বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র | ২২ জুলাই ১৯৫৮ গোপালগঞ্জ
গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা গ্রামের জনসভায় বঙ্গবন্ধু
২২ জুলাই ১৯৫৮
গোপালগঞ্জ
আমি বিশ্বের অনেক দেশ সফর করিয়াছি। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায় এরূপ উর্বর কোন দেশ আমি দেখি নাই। কিন্তু তবু কেন দারিদ্র্যের অভিশাপ হইতে আমরা মুক্ত হইতে পারিলাম না? ইহার কারণ হইতেছে এই যে, কায়েমী স্বার্থের পোষক মুষ্টিমেয় একদল লোক যুগ যুগ ধরিয়া সাধারণ মানুষকে শােষণ করিয়া আসিয়াছে। তাহার ফলেই দেখা দিয়াছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এই অসাম্য; তাহারই ফলে দেশে আজ এই অভাব-অনটন, মানুষের ঘরে ঘরে এই হাহাকার। নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য দিন দিন বাড়িয়া চলিয়াছে; মানুষের মন হতাশায় ভরিয়া উঠিয়াছে। যখন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইল তখন সকলেই আমরা আশা করিয়াছিলাম যে, এবার হয়ত মানুষের অন্ন-বস্ত্রের সমস্যার সমাধান হইবে। কিন্তু সে আশা ফলবতী হয় নাই। সেজন্য দায়ী কে? নিশ্চয়ই মুসলিম লীগের কার্যকলাপ, কেন্দ্রে ও প্রদেশসমূহে দীর্ঘ আট বৎসরকাল তাহারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লইয়া ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত ছিল, কোরিয়া যুদ্ধের তেজী মওসুমের সুযোগে বাণিজ্য উদবৃত্ত হেতু প্রচুর অর্থও তাহাদের হাতে ছিল, কিন্তু মুসলিম লীগ এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নাই। জাতীয় উন্নয়নের জন্য কোন পরিকল্পনাই তাহারা গ্রহণ করে নাই; অপরপক্ষে দরিদ্র জনসাধারণের শ্রমের বিনিময়ে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হইয়াছিল; তাহারা উহা অপচয় করিয়াছে। সর্বাপেক্ষা পরিতাপের বিষয় এই যে, এই সময় পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শিত হইয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ বিজর্সন দেওয়া হইয়াছে। কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় সবটাই পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্পায়নে ব্যয়িত হইয়াছে। আমি পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্য ও শিল্পদফতরের সচিব হিসাবে প্রদেশে যে ৫৮টি নয়া শিল্প প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিয়াছিলাম, জনাব চুন্দ্রীগড়ের ৫৪ দিনের প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় শিল্প সচিব জনাব ফজলুর রহমান সেই অনুমতি বাতিল করিয়া দেন। কারণ, এ-প্রদেশের জনসাধারণকেই উহার বেশিরভাগ শিল্প প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়া হইয়াছিল।
এতদিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার পূর্বপাকিস্তানের প্রতি যে বিমাতৃসুলভ ব্যবহার করিয়া আসিতেছিলেন, জনাব সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে উহার পরিবর্তন ঘটে। তিনি এ প্রদেশের উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ করেন, কিন্তু ইহাতে কায়েমীস্বার্থবাদী মহলের স্বার্থহানি ঘটাতে তাহারা একজোট হইয়া আওয়ামী কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটান। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবই বিশ্বের দরবারে পাকিস্তানের মর্জাদা লাঘব করিয়াছে এবং কোন সরকারের পক্ষে কোন সুষ্ঠু নীতি অনুসরণ অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে। এই জন্যই আওয়ামী লীগ যুক্ত নির্বাচন দাবী করিতেছে। নির্বাচন প্রথা সম্পর্কে একদল ওলেমা ধর্মের নামে জনসাধারণের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির যে চেষ্টা করিতেছে, সে সম্পর্কে জনসাধারণকে হুঁশিয়ার থাকিবেন।
সূত্র – বঙ্গবন্ধুওগণমাধ্যম, পৃষ্ঠা – ২৩১-২৩২, বাংলাদেশপ্রেসইন্সটিটিউট, ঢাকা, প্রকাশকাল২০১৩