You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.09.05 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | গোটা জাতির গণতন্ত্রের বিকাশের মুখে চপেটাঘাত | ত্রিদলীয় বৈঠকঃ ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রাম | যে কোনো মূল্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৫ই সেপ্টেম্বর, বুধবার, ১৯শে ভাদ্র, ১৩৮০

গোটা জাতির গণতন্ত্রের বিকাশের মুখে চপেটাঘাত

যার শুরু হয়েছিল অভূতপূর্ব শান্তি আর সুশৃংখল পরিবেশের মধ্য দিয়ে তার পরিনতি এমন অবাঞ্চিত পথে এগোবে এটা কেউ ভাবতে পারেনি। ভাবতে পারা যায়নি ডাকসু নির্বাচনে ভোট দানের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। বিকেলের দিকেও বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তরুণ-তরুণীদের প্রাণোচ্ছল আনন্দ উল্লাস লক্ষ্য করা গেছে। প্রতীক্ষারত সবাই নির্বাচনী ফলাফল জানতে। এমনি সময়ে শুরু গোলাগুলি, ভোট বাক্স ছিনতাই, রাত যত বাড়তে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ত্রাসেরও তত বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। হতবাক সাধারণ ছাত্র ছাত্রী, একদিনের জন্য যারা হয়েছিলেন মাননীয় ভোটার। ব্যাপক সন্ত্রাসের মুখে ডাকসুর ভোট গণনা স্থগিত রাখা হয়েছে। একমাত্র শামসুন্নাহার হলে ভোট গণনার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে তা থেকে জানা যায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মনোনীত প্রার্থীরা সেখানে জয়লাভ করেছে।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে যখন একনায়কত্ববাদী শাসন কায়েমের একটা অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছিল তখন বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক আদর্শকে সামনে রেখে প্রশাসন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা সবকিছু গণতান্ত্রিকীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর এ উদ্যোগ দলমত নির্বিশেষে সকল মহলের প্রশংসা অর্জন করে। স্বভাবতঃই আশা করা গিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর এ উদ্যোগে সবচাইতে আন্তরিকভাবে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসবেন সচেতন শিক্ষিত ছাত্র সমাজ আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে তার পথিকৃ্ৎ। বিগত দিনে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ভূমিকা পালন করে এসেছে, রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গণতন্ত্র স্বীকৃতি হবার পর তার লালন এবং সুষ্ঠু বিকাশে তারাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গত পরশু ঘটনার পর জনসাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ছাত্রীদের গণতান্ত্রিক চেতনাকে কোন চোখে দেখবেন, গোটা দেশ গণতান্ত্রিক দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা কতটুকু আশাবাদী হবেন সেটাই আমাদের প্রশ্ন?
আমরা জানি ছাত্র সমাজের অতি ক্ষুদ্র একটা অংশ এই অবাঞ্চিত ঘটনার জন্য দায়ী। নির্বাচনী ফলাফল যতটুকুও জানা গেছে তাতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মনোনীত প্রার্থীরাই অগ্রগামী ছিলেন। একমাত্র যে হলের চূড়ান্ত ভোট গণনার হিসেব জানা গেছে সে হলেও জিতেছিলেন ওই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদেরই মনোনীত প্রার্থীরা। কিন্তু সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে যারা ছাত্র সমাজের এই গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করে দেবার জন্য গত পরশু উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন তারা কি নিজেরাও এক মুহূর্তের জন্য ভেবে দেখেছেন যে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে নয় বরং গোটা জাতির গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার পথে তারা কতটুকু প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করলেন? গোটা জাতির সঙ্গে আমরা এই ঘৃণ্যতম অপকর্মের নিন্দা করছি এবং সরকারের কাছে দাবি করছি অবিলম্বে দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।

ত্রিদলীয় বৈঠকঃ ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রাম

গত কয়েকদিন ধরে দেশের বৃহত্তম তিনটি দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক দলের বৈঠক অনুষ্ঠানের সংবাদ লক্ষ করা গেছে। এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রকারের সংবাদও পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। গতকালের একটি সংবাদে জানা গেছে -বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগ ও মোন্যাপ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী, মুনাফাখোর, মজুতদার ও সকল প্রকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করার জন্য এই তিনটি রাজনৈতিক দল অনতিবিলম্বে তাদের বিস্তারিত কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। গত পরশুদিন সকালে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে উক্ত যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের নিকট বলেছেন, দেশের সার্বিক উন্নয়ন বিশেষতঃ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি বিধানের জন্য এই তিন দলের আন্দোলন শুরু হবে। এছাড়া উল্লেখিত এই রাজনৈতিক আন্দোলনের মুখ্য আদর্শ হবে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শ বাস্তবায়নের শপথ নিয়েই আওয়ামী লীগ, মোন্যাপ ও কমিউনিষ্ট পার্টির সকল কর্মীকে সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতির ভাষণে বলেছেন, যে কোন ত্যাগের বিনিময়েই হোক না কেন সমাজবিরোধীদের উৎখাত করে দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। নতুন আদর্শ ও প্রত্যয়ের তিনটি সংগঠনের প্রত্যেকটি কর্মীকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ইতিপূর্বে তিন দলের বৈঠকের যেসকল প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলোর একটি স্মারকলিপি গত পরশুদিন বঙ্গবন্ধুর নিকট পেশ করা হয়েছে। ত্রিদলীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত সমূহ অনতিবিলম্বে তিনটি দলের কার্যকরী কমিটিতে পেশ করা হবে বলেও জানা গেছে।
বস্তুতপক্ষে দেশপ্রমিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা আজ একান্ত প্রয়োজন। এ ব্যাপারে বহু পূর্বে আমরা একটি প্রস্তাবে বলেছিলাম যে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা সার্থক করতে হলে প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলসমূহের ঐক্য অপরিহার্য। সমাজতন্ত্রের আন্দোলন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া ত্বরান্বিত হতে পারে না। বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিকল্পনা সমূহ এগিয়ে নেবার সময় কোন ক্রমেই সমাজতান্ত্রিক শিবিরের কোন শক্তিকে দূরে ঠেলে দেওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। অবশ্যই নীতিগত ও পদ্ধতিগত পার্থক্য যদি ঐ সকল দল সমূহের মধ্যে খুব বড় একটা না থাকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগ নীতিগতভাবে এবং শেষে সাংবিধানিক শর্তে সমাজতন্ত্রের কথা ঘোষণা করেছে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র বিকাশ সাধনের এই আন্দোলনে পূর্বের দিনের ন্যায় মোন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আওয়ামী লীগের আজ আর কোনো বিরোধ থাকার কথা নয়। প্রয়োগ ও পদ্ধতিগত ব্যাপারে কিছু কিছু ভুল থাকলেও বর্তমান সরকার সমাজতন্ত্রের স্বপক্ষে কাজ করে চলেছেন। এ ব্যাপারে অবশ্যই মোন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টিকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। ক্ষমতাসীন সরকারকেও সহযোগী শক্তি হিসেবে তাদেরকে বিবেচনা করতে হবে। এবং ঐক্যবদ্ধভাবে দেশের প্রতিটি সমস্যার মোকাবেলা করে জাতীয় স্বাধীনতাকে সংহত ও সমাজতন্ত্রের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করতে হবে। সকল দ্বিধাদ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে উঠে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। দেশের কলুষ প্রশাসনের খামখেয়ালিতে ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিতে হবে কার্যকরী রাজনৈতিক পদক্ষেপ। সরকার যদি এই সকল জোটশক্তির সিদ্ধান্তের সঙ্গে আন্তরিকতা স্থাপন করতে পারেন তাহলেই একমাত্র সম্ভব সমাজদেহ থেকে অন্যায় বিদূরিত করা। অন্যদিকে বিভিন্ন স্তর পর্যন্ত তিন দলের জোট তৈরি করে দিয়ে যদি আর একটি ক্ষমতার অপব্যবহারকারী শ্রেণী তৈরি করা হয় তাহলে তা হবে আরও মারাত্মক। এক্ষেত্রে শুধু তিনটি দলের নেতার মাঝেই নয় সত্যিকারের প্রগতিশীল মানসিকতার যুব কর্মীদের মাঝে ও রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তুলে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। মনে রাখতে হবে শুধু প্রশাসনিক পদক্ষেপে নতুন সমাজ গড়া যায় না এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংগ্রাম।

যে কোনো মূল্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে

জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ না হলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। বাণিজ্য ও বৈদেশিক বাণিজ্য মন্ত্রী রাজশাহীতে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের প্রশিক্ষণ পাঠক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন। তিনি আরো বলেছেন জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ না করলে বাংলাদেশের অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে যাবে। আমরা জানি বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ দেশ গুলোর অন্যতম। শুধু তাই নয়, এদেশে জন্মের হার দিন দিন যেভাবে বেড়ে যাবার পথে তাতে ২০০০ সালেই বাংলাদেশের লোক সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা উক্তি করেছেন। অর্থাৎ আগামী ২৭ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৫ কোটির মত।
ক্ষুদ্রায়তনের আমাদের দেশ বর্তমানেই ‘কাম্য জনসংখ্যা’ ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। সুতরাং ভবিষ্যতের জন্য, এ দেশের উন্নতি ও জনগণের কল্যাণের জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে অবশ্যই রোধ করতে হবে। নইলে দেশের উন্নয়ন সম্ভব হবে না তেমনি দেশের উন্নয়ন না হলে জনগণের কল্যাণ হবে না।
আমরা জানি আমাদের দেশে জন্মের হার বৃদ্ধির পেছনে আবহাওয়া, জলবায়ু, অশিক্ষা, অল্প বয়সে বিবাহ প্রথা বেকারত্ব ইত্যাদি নানা জটিল সমস্যাবলি নিহিত। সুতরাং এসব সমস্যাগুলো দূরীকরণের জন্য যতদিন না কার্যকর ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে ততদিন পর্যন্ত কেবলমাত্র ডাক্তারি মতে ট্যাবলেট সেবন, কনডম ব্যবহার অথবা ‘লাইগেশন’ ইত্যাদি প্রক্রিয়ায় পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি সফল হবে না। কেননা সন্তান কামনা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ দুটো বিষয়ই মূলতঃ মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। সুতরাং মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞানের কষ্টিপাথর দিয়ে বাঞ্ছিত পরিবার গড়ে তুলবার পরীক্ষা চালাতে হবে। এবং সে জন্য সর্বোত্তম প্রয়োজন সবাইকে জ্ঞান দান করা। ছোট পরিবার গড়ে তোলার মধ্যেই নিহিত রয়েছে দাম্পত্য জীবনের চাওয়া পাওয়া এবং অপার শান্তি। সুতরাং বর্তমান বৈজ্ঞানিক যুগে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উদ্ভাবিত জন্মনিয়ন্ত্রণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান বিতরণের ব্যবস্থা করে জনগণকে অতীতের কুসংস্কারকে তাদের মন থেকে মুছে দিয়ে মুক্ত ও প্রগতিশীল গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। এ ব্যাপারে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মচারীদের দায়িত্বও অপরিসীম। আমাদের বিশ্বাস তারা তাদের দায়িত্ব পালনের সর্বদা ন্যায় ও নিষ্ঠার পরিচয় দেবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন