You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৮ই ফেব্রুয়ারী, সোমবার, ৬ই ফাল্গুন, ১৩৮০

আর কতদিন ধুকে ধুকে বেঁচে থাকা!

বাংলাদেশে আজ আমরা কি সুখে আছি? দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেয়া সহজসাধ্য নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান চাপে আজ আমরা তলিয়ে যেতে বসেছি। জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে আকাশচুম্বী হয়ে যাচ্ছে। বাজারে গিয়ে কোন জিনিসের গায়েই হাত দেয়ার উপায় নেই। দরদামের হাক শুনলেই অন্তরাত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম। স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে গত দু’বছর ধরে বাজারের হালচাল বড়ই গরম। কোন জিনিসেরই কোন নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা দাম নেই। আজ পাঁচ টাকায় যে জিনিস নিচ্ছি আগামীকাল সে জিনিসের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে দশ টাকায় উন্নীত হওয়া এমন কোন ব্যাপার নয় এবং এতে বিস্ময় প্রকাশেরও কিছু নেই। জনসাধারণ বরং এটাকেই স্বাভাবিক ব্যাপার বলে ধরে নিয়েছে। এই অবস্থায় সুখে স্বাচ্ছন্দে দিনযাপনের স্বপ্ন দেখাটা আকাশকুসুমেরই নামান্তর। অথচ আমরা ভেবেছিলাম, স্বাধীনতা পাওয়ার পর আমাদেরকে শাসন করার কেউ থাকবে না। আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে সুখী-সমৃদ্ধশালী জীবনযাপন করতে সক্ষম হব। কিন্তু আমাদের সেই আশায় গুড়েবালি। আমরা দিনের পর দিন দ্রব্যমূল্যের রাহুগ্রাসে নিজেদের অস্থিত্ব পর্যন্ত বেমালুম ভুলে যেতে বাধ্য হচ্ছি। সংসার সাগরে নিত্য খাবি খেতে খেতে এখন চোখে সর্ষেফুল দেখছি। দেশের সাধারণ মানুষ আজ দ্রব্যমূল্যের চাপে দিশেহারা। চারিদিকে গভীর অন্ধকার ঘনায়মান। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন শুধু সাধারণ মানুষকে নয় সমগ্র দেশকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছে। যুগটা রকেটের; তাই বাংলাদেশের দ্রব্যমূল্য পিছিয়ে থাকবে কেন? যুগের সঙ্গে দ্রব্যমূল্যকেও তো তাল মিলিয়ে চলতে হবে। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিরও তো একটা সীমা থাকা দরকার। দ্রব্যমূল্য যদি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে, তাহলে কি দেশবাসী স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে না? বাজারদর যারা নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা এ প্রশ্নটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছে বলে তো মনে হয় না। মুনাফা শিকারীরা সমাজের ভেতর শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। মুনাফা শিকারিদের এই দুর্ভেদ্য দুর্গের পতন না হওয়া পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কোনো বাঁচোয়া নেই। দ্রব্যমূল্যের সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ারও নেই কোন মসৃণ পথ। স্বাধীনতার পর আমরা কি সুখে আছি, এ প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে পাল্টা প্রশ্ন উচ্চারিত করা দরকার, আর কতদিন মৃত্যুর সঙ্গে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকা? আর কতদিন গগনস্পর্শী দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পাঞ্জা লড়া? দ্রব্যমূল্যের সাড়ে ছ’টাকা সেরের নারিকেল তেল এখন বত্রিশ টাকা বিকোচ্ছে, পাঁচ টাকা সেরের সয়াবিন পনেরো টাকা, কাপড় কাচা সাবান ন’টাকা সের এবং এক দিস্তা কাগজের দাম দুই টাকা সত্যিই তাজ্জব ব্যাপার। কালোবাজারি, মুনাফা শিকারিদের কারসাজিতেই বাজারের এ হাল হয়েছে। একথা বলে মনকে প্রবোধ দেয়ার উপায় থাকলেও আমাদের জিজ্ঞাসা মুনাফা শিকারিরা কাদের আস্কারায় এভাবে ফুলেফেঁপে উঠছে? একটি সেভেনও ক্লক ব্লেডের দাম এক টাকা পঁচিশ পয়সা হয় কেমন করে, এ প্রশ্ন আমাদের যৌক্তিক কারণেই বিদ্ধ করে। টিসিবি নামক রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে যে সব জিনিসপত্র আমদানি করে, তাই-বা কোন গোপন রন্ধ্র পথ দিয়ে কালোবাজারিদের করতলগত হয়, আমরা ভেবে পাইনা। সিগারেটের দাম প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে, তা দিয়ে কেউ কিনতে পারে না। দেশে উৎপাদিত জিনিসপত্রের দামও আকাশ ছোঁয়া। দোছাই কাঁচামালের অপ্রতুলতা কিন্তু কর্ণফুলীর কাগজের দামের বহর এত প্রকট কেন? আগে না হয় ‘করাচি’ থেকে ‘সিল’ দিয়ে আনার জন্য আট আনা দশ আনা দিস্তা কিনতে হতো, এখন যে দু’টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে এর নেপথ্য রহস্যটা কি? এখনো কি কর্ণফুলীর কাগজ কোথাও থেকে ‘সিল’ দিয়ে বাজারে ছাড়া হয়? চাল-ডাল-তেল-নুনের ব্যাপারে ঊর্ধ্বগতি সম্মানে অব্যাহত রয়েছে। বাস, রিক্সা, লঞ্চ, বেবিট্যাক্সি যেখানেই পা বাড়ান না কেন চড়া দামের কবলে জনসাধারণকে ‘গলাকাটা’ হতেই হবে। জিনিসপত্রের মূল্যমানের এই সার্বিক চেহারায় বাংলাদেশের খেটেখাওয়া মেহনতী মানুষ এবং নির্দিষ্ট আয় ভোগীরা হাবুডুবু খাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের ব্যয় বহন করতে গিয়ে আজ সবার প্রাণান্তকর অবস্থা। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এদেশের মানুষের সামনে আজ অগ্নিপরীক্ষা দেখা দিয়েছে, এবং যে সংকটাপন্ন অবস্থায় উদ্বেগ হয়েছে তাতে এই একই প্রশ্ন বারবার উচ্চকিত হবে আর কত দিন? দ্রব্যমূল্যের চাপ থেকে কি সাধারণ মানুষের নিস্তার পাওয়ার উপায় নেই? স্বাধীনতার সোনার আলোকে যেখানে সারা দেশ আলোকিত হয়ে উঠবে, মানুষের মুখে দেখা দিবে নির্মল হাসির ঝিলিক সেখানে আজ মেঘ জমে আছে। এই মেঘ জনজীবনকে নিদারুণভাবে জর্জরিত করে ফেলেছে। কাজেই দ্রব্যমূল্যের লাগাম টেরে ধরার জন্য যোগ্যতর ব্যবস্থা অবলম্বন বাঞ্ছিত, সাধারণ মানুষের জীবনকে সুন্দর করার জন্য এবং সমৃদ্ধিতে ভরিয়ে তোলার জন্য একটা হিল্লে না হলেই নয়।

ঠেলাঠেলির ঘর আল্লায় রক্ষা কর

ঢাকায় মশার উপদ্রব আবার নিদারুণভাবে বেড়েছে। মশার উপদ্রবে নাগরিক জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, প্রতিদিনের এ মশার সংখ্যা বাড়ছে। পৌর কর্তৃপক্ষ মশার এই অস্বাভাবিক বৃদ্ধির খবর জানেন কিনা আমরা জানি না। তবে তাদের নির্বিকারত্ব দেখে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে তারা মশক বৃদ্ধির খবর মোটেই জানেন না। মশা বৃদ্ধির কারণ শহরের আবর্জনা। জমাকৃত আবর্জনা থেকে মশার বংশ বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। শহরে বর্তমানে, আবর্জনা অস্বাভাবিকভাবে জমা হয়েছে। এবং তার থেকেই মশার বংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরের নর্দমা ও ডোবাগুলো ও আবর্জনায় ভরে উঠেছে। পৌর কর্তৃপক্ষ এগুলো দেখেও বা শুনেও শুনছেন না বলে মনে হচ্ছে।
এক সংবাদে প্রকাশ, ঢাকা পৌরসভার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে শহরের মশা উচ্ছেদ করার কাজ নাকি তাদের নয়। তাদের মতে ঢাকা শহরকে মশক মুক্ত করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব ঢাকা মশক নিবারণী সংস্থার। সংবাদপত্রে বলা হয়েছে মশক নিবারণী সংস্থা নাকি নিয়মিত মশা নিধন কাজে ব্যাপৃত রয়েছে। সংস্থাটির সঙ্গে যোগাযোগ করে কেমন ভাবে তারা মশা নিধন কাজ চালাচ্ছেন তা জানতে চাওয়া হলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বিস্তারিত কর্মসূচি জানাতে অস্বীকার করা হয়েছে। ঢাকা পৌরসভা ও ঢাকা মশক নিবারণী সংস্থার মধ্যকার পারস্পরিক কলহ উপভোগ করার অবকাশ ঢাকাবাসীদের আছে বলে মনে হয় না। এখন ঢাকায় যে হারে মশার বংশ বৃদ্ধি পেয়েছে তা উদ্বেগের কারণ। ঢাকাবাসী সবাই স্বীকার করবেন শহরের মশার প্রাদুর্ভাব বর্তমানে কি নিদারুন। মশার আক্রমণ থেকে জনজীবনের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালন সরকার কোন সংস্থার মাধ্যমে করবেন তা নির্ণয় করা জনগণের কাজ নয়। ঢাকা পৌরসভা অথবা মশক নিবারণী সংস্থা যার মাধ্যমে সরকার মশা নিধন কাজ পরিচালনা করে না কেন আমরা ঢাকাবাসী পক্ষ থেকে কোনো বিতর্কে সামিল না হয়ে অনতিবিলম্বে মশার উপদ্রব থেকে নগরবাসীর মুক্তি কামনা করি। যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক তা সরকার অবশ্যই গ্রহণ করবেন। একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারের সম্মুখে দুই অথবা ততোধিক সরকারি বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে ঠেলাঠেলি প্রত্যক্ষ করতে দেশবাসীর রাজি নয়। বরং দেশবাসী খাদ্য, বস্ত্র চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদাগুলোর সমাধানে সরকারের আন্তরিক তৎপরতা কামনা করে। জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে কালাতিপাত করার এই মর্মান্তিক মুহূর্তে অস্বাভাবিক মশার উপদ্রব কোনক্রমেই সহ্য করতে কেউ রাজি নয়। দায়িত্ব নিয়ে ঠেলাঠেলি দেখার সময়ও এখন আর নেই। কথা বলে ঠেলাঠেলির ঘর আল্লায় রক্ষা কর। এমনটি যেন না হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!