You dont have javascript enabled! Please enable it!

বদরুদ্দীন উমর : ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক স্থপতি | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩
আফজালুল বাসার

বদরুদ্দীন উমর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং অধিকাঠামোমূলক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বহু সমস্যার ওপর রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন। বহু ক্ষেত্রে তাঁর কৃত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও মতামতের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বাঙালী মননের জগতে বদরুদ্দীন উমরের স্থান বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং স্বীকৃত। অবশ্য রাজনৈতিক সাহিত্য রচনা ছাড়াও তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অন্যান্য উজ্জ্বল অংশ রয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মধারা অব্যাহত রাখা তার মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এখনো পর্যন্ত বদরুদ্দীন উমরের সর্বজন স্বীকৃত কৃতি হচ্ছে তিনটি বিশাল খন্ডে পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি শীর্ষক গ্রন্থ। তিনি আমাদের ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক স্থপতি। ভাষা আন্দোলনের ওপর তার এই গ্রন্থ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে সাহিত্যিক শংকর লিখেছিলেন—বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের কাশীরাম দাশ। ভাষা আন্দোলনের ওপর তাঁর রচনাসমূহ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সামগ্রিক কর্মকান্ডের সঙ্গে অবিমিশ্রভাবে মানুষের সার্বিক শোষণ মুক্তির সংগ্রামে নিরন্তর অংশগ্রহণ করে চলেছে। আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্পাদিত মাসিক লোকায়ত পত্রিকার নবেম্বর ’৮২ সংখ্যার (পৃষ্ঠা-৫৬) বরাত দিয়ে বলা যায়—‘বিগত কয়েক দশক ধরে আমাদের দেশে সৃষ্টিশীল চিন্তার ও সৃষ্টিশীল কর্মের যে একটি ধারা ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে, সকলের অজান্তে আত্মপ্রকাশ করছে, ভবিষ্যতে-রচিত-ইতিহাসে বদরুদ্দীন উমর সম্ভবতঃ সেই ধারার পথিকৃতের এবং প্রথম পর্বের প্রধান পুরুষের মর্যাদায় ভূষিত হবেন।’ তাঁর অবদানের ক্ষেত্র বিশিষ্ট ও বিশাল হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে নিয়ে আলোচনা খুবই কম হয়েছে।

পরিবার পরিজন
বিহারের বিখ্যাত অলি (a great divine) মুখদুম শাহ বদরুদ্দীন বদর এর উত্তরসূরী বদরুদ্দীন উমরের পরিবারবর্গ। বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিমের নানা ভুপালের প্রধানমন্ত্রী নবাব আবদুল জব্বার খান বাহাদুর সিআইই এবং দাদা মৌলভী আবদুল মজিদ ছিলেন আপন দুই ভাই।

বদরুদ্দীন উমরের ছবি :

এই পরিবারের অনেকেই ছিলেন বড় সরকারী চাকুরে। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সমাজ এবং ধর্মের জন্যে চিন্তা ভাবনা করতেন। অনেকেই ছিলেন ধর্মভীরু এবং উদার। এই পরিবারের দশ বারো হাজার টাকা মূল্যে একটি জমিদারী ছিল। যদিও আবুল হাশিম তাঁর পিতা আবুল কাসেমের কাছ থেকে এবং বদরুদ্দীন উমর তাঁর পিতা আবুল হাশিমের কাছ থেকে খান কয়েক পুরনো চেয়ার ছাড়া বলতে গেলে কোন সম্পত্তি পাননি। তবে তিনি যে রাজনৈতিক-সামাজিক সম্মাননার উত্তরাধিকার পেয়েছেন তা এদেশে বিরল। বদরুদ্দীন উমরের দাদা মৌলভী আবুল কাসেম তাঁর সময়ের মুসলিম রাজনীতির ‘চানক্য’ হিসেবে অভিহিত। বাউন্ডুলে, স্ত্রী ও পরিবারের প্রতি অমনোযোগী আবুল কাসেম তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত দেশের রাজনীতি বিশেষত মুসলিম রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যাণার্জী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যাণার্জীর মত তিনিও ১৯২১ সনে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ত্যাগ করেছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যাণার্জীর Bangalee কাগজ দিয়ে শুরু করে পরে অনেক পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা-প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি মোসলেম স্ট্যান্ডার্ড ও ‘মোসলেম বাণী’ সম্পাদনা করেছিলেন, বিশেষভাবে যুক্ত ছিলেন ‘প্রোগ্রেস’, ‘নবযুগ’ পত্রিকার সঙ্গে। এ ছাড়া দি মোসলমান, মুসলিম ক্লোরেনিক্যাল, মুসলিম আউটলুক প্রভৃতি পত্রিকার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। এ কে ফজলুল হক প্রেসিডেন্সী কলেজে পড়ার সময় তাঁর সহপাঠি ছিলেন আবুল কাসেম। তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বন্ধুত্বের। ১৯২০ সনে মার্চ মাসে খেলাফত ডেপুটেশনে লন্ডন এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশ ভ্রমণ করে আসার পর আবুল কাসেম রাজনীতির ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতারাই পরিচয় দিয়েছিলেন। আবুল কাসেম বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে সরাসরি কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের একজন সুপরিচিত সদস্য ছিলেন। বহুদিন রেলওয়ে বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। মন্টেগু চেমসফোর্ড সংস্কারের সময় থেকে তিনি কেন্দ্রীয় অথবা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৩৬ সনেরর অক্টোবর মাসে তিনি মারা যান।
মৌলভী আবুল কাসেমের মৃত্যুর পর আজীবন তাঁর দেশ সেবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্যে বর্ধমান বাসীগণ আব্দুল হাশিমকে ম্যাকডোনাল্ড এ্যাওয়ার্ডের আওতায় গঠিত প্রথম আইন সভার সদস্য নির্বাচন করেন। আবুল হাশিম ও তাঁর পিতার মতই সারা জীবন ধর্ম, ইসলামী রাজনীতি এবং দেশের মানুষের মঙ্গল চিন্তা করেছেন। তিনি ১৯৩৭ সনে মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ১৯৪১ সনে বাঙলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য হন। এবং ১৯৪৩ সনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৪-এর দিকে মুসলিম লীগকে পাঁচ লক্ষাধিক সদস্যের এতদাঞ্চলের সর্ববৃহৎ একটি রাজনৈতিক সংগঠনে রূপ দিতে সমর্থন হন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্ভবতঃ এই যে, মুসলিম লীগে তিনি জমিদার শ্রেণীর নেতৃত্বের বদলে মধ্যবিত্তের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থন হন। দেশ বিভাগের কয়েক বছর পর ১৯৫০ সনে এপ্রিল মাসে পূর্ব বাঙলায় আসেন। ইতিমধ্যে তিনি শরৎচন্দ্র বোস প্রমুখের সঙ্গে স্বাধীন সংযুক্ত বাঙলার জন্যে যথাসাধ্য আন্দোলন করেছিলেন। ১৯৪৭ সনের আগস্ট থেকে ১৯৫০ সনের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবাংলা বিধান সভায় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে কাজ করেছেন।
১৯৫২ সালে তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সদস্য হন এবং ২০ ফেব্রুয়ারী বিকেলে অনুষ্ঠিত এই পরিষদের মিটিং-এ সভাপতিত্ব করেন। রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনে শরীক থাকার জন্যে মুসলিম লীগ সরকার ২৫ ফেব্রুয়ারী তাকে গ্রেফতার করে। ষোল মাস তিনি কারাগারে ছিলেন।
১৯৫৬ সালে আবুল হাশিম খেলাফতে রব্বানী পার্টির চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। উদার মনোভাব থাকার ফলে তিনি মুসলিম লীগের কিছু কিছু প্রোগ্রাম সমর্থন করতেন না। তা সত্ত্বেও ১৯৫৬ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৬০ সনে আইয়ুব খান তাকে ইসলামিক একাডেমীর পরিচালক নিযুক্ত করেন। ১৯৬২ সনে তিনি ইসলামিক ইডিওলজি কাউন্সিল অব পাকিস্তানের সদস্য নিযুক্ত হন। ঐ বৎসরই তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রধান সংগঠক হন। তাঁর রচিত অনেকগুলি বই রয়েছে The Creed of Islam; In Retrospection; As I see it; Integration of Pakistan ইত্যাদি।
তিনি একটি অনুবাদ বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে কোরান শরীফের বাঙলা অনুবাদও সম্পন্ন করেন। তাঁর লেখা সুরা ফাতিহার একটি তফসির আরবীতে অনুদিত ফাতিহার একটি তফসির আরবীতে অনুদিত হয়েছিল।

পিতা ও পুত্র
১৯৬৬ সালে বদরুদ্দীন উমর ‘সাম্প্রদায়িকতা’ প্রকাশ করলে কতকটা এই বই-এর জবাবে কতকটা এই বই-এর বিরোধিতা করে আবুল হাশিম Integration of Pakistan রচনা করেন। পিতা এবং পুত্রের এই দ্বন্দ্ব আসলে আমাদের দেশের একটি সুপরিচিত সামাজিক দ্বন্দ্ব। বদরুদ্দীন উমর তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন ধর্মনিরপেক্ষতার পথ। তার বস্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সকল ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রদায়িকতার তাৎক্ষণিক ও সুদূরপ্রসারী ভয়াবহ সব প্রতিক্রিয়াশীল প্রভাবের বিরুদ্ধে উচ্চকিত হয়েছে। আবুল হাশিম গোঁড়া ছিলেন না। তিনি এমনকি অনেক ইসলামিক আইনের বা প্রথার যুক্তিভিত্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আবুল হাশিম তাঁর Integration of Pakistan বইটিতে দেখিয়েছেন পাকিস্তান অখন্ডভাবে থাকতে পারবে। অখন্ডতা বজায় রাখা এবং পাকিস্তানের অন্যান্য জাতীয় সমস্যা সমাধান সম্ভব হবে কেবল প্রকৃত ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েম করতে পারলেই। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসকে একভাবে নিলেও আবুল হাশিম সৎ মানুষ ছিলেন এবং তাঁর সততা ও ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা গেছে, তিনি মাদ্রাসা শিক্ষা সমর্থন করেননি, পৃথক নির্বাচন সমর্থন করেননি। রবীন্দ্রনাথ এবং বাঙলা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আইয়ুব সরকারের পদক্ষেপকে তিনি তীব্র বিরোধিতা করেছেন। এর বিরুদ্ধে মিটিং ও অন্যান্য কার্যকলাপে অংশ নিয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের একজন বলিষ্ঠ অনুরাগী ছিলেন, রবীন্দ্র সঙ্গীত পছন্দ করতেন, গাইনও গাইতেন। পিতা এবং পুত্রের পরস্পর বিরোধী জীবন দর্শন হলেও তাঁদের মধ্যকার বোঝাপড়া ছিল চমৎকার। যে জন্যে দু’জন আলাদাভাবে সমাজ সমস্যা সমাধানের কথা ভেবেছেন। দেখা গেছে ’৭১-এর পূর্বে বদরুদ্দীন উমরের মনোভাবের সাথে আবুল হাশিমের যে মতপার্থক্য ছিল ’৭১-এর যুদ্ধের সময়ে এবং যুদ্ধের পরে তা কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়েছে। একাত্তরের সামরিক আগ্রাসনকে সমর্থন করেননি আবুল হাশিম। তিনি এই আগ্রাসনকে বর্বর, অনৈসলামিক বলে অভিহিত করেছেন এবং এই সময় ইয়াহিয়া সরকারকে কোন রকম সাহায্য সহযোগিতা করেননি। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধকেও তিনি কোন সহযোগিতা করেননি। ধর্মপ্রাণ আবুল হাশিমের রাজনৈতিক গুরুত্ব পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু তার ধর্মপ্রাণতার কোন অন্যথা হয়নি। তিনি ১৯৭৪ সনের ৫ই অক্টোবর ঢাকাতে ইন্তেকাল করেন।
১৯৩৯ সনে ২০শে ডিসেম্বর রবিবার বিকেল ২টার সময়ে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান টাউনে বদরুদ্দীন উমর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবারে ধর্মানুরক্ত, সামন্ত ভাবধারা আচার আচরণের পাশে মুক্ত, উদার একটি পরিবেশও ছিল। কিন্তু বর্ধমানের বাড়িতে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এর রাজনৈতিক কাজকর্ম। পিতা এবং পিতামহের সূত্র ধরে তাঁদের বাড়িতে এক হিন্দু মহাসভা ছাড়া কম্যুনিস্ট পার্টি, কংগ্রেস, মুসলিম লীগ নেতাদের হরহামেশা যাতায়াত ছিল। উমরের পিতা আবুল হাশিম এক সময়ে ধর্মের সাথে কম্যুনিজমের চর্চা করেছিলেন এবং কম্যুনিস্ট কার্যকলাপের প্রতি তাঁর সহানুভূতিশীল মনোভাব ছিল উমরের চাচা এবং শ্বশুর আবদুল আহাদ ধার্মিক মানুষ ছিলেন কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি কম্যুনিস্ট পার্টির একজন দৃঢ় সমর্থকও ছিলেন। তিনি ১৯৪৮-৫০ সনে পার্টির অনেক গোপন কাজ করেছেন। চাচার বাড়িতে পার্টির মিটিং কিংবা হরেকেস্ট কেঙার প্রমুখের পরিচালিত ক্লাস সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমর হয়তো কখনো সখনো খোঁজ জেনে থাকবেন, কিন্তু সে-সবে তাঁর কোন অংশ ছিল না। এমনকি সারাজীবনে তিনি কোন ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের সাথেও সরাসরি যুক্ত থাকেননি। কোন রাজনৈতিক সংগঠনের তাঁর যোগদানের ঘটনাও অনেক পরের। ১৯৬৯ সনে, যখন তিনি তাঁর চিন্তা চেতনায় অনেকটা স্থিত হয়ে উঠেছেন কেবলমাত্র তখনই তিনি সরাসরি রাজনীতিতে আসেন, যোগ দেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টিতে। ধীরতা, স্থিরতা আর পরিতৃপ্তি নিয়ে তিনি বৃদ্ধি পেয়েছিলেন, ওক বৃক্ষের মত।

শৈশব ও কৈশোর
উদ্দীপনাময়, ঘটনাবহুল, শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি চর্চার চমৎকার একটি পারিবারিক পরিমন্ডলে উমরের শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে। এর মধ্যে থেকে অত্যন্ত সাধারণ এবং স্বচ্ছন্নগতিতে বিকশিত হয়েছেন তিনি। ছোটবেলায় নানা রকম ঘটনা ঘটিয়ে তিনি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি। তবে ছোটবেলা থেকে তার ভেতরে প্রশ্নবোধকতা ছিল। তার আব্বা-চাচারা গান গাইতেন। বাড়িতে এবং স্কুলে নাটকের চর্চা হত। স্কুলে উমর রবীন্দ্রনাথ, সেক্সপীয়র, বার্নাডশ’র নাটকে অভিনয় করেছেন। আবৃত্তিতে অংশ নিয়েছেন। কৈশোরিক পাঠতৃষ্ণা মিটিয়েছেন পারিবারিক গ্রন্থাগার এবং তার ফুফু আম্মার নামে প্রতিষ্ঠিত ‘হাবিবা ইয়াগারে’ পড়াশোনা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাপানী বোমার তোড় আর দাঙ্গার উত্তেজনাময় দিনগুলো উমরের স্মৃতিতে আটকে থাকে প্রবল সংবেদনে। জীবন সম্পর্কে নানা বিচিত্র বিপরীত অনুভূতি জাগে তাঁর বোধে। পৃথিবীর প্রতি সহানুভূতি পোষণ করতে থাকেন তিনি। এই সাথে তার ভেতরে জমতে থাকে ঘৃণার বরফ। ক্রমশঃ তার চেতনা মূল থেকে অন্ধ বিশ্বাসের রক্ষণশীল সংস্কারের সংকীর্ণতা অবসিত হতে থাকে। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে তার ভেতরে ধর্ম সম্পর্কে বাস্তবিক সব ধারণা দানা বাঁধতে থাকে। ইউরোপে কয়েক বছর অধ্যায়নকালীন সময়ে তার সমস্ত অস্বচ্ছতা কেটে যায়। পৃথিবীকে তিনি মুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে শেখেন। তার কাছে দর্শন হয়ে ওঠে মার্কসীয় দর্শন।

একাডেমিক লেখাপড়া
বদরুদ্দীন উমর বর্ধমানে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। বর্ধমান টাউন স্কুলে তিনি ক্লাস ফোরে ভর্তি হন। এবং ঐ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন ১৯৪৮ সনে। বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে ১৯৫০ সনে বিজ্ঞান শাখায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫০ সনে সপরিবারে পূর্ব বাংলায় চলে আসার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগে প্রথমবর্ষ সম্মান ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯৫৩ সনে সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৫ সনে দর্শনে এমএ পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বৃত্তি নিয়ে ১৯৫৯ সনে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। সেখানে দর্শন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং অর্থনীতি নিয়ে পিপিই কোর্স সম্পন্ন করেন ১৯৬১ সনে। ঐ বছরই তিনি দেশে ফিরে আসেন। ১৯৬৬ সনে পিএইচডি করার জন্যে কমনওয়েল্থ স্কলারশীপ পেয়েছিলেন কিন্তু পড়তে যাননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এখানকার রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তাঁকে তীব্রভাবে আলোড়িত করেছিল। লন্ডনে থাকার সময়ও সেখানকার সামাজিক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ তার পক্ষে জীবন সম্পর্কে যুক্তিবাদী মুক্ত, গভীর এবং সংগ্রামী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করেছিলে। লন্ডনে তিনি পড়াশোনা করেছিলেন বিশ্বের রাজনৈতিক সাহিত্যসমূহ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লন্ডনেই তার সাথে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির নেপাল নাগের সাথে অন্তরঙ্গ সাক্ষাৎ ঘটে।

চাকরি
বদরুদ্দীন উমরের চাকরি জীবন সংক্ষিপ্ত এবং ছড়ানো ছিটানো। ১৯৫৪ সনের অক্টোবর মাসে তিনি এমএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালীনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্ট-টাইম লেকচারার হিসেবে দর্শন বিভাগে যোগ দেন এবং পর বছর জানুয়ারী মাস পর্যন্ত ঐ চাকরি করেন। দর্শন বিভাগের তৎকালীন প্রধান গোলাম জিলানীর অধীনে দর্শন বিভাগে দশ মাস যাবত গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেন। এরপর ১৯৫৬ সনের নবেম্বর থেকে ১৯৫৭ সনের আগস্ট মাস পর্যন্ত চিটাগাং সরকারী কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৭ সনে নবেম্বর মাসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন এবং দর্শন বিভাগে অধ্যাপনারত অবস্থাতেই ১৯৬৩ সনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগেও অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন। ১৯৬৮ সনের ডিসেম্বর মাসে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেন। চাকরি ছেড়ে দেয়ার পেছনে দুটো কারণ ছিল—তিনি চেয়েছিলেন সচেতনতার কাজের ভেতরে গভীরতরভাবে আত্মনিয়োগ করতে। এবং সরকার তাকে উত্যক্ত করছিল।
উমরের প্রতি সরকারের কোপদৃষ্টি বিশেষ কারণ ছিল। ইতিমধ্যে তার কিছু রচনা প্রকাশ হয়েছিল। এর মধ্যে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থটি প্রকাশ পায় ১৯৬৬ সনে। তৎকালীন ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীল আবহাওয়ার ভেতরে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থটি প্রকাশের জন্যে প্রচন্ড সাহসের প্রয়োজন ছিল। পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বরূপ উদঘাটন করেছিলেন তিনি এই গ্রন্থে। আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িকতার বিশেষ উদ্ভব এবং বিকাশের ধারাকে পরে ‘সংস্কৃতির সংকট’ আর ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ নামক দুটি গ্রন্থে আরো বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থগুলি প্রতিক্রিয়াশীল সরকারকে এতবেশি আঘাত করেছিল যে আবদুল মান্নান সৈয়দ, সত্যেন সেনের দুটি বইসহ বদরুদ্দীন উমরের ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ কেন বাজেয়াপ্ত করা হবে না তার জন্যে সরকার নোটিশ করেছিলেন (আবদুল মান্নান সৈয়দের বাজেয়াপ্ত হয়েছিল) উমরের পক্ষ থেকে এই নোটিশের জবাব দিয়েছিলেন ডঃ কামাল হোসেন। পশ্চিমবঙ্গের অমৃত পত্রিকায় আবদুল মান্নান সৈয়দ, সত্যেন সেনের দুটি বই, ত্রৈলক্যনাথ চক্রবর্তীর একটি বই এবং বদরুদ্দীন উমরের উল্লেখিত তিনটি বই-এর ওপর ‘পাঁচটি বিপজ্জনক বই’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছিল। এই প্রবন্ধটি মিসিগান স্টেট ইউনিভার্সির এক কাগজ অনূদিত হয়েছিল। পরে লন্ডনের ‘জার্নাল অব কনটেম্পরারি এশিয়াতেও (১৯৭২, ভলুম-২, সংখ্যা-১) রচনাটি প্রকাশ হয়েছিল।
১৯৬৬ সনে সাম্প্রদায়িকতা প্রকাশ হওয়ার পর সরকার বদরুদ্দীন উমরের পেছনে লেগেছিল। এর একটি তথ্য উল্লেখ করা যায় বদরুদ্দীন উমরের কাছে লেখা আবুল হাশিমের চিঠি থেকে। উমর তার পিতার চিঠির একটি জবাও লিখেছিলেন। চিঠিটি থেকে উমরের রাজনৈতিক মতামতেরও পরিচয় মেলে। এখানে চিঠি দুটো উদ্বৃত্ত হলো।
১৩-৮-৬৭ তারিখে বদরুদ্দীন উমরের কাছে লেখা আবুল হাশিমের চিঠি :

আবুল হাশিমের কাছে কয়েকদিনের মধ্যে চিঠির জবাব দিয়েছিলেন বদরুদ্দীন উমর :

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
রাজশাহী
পূর্ব পাকিস্তান
প্রিয় আব্বা,
এইমাত্র আপনার ১৩ তারিখের পত্র পেলাম। আপনাকে যে তথ্য সরবরাহ করা হয়েছে সেটা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে কতখানি নির্বোধভাবে সমগ্র ব্যবস্থা পরিচালনা করা হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে সে ধরনের কোন সংগঠনের কথা আমি জানি না। সুতরাং তাতে নেতৃত্ব দেয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ভারতীয় সরকারকে আমি চরম প্রতিক্রিয়াশীল বলে মনে করি এবং তা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেলে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুশি হব। এ বিষয়ে আমার অন্য কোন মন্তব্য নেই এবং যারা অন্যদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট তৈরি করে নিশ্চিতভাবে তাদের মন এবং কার্যকলাপের উপর আমার কোনরকম নিয়ন্ত্রণ নেই।

বদরুদ্দীন উমরকে লেখা আবুল হাশিম-এর চিঠি :

সুরাইয়া এবং ছেলে-মেয়েরা ১৩ তারিখ সকালে নিরাপদে রাজশাহী এসে পৌঁছেছে। আমি যশোর বর্ডারে তাদের আনতে গিয়েছিলাম। সালাম রইল।
আপনার স্নেহভাজন
বদরুদ্দীন উমর

বিবাহ এবং সংসার
১৯৫৯ সনের ৭ জুন বদরুদ্দীন উমর তাঁর চাচা আবদুল আহাদের কন্যা সুরাইয়া হানমকে বিয়ে করেন। আত্মীয়তা এবং অন্যান্য সুবাদে বিয়ের আগে থেকে তাদের পরিচয় ছিল সুরাইয়া হানম অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস ফেডারেশনের বর্ধমান জেলা শাখার সক্রিয় সদস্যা ছিলেন। বর্তমানে সুরাইয়া হানম ব্যাংকে চাকরিরতা। সুরাইয়া হানমের চাকরির বেতন এবং বদরুদ্দীন উমরের বই-এর রয়ালটি দিয়ে তাদের সংসার চলে। তাদের তিন ছেলে-মেয়ে। বড় মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, একমাত্র ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ছোট মেয়ে ভিকারুন্নেছা কলেজে পড়াশুনা করে।

রাজনীতির সংগঠন
১৯৬৯ সনে বদরুদ্দীন উমর সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত হন। ঐ সময় তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ঊনসত্তরের একুশে ফেব্রুয়ারী ব্যাপক তাৎপর্যসমৃদ্ধভাবে উদযাপিত হয়েছিল এই বৎসর ‘একুশে ফেব্রুয়ারী উদযাপন কমিটির’ তিনি আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তাঁর পার্টির পক্ষ থেকে ১৯৭০ সনের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে ১৯৭১ সনের মার্চ মাস পর্যন্ত সাপ্তাহিক গণমুক্তির ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চারুমজুমদারের লাইন দ্বারা প্রভাবিত হলেও পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী লেনিনবাদী) কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিল। বদরুদ্দীন উমর এ ব্যাপারে আরো বাস্তব ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির অনুশীলন করতে থাকেন। ১৯৭১-এর এপ্রিল মাস থেকেই তিনি নতুনভাবে চিন্তাভাবনা শুরু করেন। যুদ্ধের সময় তিনি ফরিদপুর, যশোর, খুলনা ঘুরে ঢাকাতেই অবস্থান করেন। ভারতে না যাওয়া বা যাওয়াটা তাঁর কাছে কোন নীতিগত ব্যাপার ছিল না। ’৭১-এর ডিসেম্বর মাসে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭১ সনের ২৭ মার্চ তিনি মোহাম্মদ তোয়াহা এবং আরো দু’জন ছাত্রসহ রায়েরবাজার থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থক ইপিআর-এর হাতে ধরা পড়েন। পরে কয়েকজন ছাত্রের সহযোগিতায় ছাড়া পান। পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে থাকেনি। সরকারী নীতি ও রাজনৈতিক অবস্থার কারণে ১৯৭৪-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৯-এর জুলাই পর্যন্ত তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে বাধ্য হন। ১৯৭৬ সনে আগস্ট মাসে বাংলাদেশের কম্যুনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এই পার্টির ব্যাপারে জড়িত ছিলেন। ১৯৭৮ সনে বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সনে তিনি ঐ ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। ১৯৭২ সন থেকে তিনি লেখক শিবিরের সাথে জড়িত। বর্তমানে এই সংগঠনের সভাপতি। বর্তমানে তিনি ‘সংস্কৃতি’ও সম্পাদনা করছেন। ১৯৭৪ সন থেকে ‘সংস্কৃতি’ প্রকাশিত হলেও আটটি সংখ্যা প্রকাশ হওয়ার পরে দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। সাপ্তাহিক ‘নয়া পদধ্বনি’ পত্রিকার সাথেও তিনি যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠন সৃষ্টি এবং পত্রপত্রিকা পরিচালনার সাংগঠনিক ও তাত্ত্বিক দিকে তিনি প্রায়ই প্রধান ভূমিকা পালন করেছেন, কখনো সহযোগিতামূলক কাজ করেছেন।

লেখাজোখা
সমাজ, রাজনীতি এবং পার্টি—এই অবিচ্ছিন্ন তিনটি বিষয়ের প্রতি বদরুদ্দীন উমরের সার্বিক মনোযোগের অনিবার্য ফসল হচ্ছে তাঁর রচনা। উমরের রচনার সাথে তাঁর জীবন, তাঁর রাজনীতি এবং উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের সাধারণতঃ রাজনৈতিক সাহিত্য রচনার প্রতি সে অনীহা আছে বদরুদ্দীন উমর তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রম এবং শুধুই ব্যতিক্রমই নন অনন্যও বটেন। বর্তমানে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা আঠারো এবং প্রতিটি গ্রন্থই এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক-সামাজিক বিকাশ প্রত্যক্ষণের জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর রচনায় ‘সমাজ’ই মূল বিষয় এবং তিনি একটি নিশ্চিত নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই লেখেন। তাঁর রচনার উদ্দেশ্য : সমাজের সার্বিক শোষণমুক্তির উদ্দেশ্যে সমাজ পরিবর্তন-এর জন্যে আন্দোলন গড়ে তোলা, কাজ করা। সমাজ বিশ্লেষক হিসেবে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর পরিচয়টিই মুখ্য, আর সব এর আনুষঙ্গিক।
একুশে ফেব্রুয়ারী যে সব ব্যক্তিকে সংগ্রামী প্রতিবাদী আন্দোলনী হিসেবে গড়ে উঠতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে বদরুদ্দীন উমর তাঁদের মধ্যে একজন। তাঁর রচনাগুলোর ভেতরেও একুশে ফেব্রুয়ারী বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। এমনকি তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য রচনাও একুশে ফেব্রুয়ারী সম্পর্কে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ উমরের পিতা আবুল হাশিমকে ভাষা-আন্দোলনের উপর একটি রচনা লিখতে অনুরোধ করেন। আবুল হাশিম বদরুদ্দীন উমরকে এই রচনাটি তৈরি করতে বলেন। এর শিরোনাম ছিল ‘আমাদের ভাষার লড়াই’। পুস্তিকাটি দশ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল। এখন আর পুস্তিকাটি কোথাও পাওয়া যায় বলে আমাদের জানা নেই। প্রথমে বয়সে বদরুদ্দীন উমর খুব বেশি লেখাজোখা করেননি। ১৯৫১ সনের দিকে তিনি তমদ্দুন মজলিসের সদস্য ছিলেন এবং মজলিসের পত্রিকা ‘সৈনিকে’ লিখতেন। দু’একটা পত্রপত্রিকায় লেখা ছাড়া এই সময় এবং পরবর্তী আট নয় বৎসর ১৯৬২ সন পর্যন্ত তিনি প্রায় কিছুই লেখেননি। কিন্তু ১৯৬৩ সন থেকে তিনি অনবরত লিখে চলেছেন। এরপর থেকে প্রতিবছর গড়ে একটি করে বই লিখতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। পার্টির কাজ এবং সংসার (সংসারটি গোছালো এবং নির্ভর মনে হয়। সুরাইয়া হানমের ভূমিকা উমরকে সহযোগিতা করছে যারপর নাই) বাঁচিয়েও তিনি যে অকৃত্রিম নিষ্ঠা ও অধ্যাবসায়ের সাথে এবং প্রচন্ড পরিশ্রমের বোঝা বয়ে গবেষণামূলক-মৌলিক রচনা লেখেন তা অনুধাবন করলে বিস্মিত হতে হয়। কেবলমাত্র একজন সম্পূর্ণভাবে সচেতনউদ্দেশ্যপ্রবণ নিবেদিত চেতনাবান ব্যক্তির পক্ষের এই কাজ করে যাওয়া সম্ভব।

আবুল হাশিমের চিঠির জবাবে বদরুদ্দীন উমর :

ভাষা-আন্দোলনের সাহিত্যিক দলিল
‘পূর্ব বাংলার ভাষা-আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ প্রথম খন্ড, দ্বিতীয় খন্ড এবং তৃতীয় খন্ড (তৃতীয় খন্ড যন্ত্রসহ, দু’এক মাসের মধ্যে প্রকাশ পাবে) বদরুদ্দীন উমরের রচনাবলীর মধ্যে এখনো পর্যন্ত সর্বশ্রেষ্ঠ। এই গ্রন্থ তিনটির গুরুত্ব, ব্যাপকতা এবং প্রভাব বাংলাদেশের সার্বিক সামাজিক জীবনে অপরিসীম। নিরুঙ্কুশভাবে না হলেও ১৯৬৩ থেকে ১৯৮২ সন পর্যন্ত কুঁড়ি বছর ধরে প্রায় দেড় হাজার পৃষ্ঠার এই গ্রন্থ তিনটি রচনা করতে তিন সহস্রাধিক তথ্য উৎস্য ব্যবহার করতে হয়েছে প্রায় দুইশত ব্যক্তির সাক্ষাৎকার, সাহায্য নিতে হয়েছে। ১৯৬৩ সনে বদরুদ্দীন উমর পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ ইতিহাস রচনার জন্যে তথ্যাদি সংগ্রহ শুরু করেন। পরে ঐ পরিকল্পনা ত্যাগ করে তিনি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করতে মনস্থ করেন। তার গ্রন্থত্রয় সম্মিলিতভাবে প্রায় দুই শতাব্দীর আংশিক পটভূমিতে একটি বিরাট জন অঞ্চলের সামাজিক জীবনের গভীরতম প্রত্যয়যুক্ত দলিল, পূর্ব বাংলার উজ্জ্বল জীবন-নাট্য। প্রথম খন্ড লেখা হয়েছে ’৬৯-৭০-এ। দ্বিতীয় খন্ড ’৭৫-৭৬-এ এবং তৃতীয় খন্ড ৭৬-এ কিছু লেখা, বাকিটুকু ৮২ সনে। লিখতে যে সময়ের প্রয়োজন হয়েছে লেখার আয়োজন করতে সময় লেগেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। নানান অসুবিধেয় মোকাবিলা করতে হয়েছে এবং এইসব অসুবিধে মোকাবিলা করতে গিয়ে বাগ-বিতন্ডা হয়েছে প্রচুর।
ভাষা-আন্দোলনে উমরের নিজের সরাসরি কোন কার্যকরী ভূমিকা ছিল না। কিন্তু উত্তাল রক্তঝরা সেই সময়গুলোতে তিনি একজন ভাল দর্শক হিসেবে প্রায় প্রতিটি ঘটনার আশেপাশে ছিলেন। মিছিলে তিনি অংশ নিয়েছেন। এলাকাতে অবস্থান করেছেন সকল সময়। পরবর্তী সময়ে এই সব ঘটনার বিবরণ লিখতে যেতে প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও তাকে নানা রকম অসুবিধের সামনাসামনি হতে হয়েছে। এর মধ্যে স্মৃতিচারণের সমস্যা এবং তথ্য উৎসের সমস্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি। গ্রন্থ তিনটি রচনা করার জন্যে লিখিত তথ্য এবং সাক্ষাৎকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে হাজার হাজার পৃষ্ঠা তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছিল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, হাসান হাফিজুর রহমানকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করার জন্যে তিনি তার সংগ্রহ থেকে দুই হাজার পৃষ্ঠার তথ্য নিয়েছেন।
তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সরকারী কোন তথ্য উৎস থেকে তেমন সাহায্য পাননি। অজস্র তথ্যের মধ্যে দুইজন বন্ধুর মাধ্যমে মাত্র দু’টি সরকারী তথ্য উৎস ব্যবহার করেছিলেন। ‘পূর্ব বাংলার ভাষা-আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থত্রয় রচনার ক্ষেত্রে উদ্ভূত বিভিন্ন সমস্যার কয়েকটি এখানে উল্লেখ করা হল।
প্রাথমিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় ভাষা আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে লিখিত বই পুস্তকের অভাব। প্রচুর বই তো ছিলই না উপরন্তু যে দু’একখানা বই ছিল তার মধ্যে ইতিহাস রচনার মতো উপাদানের যথেষ্ট অভাব ছিল। সে সময়ের তমদ্দুন মজলিশ কর্তৃক প্রকাশিত ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ এবং হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনটি উল্লেখযোগ্য। তবে এ বই দু’টির উপর ভিত্তি করে কোন রচনা দাঁড় করানো সম্ভব ছিল না। সুতরাং বদরুদ্দীন উমরকে মৌলিক তথ্য উৎসের সন্ধানে ব্যাপক আয়োজন করতে হয়।
মৌলিক তথ্যের সন্ধান করতে গিয়ে গবেষণার প্রগতিবাদী পদ্ধতি অনুসরণ করেন তিনি। তার ফলে তাঁর সংগৃহীত তথ্যাবলীর ভেতরে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিষয়সহ শ্রমিক কৃষক ছাত্র অন্যান্য মেহনতি জনগণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নানাবিধ অবস্থা আন্দোলনের দলিল সংগ্রহ করেন তিনি। প্রথমতঃ তথ্য উৎসকে তিনি তিন ভাগে ভাগ করেন-‘(ক) পত্র-পত্রিকা, (খ) বিভিন্ন আন্দোলন সম্পাদিত পুস্তক পুস্তিকা, পার্টি দলিল-পত্র, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত সংগঠনসমূহের আন্দোলনের দলিলপত্র, খন্ড খন্ড নানা আন্দোলনের সময় প্রচারিত ইস্তাহার, পাকিস্তানের সংবিধাসভা ও পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের বিতর্কসমূহ এবং (গ) ভাষা আন্দোলনসহ অপরাপর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।’
পত্র-পত্রিকা দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহ করতে বিভিন্ন লাইব্রেরী যেমন সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ পাঠাগার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী, ইস্ট পাকিস্তান এসেম্বলী লাইব্রেরী, ঢাকা পাবলিক লাইব্রেরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরী, ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব ক্যালকাটার নিউজপেপার সেকশান ইত্যাদিতে কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু লাইব্রেরীতে প্রয়োজনীয় বই পুস্তকের সংখ্যা খুবই কম অথবা এসব বই পাওয়া যায় না। ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান বিশেষের কাছে গেলে দেখা যায় বিভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থায় তাঁদের কাছে রক্ষিত তথ্য নষ্ট হয়ে গেছে অথবা নিজেরা বাধ্য হয়ে ভয়ে নষ্ট করে ফেলেছেন। ফলে তথ্য জোগাড়ের জন্যে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে বদরুদ্দীন উমরকে কয়েকশ’ ব্যক্তির কাছে দৌড় ঝাঁপ করতে হয়েছে। বহু প্রতিষ্ঠানে সময় ব্যয় করতে হয়েছে দিনের পর দিন।

সাক্ষাৎকার সমস্যা ও স্মৃতিচারণের বিভ্রান্তি
তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারের সমস্যা একটি প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা যায়। একজন ব্যক্তিকে সময় দিতে রাজি করিয়ে নির্দিষ্ট দিনে হাজির হয়ে অথবা নানান অসুবিধার ফলে তারিখ পরিবর্তন করে করে একদিন বা একাধিক দিন প্রচুর সময় দিতে হয়েছে। বিভিন্ন কারণে একজনের সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্যের উপর সরাসরি নির্ভর করা যায় না। ফলে ঐ তথ্যকে সমসাময়িক অন্যদের দ্বারা সপ্রমাণ করে সমসাময়িক সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে তার স্বাভাবিকতা বিচার করে গ্রহণ করতে হয়। কারণ ঐ সব সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে (ক) অতিশয়োক্তি, (খ) নিজের ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করা, (গ) অন্যের ভূমিকাকে ছোট করা, (ঘ) অনিচ্ছাকৃত বা দুর্বল স্মৃতির জন্যে ভুল বিবৃতি দেয়া—প্রভৃতির সম্ভাবনা থাকে। ফলে এতসব সতর্কতা অবলম্বন করে একটি তথ্যকে সঠিক ধরে নিয়ে অগ্রসর হতে কেমন ধরনের পরিশ্রম ও চেতনার প্রয়োজন হয় তা অনুমান করা যেতে পারে। পদ্ধতি এবং পরিশ্রম বোঝানোর জন্যে এখানে একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
১৯৪৮ সনের ২৪ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকাতে রাষ্ট্রভাষা কার্যপরিষদের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জনাব আতাউর রহমান খানের সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাপারে আলোচনার সময় খান সাহেব বদরুদ্দীন উমরকে বলেন যে, তিনি এই সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি ঐ সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন না। জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে উপস্থি কমরুদ্দীন আহমদকে তৎক্ষণাৎ ফোন করা হলে কমরুদ্দীন আহমদ সঙ্গে সঙ্গে জানান যে আতাউর রহমান খান ঐ সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন না। তারপরও আতাউর রহমান খান সেকথা মেনে নেননি। পরে কমরুদ্দীন আহমদ, আবুল কাসেম, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ যারা ঐ সাক্ষাৎকারে উপস্থিত ছিলেন তাঁদের সঙ্গে দেখা করলে তারা কেউই ঐ সাক্ষাৎকারে আতাউর রহমান খানের উপস্থিতির কথা অস্বীকার করেন। এভাবে বদরুদ্দীন উমর বিষয়টির সমাধান করেন, যদিও পরবর্তীকালে আতাউর রহমান খান তাঁর অভিযোগ অব্যাহত রেখেছেন।
স্মৃতিচারণের বিভ্রান্তির সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি উদাহরণ উল্লেখ করে বলেন, অলি আহাদের বইটি (জাতীয় রাজনীতি—১৯৪৫-৭৫) full of slander নিজেকে বড় করা, অন্যকে ছোট করা, তিনিই মূল নায়ক এবং তাকে অবহেলা করা হয়েছে— এরকম ধারনায় ভর্তি বইটির গুরুত্ব খর্ব হয়েছে। ফেব্রুয়ারীর দিনগুলোতে অলি আহাদের গুরুত্ব ছিল কিন্তু তার বই-এর বক্তব্যের ব্যাপারে সে গুরুত্ব আরোপ করলে সকলকেই বিভ্রান্ত হতে হবে।’
তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে উমরের পদ্ধতি স্পষ্ট। উপযুক্ত প্রমাণ পেলে তার মতামতকে যেকোন মুহূর্তে তিনি শুধরে নিতে রাজি।

তথ্য সম্পর্কে বিতর্ক
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি প্রকাশ পেলে বিভিন্ন মহলে নানাবিধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যাঁরা এইয়ের গুরুত্ব এবং অপরিহার্যতা বোধ করার মত যথেষ্ট সচেতন তাঁরা সকলেই একবাক্যে বইটিকে বাঙালীর ইতিহাসের এক মহান কীর্তি হিসেবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু অনেকে এই বইয়ের রাজনৈতিক মতামত তথ্য ইত্যাদি সম্পর্কে ভিন্ন মতামতও জ্ঞাপন করেছেন। ফলে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৭৪ সনের একুশে ফেব্রুয়ারী বিশেষ সংখ্যা দৈনিক ইত্তেফাকে এবং পরবর্তী কয়েক সংখ্যা রবিবাসরীয় ইত্তেফাকে মযহারুল ইসলাম ‘ভাষা-আন্দোলন ও শেখ মুজিব’ নামক একটি রচনা প্রকাশ করেন। মযহারুল ইসলাম সে সময় বাঙলা একাডেমীর মহাপরিচালক ছিলেন। মযহারুল ইসলাম যেসব অভিযোগ এবং দাবী করেছে তার প্রধান একটি হলো শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে। মযহারুল ইসলামের অভিযোগ যে, বদরুদ্দীন উমর ব্যক্তির ভূমিকাকে খাটো এবং বিভ্রান্তিকরভাবে উল্লেখ করেছেন। ভুল বর্ণনা দিয়েছেন। বিষয়টি ১৯৪৮ সনে ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় শেখ মুজিবের ভূমিকা সম্পর্কিত। মযহারুল ইসলাম যেসব দোহাই দিয়ে উমরের বক্তব্যকে খন্ডন করার চেষ্টা করেছেন বদরুদ্দীন উমর তাঁর ‘ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গে’ সংকলিত ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি প্রসঙ্গে কয়েকটি বক্তব্য প্রবন্ধে তার দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন মযহারুল ইসলাম একজন ভৌতিক সৃষ্টিশীল উচ্চমার্গের গবেষক যার সম্পর্কিত রচনা অসংখ্য ভুলে ভরা এবং সকল অভিযোগই অন্তঃসারশূন্য এবং ভ্রান্ত। বস্তুতঃ বদরুদ্দীন উমরের বই সম্পর্কে মযহারুল ইসলামের এই মিথ্যে আক্রমণ বদরুদ্দীন উমরের সঙ্গে মযহারুল ইসলামের কোন ব্যক্তিগত রেষারেষির ফসল নয়। এ ক্রুটি শ্রেণী মানসিকতার আক্রমণ অন্য একটি শ্রেণী মানসিকতার উপর, শোষণকামী ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীশ্রেণীর আক্রমণ প্রতিবাদী মুক্তিকামী শ্রেণীর উপর।
উমরের গ্রন্থের তথ্যের সত্যতা, আন্তরিকতা প্রভৃতি বিষয়ে সচেতন ব্যক্তিদের কোন দ্বিমত নেই।

গ্রন্থ রচনায় শরীক
বদরুদ্দীন উমর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচনা করতে বহু মানুষের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সহযোগিতা নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় দুইশত ব্যক্তি সাক্ষাৎকার দেয়া এবং তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছেন। অন্যান্য ব্যাপারেও অনেকের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সহযোগিতা দরকার আছে। এর মধ্যে কেউ কোন বিষয়ের গভীরতা সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন, কেউ বা কপি করেছেন, কেউ নির্ঘন্ট প্রস্তুত করেছেন ইত্যাদি। এখানে যাঁরা নিজেদের নাম প্রকাশ করতে আপত্তি করেছেন তাদের ছাড়া অন্যান্য অধিকাংশ নাম উল্লেখ করা হল।
পত্রপত্রিকা এবং অন্যান্য তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে উমরকে সহযোগিতা করেছেন তাজউদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক শাহেদ আলী, এমদাদ আলী, শামসুল হক, সৈয়দ হোসেন রেজা, আবদুল কাদের ভুঁইয়া, সাইফুল ইসলাম, নূরুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক শামসুল আলম, আবদুর রশীদ খান, কমরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান (রাজশাহী), অলি আহাদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, শফিউদ্দীন আহমদ, শামসুদ্দীন আহমদ, মাহবুব জামাল জাহেদী, ডক্টর রশিদুজ্জামান, আমানুল হক, অজয় ভট্টাচার্য, কামাখ্যা রায় চৌধুরী, নগেন সরকার, প্রমোদ দাস, সইফ-উদ-দাহা, সুষমা দে প্রমুখ।
গ্রন্থরচনার জন্যে যাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ আলাপ করতে হয়েছে তাঁরা হলেন প্রথম খন্ডের জন্য—অজিত গুহ, অলি আহাদ, আজিজ আহমদ, আজহার হোসেন (নবাবগঞ্জ), আতাউর রহমান (রাজশাহী), আতাউর রহমান খান, আবু জাফর শামসুদ্দীন, আবদুর রহমান চৌধুরী (বরিশাল), আবদুল জব্বার খন্দর, আবদুল মতিন (পাবনা), ডক্টর আবদুল মালেক, আবদুল হক, আবদুশ শহীদ, আবুল হাশিম, সৈয়দ আলী আহসান, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া), কাজী গোলাম মাহবুব, কাজী মুহম্মদ ইদ্রিস, কমরুদ্দীন আহমদ, ডক্টর করিম খয়রাত হোসেন, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, তাজউদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল আলী, মোহাম্মদ তোয়াহা, নগেন সরকার, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, নুরুল আমিন, মনি সিংহ, মুনীর চৌধুরী, মারুফ হোসেন, খন্দকার মুশতাক আহম্মদ, মহীউদ্দীন আহম্মদ (বরিশাল), মাহমুদ আলী, রনেশ দাশগুপ্ত, শওকত আলী, শেখ মুজিবুর রহমান, শফিউদ্দীন আহমদ, শামসুজ্জোহা (নারায়ণগঞ্জ), শামসুদ্দীন আহমদ, শাহ আজিজুর রহমান, ক্যাপ্টেন শাহজাহান, শাহেদ আলী, শহীদুল্লাহ কায়সার, সমর সেন, সরদার ফজলুল করিম এবং হামিদা সেলিম (রহমান)।
দ্বিতীয় খন্ডের জন্যে—অজয় ভট্টাচার্য, অলি আহাদ, আজহার হোসেন, আবদুল হক, আবদুল শহীদ, ইমতিয়াজউদ্দীন খান, কমরুদ্দীন আহমদ, তফাজ্জল আলী, নগেন সরকার, মনি সিংহ, রমেন মিত্র, শরদিন্দু দে লালা, দস্তিদার সুধাংশু, বিমল দত্ত, স্বদেশ বসু এবং হাজী মুহম্মদ দানেশ।
তৃতীয় খন্ডের জন্যে যাদের সাক্ষাকার নেয়া হয়েছে এবং অন্যান্য সহযোগিতা পাওয়া গেছে এবং তাদের নাম হল—খন্দকার গোলাম মোস্তফা, হাসান হাফিজুর রহমান, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, গাজীউল হক, আবদুর রাজ্জাক, মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, এম আ আখতার, হাবিবুর রহমান শেলী, খয়রাত হোসেন, অজিত গুহ, আবদুর রহমান চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দীন, হেদায়েত হোসেন চৌধুরী, হাশিমউদ্দীন আহমদ, ইশতিয়াক আহমদ, সুফিফা আহমদ, বদরুল আমিন, আহমদ হোসেন, মোস্তফা জামাল জাহেদী প্রমুখ।
এছাড়া সিরাজুল হক কুতুব, পিনাকী দাস, সালাহুদ্দীন আবুল আসাদ, আবদুর রশীদ খান এই গ্রন্থ রচনায় বিভিন্ন সহযোগিতা করেছেন।

বিষয়বস্তু
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি গ্রন্থটির প্রথম খন্ডে পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, সাংস্কৃতিক আন্দোলনরূপে তাঁর বিকাশ এবং রাজনৈতিক সংগ্রামের উন্নততর পর্যায়ে তাঁর উত্তরণের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় খন্ডে ভাষা আন্দোলনের পটভূমির অংশবিশেষ আলোচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শেষ পর্যায়ে পূর্ব বাংলার কৃষকদের অবস্থা ’৫০-এর দাঙ্গা ছাত্র ও অন্যান্য নির্যাতন ও নির্যাতনের প্রতিরোধ শাসনতান্ত্রিক আন্দোলনভিত্তিক অবস্থার বর্ণনা। তৃতীয় খন্ডে রয়েছে ভাষা আন্দোলনের সময়ে শ্রমিক আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন এবং বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারীর নাটকীয় ঘটনাবলী। নীচে গ্রন্থের তিন খন্ডের মূল শিরোনামগুলো উল্লেখ করা গেল :
প্রথম খন্ড : প্রথম প্রকাশ নবেম্বর ১৯৭০ : প্রকাশনা—মাওলা ব্রাদার্স ঢাকা : প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরী : পৃষ্ঠা-৪১৬ : মূল্য—১৫ টাকা। (ঢাকায় দুটি এবং কলকাতায় একটি সংস্করণ প্রকাশিত)
প্রথম পরিচ্ছেদ : সূত্রপাত
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : প্রথম রাজনৈতিক সংগ্রাম
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : পূর্ব বাংলায় কায়েদে আযম
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : নাজিমুদ্দিন সরকারের বিশ্বাসঘাতকতা
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : ভাষা আন্দোলন উত্তর ঘটনাপ্রবাহ ১৯৪৮
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনের অগ্রগতি
সপ্তম পরিচ্ছেদ : পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্থান
অষ্টম পরিচ্ছেদ : আরবী হরফ প্রবর্তনের ষড়যন্ত্র
নবম পরিচ্ছেদ : পূর্ব বাংলা ভাষা কমিটি
দশম পরিচ্ছেদ : ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস ও পরবর্তী পর্যায়।

দ্বিতীয় খন্ড : প্রথম প্রকাশ—সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ : প্রকাশনা-মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা : প্রচ্ছদ কাইয়ুম চৌধুরী : পৃষ্ঠা-৪৬০ : মূল্য—চল্লিশ টাকা।
প্রথম পরিচ্ছেদ : পূর্ব বাংলায় দুর্ভিক্ষ
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : পূর্ব বাংলা জমিদারী ক্রয় ও প্রজাস্বত্ব আইন
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : পূর্ব বাংলায় কৃষক আন্দোলন
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ১৯৫০
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : জুলুম ও প্রতিরোধ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি প্রস্তাব বিরোধী আন্দোলন।

তৃতীয় খন্ড : (যন্ত্রস্থ)
প্রথম পরিচ্ছেদ : পূর্ব বাংলায় শ্রমিক আন্দোলন
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : শিক্ষা ও সাংস্কৃতকি আন্দোলন
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক শিক্ষক ধর্মঘট
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : ছাত্র আন্দোলনের নোতুন পর্যায়
পঞ্চম পরিচ্ছেদ : পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : রাজনৈতিক দলসমূহের সাংগঠনিক অবস্থা
সপ্তম পরিচ্ছেদ : খাজা নাজিমউদ্দীনের পল্টন বক্তৃতা ও তার প্রতিক্রিয়া
অষ্টম পরিচ্ছেদ : ২০ ফেব্রুয়ারী
নবম পরিচ্ছেদ : ২১শে ফেব্রুয়ারী
দশম পরিচ্ছেদ : ২২শে ফেব্রুয়ারী
একাদশ পরিচ্ছেদ : ২৩শে ফেব্রুয়ারী
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : আন্দোলনের শেষ পর্যায়
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : এপ্রিল কনভেনশন
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : এলিশ কমিশন
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : পর্যালোচনা।

ভাষা আন্দোলনের মূল তাৎপর্য
উমরের মতে ১৯৪৮ বিশেষ করে ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলনই পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম ব্যাপক জাতীয় প্রতিরোধ। এর মাধ্যমে যে প্রতিরোধ আন্দোলনের সূত্রপাত হয় সেই আন্দোলনই ক্রমশঃ বিকশিত হয় ১৯৫৪ সনের সাধারণ নির্বাচন, ১৯৬৪-৬৫ সনের আইয়ুবী নির্বাচন, ১৯৬৮-৬৯ সনের ডিসেম্বর মার্চ আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২৫শে মার্চ পরবর্তী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে। পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিকাশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন এজন্যেই এত তাৎপর্যপূর্ণ। ২১শে ফেব্রয়ারী এজন্যেই আমাদের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ পথচিহ্ন। (ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ, পৃ—২) ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সনের ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলার রাজনীতিক্ষেত্রে একটা মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা করে। এই পরিবর্তন একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গণবিরোধী চরিত্র সম্পর্কে এদেশের শিক্ষিত সমাজ ও জনগণকে সচেতন করে তোলে অন্যদিকে তেমনি তা পূর্ব বাংলার জনগণের উপর জাতির নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনকেও স্থাপন করে ব্যাপক গণভিত্তির উপর।…..পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন যে কেবলমাত্র ছাত্র ও শিক্ষিত জনগণের আন্দোলন ছিল না সে কথা আজ বলাইবাহুল্য। আমাদের দেশে পাকিস্তান সরকার যে জাতিগত নির্যাতন জারি রেখেছিল, তাদের বাংলা ভাষা সম্পর্কিত নীতি ছিল তারই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভাষার ওপর বিধিনিষেধ জারি করে, বাংলা ভাষা শিক্ষাকে গুরুত্বহীন করে তারা শুধু বুদ্ধিজীবী ছাত্র শিক্ষক এবং বুর্জোয়া শ্রেণীকেই পঙ্গু করার ব্যবস্থা নেয়নি, এর দ্বারা তারা শ্রমিক শ্রেণীর শিক্ষা তার রাজনৈতিক অগ্রগতি এবং কৃষক জনগণের সংগঠিত রাজনীতির পথও রুদ্ধ করেছিল। বস্তুতপক্ষে ভাষা প্রশ্নে সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়ে তারা সামগ্রিকভাবে পূর্ব বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেই খর্ব এবং চূর্ণ করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছিল। জনগণও সেক্ষেত্রে নির্লিপ্ত থাকেনি। বাংলা ভাষার উপর আক্রমণকে নিজেদের সংস্কৃতি আর্থিক জীবন এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর সামগ্রিক আক্রমণ হিসেবে ধরে নিয়ে তার বিরুদ্ধে তাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ব্যাপকভাবে। তাই যে আন্দোলন ১৯৪৭ সনে শুরু হয়েছিল মুষ্টিমেয় শিক্ষিত ছাত্র যুবকের সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবে, সে আন্দোলন মাত্র কয়েকবছর পর ১৯৫২ সনের ফেব্রুয়ারী মাসেই পরিণত হলো সারা পূর্ব বাংলাব্যাপী এক বিরাট গণআন্দোলনে।….
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন শুধু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং শিক্ষার মাধ্যমের আন্দোলন ছিল না। সামগ্রিকভাবে তা ছিল আমাদের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের যথাযথ বিকাশের সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে ব্যবহারের অধিকার ও স্বাধীনতার সংগ্রাম। (ঐ পৃঃ—৩-৫)

ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতা
গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতা দু’টি হচ্ছে ‘রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটিকে পাকিস্তানের সকল অঞ্চলের সমস্যা হিসেবে দেখতে না পারা এবং ভাষা নির্যাতনকে মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের মুৎসুদ্দীদের চক্রান্ত হিসেবে না দেখা। পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী নানান ভাষাভাষী বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণ উর্দুকে ধর্মীয় ভাষা হিসেবে মোটামুটি স্বীকার করে নেন। ভাষার লড়াইকে তাঁরা ধর্ম বিরুদ্ধ আন্দোলন হিসেবে দেখেন। এর ফলে সারা পাকিস্তানের জনগণ নিজ নিজ ভাষার দাবীকে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। এবং ভাষা আন্দোলন বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে উগ্র জাতীয়তাবাদের রাজনীতিকে সামনে নিয়ে আসে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্র না থাকা ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় দুর্বলতা। পাকিস্তানে সাম্রাজ্যবাদের দালাল ও মুৎসুদ্দী শ্রেণী ছিল ভাষানীতির মূল নির্ধারক এবং জাতিগত নিপীড়ক। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের এই সম্পর্ক ব্যাপকভাবে বুঝতে আন্দোলনীদের বেশ সময় লেগেছিল। ভাষা আন্দোলন এক ধরনের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী চেতনা সঞ্চার করেছিল। কিন্তু সমগ্র পাকিস্তানের নিপীড়িত জনগণের মধ্যে ভাষার প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদী ও তার মুৎসুদ্দীরা যে অনৈক্য ও বিভেদ সৃষ্টি করেছিল তার মীমাংসা করতে সে আন্দোলন ব্যর্থ হয়।’ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা না থাকার ফলে এই আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চরিত্র অনেকাংশে খর্ব হয়।

অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও প্রতিরোধের প্রতীক একুশে
উমরের মতে ভাষা আন্দোলন আমাদের প্রতিরোধের প্রতীক। এবং ভাষা আন্দোলন এদেশের বুর্জোয়া রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতার থেকে ধর্ম নিরপেক্ষতা দান করেছে। কিন্তু এই আন্দোলনের দুর্বলতার দিকগুলোও তিনি উল্লেখ করেছেন। চীনের ৪ মে আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করে উমর বলেছেন, ৪ মে আন্দোলনের একটি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা ছিল। একইভাবে অর্থাৎ সাংস্কৃতিকভাবে শুরু হলেও আমাদের ভাষা আন্দোলনে এই ভূমিকা অনুপস্থিত ছিল। এর কারণ হিসেবে তিনি দেখিয়েছেন, ভাষা আন্দোলনের ঘটনায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের ভূমিকা বুঝতে অনেকেরই সময় লেগেছিল। এছাড়া ৪ মে আন্দোলন যেমন পরবর্তীকালে রাজনৈতিকভাবে বিকশিত হয়েছিল আমাদের ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে তা হয়নি। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায় বা প্রকাশ হিসেবে দেখা গেল, এখানকার কম্যুনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে উপস্থিত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল, কোন শক্তিশালী সাহিত্যের জন্ম হল না। আরো পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনের ফসলকে নিয়ে যেতে দেখা গেল শাসক-শোষকদেরকেই এদেশের প্রগতি আন্দোলনীরা ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্যকে নিজেদের অর্থাৎ শোষিত জনগণের পক্ষে নিয়ে যেতে সক্ষম হননি। ফলে শহীদ মিনার এখনো দাঁতাল শোষক শ্রেণীর পদপিষ্ট হয়েই চলেছে—একুশে ফেব্রুয়ারীর চেতনা আজকের তরুণদের কাছে এবং সমাজের কাছে প্রায়শই বিকৃতভাবে উপস্থিত।

অন্যান্য গ্রন্থসমূহ
পূর্বে উদ্বৃত্ত সূত্রে আবুল কাসেম ফজলুল হকের আর একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে : বদরুদ্দীন উমরের গ্রন্থ পাঠ করা এবং তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে অথবা বিপক্ষে সাড়া দেয়া সুশিক্ষিত বাঙালী মাত্রেরই কর্তব্য।’ বদরুদ্দীন উমর আমাদের দেশের অনেকানেক বিষয়ের উপরে যে সমস্ত মূল্যবান বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছেন অনেকগুলি গ্রন্থে তার যথেষ্ট পরিমাণ আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। অথচ সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলি নিয়ে তিনি লিখেছেন। তিনি কনস্পিরেসি অব সাইলেন্স বা নীরব থাকার ষড়যন্ত্রে পড়েছেন কিনা অথবা তাঁর মত আন্তরিকতা, পরিশ্রম ও অকাট্য যুক্তি দ্বারা তাঁকে আলোচনা করার মত ব্যক্তির অভাব দেশে রয়েছে কিনা আমরা জানি না।
এখানে উমরের গ্রন্থগুলির পরিচিতিমূলক নামোল্লেখ করা হল।

সাম্প্রদায়িকতা : চতুর্থ প্রকাশ-জুন ১৯৮০ : প্রকাশনা—মুক্তধারা : প্রচ্ছদ—হাশেম খান : পৃষ্ঠা ৯৬ : মূল্য—১২ টাকা (বাংলাদেশে চারটে পশ্চিমবঙ্গে দুটো সংস্করণ প্রকাশিত)
পরিশিষ্টসহ মোট আটটি প্রবন্ধ রয়েছে এই গ্রন্থটিতে। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় রাষ্ট্র মুসলিম জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম সংস্কৃতি, সাম্প্রদায়িকতা ও রাজনৈতিক অগ্রগতি—প্রবন্ধ তিনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আমাদের দেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার অবস্থানকে মার্কসীয় দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করে সমাজে তার অনিবার্য বহিঃপ্রকাশগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। অবিতর্কিত না হলেও গ্রন্থটি এ দিক দিয়ে খুবই উল্লেখযোগ্য।

সাংস্কৃতিক সংকট : তৃতীয় প্রকাশ-১৯৭৪ : প্রকাশনা—মাওলা ব্রাদার্স—প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী : পৃষ্ঠা—১২০। মূল্য—৮ টাকা (কলকাতায় একটি, ঢাকায় দুটি সংস্করণ প্রকাশিত)
গ্রন্থটিতে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সংকটের উপর মোট ৭টি প্রবন্ধ রয়েছে। এর প্রত্যেকটি প্রবন্ধই মূল্যবান। বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় কি হবে তাঁর একটি সচেতন ব্যাখ্যাও একটি প্রবন্ধে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।

সাম্প্রদায়িক সাম্প্রদায়িকতা : প্রথম প্রকাশ—ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ : প্রকাশনা—গ্রন্থনা : প্রচ্ছদ নিয়ামত হোসেন : পৃ—১১২, মূল্য—চার টাকা : (ঢাকায় দুটি এবং কলকাতায় একটি সংস্করণ প্রকাশিত)

অনেকগুলি প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হলেও এই বই-এর গুরুত্বপূর্ণ রচনাগুলো হচ্ছে সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতার শ্রেণীগত ভূমিকা, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা, মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, এবং নজরুল ইসলাম অহিফেন। গ্রন্থের এসব প্রবন্ধে বিশেষ করে এই দেশের মুসলিম সম্প্রদায় এবং সাম্প্রদায়িকতার শ্রেণীরূপে আলোচিত হয়েছে। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, রচনাটিতে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ এবং প্রাসঙ্গিক সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটি উত্থাপন করে লেখক দেখিয়েছেন বাঙালী বুদ্ধিবৃত্তিক ক্রমবিকাশে প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে সাম্প্রদায়িকতা কিভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে দানাবাঁধবার পথ পেয়েছিল।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলাদেশের কৃষক : প্রথম প্রকাশ-১৯৭২ : প্রকাশনা—আহমেদ আতিকুল মাওলা ও আবু নাহিদ, ঢাকা : প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী, মূল্য : ছয় টাকা মাত্র, পৃঃ—১৫২ (ঢাকায় একটি, কলকাতায় তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত)

গ্রন্থটিতে একদিকে বৃটিশ সরকার এবং তার সহযোগী এদেশী ব্যক্তি ও সংগঠনের ভূমি রাজস্ব এবং ভূমিনীতি সম্পর্কিত ভূমিকা, অন্যদিকে কৃষকদের অবস্থার বিবর্তন আলোচিত হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এবং এর ফলে সৃষ্ট কৃষকদের চরম দূরাবস্থা, পরবর্তী পর্যায়ে কৃষক আন্দোলন ও বিদ্রোহের ইতিবৃত্ত ১৯৪৭ সন পর্যন্ত আলোচিত হয়েছে। ১৭৬৫ থেকে ১৯৪৭ সন পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রস্তুতি এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও তার সংশোধনীসমূহের দ্বারা দৃঢ়কৃত শোষণের যাতাকলে—পঞ্চাশের মন্বন্তরে পিষ্ট কৃষকের অবস্থা দেশের অবস্থা, পরে ভাগ-চাষীদের দাবীদাওয়া তেভাগার লড়াই—এ লড়াইয়ের বিভিন্ন দিকসহ জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ প্রশ্নে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ভূমিকা এবং মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ সম্পর্কেও বিস্তৃত আলোকপাত করা হয়েছে।

Politics and Society in East Pakistan and Bangladesh : প্রথম প্রকাশ-১৯৭৪ : প্রকাশনা—মাওলা ব্রাদার্স : প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী : পৃ-৩৪৪ : মূল্য-৩০ টাকা (ঢাকায় একটি এবং কলকাতায় গ্রন্থটির প্রথম অংশের একটি সংস্করণ প্রকাশ হয়েছে)

দুই অংশে বিভক্ত এই পুস্তকটির প্রথম অংশে ২৪টি এবং দ্বিতীয় অংশে ৪৪টি মোট ৬৮টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩ সনের মধ্যবর্তী সময়ে কিছু সাময়িকীতে প্রকাশিত এই রচনাগুলিতে পূর্ব বাংলায় পাক আমলের শেষ পর্যায় এবং বাংলাদেশ হওয়ার অব্যবহিত পরপরই দেশের অবস্থার নানাদিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ শাসক-শোষক শ্রেণীর চরিত্র এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কৃষি শিল্প বাণিজ্য প্রশাসন যোগাযোগ জনমত-গুজব সংবিধান, পররাষ্ট্রনীতি, আইন-শৃংখলা প্রভৃতি বিষয়ে তাদের অনুসৃত নীতি-নিয়ম পরিকল্পনা সম্পর্কিত বিশ্লেষণ। এছাড়া দেশের বিরোধী সংগঠনের অবস্থা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপরেও আলোচনা রয়েছে। বইটি পড়ে যুদ্ধপূর্ব এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ সম্পর্কে তুলনামূলক এবং শ্রেণী সচেতন রাজনৈতিক মূল্যায়ন করতে সাহায্য পাওয়া যায়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ : প্রথম প্রকাশ-জুলাই ১৯৭৪ : প্রকাশনা—সুবর্ণ প্রকাশন : প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী : পৃ-১২৮, মূল্য-১৫ টাকা (ঢাকায় একটি কলকাতায় দুটি সংস্করণ প্রকাশিত)

কম্যুনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম বাংলার তত্ত্বগত দ্বন্দ্বের একটি অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঊনিশ শতকের বাঙালী সমাজ’ গ্রন্থটি। পশ্চিম বাংলার নৈরাজ্যিক ও সন্ত্রাসবাদী সাংস্কৃতিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবী কম্যুনিস্ট কর্মীদের সঠিকতর চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এই গ্রন্থে।

রাষ্ট্রতত্ত্বের ইতিহাস : যুগ্ম অনুবাদক-বদরুদ্দীন উমর : প্রকাশনা—বাংলা একাডেমী : দ্বিতীয় প্রকাশ—মে ১৯৭৫, প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী পৃ—৬৪২ : মূল্য—৩০ টাকা।

রাষ্ট্রতত্ত্বের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উমরের অনুবাদের কাজ ভাল হলেও তেমন অনুবাদ করেননি। এই বইটিতে বিশ্বখ্যাত রাষ্ট্রতত্ত্ববিদদের মতামতের পরিচয় পাওয়া যায়।
তার পিতা মৌলভী আবুল হাশিম রচিত দি ক্রীড অব ইসলাম অনুবাদ করেছিলেন ১৯৫১ সনের দিকে। অনূদিত বইটির নাম ছিল ‘ইসলামের মর্মবাণী’। বইটি পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে জনাব ফারুক মাহমুদ প্রকাশ করেছিলেন।

বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা : প্রথম প্রকাশ—১৯৭৬ : প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী, পৃ—১২৬ মূল্য : ১৪ টাকা (ঢাকায় এবং কলকাতায় একটি বইর সংস্করণ বেরিয়েছে)
গ্রন্থটিতে মোট পাঁচটি প্রবন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশে সামন্ত সংস্কৃতি ও বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, বাংলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে এবং বিপ্লবী তত্ত্বের সমস্যা। বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের যেসব সমস্যা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার মধ্যে বিশেষত কয়েকটি বিষয় নিয়ে এই গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে। দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা বিপ্লবী পরিস্থিতি এবং তত্ত্বই এর মধ্যে প্রধান। সম্পর্কিত বিষয়ে বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিতর্কিত। এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে আরো অনেক সমস্যা রয়েছে যা এই গ্রন্থের আলোচনায় প্রতিফলিত হয়নি।

Imperialism and General Crisis of the Borgeoisie in Bangladesh : প্রথম প্রকাশ—১৯৭৯ : প্রকাশনা—প্রগতি প্রকাশনী : প্রচ্ছদ—সৈয়দ লুৎফুল হক : পৃ-১১৮ : মূল্য—৪০ টাকা।
গ্রন্থটির তিনটি খন্ডে ১২টি, ২টি এবং ৭টি করে মোট ২১টি প্রবন্ধ রয়েছে। এর প্রথম খন্ড সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত, দ্বিতীয় খন্ড বাংলাদেশে বুর্জোয়া সংকট এবং তৃতীয় খন্ডে এই বুর্জোয়া সংকটের প্রাথমিক কিছু উদাহরণ আলোচিত হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিভিন্ন চরিত্র বিশেষতঃ নানান মুখোশ কিভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে অবদমিত করছে তার কিছু স্পষ্ট ব্যাখ্যা-প্রমাণ দেয়া হয়েছে।

আমাদের ভাষার লড়াই : প্রথম প্রকাশ—১৩৮৭ : প্রকাশনা—শিশু সাহিত্য বিতান : প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী : পৃ-৭৫ : মূল্য—১৫ টাকা।
বইটি ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থের শিশু সংস্করণ বলা চলে। শিশুদের জন্যে লিখিত একটি প্রামান্য ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। শিশু মনস্তত্ত্ব লক্ষ্য রেখে বইটির অঙ্গসজ্জা করা হয়েছে।

ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ : প্রথম সংস্করণ ১৯৮০ বইঘর : চট্টগ্রাম : প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী : মূল্য—১২ টাকা : পৃ-১১৪ (ঢাকায় একটি, কলকাতায় একটি সংস্করণ প্রকাশিত)।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত মোট ১৪টি প্রবন্ধ নিবন্ধের সংগ্রহ এই বইটি। বইয়ের প্রথম ৭টি প্রবন্ধে অল্পকথায় ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক দার্শনিক চরিত্র আলোচিত হয়েছে। এসব প্রবন্ধে মূলতঃ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চরিত্র না থাকার দুর্বলতা, দেশীয় রাজনীতিকে অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতান্ত্রিকতার পথে উত্তরণ ঘটানোর এই উৎস এবং প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে ভাষা আন্দোলনের চরিত্র চিহ্নিত হয়েছে। অন্যান্য প্রবন্ধে সুকান্ত ভট্টাচার্য, শিক্ষা দর্শন ছাত্র আন্দোলন, মুক্তিযোদ্ধা প্রভৃতি বিষয় আলোচনা করেছেন। সুকান্তকে তিনি শ্রেণী সংগ্রামের মুখপাত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। ’৭১ সনের তুফানে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের স্বাধীনতা, জাতির মুক্তি ও জনগণের জীবনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্যে লড়েছিলেন, শেখ মুজিবের উৎখাত সেই লড়াইয়ের প্রতিক্রিয়ারই অংশ।–উমরের আহ্বান, বাংলাদেশের নতুন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা সে প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবেন।

Towards the Emergency : প্রথম প্রকাশ আগস্ট ১৯৮০ : প্রকাশনা—মুক্তধারা : প্রচ্ছদ—গোলাম সরোয়ার : পৃ-১৭১ : মূল্য—ডিলাক্স এডিশন—৬০ টাকা, চীপ এডিশন—৩০ টাকা।
মুজিব আমলের সংকটকালে দেশের সামগ্রিক অবস্থা কেমন ছিল এই গ্রন্থটিতে তার কিছু প্রতিবেদন মিলবে। যে অবস্থায় শেখ মুজিব সামরিক আইন জারী করতে বাধ্য হয় সেই অবস্থার বিকাশ অনুধাবন করার জন্যে বইটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। উমরের বেশ কিছু গ্রন্থের রাজনৈতিক সংবাদমূলক সাহিত্য (জার্নালিস্ট পলেটিক্যাল লিটারেচার) সহজে সমাজ-গতি অনুধাবন করতে সাহায্য করে। এই পুস্তকটি ছাড়াও উমরের রচনার একটি বড় অংশই সংবাদমূলক রাজনৈতিক সাহিত্য।

যুদ্ধপূর্ব বাংলাদেশ : দ্বিতীয় প্রকাশ-১৯৮১ : প্রকাশনা—মুক্তধারা : প্রচ্ছদ—আবুল বারক আলভী : পৃ-৩৩৯ : মূল্য—৩৭ টাকা (সাদা কাগজ) ২৭ টাকা (নিউজপ্রিন্ট)।
ফেব্রুয়ারী ১৯৭০ থেকে মার্চ ১৯৭১ সন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গণশক্তি পত্রিকায় প্রকাশিত শতাধিক প্রবন্ধ এই বইটিতে সংকলিত হয়েছে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রে গ্রন্থটি একটি দলিল বিশেষ। একজন ব্যক্তির দ্বারা লিখিত হলেও প্রবন্ধগুলিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক মতামত ও চেতনার মান প্রতিফলিত। গ্রন্থটির বিষয়বস্তু হচ্ছে তৎকালীন সময়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়।

যুদ্ধত্তোর বাংলাদেশ : তৃতীয় প্রকাশ-১৯৮২ : প্রকাশনা—মুক্তধারা : প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী : পৃ-১৪৯ মূল্য—২৩ টাকা (সাদা কাগজ)।
বইটিতে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সনের মধ্যে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত এবং এই সময়ে লিখিত মোট ৩৪টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। প্রবন্ধগুলিতে সমসাময়িক ঘটনাবলী বিশেষত রাজনৈতিক বিষয়াবলী প্রাধান্য পেয়েছে। এর সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে দেশের দেশের অর্থনৈতিক অধিকাঠামোমূলক নানারকমের প্রসঙ্গ এসেছে। চলতি বিষয়ের উপর মন্তব্যমূলক ছোট ছোট এই প্রবন্ধগুলিতে ঐ সময়ের একটি সাধারণ চিত্র প্রস্ফূটিত হয়েছে।

বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষক আন্দোলন : প্রকাশনা-প্যাপিরাস প্রেস : প্রথম প্রকাশ—ফেব্রুয়ারী ১৯৮৩।
গ্রন্থটিতে বাংলাদেশের কৃষক সম্পর্কে মোট আটটি প্রবন্ধ রয়েছে। ভূমি ব্যবস্থা এবং কৃষকদের অবস্থা সম্পর্কে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও বাংলাদেশের কৃষক’ গ্রন্থে এবং ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ডে বৃটিশ আমলের পূর্ব থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বিস্তৃত আলোচনার পূর্ণতার পর্যায় হিসেবে ‘বাংলাদেশের কৃষক ও কৃষক আন্দোলন’ বইটিকে গ্রহণ করা যেতে পারে। এই বইতে বাংলাদেশের কৃষকদের নানা প্রসঙ্গ, ভূমি সংস্কার এবং ভারতীয় কৃষকের সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষকদের তুলনামূলক আলোচনাও স্থান পেয়েছে।

বাংলাদেশ মার্কসবাদ : প্রথম প্রকাশ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৯ : প্রকাশনা—বইঘর : প্রচ্ছদ—কাইয়ুম চৌধুরী : পৃ-১৫৪ : মূল্য—১২ টাকা।
বাংলাদেশে মার্কসবাদ পুস্তকটি কোন একটি বিশেষ বিষয়কেন্দ্রিক নয়। তবে একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে বাংলাদেশের কৃষক এবং শ্রমিকের অবস্থাই বেশিরভাগ প্রবন্ধে এসেছে। বাংলাদেশে মার্কসবাদ বলতে আরো যে যে বিষয় আসে এখানে তার কিছু অপূর্ণতা রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে বুর্জোয়া রাজনীতির চালচিত্র : প্রথম প্রকাশ—ডিসেম্বর ১৯৮২ : প্রকাশনা—ও জে পাবলিশিং হাউজ : প্রচ্ছদ—কামরুল হাসান : পৃ-১৭৫ : মূল্য—৩০ টাকা।
পুস্তকটিতে সংকলিত প্রবন্ধগুলি ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সনের মধ্যে রচিত এবং নয়াপদধ্বনি ও জাগরণ পত্রিকায় প্রকাশিত। এই বইতে মূলতঃ বাংলাদেশের সামরিক আমলা ও আমলাতন্ত্রের কর্মসূচীভিত্তিক আলোচনা করা হয়েছে, যা বুর্জোয়া রাজনীতি হিসেবে অভিহিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া এবং তার অনুসঙ্গীদের সম্পর্কে বেশ কতকগুলো রচনা রয়েছে। জিয়াউর রহমানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি—রচনাটি এই বই-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ।

তাঁর অবদান
বদরুদ্দীন উমর সহজ অনাড়ম্বর বক্তব্য প্রকাশক কাটা কাটা বাক্যে তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-যুক্তি উপস্থিত করেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিশালী গদ্য শিল্পী। লেখায়, রাজনৈতিক সংগঠনে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড সংগঠনে, আমাদের দেশের শোষিত জনমানুষের সার্বিক মুক্তির জন্যে—অর্থনৈতিক অধিকাঠামোমূলক মুক্তির জেন্য তিনি অনবরত এবং নিরাপোষ সংগ্রাম করে চলেছেন। ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থ রচনা করে তিনি আমাদের দেশের জনগণের ব্যক্তিত্ব সৃষ্টিতে সহায়তা করেছেন এই দেশের মানুষকে অন্যায়ের প্রতিবাদে সদাজাগ্রত চেতনা দান করেছেন। এখনো পর্যন্ত অবিরামভাবে নানা কর্মকান্ডের মাধ্যমে তিনি আমাদের দেশের মেহনতি মানুষকে শোষণমুক্তির সংগ্রামে উদ্দীপিত করে চলেছেন।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!