গণহত্যার মদতদার আমেরিকা
মার্কিন অস্ত্র এবং অর্থ সাহায্য যাচ্ছে পাকিস্তানে। এগুলাের সরবরাহ বন্ধের কোন ইচ্ছা ইেন কর্তৃপক্ষের। বাংলাদেশে গণহত্যা সুরু হয়েছে গত পঁশিচে মার্চ। তারপর পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন ওয়াশিংটন। তাঁরা দুনিয়াকে বুঝাতে চেয়েছিলেন—মার্কিন সরকার বিবেক বর্জিত নন। ইসলামাবাদেও হাতে অস্ত্র গেলেই তীব্র হয়ে উঠবে বাংলাদেশে পাক-চমুর মারন্যজ্ঞ। মানবতার খাতিরেই আমেরিকা হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। খুশী হয়েছিলেন ভারতের এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। নয়াদিল্লী এর মধ্যে দেখেছিলেন ইয়াহিয়ার উপর মার্কিন চাপের পূর্বাভাষ। সব ধারণা উল্টে গেছে। পাক-সাহায্যে জাহাজ বােঝাই অস্ত্র পাঠচ্ছেন ওয়াশিংটন। আর্থিক সাহায্যেও পাবেন ইসলামাবাদ। এগুলাে অবশ্যই ব্যবহৃত হবে পূর্ব বাংলার গণহত্যায়। ভারতের এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ধারণা, তারা প্রতারিত। প্রতিশ্রুতি ভেঙ্গেছেন মার্কিন কর্তৃপক্ষ। জোরদার করছেন তারা ইয়াহিয়ার হাত। চারদিকে উঠছে বিরূপ সমালােনার ঝড়। ওয়াশিংটনের কর্তারা তাতে লজ্জিত কিম্বা উদ্বিগ্ন নন। ওদেও যুক্তি সরল। নিষেধাজ্ঞা জারী হয়েছিল গত পঁচিশে মার্চেও পর। সেসব অস্ত্রশস্ত্র যাচ্ছে পাকিস্তানে সেগুলাে সরবরাহের চুক্তি হয়েছিল তার আগে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়বে না এই লেনদেন। এদিকে কানাডা, হল্যান্ড, বৃটেন প্রভৃতি রাষ্ট্র বন্ধ করেছে পাকিস্তানে অস্ত্র প্রেরণ। বড় কওে দেখ নি তার চুক্তি। এরা জানে, চুক্তির মর্যাদা রক্ষার অর্থ, বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের জীবনহানি।
চুক্তির প্রতি মার্কিনী নিষ্ঠাও যে খুব বেশী, এমন নয়। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত লড়াইয়ের সময় ওয়াশিংটন উহৃ কওে দিয়েছিলেন ভারত এবং পাকিস্তানে সব রকমের সাহায্য দান। তার আওতা থেকে খাদ্য সরবরাহও বাদ যায় নি। এবার তার যুক্তি সেই পুরােনাে কাসুন্দিও ঘাটাঘাটি। পাকিস্তানকে অস্ত্র এবং আর্থিক সাহায্য না দিলে সে হবে অন্য রাষ্ট্রের শরণাপন্ন। তাতে ঘটবে আমেরিকার প্রভাবহানি। এই সম্ভাব্য অনাসৃষ্টি ঠেকাবার জন্য ইসলামাবাদেও গনহত্যায় মদৎ দিতেও আমেরিকা রাজী। ওয়াশিংটনের এই ধোঁকাবাজী নূতন নয়। এশিয়ার সামরিক স্ট্রাটেজীর উপর নির্ভরশীল তাঁদেও পাকিস্তানি নীতি। পাক-ভারত শক্তিসাম্য বজায় রাখা মার্কিন কর্তৃপক্ষের চিরাচরিত মতলব। তার জন্য ইসলামাবাদেও যেকোন প্রতিক্রিয়াশীল শয়তানকেও আলিঙ্গন দিতে তারা পিছপা নন। পাক-দরদেও ফলগুধারা নিয়ত বইছে মার্কিন প্রশাসন দপ্তরে। সেখানে পাত্তা পাবে না নয়াদিল্লীর ওজর-আপত্তি। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্ট কেনেডি ভারতকে দিতে চেয়েছিলেন ছ’ কোটি ডলারের অস্ত্রশস্ত্র। মহা কলরব তুলেছিল পাকিস্তান। পুরাপুরিভাবে প্রতিশ্রুতি পালনের আগেই হাত গুটিয়েছিল আমেরিকা। ১৯৬৫ সালে ভারত এবং পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিল মার্কিন অস্ত্র সরবরাহ। পাকিস্তান পড়েছিল মহাফ্যাসাদে। তাঁকে উদ্ধার করার জন্য ওয়াশিংটন নিয়েছিলেন তৃতীয় রাষ্ট্রের সাহায্য। শ’খানেক গােপন ষড়যন্ত্র ফাঁস না হলে এবং নয়াদিল্লী সােরগােল না পাকালে এগুলাে অবশ্যই থেকে যেত পাক-জঙ্গীশাহীর হাতে। তারপর তুরস্কেও মাধ্যমে পাকিস্তানে পাঠাবার চেষ্টা হয়েছিল জনমতের চাপে। ১৯৬৭ সাল থেকেই পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের উপর নিষেধাজ্ঞা আস্তে আস্তে তুলে নিচ্ছিলেন ওয়াশিংটন। তাদেও দৌলতেই অস্ত্র সজ্জিত এবং পুণর্গঠিত হচ্ছিত পাকসৈন্যদল। পওে তাতে যােগ দিয়েছিল সােভিয়েট রাশিয়া। চীনা অস্ত্র সরবরাহ আগেও বন্ধ হয় নি, এখনও হচ্ছে না। বাংলাদেশের ঘটনার পর থমকে দাঁড়িয়েছেন মস্কো। লজ্জা সরম এবং আদর্শেও বালাই নেই পিকিংএর বিপ্লবীদের। ওরা যা ভাল বুঝেন তাই করেন। বিশ্ব জনমতের কোন দাম নেই তাদের কাছে। মার্কিন কর্তৃপক্ষের আছে লােকলজ্জার ভয়। তাই তাঁরা ঘােমটার নীচে খেমটা নাচ নাচেন। সদর দরজা বন্ধ হলে খিড়কীর দরজা দিয়ে চলে তাদের অশালীন কারবার।
মার্কিন অনুসৃত পাক-নীতির ইতিহাস যারা জানেন তাঁদের কাছে আমেরিকার বেহায়াপনা মােটেই অপ্রত্যাশিত নয়। নয়াদিল্লীর পররাষ্ট্র দপ্তর ভ্রান্ত। তারা অহেতুক গুরুত্ব দিয়েছিলেন মার্কিন প্রতিশ্রুতির উপর। এদের জানা উচিত, এশীয় রাষ্ট্রগুলাের উপর কোন শ্রদ্ধা নেই মার্কিন কর্তাদের। টাকার ওজনে করেন তারা এশীয় নেতা এবং জনগণের মতামতের মূল্যায়ন। পাকিস্তানে যাচ্ছে মার্কিন অস্ত্র। তা নিয়ে হৈচৈ করছে ভারত। তাকে শান্ত রাখার জন্য অমনিই আসছে মার্কিন অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি। এই টাকা ধুয়ে শরণার্থীদের জল খাওয়াবেন নয়াদিল্লী। এবটি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন জাতির পিঠে আর্থিক চাবুক মারার কি অপরূপ কৌশল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিংএর বরাত খারাপ। ঘা খেয়েও তাঁর শিক্ষা হয় নি। তিনি বলছেন, সাম্প্রতিক মার্কিন ডিগবাজী সাময়িক। ইতিহাসের নজীর প্রতিকুল। আমেরিকার পাক-প্রীতি ট্রাডেশন্যাল। জনমতের তাড়নয় সকীয়া যেখানে অচল সেখানে তার আশ্রয় পরকীয়। পরকীয়া যেখানে ব্যর্থ সেখানে চলবে ব্যাখ্যার ওলট পালট। ব্যাভিচারের উপর দেবার চেষ্টা হবে সদাচারের কোটিং। এই সহজ কথাটি কেন্দ্রীয় সরকার বুঝতে পারছেন না বলেই তারা নিতে পারছেন না বাংলাদেশ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত। ফলে ভারতের উপর ঘনিয়ে আসছে নিদারূণ বিপর্যয়। শরণার্থীর বােঝা নিয়ে সে ধুকছে। তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া ইয়াহিয়ার আঘােষিত লড়াইয়ের যােগ্য প্রতুত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না নয়াদিল্লী।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২ জুলাই ১৯৭১