You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৩শে ফেব্রুয়ারী, শনিবার, ১১ই ফাল্গুন, ১৩৮০

এবার অন্ততঃ সাড়া দিতে হবে

বাংলার দুঃখী মানুষের কল্যাণে ঐক্যবদ্ধভাবে আত্মনিয়োগের শপথেই হবে মহান একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের সর্বোত্তম পন্থা। বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারীতে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলা মায়ের সন্তান সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও আরো অনেকে আত্মত্যাগের যে আদর্শ রেখে গেছেন সমগ্র জাতি তা সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করে। বায়ান্নর একুশের রক্তক্ষয়ী পথ বেয়েই বাঙালীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং স্বাধিকার চেতনা ধীরে ধীরে দুর্বার গতি লাভ করে একাত্তুরের ১৬ই ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলার মানুষ আজ আর এক সংগ্রামে নিয়োজিত- সে সংগ্রাম অর্থনৈতিক মুক্তির, শোষণমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রাম। দেশ গড়ার এই সংগ্রাম তথা বাংলার দুঃখী মানুষের কল্যাণে ঐক্যবদ্ধভাবে আত্মনিয়োগের শপথেই হবে মহান একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদদের সম্মান প্রদর্শনের সর্বোত্তম পন্থা। গত বৃহস্পতিবার মহান শহীদ দিবস তথা জাতীয় শোক দিবস পালনের প্রাক্কালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বাণীতে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন।
বস্তুতঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই দাবীর মাধ্যমে সত্যিকারভাবে রোপিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ। আর সে বীজ উক্ত হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি মায়ের ভাষা, মুখের ভাষা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মহান বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের বুক নিংড়ানো রক্ত ধারার মাধ্যমে। বায়ান্নর শহীদদের রক্তনদীতে অবগাহন করে বাংলা ভাষা তার স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হোল- মায়ের ভাষা, ভায়ের ভাষা স্বীকৃতি পেল রাষ্ট্রভাষার। কিন্তু রক্তদান তো থেমে রইলো না- থেমে রইলো না বাঙালির রক্তাক্ত ইতিহাসের গতি। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারীতে বাংলার বুকে রক্তের স্রোতধারা বয়ে আনার যে শুভ উদ্বোধন হয়েছিল সে ধারা আরো স্রোতস্বিনী হল বছর বছর- চুয়ান্নতে, বাষট্টিতে, ছেষট্টিতে, ঊনসত্তুরে এবং সেই মহা সাগরের অতলান্ত থেকে শেষটায় বেরিয়ে এল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। রক্তস্রোতে যত বেশি বেগবান হল স্বাধীনতা সূর্যের উদয় পথ যেন ততখানি সহজ ও সাবলীল হয়ে উঠলো। তাই একুশ আমাদের কেবল শোকের প্রতীকই নয় একুশ আমাদের স্বাধীনতা সত্তার নবজাগরণ।
বায়ান্নর একুশ গেছে, চুয়ান্নর দিনটাও পেরোলো, বাষট্টির সতের গেছে, গেছে ছেষট্টির ৭ই জুন, ঊনসত্তুরের বিশ ও চব্বিশে জানুয়ারী ও পেরিয়ে গেছে- গেছে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর- এসেছে স্বাধীনতা তথা রাজনৈতিক মুক্তি- কিন্তু সার্বিক মুক্তি তো আসেনি- আসেনি আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তি। রবি ঠাকুরের সোনার বাংলা, কাজী নজরুলের বিদ্রোহী বাংলা এবং মুজিবের শান্ত-সৌম্য বাংলা বারবার বিদেশিদের নখরাঘাতে যে শ্মশান বাংলায় পরিণত হয়েছিল সে শ্মশান সে ভাগাড়ের হাত থেকে বাংলার দুঃখী মানুষ তো এখনো মুক্তি পায়নি- পাচ্ছে না এবং যদি বলি সে মুক্তি পাবার দিনগুলো ক্রমাগত অবরুদ্ধ হয়ে আসছে বলে অনুমিত হচ্ছে- দিনকে দিন দেশের মানুষ শঙ্কিত হয়ে উঠছেন- তবে কি খুব একটা অত্যুক্তি করা হবে?
বঙ্গবন্ধু তাঁর বাণীতে দেশের দুঃখী মানুষের কল্যাণে ঐক্যবদ্ধভাবে আত্মনিয়োগের শপথ নেবার আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু এ আহ্বান জাতির প্রতি জাতির জনকের আহ্বান। এমন আহ্বান তো তিনি অতীতেও আরো বহু বার জানিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে বহুবার এ আহ্বান তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল। কিন্তু কেন জানি তার এ আহ্বানগুলোর সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছেনা জাতীয় জীবনে। সুরের মাঝে কারা যেন কোথাও বেসুরের সন্ধানরত। তাই জাতির পিতাকে আক্ষেপ করে বলতে শোনা যায়, আমার মনে হয় আমার বাণী যেন নীরবে নিভৃতে কাঁদে। তাই তাকেও বলতে শোনা যায় দেশের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ঢুকে গেছে-দুঃখী মানুষের কল্যাণকামী সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে পারছেনা। তাই জাতির পিতার এবং সেই আহবানের সঠিক মূল্যায়ন না হয়ে পরন্তু তার উল্টোটা ঘটে যে কত বড় জাতীয় লজ্জা এবং জাতির আত্মশক্তির অবমাননা, সে কথা কি বলার অপেক্ষা রাখে?
যাহোক এবার কারো শহীদ দিবসেও- এবারকার শোক দিবসেও জাতির পিতা জাতির কাছে আহ্বান জানিয়েছেন। অতীত দিনের ব্যর্থতার আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে এবার অবশ্যই জাতিকে-জাতির প্রতিটি নাগরিককেই ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত, সম্প্রদায়গত এবং শ্রেণীগতভাবে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ন্যায়নিষ্ঠ সৈনিকের মতো, কর্তব্যনিষ্ঠ দেশপ্রেমিকের মত নিঃস্বার্থ ভাবে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে জাতিকে তথা জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। না হলে বায়ান্ন থেকে একাত্তুর এবং একাত্তুর পরবর্তী কালে যে শহীদরা দেশ-জাতি ও রাষ্ট্রের জন্য আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের প্রতিতো অমর্যাদা দেখানো হবেই, পরন্তু জাতি হিসেবে আমাদের টিকে থাকার দুস্তর বাধার সম্মুখীন হতে বাধ্য বলেই আমরা মনে করি।

প্রকৃত সংকট বস্তুত না-আমাদের মানসিকতায়

সংকট-চারিদিকে শুধু ভেজাল, সমস্যা আর সংকট। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, সমস্ত বাংলাদেশই আজ সমস্যা ও সংকটের এক বিশাল কূলহীন মহাসাগর। আর সেই মহা সাগরের উত্তাল তরঙ্গাঘাতে গড্ডালিকার মতো অনির্দিষ্ট ভেসে চলেছি মরণোন্মুখ আমরা দেশের কয়েক কোটি উদ্ভ্রান্ত মানুষ।
এ কথা অস্বীকার করবে কে যে, দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে দেশের মানুষের মতো দেশের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটও একেবারে ডাল ভাত বা ‘ফ্রিষ্টাইল’ হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ, আমাদের সাধারণ মানুষের মতো আমাদের বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটও ভেবে ফেলেছে যে, স্বাধীনতা মানে উচ্ছৃঙ্খলতা, নিয়ম লঙ্ঘনের উন্মাদ প্রতিযোগিতা। অন্ততঃ, চারদিকের অবস্থা দেখে একথা মনে না করে উপায় নেই।
কারণ, আগে আমাদের সামনে যে কোন সমস্যা বা সংকট আসতো নিতান্তই আচম্বিতে বা কালে কস্মিনে। কিন্তু এখন সমস্যা ও সংকট আসছে পূর্ব ঘোষণা দিয়ে প্রতিনিয়ত এবং ম্যারাথন রেসের দ্রুততা নিয়ে। এখন সমস্যা ও সংকটেই মূখ্য আর সব গৌণ। জীবনের যে-কোন দিকের কথাই ভাবা যাক না কেন, বর্তমানে আমাদের ভাবনার চিত্রপটে বস্তুর চেয়ে বস্তুর সমস্যা ও সংকটেই প্রধানভাবে প্রতিভাত। সমস্যা ও সংকট ছাড়া এক দণ্ড পল কল্পনা করাও যেন গুনাহে কবিরা।
আগে যে কোনো সমস্যা বা সংকট এলে তা’ খুব সহজেই সমাধান করা সম্ভব হতো। কারণ, কর্তৃপক্ষের দূরদৃষ্টি ও সজাগ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের আগ্রহ অত্যন্ত তৎপর ছিল। এমনকি জনসাধারণের উপর কতৃপক্ষের প্রভাবও দারুন বিস্তৃত ছিল। আমলার ঘাপলার এ দৌরাত্ম্য ছিল না। ফলে জনসাধারণও সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের পাশে সহযোগিতা দিত। কিন্তু আজ সবাই নিথর, নিস্তব্ধ, নীরব দর্শক। কিছু কিছু বেতমিজ পত্র-পত্রিকা নাভিশ্বাস মানুষের বুক ফাটা কান্নার ধ্বনি তুলে ধরে মাঝে মাঝে একটা দু’টো হই-চই বাধায় ঠিকই, তবে, তাতে খুব একটা ফল হয় বলে মনে হয় না। কারণ, কর্তৃপক্ষের কানে তুলো, চোখে সর্ষেফুল। তাই আজ সবাই একসঙ্গে হতাশঃ সমস্যার সমাধান নেই, সংকট অপ্রতিরোধ্য।
ডিজেল সংকট, তা যানবাহনসহ রিফাইনারি বন্ধ। পাওয়ার পাম্পে সংকট, তাই চাষাবাদ ব্যাহত। আইন ও আইন প্রয়োগের সংকট, তাই জননিরাপত্তা বিধ্বস্ত। সংকটের দরূণ ৬৫ টাকার সোনা আজ ৯৬৫ টাকা। ডাকঘরে সংকট তাই চিঠি বিলিতে অব্যবস্থা। বয়লারে সংকট ঘোড়াশালের সার কারখানা বন্ধ। কাঁচামালের সংকট, তাই দেশের বহু মিল কারখানা বন্ধ। বিদ্যুৎ সংকট, খুচরো যন্ত্রাংশের সংকট, শিক্ষা সংকট -সংকট কোথায় না?
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজারের সংকট তো অনেক আগেই মানুষকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। চাল কোথাও কোথাও দেড়শ’ টাকা মণ। অথচ, এই সেই বাংলাদেশ যেখানে মানুষ ঢাকায় ৮ মণ চাল খেয়েছে। আর এই দরে চাল বিক্রি করেও ব্যবসায়ীরা বিপুল মুনাফা করেছে, সুরম্য প্রাসাদ তুলেছে।
কিন্তু আজকের ব্যবসায়ীর নাকি দেড়শ টাকা মণ বিক্রি করেও মন ভরছে না, পুঁজি ফেরৎ হচ্ছে না। একেই বলে লম্বা জিব্বা। নুনের মন পঞ্চাশ টাকা। আরো কত কি।
হালে এক নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। তা হচ্ছে দেশলাইয়ের সংকট। দেশলাই শিল্পে আমাদের দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ’ হয়েও বেশি। ইচ্ছে করলে আমাদের উৎপাদন প্রায় শতকরা ৫৫ ভাগ আমরা বিদেশে রপ্তানী করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। অথচ আমাদের দেশের মোট ১৯টা কারখানার মধ্যে প্রায় ১৫টাই নাকি বন্ধ হয়ে রয়েছে। যা-ও দু’চারটে চলছে তাও নাকি পটাশিয়াম ক্লোরাইডের অভাবে দু-এক দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাবে। পাঁচ পয়সার ম্যাচ এখন খোলাবাজারে ৪০ পয়সা বিক্রি হচ্ছে। অথচ পটাশিয়াম নাকি কালোবাজারে অভাব নেই।
আসলে, এসমস্ত সংকটের উৎসব বা মূল বিশ্লেষণ করলে শুধুমাত্র একটি প্রধান সংকটেই খুঁজে পাওয়া যায়। তা’ হচ্ছে, মানুষের মনের ভেজাল বা সংকট। আর এই সংকট থেকেই শুরু হয়েছে দেশের অপরাপর সমস্ত সংকট। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের দেশে কোন কিছুরই অভাব নেই, অভাব শুধু শিক্ষার, দেশপ্রেমের, সহনশীলতার, দূরদর্শিতা ও আন্তরিকতার। আমরা যে ডালে বসি, সেই ডালেই কোপ মারি, যে থালে খাই, সে থালেই ময়লা ফেলি। আমরা স্কুলে গেছি কালিদাসের প্রথম জীবনের নির্বুদ্ধিতা, ইতিহাসের আদ্যোপান্ত শিক্ষা।
তাই বলছিলাম এখনো সময় আছে শুধরাবার-এর পর আর থাকবেনা। আমাদের সত্যিকারের জাতীয় সুখ সমৃদ্ধি আনতে প্রথমে গলদ না ধরে গলদের উৎসকে বাগে আনতে হবে। কারণ, আমাদের সংকট বস্তুতে নয়, আমাদেরই মানসিকতায়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!