You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৮ই ডিসেম্বর, শনিবার, ২২শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০

ধান-চাল সংগ্রহে শ্লথ গতি পরিহার করুন

এবারে দেশে উৎপাদিত ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের কর্মসূচি বেশ কিছুদিন ধরে শুরু হয়েছে। কোন কোন অঞ্চল থেকে সংবাদ এসেছে যে, সংগ্রহ কাজ বেশ আশাপ্রদ, আবার কোন কোন অঞ্চলে সংবাদ নৈরাশ্যজনক। সরকার কর্তৃক ধান-চাল সংগ্রহ করে অভিযানকে আমরা স্বাগত জানিয়ে পূর্বাহ্নে বলেছিলাম, শুধু সরকারি প্রযত্নে নয় ব্যাপক রাজনৈতিক তৎপরতাও সরকারী যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হবে। এবং আমরা আশাবাদী যে, সরকার ও সংগঠনের যৌথ প্রয়াসই কেবলমাত্র এই বিরাট অভিযানকে বাস্তবায়িত করা সক্ষম। দেশের গড়-পরতা ধান উৎপাদনের পরিমাণ এবার উল্লেখযোগ্য কোন কোন অঞ্চলে এর উৎপাদন আশাতীত।
সরকার এটি বাস্তব মূল্য নির্ধারণ করে কৃষকদের নিকট থেকে সরাসরি ধান বা চাউল কেনার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন দেশের সর্বস্তরের মানুষ তাকে স্বাগত জানিয়েছে। আমরাও আশাবাদী ছিলাম এই ভেবে যে, সরকারের আন্তরিকতার সঙ্গে এই মহান দায়িত্বটি পালন করবেন। কিন্তু মাঝে মাঝে নৈরাশ্যজনক সংবাদ লক্ষ্য করে আমরা আশাহত হয়েছি। অনেকদিন পূর্বে খুলনা থেকে একটি সংবাদ পাওয়া গেছে। যে, সেখানে বিভিন্ন অঞ্চলে তিরিশ টাকা মণ দরে নাকি ধান বিক্রি হচ্ছে। সরকারি ক্রয় সংস্থা সমূহের অযোগ্যতার দরুন সেখানে ধান কেনা হয়নি। ফলে ধান বা চাউল পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে অনেকের ধারণা।
একথা সত্য যে যদি সরকার ধান বা চাউল কেনার ব্যাপারে যথার্থ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হন তাহলে চাউল বা ধান ফড়িয়া বা গ্রাম্য মহাজন শ্রেণী স্বল্প মূল্যে ক্রয় করে সুযোগ বুঝে অধিক মূল্যে বিক্রয় করবে অথবা সীমান্তের ওপারে পাচার করে দেবে। অতএব অত্যন্ত পারদর্শীতার সঙ্গে এই সংগ্রহ অভিযান পরিচালিত হওয়া আবশ্যক। একটি সংবাদে প্রকাশ, গত বিশ দিনের অভিযানে নাকি প্রায় এক লাখ দশ হাজার টন ধান ও চাউল সংগৃহীত হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য হলো চার লক্ষ্য টন সংগ্রহ করা। যদি আরো জোর দিয়ে এই অভিযান চালানো না হয় তাহলে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হবেনা। সীমান্ত এলাকায়ও অভিযান আরো জোরদার হওয়া আবশ্যক বলে আমরা মনে করি। ধানের মণ পঁয়তাল্লিশ টাকা নির্ধারিত হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল থেকে জানা গেছে যে, কৃষকদের নিকট থেকে নাকি পঁত্রিশ টাকা মণ দরেও কেনা হচ্ছে। কৃষকদেরকে যেন কেউ না ঠেকাতে পারে কর্তৃপক্ষকে সে দিকেও নজর রাখতে আমরা অনুরোধ করি। সর্বোপরি সংগ্রহ অভিযানকে যে করেই হোক সাফল্যমন্ডিত করতে হবে। এটাই জনগণের পক্ষ থেকে আমাদের দাবী।

অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই

গতকালের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকা সমূহের দিকে তাকালে আমরা আমাদের মূল্যবান জাতীয় সম্পদ অপচয় সম্পর্কে দু’দুটো মারাত্মক সংবাদ পাইঃ একটি হাজার হাজার টাকার কাপড় পোড়ানো সম্পর্কে অপরটি লক্ষ লক্ষ টাকার পাট নদীগর্ভে নিক্ষিপ্ত করার সম্পর্কে। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে গত রোববার আমাদের অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প সংস্থা চাঁদ টেক্সটাইল মিলে। অভিযোগটি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এনেছেন মিলের খোদ শ্রমিক ভাইয়েরা। আশ্চর্য, দেশের মানুষ যখন এক টুকরো কাপড়ের অভাবে চট, ছালা ইত্যাদি ব্যবহারে কোনো মতে লজ্জা নিবারণ করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে কাপড় কলের বড় কর্তারা ‘কাপড় নষ্ট হয়ে গেছে’ শুধু এই অজুহাতে এতো হাজার হাজার টাকার কাপড় পুড়িয়ে দিলেন তাকে আমরা কোন ক্রমেই একটি সহজ ঘটনা বলে ধরে নিতে পারিনা।
শ্রমিকেরা যে কাপড় দিনের পর দিন তাদের শ্রম দিয়ে, রক্ত দিয়ে উৎপাদন করেছে, সেই শ্রমের ফসল তাদেরই সামনে কর্তারা অহেতুক পুড়িয়ে দিলেন, তা তারা কিছুতেই সহ্য করতে পারেনি। তাই ক্ষোভে, দুঃখে ও প্রতিবাদে তারা ছুটে গিয়েছিল মিছিল করে গণভবনে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের অভিযোগ গ্রহণ করে উপযুক্ত তদন্তের নির্দেশও দিয়েছেন বলে জানা গেছে। জাতীয় সম্পদ অপচয়ের আর একটি ঘটনা ঘটেছে ঘোড়াশাল জাতীয় জুট মিলে। সেখানে কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি প্রায় পনেরো লাখ টাকার পাট পচে যাবার অজুহাতে শীতলক্ষ্যা নদীতে নিক্ষেপ করেছেন বলে জানা গেছে। পাটগুলি কেনা হয়েছিল গত বছর লাখ লাখ টাকা খরচ করে। দীর্ঘদিন গুদামের অভাবে খোলা আকাশের নিচে পড়ে থেকে ও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে পচে পাটগুলি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে উঠেছিল বলে সেগুলি কর্তৃপক্ষ ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে কর্তৃপক্ষ সূত্রে বলা হয়েছে।
বাঃ কী চমৎকার গা-সাফাই, জাতীয় সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কি অপূর্ব প্রয়াস।
এই উভয় ঘটনাতেই দেশের সাধারণ মানুষ যারপরনাই অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছেন। এবং সবারই একই বক্তব্য যে, আমাদের মতো একটি গরিব দেশের জাতীয় সম্পদ নিয়ে যে সব অযোগ্য ও অপদার্থ কর্তারা দিনের পর দিন ছিনিমিনি খেলছেন তাদের জন্য চরম দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক এবং ভবিষ্যতে যাতে আর এই ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির উদ্ভব না হয় সেজন্য যাবতীয় কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আজো পর্যন্ত একটি ম্যানিয়া বা এলার্জি আমাদের ঘোরতরভাবে ঘিরে আছে। তা হচ্ছে গতানুগতিক বা মান্ধাতার আমলের ধারায় শাস্তি প্রদান। শুধুমাত্র সাসপেন্ড বা ডিসমিস করলেই আমরা অপদার্থ কর্তা-ভূতের হাত থেকে রেহাই পাবোনা। কারণ লাখ লাখ টাকা কুপথে বানিয়ে নেবার পর চাকরি গেলে বা লাখ খানেক চলে গেলেও তাতে আসলে অপরাধীর কিছুই ক্ষতি হয়না। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা, যাতে একজনের এ শাস্তি দেখে ভবিষ্যৎ আরো দশজন সাবধান থাকে বা ভবিষ্যতে এ অপরাধ আর সংঘটিত হতে না পারে।
চাঁদ মিলে কার নির্দেশের ভিত্তিতে কাপড় পোড়ানো হোল, কে পোড়ানোর হুকুক দিলেন, কেন হুকুম দিলেন, সপ্তাহের অন্যান্য রিন ছেড়ে হঠাৎ রোববারে বা ছুটির দিনে কেন পোড়ানো হোল, পোড়া কাপড়ের ধ্বংসাবশেষ কোথায় ফেলা হোল ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় গভীর তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হবে দেশের সাধাতণ মানুষ স্বভাবতঃই সরকারের কাছ থেকে এ প্রত্যাশা করে।
অনুরূপভাবে ঘোড়াশাল মিলের ওই লক্ষ লক্ষ টাকার পাট নদীগর্ভে ফেলে দেবার আভ্যন্তরীন চক্রান্তকে উদ্ধার করে সরকার সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে বাংলার পুণ্য মাটি থেকে এ ধরনের যাবতীয় চক্রান্ত চিরতরে মুছে ফেলবেন বলেও মানুষ আশা করে।

তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করাই মঙ্গলজনক

রাজধানী এবং রাজধানীর বাইরের হাসপাতালগুলোতে এক্সরে ফিল্মের দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে। প্রতিদিন সারা দেশের হাসপাতালে রোগীরা এক্সরে ফিল্মের অভাবে মারাত্মক সঙ্কটের মুখোমুখি হচ্ছেন। মেডিক্যাল এবং মিটফোর্ড হাসপাতালে জরুরী ভিত্তিতে এক্সরে ফিল্ম সরবরাহ করা হচ্ছে। জাপান থেকে দু’সপ্তাহ আগে জরুরী ভিত্তিতে পাঁচশ প্যাকেট এক্সরে ফিল্ম আমদানি করা হয়েছিল, এবং ইতিমধ্যে ওই ফিল্ম শেষ হয়ে এসেছে। কাজেই এখন চাহিদানুযায়ী হাসপাতালগুলোতে এক্সরে ফিল্ম সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রোগীদের ভাগ্যে যে কি করুণ অবস্থায় উদ্রেক হয়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই যে, বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ এক্সরে ফিল্মবাহী বিদেশী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বাইরে আটদিন ধরে পড়ে আছে বলে বৃহস্পতিবার ‘বাংলার বাণীতে’ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে। টিসিবি জিডিআরের সংগে চুক্তি করে ৭৭ হাজার পাউন্ড ওজনের এক্সরে ফিল্ম আমদানীর যে ব্যবস্থা করেছিল, সেই ব্যবস্থানুযায়ী গত অক্টোবর মাসে একটি জাহাজ জিডিআর ছেড়ে চট্টগ্রামের বহির্বন্দরে এসে পৌঁছেছে গত নভেম্বর আটাশ তারিখে। কিন্তু জাহাজটি বাংলাদেশে আসার পরও চট্টগ্রাম বন্দরের তীরে এসে নোংগর ফেলতে পারেনি।
টিসিবি কর্মকর্তাদেরই গাফিলতির ফলেই নাকি এহেন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে হাসপাতালগুলোতে এক্সরে ফিল্মের চরম সংকট দেখা দিয়েছে, রোগীরা এক্সরে ফিল্মের আশায় হাপিত্যেশ করে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তবুও টিসিবির কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়েনি। জাহাজ থেকে এক্সরে ফিল্ম খালাস করার জন্য টিসিবির কর্তারা নাকি বন্দর কর্তৃপক্ষকে বিষয়টির গুরুত্বের কথা অবগত করাননি। অভিযোগটি যে কতোটুকু মারাত্মক, তা যদি টিসিবির কর্তারা অনুধারন না করে থাকেন, তাহলে তা খুবই দুঃখজনক ব্যাপারে পরিণত হতে বাধ্য। কারণ, এক্সরে ফিল্মের সঙ্গে দেশের হাজার হাজার মরণাপন্ন রোগীর জীবনমরণ সমস্যা জড়িয়ে রয়েছে। রোগীদের দিকে তাকিয়ে জরুরী ভিত্তিতে বিদেশি জাহাজ থেকে এক্সরে ফিল্ম খালাস করা একান্ত দরকার। এ ব্যাপারে টিসিবি কর্মকর্তারা জরুরী ব্যবস্থাবলম্বন করেছেন কি না জানিনা। তবে ব্যাপারটি যে নিতান্ত খেয়াল-খুশির বিষয় নয়, তা টিসিবি’র কর্মকর্তারা যতো তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবেন ততই মংগল বলে আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!