির্বাহের তাগিদে চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হতে হয়েছিল। সেকারণেই তার গণসংগীতের চর্চা বা পরিবেশনা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। তবু তিনি যখন ফাকে ফাকে ঢাকা আসতেন তখনই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (এপ, সংস্কৃতি সংসদ এরা তাকে ধরে নিয়ে যেত গাওয়ার জন্য। কি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সনের ছাত্র আন্দোলনের পর দেশে যখন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে জনতার ক্ষোভ ও ঘৃণা দানা বাঁধছে এমনই সময় ১৯৬৩ সনে আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় ফিরে এলেন। আলতাফ মাহমুদের প্রত্যাবর্তন আমাদের মনে শক্তি এনে দিল প্রচণ্ড। কারণ সহযােদ্ধাদের মধ্যে তেমন গণসঙ্গীত সুরকার বা গায়কের অভাব ছিল দারুণ। সবেধন শেখ লুৎফর রহমান, সুখেন্দু চক্রবর্তী ছাড়া আর তাে কেউ ছিলেন না। লতিফভাই ছিলেন সরকারি চাকুরে। ফলে তার ছিল পদে পদে বাধা। আলতাফ মাহমুদ এলেন। আবার মিশে গেলেন এদেশের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রবাহমান ধারার সাথে।
প্রচণ্ডবেগে দুর্বার বেগে চলল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। ৬২’র আন্দোলনের পর বাঙালি জাতীয়তাবােধ থেকে জনগণকে তৈরি করার আকাভকায় গড়ে উঠলাে ছায়ানট। আলতাফ মাহমুদ ছায়ানটের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন না। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানের যেকোনাে অনুষ্ঠানে ডাকলেই তিনি আসতেন। ছাত্র ইউনিয়ন, সংস্কৃতি সংসদ, পাক-চীন মৈত্রী সমিতি, পাকসােভিয়েত মৈত্রী সমিতির যেকোন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড মানেই আলতাফ মাহমুদের সরব উপস্থিতি। একাত্তরের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সময় পর্যন্ত তিনি ছিলেন এক সাহসী যােদ্ধা, সচেতন সংগঠক এবং দরাজ গলার শিল্পী। ১৯৬৭ সাল। জনগণের জন্য শিল্পকে অর্থবহ করে তােলার জন্য ক্রান্তি শিল্পী গােষ্ঠী সংগঠিত হলাে এবং তাদের প্রথম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে পল্টন ময়দানের বিশাল প্রাঙ্গণে। ক্রান্তির অধিকাংশ কর্মীই মার্কসবাদে বিশ্বাসী। তাদের লক্ষ্য শিল্পসাহিত্যকে গণমুক্তির হাতিয়ার হিসেবে তৈরি ও পরিবেশন করতে হবে। তাই তাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়ােজন ভােলা ময়দানে। | ১৯৫৭ সালে আলতাফ দেশে ফিরলেন কদিনের জন্য। সেবার ডাকসুর উদ্যোগে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান করতে হবে। এ বাংলার প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক বদরুল হাসান ছিলেন এ অনুষ্ঠান প্রযােজনার দায়িত্বে। এ সময় ছাত্র আন্দোলনের পুরােভাগে ছিলেন পাবনার।
জয়নাল আবেদিন, দিনাজপুরের মােহাম্মদ ফরহাদ, খুলনার এ, কে, এম জিয়াউদ্দিন এবং জিয়াউদ্দিন মাহমুদ (বর্তমানে বিলেতে আইন ব্যবসা করছেন)। এদের অনুরােধে, সামনে সময় খুব কম থাকলেও বদরুল ভাইকে অনেক বলে কয়ে সম্মত করলাম অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নিতে। বদরুল হাসান তখন দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় সাব-এডিটরের চাকরি করেন। থাকেন আমাদের সাথে ১৫৬, নবাবপুর রােডে। প্রযােজনা ও ধারাবর্ণনা লিখছেন তিনি আর রিহার্সেল করছেন আলতাফ মাহমুদ। এ অনুষ্ঠানের শিল্পী হিসেবে পাওয়া গেল শেখ লুৎফর রহমানকেও (তিনিও তখন করাচীতে থাকতেন)। লতিফ ভাইও ছিলেন। উদ্বােধনী গানটি গেয়েছিলেন সেদিনের হােট ফাহমিদা খাতুন (আজকের স্বনামখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী)। গানটি ছিল ‘মমাদের গরব, মােদের আশা, আ-মরি বাংলাভাষা’। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী ড. কাজী মােতাহার হােসেন। বদরুল হাসানের বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের প্রতিভায় সংগঠিত এ অনুষ্ঠান উপস্থাপিত হয়েছিল তখনকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল কার্জন হলে। এতে যারা অংশ নিয়েছিলেন তাদের অনেকের কথাই আজ মনে পড়ছে না। কিন্তু হামিদা হক (আজকের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী) আর ধারাবর্ণনায় আজমিরী বেগম (অভিনেত্রী। রেশমা) ছিলেন এবং অনুষ্ঠানটি দারুণ হৃদয়গ্রাহী হয়েছিল। আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। এত অল্প সময়ে অনুষ্ঠান করতে ডাকা হয়েছে বলে বদরুল হাসান সংগঠকদের দারুণ কথা শুনিয়েছিলেন-‘আপনারা দায় সারতে চান বুঝি। এমন করলেও তে পারেন। আপনাদের দায়িত্ব এবং আন্তরিকতা থাকা উচিত।’ইত্যাদি ইত্যাদি। মুসলিম লীগের ও মােনেম খানের ভাড়াটিয়া ঠ্যাঙ্গাড়ে বাহিনীর ভয়ে কম্পিত সবার হৃদয়। উচ্চবাচ্য করলেই জেলজুলুম নির্যাতন।
এমনকি মহিলা নির্যাতনেও তাদের কোন দ্বিধা ছিল না। এমনি এক পরিবেশে ক্রান্তি ২১, ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে পল্টন ময়দানে। শহীদ দিবস উপলক্ষে প্রথমদিন ডাকসুর সঙ্গীতানুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। পরের দুদিন ক্রান্তি বিশাল জনতার সামনে উপস্থাপন করে পশ্চিম বাংলার শক্তিধর অভিনেতা জ্ঞানেশ মুখার্জীর লেখা ও দৈনিক স্বাধীনতার শারদীয় সংখ্যায় প্রকাশিত নাটক আলাের পথযাত্রা, সঙ্গীতানুষ্ঠান ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’ এবং সাংবাদিক আব্দুল মতিনের কাহিনীর ভিত্তিতে রচিত নৃত্যনাট্য জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে’। নৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালনা করেন আলতাফ মাহমুদ এবং নৃত্য পরিচালনায় ছিলেন আমানুল হক। বিপুল দর্শকচিত্ত সংগ্রামী চেতনায় উদ্বেল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সবচে বড় আকর্ষণ ছিল সঙ্গীতাংশ। যেখানে একটি নৃত্যনাট্যের সঙ্গীত রচনার জন্য পাঁচ সাত দশজন যাত্রীর প্রয়ােজন হতাে সেসময়, এখনতাে ২০-৩০ জনের কমে হয় না। সেখানে জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে যন্ত্রী ছিল। মাত্র একজন, নাম আলতাফ মাহমুদ। তিনি হারমােনিয়াম টেনে নিয়ে, কখনও রিডে হাত চালিয়ে, কখনও তবলায় চাটি মেরে আবার কখনও বা পকেটের চিরুনীর কাঁটাগুলােয় আঙ্গুল টেনে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক কিংবা এফেক্ট মিউজিক সৃষ্টি করছেন। কী অদ্ভুত তার উপলব্ধি! সৃষ্টিতে কতটা আন্তরিক, সহজেই অনুধাবন করা যায়। সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অর্থাভাব সবসময়ই থাকে, তাই তিনি উপলব্ধিকে আন্তরিকতা দিয়ে রূপান্তরিত করেছেন। এখানে কোনাে ব্যয় হয়নি। এই অনুষ্ঠানের রিহার্সেল চলছে সারাদিন ধরে। একদিকে গানের, অন্যদিকে নাচের। রিহার্সেল হচ্ছে কাকরাইলের মােড়ে সার্কিট হাউসের দক্ষিণমুখের দোতলায় চিফ ইঞ্জিনিয়ার জনাব হাতেম আলী খানের বাসায়। হায়দার আকবর খান রনাে ও হায়দার আনােয়ার খান নূনাের বাবা হাতেম আলী খান ছিলেন প্রচণ্ড রাজনীতি সচেতন। তাঁর খী মাতৃস্নেহে সব শিল্পীকে দুপুরে খেতে দিয়েছেন। চমৎকার রান্না। প্রায় ভুরি ভােজনে ভারাক্রান্ত।
মি খাবারের পর কোনাে মিষ্টান্ন নেই দেখে আলতাফ ভাই সুধােলেন-“খালাম্মা, পায়েস টায়েস নেই?’ খালাম্মা দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং পায়েস বসিয়ে দিলেন সবার জন্য। কিন্তু আলতাফ ভাই বললেন-“ঠিক আছে, লােহানী এই নেন টাকা, মরণচাদের দুই আনান।’ বলে পঞ্চাশ টাকার একটা নােট বের করে দিলেন আলতাফ মাহমুদ। দই এনে পরম পরিতােষে খেলাম আমরা। ৬৭ সালে পঞ্চাশ টাকা বের করে দেয়া, চটিটিখানি কথা নয়…একদিন এই টাকা ফেরত দিতে গেলাম আলতাফ ভাইকে। তিনি বললেন-কি খুব টাকা হয়েছে বুঝি? রাখেন টাকাটা কাজে লাগবে। বেশি বড়লােকি দ্যাখায়েন না।” আমি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কারণ আমি অন্তত জানি আলতাফ ভাইয়ের অনটনের কথা। কিন্তু তার মানসিক উদারতা তুলনাহীন আজকে একটা ঘটনা মনে পড়ছে-বছরটা মনে নেই। তবে এপসু’র বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বাংলা একাডেমীতে হবে। সব শিল্পীকে অনুষ্ঠানের আগে ফাইনাল রিহার্সেলের জন্য বিকেল চারটায় আসতে বলা হয়েছে। সাড়ে চারটায়ও কেউ আসেনি। খানিকক্ষণ পরে যখন সবাই এল দেখি রিহার্সেল করার জন্য আলতাফ মাহমুদকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। আমি আর ছাত্র ইউনিয়ন নেতা রেজা আলী (বর্তমানে ব্যবসায়ী, বিটপী অ্যাডভার্টাইজাসের মালিক) বেরুলাম বড় ভয়াগন গাড়ি নিয়ে, ঢাকার শহরে যে সব জায়গায় আলতাফ ভাইয়ের আড্ডাখানা আছে খুঁজে দেখতে, কি তাকে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত আধুনিক গানের শিল্পী মােহাম্মদ আলীকে দিয়ে অনুষ্ঠান চালাতে হলাে। সেও এ অনুষ্ঠানে ছিলেন…পরে আলতাফ ভাই বললেন—আগে সময়জ্ঞান দিন শিল্পীদের, তারপর গাইতে বলুন। নাঙ খুব শক্ত ছিল। অন্যায় দেখলে মেজাজ খুব খারাপ হয়ে যেত তার। সময় ঠিক না রাখলে তিনি ক্ষেপে যেতেন।
এ ধরনের বহু ঘটনাই আজ মনে পড়ে যাচ্ছে। ৬৭, ৬৮, ৬৯, ৭০, ৭১ এই ক’বছর তিনি একনাগাড়ে অসংখ্য গণসঙ্গীত হাটে মাঠে ঘাটে গেয়েছেন এবং গাইয়েছেন। যে গান মানুষকে করেছে উদ্দীপ্ত। শ্রমিকের পেশীতে বল এনে দিয়েছে। কৃষককে দিয়েছে অফুরন্ত আশা। ছাত্রদের দিয়েছে প্রতিরােধের প্রকার গড়বার দুরন্ত দুর্বার সাহস।
৬৭ সালেই পাক-সােভিয়েত মৈত্রী সমিতির এক পল্টন অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালনা করেন আলতাফ মাহমুদ। এ অনুষ্ঠানের আকর্ষণীয় নতুন গানটি ছিল | শহীদুল্লাহ কায়সারের লেখা
“আমরা পেয়েছি রক্তদ্বীপের নিশানা আমরা জেনেছি সূর্যের ঠিকানা আমরা চলি অবিরাম। অগ্নি আখরে লিখি মােদের নাম।”
এছাড়া আলতাফ মাহমুদ তার গণসঙ্গীত পরিবেশন কালে আই পিটি এর বহু গানই গেয়েছেন। তারমধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে :
১. ধন্য আমি জন্মেছি মা তােমার ধূলিতে।
২. বিচারপতি তােমার বিচার করবে যারা
৩. আজ জেগেছে সেই জনতা আমাদের নানান দলে নানান মতে দলাদলি কেউবা চলে ডাইনে বা কেউ বাঁয়ে চলি। নওজোয়ান নওজোয়ান বিনে জেগেছে নওজোয়ান। নাকের বদলে নতুন পেলাম তা ডুম ডুম ডুম জান দিয়ে জানােয়ার পেলাম লাগলাে দেশে ধুম। এসাে মুক্ত কর এসাে মুক্ত কর অন্ধকারের এই দ্বার।
৭. ও আলাের পথযাত্রী এযে রাত্রি এখানে থেমাে না। পথে এবার নামে সাথী পথেই হবে পথ চেনা। কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
কালাে যারে বলে গায়ের লােক। এমনি বহু গানেরই উল্লেখ করা যায়, যার মধ্যে অনেকগুলাে এখনও গাওয়া হয়ে থাকে।
এছাড়া আলতাফ মাহমুদ বাংলাদেশের একমাত্র গীতিনাট্য হাজার তারের বীণা’র লংপ্লে রেকর্ড প্রকাশনার কৃতিত্বের অধিকারী। ১৯৭১ সালেও আলতাফ মাহমুদ ছিলেন সংগ্রামী জনতার সচেতন সৈনিক। বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের ক্রোধের মিছিলে আলতাফ মাহমুদ ছিলেন বন্ধু নিনাদ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কিংবা বাংলা একাডেমীর বটতলা অথবা রাজপথে উচ্চকিত
মিছিলে আলতাফ মাহমুদের কষ্ঠ নিঃসৃত গান ছিল শ্লোগান—এক লড়াকু মানুষের। তাইতাে দেখি তিনি মুক্তিবাহিনী, গেরিলা ক্র্যাক প্লাটুন-এর স্বাধীন বাংলা বেতারের সাথে সংযােগ রক্ষা করে চলেছেন আমৃত্যু। হারমােনিয়ামের রিড যে হাতে বাজতাে, সে হাতেই উঠেছিল মলােট ককটেল, গ্রেনেড, এল এম জি, এসএমজির ট্রাঙ্ক। গােলাবারুদ লুকিয়ে রাখতেন, পেট্রোল সরবরাহ করতেন গেরিলাদের নদীর ওপারে জিনজিরা গিয়ে গােপনে রানা হােসেন খান আর হাফিজ ভাইকে সাথে নিয়ে গণসঙ্গীত সুর আর রেকর্ড করে, স্বাধীনবাংলা বেতারে পাঠাতেন বাজারের থলে ভর্তি করে—এইতাে আলতাফ মাহমুদ। | দরাজগলার দরদী কণ্ঠস্বরের অধিকারী আলতাফ মাহমুদ মানুষকে মােহমুগ্ধ করে রাখতাে। সুরেলা সুষমামণ্ডিত স্নিগ্ধ মানসিকতার সেই সচেতন যােদ্ধা আলতাফ মাহমুদ আজ আর নেই। কিন্তু রয়ে গেছে তার স্মৃতি, অপূর্ব সুরসৃষ্টি, বলিষ্ঠ কণ্ঠের গান—স্লোগান আমাদের বাঁচবার প্রেরণা হিসেবে।
কামাল লােহানী
“লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং নাট্যকারদের লেখনীতে প্রতিধ্বনিত হােক কৃষক ও শ্রমিকের জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি
-বঙ্গবন্ধু
সূত্র : জয় বাংলা – এম আর আখতার মুকুল