বাংলার বাণী
২৬শে জানুয়ারী, ১৯৭৩, শুক্রবার, ১২ই মাঘ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ
সে সংগ্রামেও আছি সাথে, পাশে
অবশেষে শান্তির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সেই রক্তাপ্লুত ভূমিখন্ডে। যুদ্ধাবসান এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্বাক্ষরিত হয়েছে এক সম্ভাবনাময় দলিল। প্রেসিডেন্ট নিক্সন বলেছেন আগামী শনিবার শান্তি আলোচনায় অংশ গ্রহণকারী চারটি পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর দান করবেন। এতদুদ্দেশ্যে উত্তর ভিয়েতনামের পররাষ্ট্রমন্ত্রী নগুয়েন ডাইট্রিন প্যারিস রওয়ানা হয়ে গেছেন, যাত্রার আয়োজন করছেন উইলিয়াম রজার্স। চুক্তির কথা ঘোষিত হবার দু’ঘন্টা পরে দক্ষিণ ভিয়েতনাম জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট তাদের বেতারে অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের পররাষ্ট্র দফতরের নামে সে খবর পরিবেশন করেন।
চুক্তির পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ না পেলেও প্রেসিডেন্ট নিক্সনের টেলিভিশন ভাষণ থেকে যতটুকু জানা যায় আনুষ্ঠানিকভাবে চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার ষাট দিনের মধ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহার, ইন্দোচীনে আটক সকল মার্কিনী যুদ্ধবন্দীর মুক্তিদান, দক্ষিণ ভিয়েতনামে উত্তর ভিয়েতনামী সৈন্যের অবস্থান এবং আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধবিরতি তদারকির ব্যবস্থা—এই হ’লো মহাদলিলের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রেসিডেন্ট স্বয়ং এই চুক্তিকে সম্মানজনক নিষ্পত্তি, উত্তর ভিয়েতনাম এটিকে ভিয়েতনামী জনগণের মহান বিজয়, প্রেসিডেন্ট থিউ এটাকে শুধু একটা প্রথম পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। দক্ষিণ ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তিফ্রন্টের মতে চুক্তিটির মর্যাদা দেওয়া হলে এবং সকল পক্ষ যথাযথভাবে তা পালন করলে ভিয়েতনামে শান্তি আসবে এবং ইন্দোচীন ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় তা শান্তি প্রতিষ্ঠার সহায়ক হবে।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং তা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষের অভিনন্দন কুড়িয়েছে। এ থেকে অন্ততঃ একটা কথা প্রমাণ হয়েছে যে, বিশ্বের মানুষ কোন অবস্থায়ই ভিয়েতনাম যুদ্ধ চায়নি। এ যুদ্ধ চায়নি ভিয়েতনামের মানুষও। কিন্তু যুদ্ধ চলছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। জীবনটাকে বাজী রেখে সংগ্রাম চালিয়েছে ভিয়েতনামের গণমানুষ। একের পর এক সংসার বিনষ্ট হয়েছে, শস্যের গোলা, শিশুর হাসি, বৃদ্ধের অসহায়ত্ব সব কিছুকে ব্যঙ্গ করে ঝাঁকে ঝাঁকে বোমা ফেলা হয়েছে ভিয়েতনামের জনপদে। আজ সেই বিধ্বস্ত ভিয়েতনামে যদি প্রার্থীত শান্তির সম্ভাবনায় আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়, পরিজন হারানো বেদনায় যদি সান্ত্বনার এতটুকু প্রলেপ মেলে তবে তা-ই বা কম কিসে।
কিন্তু না, যে সর্বগ্রাসী মানসিকতা একদিন বাওদাই সরকারের ঘাড়ে পা রেখে পেন্টাগনের উপর ভর করেছিলো, যে মানসিকতা একদিন ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শক্তির হাত গলিয়ে হোয়াইট হাউসের কানা গলিপথে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলো তার অবসান এত শীঘ্রই ঘটবার নয়। সেই সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক মানসিকতার ঔরসজাত থিউ এই চুক্তি সম্বন্ধে বলতে গিয়েই বলেছেন আমাদের সন্দেহ করার এবং বিশ্বাস না করার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে। একমাত্র সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি আমাদের শান্তির একমাত্র গ্যারান্টি।
মারের মুখে মুখ লুকিয়েছে যে পাশবিক শক্তি, সুযোগ পেলে তা যে আবার আঘাত হানবেনা এমন নিশ্চয়তা বোধকরি কেউ দিতে পারবেন না। ভিয়েতনামে যে মুখ আজ হাসিতে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কোন জঙ্গী বিমান যে আবার তা আঁধারে ভরিয়ে দেবেনা, যে জমিতে আজ নতুন শস্যবীজ ছড়ানো শুরু হয়েছে বিষাক্ত জীবাণু যে আবার বিনষ্ট করবে না, আজ যে ভিয়েতনামীর ঘরে নবজাত সন্তানটির ক্রন্দনধ্বনি দ্রুত হচ্ছে তা যে আবার স্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলবেনা তা-ই বা কি করে বলা চলে। প্রেসিডেন্ট থিউ রয়েছেন, রয়েছেন তার পাশে জাঁদরেল জেনারেলের দল। মাটি আর মানুষ সেখান থেকে অনেক দূরে। সামরিক শক্তিকে যারা শান্তির গ্যারান্টিরূপে ভাবেন, অন্ত্রের ঝঙ্কারে যাদের উন্মাদনা বেড়ে চলে, জাতীয় মর্যাদাকে দূরে ঠেলে যারা বিদেশী প্রভুদের পদলেহনে অশেষ সুখ অনুভব করেন, তাদের দিয়ে আর যাই হোক শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনা।
শান্তি আমাদের প্রত্যাশিত অনুভব। সে শান্তি স্থানীয় শান্তি, সে শান্তি মর্যাদা নিয়ে প্রতিষ্ঠার শান্তি। বিশ্বশক্তির প্রভাব বলয়ে নিজেদের খন্ডিত করে যে শান্তি তা পরাধীনতা, তা গ্লানির। তাই উত্তর ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী মিঃ ফাম ভ্যান ডং বলেছেন, এই চুক্তি এবং আরো যে সব দলিল স্বাক্ষরিত হবে তার উপর ভিত্তি করে ভিয়েতনামী জনগণের বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। শান্তি, মৈত্রী এবং গণতন্ত্রের পতাকাকে আমরা সমুন্নত রাখবো।
প্রায় পাঁচ বছর অবিরাম আলোচনার পর মূল শান্তির লক্ষ্যকে সামনে রেখে ওয়াশিংটন এবং হ্যানয়ের মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ইচ্ছেকেই কন্ঠে ধারণ করে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ আন্তরিকভাবে আশা করে যে এই চুক্তি ভিয়েতনাম ও সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করবে। আমাদের এবং বিশ্বের কোটি কোটি শান্তিকামী মানুষের সেই আশা পরিপূর্ণ হোক। ভিয়েতনামীদের জীবনে নেমে আসুক শান্তির বারিধারা। সকল বিদেশী প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বাধীন মুক্তভাবে তারা ভবিষ্যত অগ্রযাত্রায় অংশ গ্রহণ করুক। সকল নীতি নির্ধারণে ভিয়েতনামের সর্বস্তরের মানুষের রায়ই হোক শেষ কথা। জাতীয়তাবাদের অগ্রবর্তী শিখা তাদের পথ দেখাক, গণতন্ত্রের মানবিক অধিকারে বলীয়ান হয়ে তারা সমাজতন্ত্রের মূল লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে জয়ী হোক। তাদের চিন্তা, চেতনা ও সংগ্রামের সাথে একাত্ম বাংলার মানুষ আজকের এই বিশেষ মূহূর্তে তাই কামনা করে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক