You dont have javascript enabled! Please enable it!

পঞ্চাশ দশকের শুরুতে শিক্ষা ও শিক্ষক
বদরুদ্দিন উমর | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ঈদসংখ্যা ১৯৮২ 

১। শিক্ষা সমস্যা
ব্রিটিশ আমলে পূর্ব বাঙলাসহ সারা ভারতবর্ষে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তাতে মেহনতী জনগণ, বিশেষত শ্রমিক-কৃষকের শিক্ষার কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসনে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বৃটিশ-ভারতীয় সরকার নিজেদের আমলে দেশে একটি মধ্য শ্রেণী সৃষ্টি করে সেই শ্রেণীকে নিজেদের ঔপনিবেশিক স্বার্থে নিয়োজিত রাখার উদ্দেশ্যে উনিশ শতকের গোড়া থেকেই এক নতুন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করে।১৯৪৭ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত সেই শিক্ষাব্যবস্থার ভারতবর্ষের অতি অল্প সংখ্যক মানুষ এই শিক্ষা লাভে সমর্থ হন এবং অশিক্ষিতের হার প্রকৃতপক্ষে ৯০ শতাংশেরও বেশি থাকে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন সাধনের কোন উদ্যোগ তো দেখাই যায় না, উপরন্তু ব্রিটিশ আমলের শিক্ষার মে কাঠামোটুকু ছিল সেটাও ন্যূনতম থেকে উচ্চতম পর্যায় পর্যন্ত সর্বস্তরেই ভেঙে পড়তে থাকে। এর ফলে মধ্যশ্রেণীবদ্ধ পরিবারের যেসব ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষার কিছু কিছু সুযোগ লাভ করেন তাঁদেরও শিক্ষার মান দ্রুতগতিতে নেমে যেতে থাকে। শুধু তাই নয়, তাঁদের সংখ্যাও বৃদ্ধির পরিবর্তে হ্রাস হয়ে চলে। স্কুল-কলেজ বন্ধ হতে থাকে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকরা ছাঁটাই হতে থাকেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও সংখ্যাও যোগ্যতার মান কমে আসে। এই পরিস্থিতিতে সারাদেশব্যাপী ছাত্র ও শিক্ষক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা ব্যাপক গভীর বিক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে এবং ছাত্র ও শিক্ষক আন্দোলনের মধ্যে তার অভিব্যক্তি ঘটে। পূর্ব বাঙলার শিক্ষিত সম্প্রদায় ও বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান অবনতিও ভেঙ্গে পড়তে থাকা অবস্থায় যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। শিক্ষা সমস্যার উপর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠান আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকেন। পত্রপত্রিকায়ও এ বিষয়ে কিছু কিছু লেখালেখি শুরু হয়।
২। শিক্ষা সম্মেলন আহবান ও তার প্রতি গণসমর্থন
১৯৫০ সালের ১৭ আগস্ট ঢাকায় একটি ছাত্র কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন ১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা শহরের নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন আহবানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১ শিক্ষা সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অলি আহাদ এবং সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিম্নলিখিত বিবৃতি দেনঃ
‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পর আজ চতুর্থ বৎসরের প্রারম্ভে দাঁড়াইয়া যেমন প্রতিটি মানুষের প্রশ্ন করিতেছে সামাজিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে জাতীয় অগ্রগতি কতটুকু আগাইয়া গেছে, তেমনি প্রতিটি ছাত্র, প্রতিটি শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীও আজ প্রশ্ন করিতেছে সংস্কৃতিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতীয় লক্ষ্য আজ কোন দিকে। যে শিক্ষা মানুষের সাধারণ বুদ্ধিশক্তি ও সর্বাঙ্গিন প্রতিভা বিকাশে আবহমানকাল ধরিয়া সাহায্য করিয়া আসিতেছে ও ভবিষ্যতেও যাহা কাজ করিয়া যাইবে তার ভবিষ্যৎ রূপ নির্ধারণ করিবার সুকঠিন দায়িত্ব আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে প্রতিটি মননশক্তির নিকট।
পূর্ববঙ্গে আজ শতকরা ৩০ ভাগ প্রাইমারি স্কুল উঠিয়া যাইতেছে, সরকারি অবহেলায় হাইস্কুলগুলির চরম ধ্বংস অনিবার্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে, কলেজগুলির স্বাভাবিক অবস্থা আজ আর নেই ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ইচ্ছাকৃত কার্পণ্যে যে অবস্থা দাঁড়াইয়াছে তা যে কোনো স্বাধীন (?) দেশের পক্ষে লজ্জাকর। অপরদিকে ছাত্রবেতন বৃদ্ধি করিয়া, পরীক্ষার ফি বাড়াইয়া ও আরবি হরফে বাংলা লেখার অপচেষ্টা করিয়া সরকার যে শিক্ষা সংস্কৃতির পরিচয় দিয়া যাইতেছে তা আরও ভয়াবহ।
এমনিভাবে যে বিবিধ শিক্ষা সমস্যা আসিয়া দাঁড়াইয়াছে আমাদের সামনে তার শুধু বিশ্লেষণ ও সঠিক সমাধানের পথ নির্ধারণ করা আজিকার দিনে ঐতিহাসিক কর্তব্য। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা আগামী সেপ্টেম্বরের (১৯৫০ সাল) ১৫ ও ১৬ ঢাকায় নিখিল পূর্ব-পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন আহ্বান করিয়াছি। সক্রিয় সমর্থন জানাইয়া এই সম্মেলনকে সার্থক করিবার জন্য আমরা দেশের প্রতিটি চিন্তাশীলের নিকট আহ্বান জানাইতেছি। আমরা বিভিন্ন জেলায় অবিলম্বে কর্মী পাঠাইতেছি। ১৭/১২ রেনকিন স্ট্রীট (মিনার অফিস) পোঃ অঃ ওয়ারী, ঢাকা এই ঠিকানায় সংযোগ স্থাপন করিবার জন্য অনুরোধ করিতেছি। ২’
ছাত্রদের দ্বারা আহুত এই শিক্ষা সম্মেলনের সমর্থনে ও তাকে সাফল্যমন্ডিত করার আহ্বান জানিয়ে ২৮ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম, সম্পাদক মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান সংবাদিক সমিতির সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী, কাজী মোঃ ইদ্রিস (ইনসাফ), সৈনিক সম্পাদক শাহেদ আলী ও সৈয়দ নুরুদ্দিন (পাকিস্তান অবজারভার) একটি বিবৃতিতে বলেন,
‘১৫ ও ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকাতে একটি নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠানের মে সিদ্ধান্ত ঢাকার ছাত্ররা গ্রহণ করেছেন তা সমালোচিত ও বিজ্ঞানোচিত হয়েছে এবং তার মাধ্যমে জাতীয় শিক্ষাকে অধিকতর অবনতির হাত থেকে রক্ষার জন্য সাধারণভাবে জনগণের ও বিশেষভাবে ছাত্রদের উদ্বেগই প্রতিফলিত হয়েছে। শীল সম্মেলনে বর্তমান শিক্ষা সংকটের যে বিশ্লেষণ সম্ভব হবে সেটাই হবে অন্য কোন পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্ববর্তী পদক্ষেপ। সেজন্য আমরা সর্বান্তঃকরণে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করছি এবং সম্মেলনের সংগঠকদের সক্রিয় সমর্থন দানের জন্য পূর্ববাঙলার সচেতন জনগনের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি। ৩’
এছাড়া আওয়ামী মুসলিম লীগের সহ সভাপতি আতাউর রহমান খান, পাকিস্তান ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি নুরুল হুদা; পোস্টও টেলিগ্রাফ ইউনিয়নের সভাপতি কমরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক এম, এন, এ, খয়রাত হোসেন এম; এন; এ; আনোয়ারা খাতুন এম, এন, এ; শামসুদ্দিন আহমদ এম, এন, এ, আলী আহমদ এম, এন, এ, নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার আলমাস আলী, পূর্ব পাকিস্তান বুকসেলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক মোঃ আবুল হোসেন ও পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সংক্রান্ত সম্মেলনকে সমর্থন দান করে একটি বিবৃতি দেন এবং তাকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য দান করতে জনসাধারণের কাছে আহ্বান জানান। ৪’
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ওদুদ ও হালিম, নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ আব্দুস সামাদ, পাকিস্তান ছাত্র এসোসিয়েশনের আমিনুল ইসলাম, ছাত্র ফেডারেশনের এ, জামান সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সহ-সভাপতি মুস্তফা নুরুল ইসলাম ও নারায়ণগঞ্জ মুসলিম কলেজ ইউনিয়নের মফিজউদ্দিন একটি যুক্ত বিবৃতিতে জনগন সাধারণ ছাত্রদের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন,
‘আমরা জনসাধারণ বিশেষ করে ছাত্র সমাজের প্রতি বিনীত আবেদন জানাইতেছি যে, ঢাকায় আসো নালিকুল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে আপনাদের প্রতিনিধি প্রেরণ করিয়া উক্ত সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করুন। এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে আমাদের আরজ, সম্মেলনের সর্বাঙ্গীন সাফল্যের জন্য সর্বপ্রকার আর্থিক সাহায্য প্রেরণ করুন। ৫’
জনগণ ও ছাত্র সাধারণের কাছে আর্থিক এবং অন্যান্য সাহায্য সহযোগিতার আবেদন জানিয়ে শিক্ষা সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতি এই সময় বেশ কয়েকটি ইশতেহার প্রকাশ করেন।
ছাত্রনেতাদের উপরোক্ত বিবৃতি থেকে সুস্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, এই পর্যায়ের শিক্ষা সংকট এমন একটা পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল এবং ছাত্রদের উপর নানান নির্যাতন এমন ভাবে জারি হয়েছিল যা ছাত্রেরা প্রায় সকলেই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন এবং তারই প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে শিক্ষা সম্মেলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। এ সম্পর্কে ঢাকা থেকে প্রেরিত নওবেলালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়ঃ
‘শিক্ষা জীবনের উপর সরকারি আঘাত যে আজ ছাত্রসমাজকে কত চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের নূতন রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে। পুরাতন সকল দলাদলি ভুলিয়া গিয়া নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ছাত্র এসোসিয়েশন, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন প্রভৃতি সব ছাত্র ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলিয়াছে শিক্ষা সংকোচন চলিবে না, এবং আগামী শিক্ষা সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করার কাজে মিলিতভাবে অগ্রসর হইতেছে।’৬
শিক্ষা সম্মেলন এর সমর্থনে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিলেটে ছাত্র-ছাত্রীদের একটি মিছিল বের হয়।৭ এরপরই নওবেলাল ‘শিক্ষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয়তে বলেন ,
‘শীঘ্রই ঢাকা মহানগরীতে পাকিস্তানের শিক্ষাবিদগণ একটি সম্মেলনে মিলিত হইয়া পাকিস্তানের শিক্ষার সমস্যা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করিবেন।…. এই সমস্যা শুধু বিদ্যার্থীদের সমস্যা নহে -এই সমস্যাটি দেশের প্রত্যেকটি নর-নারীর।…. আমরা মনে করি না দেশের এত বড় সমস্যা সমাধানের একমাত্র দায়িত্ব ছাত্রসমাজের। ছাত্রসমাজের অভিভাবকগণ আজও যদি নির্লিপ্ত হইয়া এই সমস্যাকে দূরে সরাইয়া রাখিতে চাহেন তবে তাহাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের পুনরায় মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক যুদ্ধের দিকে ঠেলিয়া দিবেন। শিক্ষার পরিধি আঞ্চলিক পরিধির ঊর্ধ্বে এখানে সাম্প্রদায়িক ছোঁয়া লাগিতে পারে না।’৮
সেপ্টেম্বরের শিক্ষা সম্মেলন উপলক্ষে এই সময় বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।’সরকারের শিক্ষাবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন’নামে এই ধরনের একটি প্রবন্ধে ৯ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রনেতা (ছাত্র ফেডারেশন) সৈয়দ মোহাম্মদ আলী বলেন,
‘গত তিন বছরের ছাত্র আন্দোলনের সাফল্য ও ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতেই আসন্ন শিক্ষা সম্মেলন এর গুরুত্ব বিচার করতে হবে। এই শিক্ষা সম্মেলনের প্রতি আমাদের সমর্থন জানিয়ে আমরা প্রথমে স্বীকার করে নিচ্ছি যে বর্তমান পরিস্থিতিতে নানা ধরনের খন্ড আন্দোলনের পরিকল্পনা ছেড়ে দিয়ে সরাসরি প্রদেশব্যাপী আন্দোলনের প্রস্তুতি চালাতে হবে। এই প্রস্তুতির জন্য আমাদের প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে প্রদেশব্যাপী সংগ্রামী ঐক্য। এই ঐক্যের জোরে আমরা শুধু সামগ্রিকভাবে আমাদের আন্দোলনকে জোরালো করে তুলব তা নয়, সঙ্গে সঙ্গে আলাদাভাবে বিভিন্ন দুর্বল ঘাঁটি কেউ কর্মচঞ্চল করে তুলতে পারব।
সর্বোপরি প্রদেশব্যাপী ঐক্য আন্দোলনের নেতৃত্বেকে কোন বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ছড়িয়ে দেব আন্দোলনের স্তরে স্তরে শহরে গ্রামে নগরে প্রান্তরে। দলীয় ও স্থানীয় স্বার্থ মিলেমিশে এক হয়ে যাবে সামগ্রিক ও সাধারণ স্বার্থে, জেগে উঠবে যা এতদিন আমরা গড়তে পারিনি , Basic Leadership-
শিক্ষা সম্মেলনের পরে প্রদেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য আমরা কোন পথ বেছে নেবো তা নির্ভর করছে সম্মেলনের প্রতিনিধিদের উপর, তবে যে পথে আমরা বেছে নেই না কেন সে পথে আপোস ও নিষ্ক্রিয়তার স্থান নেই। আর নেতৃত্ব সরাসরি থাকবে সে গণতান্ত্রিক ছাত্র সমাজের হাতেই, যারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের রক্ত রাঙা পথে এক সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলেছিল। গড়ে তুলেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক কর্মচারীর সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস।
আপোস নয়, আঘাত করব, নিষ্ক্রিয়তা নয়, এগিয়ে যাব আমাদের গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর যে হামলাই আসুক না কেন – আমরা সবাই মিলে আরও জোর গলায় আওয়াজ তুলবো -‘শিক্ষার প্রসার চাই, জাতীয় শিক্ষাকে রাষ্ট্রনায়কদের জুলুমবাজির হাত থেকে বাঁচাব।’
ঢাকাতে শিক্ষা সম্মেলন শুরু হওয়ার পূর্বে নওবেলাল ‘শিক্ষা- সংস্কার’ শীর্ষক আর একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন। তাতে শিক্ষার তৎকালীন অবস্থা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে পত্রিকাটি মন্তব্য করে,
‘প্রাক-আজাদী যুগে ইংরেজ শাসনের অমিলে যে বিদ্যায়তনগুলি দেশীয় আমলা প্রস্তুতির জন্য সৃষ্টি করা হইয়াছিল সেই পল্লী ও শহরের পর্ণকুটিরগুলো ঝড়ের মুখে উড়িয়া যাইতেছে। পল্লীর অসহায় প্রাথমিক শিক্ষক ও শহরের বিদ্যালয়গুলির শিক্ষকগণ ঝড়ের মুখে হাল ছাড়িতে বাধ্য হইতেছেন। পল্লীর শিক্ষায়তনগুলি আজ প্রেতপুরীতে পরিণত হইয়াছে। কঙ্কালসার শিক্ষকেরা ধীরে ধীরে তাদের জীবন শক্তি হারাইয়া ফেলিতেছেন। আগত সমাজের মানবগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া উঠিয়াছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চ বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষা সমস্যা জটিল আকার ধারণ করিয়াছে। বহু শিক্ষক শিক্ষা কেন্দ্র গুলি ছাড়িয়া অন্যত্র চলিয়া গিয়াছেন – তা পূরণের কোন সক্রিয় চেষ্টা শিক্ষা বিভাগে কর্তৃপক্ষের পক্ষ হইতে আজও হয়নি। আজ সরকারের শিক্ষা প্রসারের কোন পরিকল্পনা দেখা যাইতেছে না। যে সকল ব্যক্তির অতীত জীবনে কোন মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় নাই তাহারাই জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনার ভার লইয়াছেন। শিক্ষা জগতে যদি দেখা দেয় রাজনৈতিক শক্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতা তবে বাস্তবিক তাহা জাতীয় দুর্দিন বলিতে হইবে। পূর্ব বাংলার নিজস্ব ভাষা বাংলা ভাষার ওপর জোর করিয়া অপর এক ভাষা চাপিয়ে দিতে চাহিতেছেন এবং সেই উদ্দেশ্যেই নির্লজ্জভাবে গভীর ষড়যন্ত্র করিতে দ্বিধাবোধ করিতেছেন না। বাঙালির বহুযুগের নিজস্ব সত্তার ভিত্তিতে যে বাংলা ভাষা গড়ে উঠিয়াছিল – যে ভাষার বৈভব পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা বলে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে – যে ভাষা আমাদের শিক্ষার বাহন হইবে তাহাকে সমুদ্রের অতল গর্ভে নিমজ্জিত করিবার জন্য নানাবিধ প্রচেষ্টা চলিতেছে। আমাদের রাষ্ট্রপরিচালকগণ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে মুখ্য স্থান না দিয়া দেশরক্ষার অজুহাতে বিদ্যাকেন্দ্রগুলি হুকুমদখল করিতে দ্বিধাবোধ করিতেছেন না।’১০
৩। নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলন
নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৫০ তারিখে বেলা ১ টায় ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে।১ পূর্ব বাংলার সমস্ত এলাকা থেকে প্রায় ২৫০ জন ছাত্র প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেন। এছাড়া ঢাকার শিক্ষা কেন্দ্র গুলির বহুসংখ্যক ছাত্রও এই প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত থাকেন।
অধিবেশনের প্রথমে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অলি আহাদ শিক্ষা সমস্যার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে একটি সুদীর্ঘ অভিভাষণ পাঠ করেন।২ জাতীয় শিক্ষা সম্পর্কে সাধারণভাবে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঠিক পরবর্তী পর্যায়ের অবস্থা সম্পর্কে বলেন,
‘জাতীয় শিক্ষার গোড়ায় সুপরিকল্পিত হামলার অধ্যায় শুরু হলো, শুরু হলো নয়া রাষ্ট্রের পত্তনের নামের শিক্ষার খরচ কমানো। শুরু হলো সরকারি অফিস ও উর্দ্ধতন অফিসারদের জন্য স্কুল-কলেজ বিল্ডিং রিকুইজিশন। শুরু হলো এক এক করে বা সাময়িকভাবে স্কুল-কলেজের দ্বার বন্ধ করা।……..
সরকারি স্কুল কলেজগুলির সংস্কারের প্রশ্ন তুলতেই সরকার তা ধামাচাপা দিতে একটি বড় ওজর তুলেছে -‘ শিক্ষক পাওয়া যায় না।’কিন্তু সঠিক খবর নিলে জানা যাবে যে, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল, কলেজগুলি থেকে এলাউন্স কেটে নেওয়া নিয়ম মোতাবেক বর্ধিত বেতন মঞ্জুর না করা ইত্যাদি পরোক্ষ শিক্ষক ছাঁটাই নীতির চাপে, এমনকি সরাসরি চাকরিতে জবাব পেয়ে বেকারত্ব বরণ করেছেন এমন শিক্ষকের সংখ্যা নগন্য নয়। সরকারি স্কুল কলেজগুলিতে অনেক অভিজ্ঞ শিক্ষককেও যতদিন খুশি অস্থায়ী পদবাচ্য করে রাখা হয়েছে এবং হচ্ছে। অনেক সময় তিন চার মাস ধরে গরিব শিক্ষকদের মাইনে বাকি ফেলে রাখা হয়েছে। এই অবহেলার দরুন সর্বত্র সরকারি বেসরকারি স্কুল কলেজ গুলো ভেঙে পড়তে লাগলো, হিন্দু শিক্ষকগণ অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেন।’
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর সরকারি আক্রমণ সম্পর্কে অলি আহাদ তাঁর অভিভাষণে বলেন,
‘এদেশের গণশিক্ষা ও জাতীয় স্বার্থের আন্দোলনের মহীরুহ সমূলে উৎপাটনের অভিসন্ধি নিয়ে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে মুছে ফেলার চক্রান্ত আঁটা হলো। তারই প্রথম ধাপ হিসেবে আক্রমণ এল বাংলা ভাষার উপর। চক্রান্ত করা হলো ভবিষ্যতের বাঙালিকে মূক করে দেবার – যাতে সে মুখ ফুটে শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে না পারে, যাতে সে ভুলে যায় তাঁর জাতীয় ও সামাজিক অস্তিত্বের মর্যাদা, ভুলে যায় তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার।
অনেক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী পূর্ব বাংলার বলিষ্ঠ ছাত্রসমাজ এ আক্রমণ চোখ বুঁজে বরদাশত করবে না। যে ভাষা এ দেশের লোকের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাব ও ভাবনার ঐতিহাসিক পরিণীতি ও ঐতিহ্যকে বহন করছে, যে ভাষায় বাংলার প্রতিটি শিশুর প্রথম বুলি ও প্রথম পাঠ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে, সরকারি ভাষা হিসেবে ‘আজাদ বাংলা’ কেন তাকে পাবে না? চারদিকে আওয়াজ উঠল -‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।’ মিছিলের মুখে তথাকথিত গদিনশীন নেতাদের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার জবাবদিহি তলব করা হলো। সমগ্রহ দেশজুড়ে পূর্ববাংলার বৃহত্তম ছাত্র ও গণ-আন্দোলন গড়ে উঠলো।
শিক্ষা সম্মেলনের পটভূমি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে একটি বিশেষ গোপনীয় সরকারি সার্কুলারের উল্লেখ করে অলি আহাদ বলেন,
‘স্পষ্টতই এই কালা নির্দেশের ভিত্তিতে ছাত্রদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা সরকার ও শিক্ষা বিভাগের কর্তৃপক্ষ যথেচ্ছ চালিয়ে যেতে কসুর করেননি। শিক্ষকদের স্বাধীন গতিবিধির তো প্রশ্নই ওঠে না, কেউ তার ন্যায় সঙ্গত দাবীর করলে তাকে রাষ্ট্রের শত্রু, ইসলামের শত্রু দমন নীতির প্রকোপে ফেলে দেওয়া হয়। এই কালাকানুনের প্রকাশ্য ও গোপন প্রকোপে জরিমানা, বহিষ্কার ও গ্রেপ্তারের ঝড় বয়ে গেছে ছাত্র সমাজের বুকের উপর দিয়ে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বগুড়ার অধ্যাপক গোলাম রছূল সাহেব, গাইবান্ধা ও নড়াইলের কয়েকজন শিক্ষকের বহিষ্কার; মেডিকেল কলেজের ছাত্র বহিষ্কার, বিশিষ্ট ছাত্র কর্মীর কারাবাসের ইতিহাস কারো অজানা নাই। এছাড়া কথায় কথায় স্কুল- কলেজে পুলিশ পিকেট বসিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কয়েদখানায় পরিণত করা হয়েছে। তবু ছাত্র আন্দোলন দমনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলো ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলন দমন নীতি ও ছাত্র বহিষ্কারের বিরুদ্ধে। তারপরে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে। তারপরে বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে নয়া চক্রান্ত পাকানো হল আরবি – হরফে বাংলা লেখার চক্রান্ত।[পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতির প্রথম খন্ড দ্রষ্টব্য।] ঢাকা ও মফস্বল ছাত্রদের ধ্বনি চক্রান্তকারীদের হকচকিয়ে দিয়েছিল। তারপর এল সর্বশেষ ব্যাপক আক্রমণ স্কুলে-কলেজে বেতন বৃদ্ধি। এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নেতৃত্বে প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে আজ আমরা শিক্ষা সম্মেলনের দ্বারে এসে পৌঁছেছি।’
সরকারি প্রয়োজনে পূর্ববাংলা সরকার স্কুল-কলেজের বাড়িঘর দখল করে শিক্ষাক্ষেত্রে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল সে বিষয়ে অলি আহাদ বলেন,
‘একমাত্র ঢাকাতেইঃ ইডেন কলেজ -এখন সেক্রেটারিয়েট, কলেজিয়েট স্কুল -স্টেট ব্যাংক, জগন্নাথ হল -অ্যাসেম্বলি হাউস; ইডেন গার্লস স্কুল অফ স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া নবকুমার হাইস্কুল, নারী শিক্ষা মন্দির, প্রিয়নাথ হাই স্কুল; সলিমুল্লাহ কলেজ, আরমানিটোলা গার্লস স্কুল ও জগন্নাথ কলেজ অনেক পরে রিকুইজিশন করে মাসাধিককাল রাখা হয়।
সিলেটের সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা, মুরারিচাঁদ কলেজ হোস্টেল এবং আরো কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হুকুম দখল করা হয়। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও অন্যান্য জেলাতেও নির্বিচারে অনুরূপ হুকুম দখলের বিরুদ্ধে ছাত্র প্রতিরোধের নজির হিসাবে অল্পদিন পূর্বে সিলেটের ছাত্র-ছাত্রীর সার্থক হুকুম দখল প্রতিবাদ ও মেয়ে কলেজ আন্দোলন, ঢাকা কামরুন্নেসা স্কুলের ছাত্রীদের আন্দোলন ও কুষ্টিয়ায় হোস্টেল আন্দোলনের উল্লেখ করা যেতে পারে। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল এবং ময়মনসিংহের ভটপুরা ও অন্যান্য কয়েকটি বিদ্যালয় আজও মিলিটারির কবলে। এমনি করেই মিলিটারির খাতিরে শিক্ষাকে বলি দেওয়া হচ্ছে।
কতকগুলো ভাঙাচোরা বাড়িতে ঢাকা কলেজের প্রাণপ্রদীপ মিটিমিট করে জ্বলছে। গত ৪৮ সনের নভেম্বরে উক্ত কলেজের ছাত্রদের অনশন ধর্মঘটে প্রবল আন্দোলনের [পূর্ব বাঙালির ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি প্রথম খন্ড দ্রষ্টব্য।] চাপে সরকার অবিলম্বে উপযুক্ত স্থানে স্থানান্তরিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। আর স্কুলের ছাত্ররা স্কুল বিল্ডিং-এর সংস্কার বা স্থান পরিবর্তনের জন্য বহুদিন ধরে আবেদন নিবেদন করে আসছে । প্রতুত্তরে এসব প্রশ্ন তো ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছেই উপরন্তু ইস্পাহানীর জন্য ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুল বিল্ডিং হুকুম দখলের নির্লজ্জ প্রস্তাব তোলা হচ্ছে।’
এরপর অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতির অভিভাষণে অলি আহাদ প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষকদের অবস্থার কিছুটা বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে তাদের উপর বিভিন্ন রকমের সরকারি হামলা ও তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি উল্লেখ করেন। [বিস্তারিত বিবরণের জন্য বইয়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।] এছাড়া কারিগরি শিক্ষা ও মেডিকেল স্কুল-কলেজের অবস্থা সম্পর্কেও এই ভাষণে বর্ণনা করা হয়। [এ বইয়ের চতুর্থ পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।] মোহাজের ছাত্রদের সমস্যা। নারী শিক্ষার সমস্যা, ছাত্রাবাস সমস্যা, বেতন বৃদ্ধি, সরকারি দমননীতি ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনার পর অলি আহাদ পূর্ববাংলায় ‘শিক্ষাকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র’ সম্পর্কে নিম্নলিখিত বক্তব্য পেশ করে তার ভাষণ শেষ করেন,
‘বাংলা ভাষা বিরোধী চক্রান্ত আজ চারিদিক থেকে পাকিয়ে তোলা হয়েছে। ১ নম্বর -ঢাকা রেডিও ও ‘মাহে নও’-এর মারফত মিজানুর রহমান পরিকল্পিত উর্দু মিশ্রিত এক বিকৃত বাংলার প্রচলন। এ এক অভিনব ফন্দি, বাঙালির কৃষ্টি, বাঙালি রুচিবোধকে পিষে মারতে ভাষার ওপর ছুরি চালানোর এ এক জঘন্য অত্যাচারের অস্ত্র। ২ নম্বর -আরবি হরফের বাংলা লেখার ষড়যন্ত্র। বাংলা ভাষার অস্তিত্বের গোঁড়াটিতে আঘাত হানতে সরকার অবিচলভাবে সুনির্দিষ্ট পথে এই ঘৃণ্য পরিকল্পনা কার্যকরী করার দিকে এগিয়ে চলছে। জনসাধারণের টাকা এভাবে অপব্যয় করে খরচা যোগান হচ্ছে আরবি হরফ লেখার ১৭ টি পরীক্ষামূলক কেন্দ্রের। বিশেষজ্ঞ কমিটি ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত বাংলাদেশে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অবিলম্বে চালু করার যে সুপারিশ দাখিল করেছিল তাও কেন্দ্র থেকে নাকচ করে দেয়া হয়েছে।
প্রাদেশিক সরকারের বাজেটের চেহারা দেখলে এই আক্রমণের অর্থ আরো পরিষ্কার হয়ে যায়। বাজেটের শতকরা মাত্র ৫.২৬ ভাগ দেয়া হয়েছে শিক্ষাখাতে আর মিলিটারি পুলিশ খাতে গিয়েছে ৭২ ভাগ।
এই বিভিন্নমুখী আক্রমণ ব্যর্থ করে শিক্ষা ও জাতীয় স্বার্থকে রক্ষা করতে হলে আমাদের গড়ে তুলতে হবে ছাত্র ঐক্য এবং ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সকল দেশ প্রেমিক জনসাধারণের সম্মিলিত জাতীয় প্রতিরোধ দুর্গ।’
নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু সংখ্যক সদস্য সরকারি এজেন্ট হিসেবে প্রথম থেকেই শিক্ষা সম্মেলন এর বিরোধিতা করে আসছিলো। অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি অলি আহাদ বক্তৃতার পর আবু হেনা ও আহসানুল্লাহ নেতৃত্বে সম্মেলনকক্ষে গণ্ডগোলের সূত্রপাত করে।৩ গোলযোগকারীরা সভাপতি টেবিলের উপর উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে থাকে কিন্তু দারুণ গোলমালের ফলে তাদের কোন বক্তব্য উপস্থিত কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়না। এই গন্ডগোলের ফলে সভাপতির অভিভাষণের পর সম্মেলনের কাজ চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং অধিবেশন তখনকার মতো ভেঙে দেওয়া হয়।৪ সন্ধ্যার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল মিলনায়তনে সম্মেলনের কাজ আবার শুরু হয়। ৫
পরদিন শনিবার ১৬সেপ্টেম্বর সকাল ৮-৩০ মিনিটে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন ফজলুল হক হল মিলনায়তনে যথারীতি শুরু হয়। পূর্ব দিন সন্ধ্যায় এবং এদিনের অধিবেশনে প্রতিটি জেলার ছাত্র প্রতিনিধিরা নিজ নিজ জেলার শিক্ষা সম্পাদকীয় রিপোর্ট পেশ করেন। এই ছাত্র প্রতিনিধিদের একজন তার রিপোর্টে প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থান বর্ণনা প্রসঙ্গে নিম্নলিখিত ঘটনাটি উল্লেখ করেন,
রিলিফ কাজের জন্য আমাকে একবার ….পুকুর (বগুড়া) যেতে হয়েছিল। সেখানে ঘটনাক্রমে এক প্রাইমারি শিক্ষকের সঙ্গে পরিচিত হই। যখন তাকে দেখি তখন বেলা বারোটা। স্কুলের সময়, অথচ তাকে খেতে লাঙ্গল ঠেলতে দেখে আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলামঃ
আপনার স্কুল নেই?
ঃ আছে।
ঃ তবে এখানে কেন?
ভদ্রলোক তার চাষ রেখে অনেক কিছুই বলে গেলেন। তিনি বললেন ত্যরো টাকা মাইনে, পাও পাইনি আজ নয় মাস। উপায় কি?
আশ্চর্যের বিষয় তাঁর পরনে ছিল পাতলা ছেরা গামছা আর দেহ নগ্ন । মনে রাখতে হবে তিনি স্বাধীন রাষ্ট্রের একজন শিক্ষক এবং ভদ্রলোক।
জিজ্ঞেস করলামঃ ইস্কুল কখন করেন?
স্কুল ?
তাঁর ভুরু কুঁচকে গেল।
ঃ সে ত কবে ফক্কা। ছাত্ররা তো বোনারপাড়ায় কুলিগিরি করে। কেউবা হয়েছে ছিঁচকে চোর।৬
বিভিন্ন জেলার ছাত্র প্রতিনিধিরা রিপোর্ট প্রদান প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন কীভাবে কর্তৃপক্ষের অবহেলা, দলাদলি ও সুপারিশ পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের হামলায় শিক্ষার দ্রুত অবনতি হয়েছে এবং ছাত্র-শিক্ষক সম্প্রদায় নিপীড়িত হয়েছেন। সরকারি দমননীতির কবলে পড়ে সংগ্রামী ছাত্র নেতৃবৃন্দের কারাবরণ, নিজ নিজ এলাকা থেকে বহিষ্কার, স্কুল-কলেজ উঠে যাওয়া, ছাত্র-শিক্ষক সংখ্যা হ্রাস ইত্যাদি সম্পর্কিত যে সমস্ত ঘটনা রিপোর্ট গুলোতে উল্লেখ করা হয় তার ফলে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো ভেঙে পড়ার ব্যাপারটি খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।(অস্পষ্ট)…. সংকোচন নীতিরও তীব্র সমালোচনা করা হয়।৭
১৬ তারিখের অধিবেশন পাঁচ ঘন্টাকাল চলার পর একটি মূল প্রস্তাব এবং কতগুলি দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে একটি দীর্ঘ প্রস্তাব পাস করেন। এই সমস্ত দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য দেশব্যাপী ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য সম্মেলনে ছাত্র প্রতিনিধিদেরকে নিয়ে ‘গণশিক্ষা পরিষদ’ নামে একটি পরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের সেক্রেটারিয়েট ‘ঢাকায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ৯ জন সদস্য বিশিষ্ট সেক্রেটারিয়েটের কনভেনার নির্বাচিত হন আব্দুল ওয়াদুদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতনবৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য শিক্ষা পরিষদকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদের সহযোগিতায় কাজ করতে অনুরোধ জানানো হয়।৮
১৬ সেপ্টেম্বর সম্মেলনের সর্বসম্মতিক্রমে যে মূল প্রস্তাবটির গৃহীত হয় তা হল এইঃ
‘সর্বপ্রথমেই সম্মেলন গত তিন বছর ব্যাপী ছাত্রসমাজ শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করিয়াছে সেই জন্য ছাত্রসমাজকে অভিনন্দন জানাইতেছে।
গয়াআগয় ঢগ্ট্আগঠিয়া যাইতেছে। যে অল্প সংখ্যক যুবক ডিগ্রি লইয়া বাহির হইতেছে তাদের সম্মুখে বেকারী অভাব-অনটনের এক মর্মন্তুদ ভবিষ্যৎ ছাড়া আর কিছু নাই। দেখা যায় যে সরকারি হিসাবে ১৯৫০ সালে মাত্র ফেব্রুয়ারি মাসেই Pakistan Employment Exchange-এ ১৬,৮১১ জন ও নারায়ণগঞ্জ Eployment Exchange-এ উক্ত সনের শুধু মার্চ মাসেই ৫,৪৬১ জন বেকারের নাম রেজিস্ট্রি করা হয়। সম্মেলন মনে করে যে বেতন ও আনুষঙ্গিক শিক্ষার ব্যয় বৃদ্ধি, শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কমাইবার একটা সুস্পষ্ট পরিকল্পনা।
তাই এই ধরনের চরম আর্থিক সংকটের সময় কর্তৃপক্ষ সারা প্রদেশের স্কুল-কলেজের যে শতকরা ২৫ ভাগ বেতন বৃদ্ধির নির্দেশ দিয়েছে এই সম্মেলন তার প্রতিবাদ ও প্রত্যাহারের দাবি জানাইতেছে। পরীক্ষার ফিস, সিট ভাড়া বাড়ানো হইয়াছে। ইহার পরিষ্কার অর্থ আরো হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে শিক্ষার দুয়ার চিরতরে বন্ধ করিয়া দেওয়া।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্বে দেশের ছাত্র সমাজ শিক্ষা,স্বাস্থ্যে উন্নততর বলিষ্ঠ জীবনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল তাহা আজ ভাঙিয়া টুকরা টুকরা হইয়া গিয়াছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে লীগ নেতারা যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সে সমস্ত প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রক্ষা করেন নাই।
সম্মেলন লক্ষ্য করেছে যে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট হইতে আজ পর্যন্ত এই তিন বৎসরে শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবল ভাঙন আসিয়াছে। বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা তো দূরের কথা ১৯৪৮ সালে শতকরা ৪০ -৫০ ভাগ প্রাথমিক স্কুল তুলিয়া দেওয়া হইয়াছে। বহু শিক্ষায়তন সরকারি অফিস এবং বড় বড় আমলার বাসভবনে রূপান্তরিত হয়। ইহা হইতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, আপামর দেশবাসীকে শিক্ষার আলো হইতে দূরে রাখিয়া স্বীয় শোষণ ও শাসনযন্ত্রকে চালু রাখার জন্য কেবল মুষ্টিমেয় সৌভাগ্যবানদের শিক্ষিত করে তোলার যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষানীতি, গত তিন বছর সরকার সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষানীতিই অনুসরণ করিয়া আসিতেছে। শুধু তাই নয়। ব্রিটিশ আমলে লড়াই করিয়া দেশবাসীর শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতির জন্য যে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা অর্জন করিয়াছিল সরকার উহাও একটার পর একটা করিয়া কাঁড়িয়া লইতেছে। মুখে ইসলামী শিক্ষার বুলি আওড়াইয়া সরকার শিক্ষা সংকোচ নীতি অনুসরণ করিতেছে।
সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে যে পুরাতন সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করইতেছে গত কেন্দ্রীয় বাজেটের দিকে তাকালেই তাহা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এই বাজেটে ৭৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হইয়াছে মিলিটারি, পুলিশ, জেল ইত্যাদি বিভাগে। আর শিক্ষা বিভাগের বরাদ্দ ২০ লক্ষ টাকা।
সম্মেলন এই পুলিশি বাজেটের নিন্দা করিতেছে এবং দাবি করিতেছে যে আই, বি, ও পুলিশ খাতে টাকা কামাইয়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্য বিভাগের বরাদ্দ বাড়ানো হউক।
সম্মেলন মনে করে যে, শিক্ষাক্ষেত্রে আক্রমণের আরেকদিক হইল যে শিক্ষকদের ভদ্রভাবে বাঁচিবার মতো বেতন দিতে অস্বীকার করা। সম্মেলন দাবি করেছে যে শিক্ষকদের সকল দাবি মানিয়া লওয়া হউক। সম্মেলন দাবি করিতেছে যে, বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ করিয়া বিদেশি পুঁজি বাজেয়াপ্ত করিয়া শিক্ষা, শিল্প ও স্বাস্থ্যের খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করা হউক। সমস্ত প্রাথমিক স্কুল চালু করা হউক। কারিগরি শিক্ষার প্রসারের জন্য সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হউক।
সম্মেলন মোহাজের ছাত্রদের অভাব-অভিযোগের প্রতি সরকারের উপেক্ষার তীব্র নিন্দা করিতেছে। এবং দাবি করিতেছে মোহাজের ছাত্রদের পুনর্বাসিত ও শিক্ষার সুযোগ দিতে অবিলম্বে উপযুক্ত বন্দোবস্ত করিতে হইবে। সম্মেলন সরকার কর্তৃক নারীশিক্ষার অবরোধের নিন্দা করিতেছে এবং নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহণের দাবি জানাইতেছে।
এই সম্মেলন দাবি করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে কেন্দ্রের অন্যতম ভাষা হিসাবে স্বীকার করা হউক, পূর্ববাংলার আইন-আদালতে একমাত্র ভাষা হিসেবে কার্যে পরিণত করা হউক, আরবি হরফে বাংলা লেখা ও উর্দু বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক। ৯
এই মুল প্রস্তাবটির ছাড়াও সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত ১৬ টি দফা সম্বলিত নিম্নলিখিত দাবিনামা সরকারের কাছে পেশ করা হয়ঃ
১। পুলিশ, আই,বি, ইত্যাদি খাতে টাকা কমাইয়া মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ভাত কমাইয়া শিক্ষা খাতে টাকা বাড়ানো। অবিলম্বে বিনা খেসারতে জমিদারি উচ্ছেদ করিয়া, প্রকৃত চাষিদের মধ্যে জমি বন্টন করিয়া, অতিরিক্ত মুনাফা কর ( E.P.T) ও ব্যবসার কর (B.P.T) বসাইয়া ঐ সকল অর্থ শিক্ষার কাজে লাগাইতে হইবে।
২। (ক) বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য সরকারি বেসরকারি স্কুল-কলেজের ঘাটতি বাজেটের সম্পূর্ণ পূরণ এবং উহাদের সংস্কারের জন্য সরকারি অর্থ সাহায্য মঞ্জুর করিয়া একদিকে ছাত্রদের বেতনের হার কমাইতে হইবে, অন্যদিকে শিক্ষকদের মাহিনা বৃদ্ধি করিতে হইবে।
(খ) স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দের বেতন বৃদ্ধি নোটিশ প্রত্যাহার করিতে হইবে উপরন্তু পূর্বতন হারেরও ২৫% বেতন হ্রাস করিতে হইবে।
৩। (ক) অবিলম্বে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করিতে হইবে এবং প্রাথমিক শিক্ষকগণের সম্মানজনকভাবে বেতন ভাতা দিতে হইবে। উঠিয়ে দেওয়া প্রাইমারি স্কুলগুলি পুনরায় চালু করিতে হইবে।
(খ) একজন প্রাথমিক শিক্ষকের নিম্নতম বেতনের হার মাসিক ৫০-৬০ টাকার কম হইলে চলিবে না।
(গ) প্রতিটি শহরের মহল্লায় মহল্লায় এবং প্রতিটি গ্রামে প্রাপ্তবয়স্কদের নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য নৈশ বিদ্যালয় স্থাপনের স্বল্পমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হইবে।
৪। (ক) মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সংস্কার করিয়া গণতান্ত্রিক উপায়ে পুনর্গঠন করিতে হইবে।
(খ) মাধ্যমিক শিক্ষকদের নিম্নতম বেতনের হার ১৫০ টাকার কম হইলে চলিবে না এবং সরকারি ভাতার পরিমাণ ২৫% বাড়াইয়া জীবনযাত্রার মানের সহিত সমতা রক্ষা করিতে হইবে।
(গ) চারিটি ভাষা শিক্ষার দুঃসাধ্য বোঝা চাপানো বোর্ডের বিবেচনায়শূন্য কারিকুলাম ও সিলেবাসের সংশোধন করিতে হইবে -বিশেষতঃ উর্দুকে স্কুলের ছাত্রদের জন্য বাধ্যতামূলক করা চলিবে না।
৫। (ক) মফস্বল কলেজগুলিতে দুই বৎসরের অনার্স কোর্স খুলিতে হইবে।
(খ) সমস্ত স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরির পরিবর্ধন ও সমৃদ্ধির জন্য বিশেষ অর্থ মঞ্জুর করিতে হইবে।
(গ) বেসরকারি কলেজগুলির অধ্যাপকদের নিম্নতম প্রাথমিক মাহিনার হার ৩০০ টাকার কম হইলে চলিবে না।
(ঘ) অবিলম্বে সরকারি-বেসরকারি কলেজগুলিতে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে উপযুক্ত স্টাফ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য সরকারকে বিশেষ সাহায্য (আর্থিক ও পরিচালনা মূলক উভয় প্রকার) ও অতিরিক্ত শিক্ষা ভাতা মঞ্জুর করিতে হইবে।
(ঙ) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের সংস্কারের জন্য ছাত্র-ছাত্রীগণ যে সকল দাবী করিয়াছে তাহা মানিতে হইবে। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুরূপ দাবিও মানিতে হইবে।
৬। কারিগরি শিক্ষার বহুল প্রচারের জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা তৈয়ার করিয়া অবিলম্বে চালু করিতে হইবে।
(ক) মেডিকেল স্কুল গুলিকে কলেজে পরিণত করিতে হইবে এবং অটোমেশনের অবসান ও কারিকুলামের সংস্কার করিতে হইবে।
(খ) ঢাকার এম,বি, ডিগ্রী এবং বেসরকারি মেডিকেল স্কুলগুলির ডিগ্রীর সরকারি অনুমোদন চাই।
(গ) কনডেন্সড এম,বি, ও বি;ই; কোর্স যথাক্রমে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলগুলিতে প্রবর্তন করিতে হইবে।
(ঘ) ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ-এর যথোপযুক্ত সংস্কার ও সরঞ্জাম চাই। এই জন্য যথোপযুক্ত টাকা মঞ্জুরী ও সেই টাকা সদ্ব্যবহার হইতেছে কিনা তাহার নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের বন্দোবস্ত করিতে হইবে।
(ঙ) সপ্তম মান হইতেই বিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভোকেশনাল কারিগরি শিক্ষার সুযোগ দিতে হইবে। প্রভৃতি অনুসারে (aptitude) শিক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হউক।
৭। অবিলম্বে নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য আগামী বছরের মধ্যে –
(ক) প্রত্যেক শহরে বালিকা বিদ্যালয় ও তৎসংলগ্ন মেয়ে হোস্টেল স্থাপন করিতে হইবে।
(খ) প্রত্যেক শহরে বিজ্ঞান বিভাগ সমন্বিত আবাসিক মহিলা কলেজ খুলিতে হইবে। গ্রামাঞ্চলেও নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার করিতে হইবে।
৮। মোহাজের ছাত্রদের শিক্ষার সকল সুযোগ দানের জন্য –
(ক) গণতান্ত্রিক উপায়ে গঠিত একটি নির্ভরযোগ্য বোর্ডের সাহায্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়া অবিলম্বে কাজ শুরু করিয়া দিতে হইবে।
(খ) উক্ত পরিকল্পনার কাজে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা মঞ্জুর করিতে হইবে -এবং উক্ত অর্থের সদ্ব্যবহার ব্যবহার হইতেছে কিনা তা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
(গ) পরীক্ষার্থী মোসাদের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ফি মওকুফ বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং যাহারা সার্টিফিকেট লইয়া আসিতে পারে নাই তাহাদের পরীক্ষার সাময়িক অনুমতি দিতে হইবে।
৯। অবিলম্বে ছাত্রাবাস সমস্যার প্রতিকারার্থে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা মঞ্জুর করিতে হইবে।
১০। হুকুম দখলকৃত সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ছাত্রাবাসগুলির দখল আদেশ প্রত্যাহার করিতে হইবে এবং অবিলম্বে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হইবে।
১১।(ক) বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হউক।
(খ) বাংলা ভাষা আন্দোলনের জনতার মিছিলের মুখে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি অবিলম্বে পরিপূর্ণ করিতে হইবে এবং কেন তাহা এতদিনেও পালন করা হইল না তাহার কৈফিয়ৎ দিতে হইবে।
(গ) শিক্ষার অন্যতম মান পর্যন্ত মাধ্যম হিসেবে বাংলাকে চালু করার আইন অবিলম্বে কার্যকরী করিতে হইবে।
(ঘ) আরবি হরফে বাংলা লেখার ১৭ টি পরীক্ষামূলক কেন্দ্র অবিলম্বে তুলিয়া দিতে হইবে এবং ঐ ধরনের কোন প্রকার সরকারি প্রচেষ্টা করা চলিবে না।
(ঙ) পাকিস্তান রেডিয়োর উর্দু মিশ্রিত বিকৃত বাংলার প্রচার অবিলম্বে বন্ধ করিতে হইবে। পাক রেডিয়ো প্রোগ্রাম-এর শতকরা ৭৫ ভাগ বাংলা থাকিতে হইবে। বাংলার খ্যাতনামা যে সকল ব্যক্তিকে ঢাকা রেডিয়ো হইতে বহিষ্কার করা হইয়াছে তাহার কৈফিয়ৎ দিতে হইবে ও অবিলম্বে তাহাদিগকে ফিরাইয়া আনিতে হইবে।
১২। (ক) ছাত্রদের ন্যায্য অধিকারের জন্য সংগ্রামের যোগদান করায় এ পর্যন্ত যতজনের উপরে শাস্তিমুলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইয়াছে তাহাদের সকলের উপর হইতে বহিষ্কার আদেশ ও অন্যান্য শাস্তিমুলক ব্যবস্থা বিনাশর্তে অবিলম্বে প্রত্যাহার করিতে হইবে।
(খ) স্কুল কলেজ মিটিং ইত্যাদির গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হইবে এবং কোন কারণেই স্কুল-কলেজে পুলিশের হস্তক্ষেপ চলিবে না।
(গ) সমস্ত ছাত্র বন্ধুদের অবিলম্বে মুক্তি অথবা প্রকাশ্য আদালতে বিচার দিতে হইবে।
১৩। জাতিসংঘের ‘মানবিক অধিকার বিলের’সর্বস্বীকৃত আদর্শের খাতিরেও শিশুশ্রম (চাইল্ড লেবার) রদ করার এবং ছাত্র ও যুবসমাজের স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য অবিলম্বে একটি স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করিতে হইবে।
১৪। (ক) পূর্ব পাকিস্তানে একটি সামরিক শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার করিতে হইবে।
(খ) সার্বজনীন সামরিক শিক্ষার্থে অবিলম্বে বিভিন্ন শিক্ষায়তনে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার বন্দোবস্ত করিতে হইবে।
১৫। সরকারি নীতির ফলে উদ্ভূত শিক্ষা সংকটের কারণ ও গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উপায় নির্ধারণের জন্য ছাত্র প্রতিনিধি-সংবলিত বেসরকারি কমিটি নিয়োগ করিতে হইবে।
১৬। পূর্ববঙ্গ সরকারের চিপ সেক্রেটারি সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ও শিক্ষকদের উপর দমননীতি চালাইবার জন্য যে গোপন সার্কুলার (Memo no 300 G A C) দিয়েছেন অবিলম্বে প্রত্যাহার করিতে হইবে।১০
নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনের মূল প্রস্তাবও দাবিসমূহ বিস্তারিতভাবে উপরে উদ্ধৃত হলো তার থেকে শুধু যে ছাত্রদের কতগুলি দাবি-দাওয়ারই বিবরণ পাওয়া যায় তাই নয়। এই প্রস্তাব ও দাবী নামার মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের শিক্ষাব্যবস্থা তার সাথে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়েরও পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে আরো লক্ষনীয় বিষয় এই যে, ছাত্রদের দ্বারা আহুত ও সংগঠিত শিক্ষা সম্মেলনে ছাত্রেরা নিজেদেরকে সমাজের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে না দেখে নিজেদের সমস্যাসমূহ তৎকালীন সামগ্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিচার করেছেন এবং তার সমাধানের পথ নির্দেশ করতে চেষ্টা করেছেন। ভূমি ব্যবস্থার পরিবর্তন, শিক্ষকদের জীবিকার সন্তোষজনক সমাধান, ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সরকারি চক্রান্ত ও হামলার প্রতিরোধ, মতামত প্রকাশের অধিকার, পুলিশ ও আই বি-কে ছাত্র শিক্ষকদের থেকে অগ্রাধিকার প্রদান ইত্যাদি বিষয়ে বক্তব্য দাবিসমূহ ওই সম্মেলনে উপস্থিত করেন তার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, এই পর্যায়ে সামন্তবাদী সংস্কৃতি, সাম্রাজ্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থা ও আমলা মুৎসুদ্দী শ্রেণীর শোষন শাসনের প্রকৃতি চরিত্র সম্পর্কে ছাত্রেরা সচেতন হতে শুরু করেছেন এবং তাদের মধ্যে এক নতুন সাংস্কৃতিক সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এই শিক্ষা সম্মেলনের পর পূর্ব বাংলায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, শিক্ষকদের আন্দোলন ও যুব আন্দোলন এক নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। তৎকালীন শোষক শাসক শ্রেণী সমূহের বিরুদ্ধে ছাত্র ও যুবসমাজের গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ আন্দোলন করেছিল পূর্বের থেকে অনেক বেশি সংঘটিত চরিত্র।
৪। গণশিক্ষা পরিষদ
১৫ই ও ১৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত নিখিল পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা সম্মেলনে এর শিক্ষা আন্দোলনকে সংগঠিত করা ও এগিয়ে নেওয়ার জন্য ‘শিক্ষা পরিষদ’ নামে যে সংস্থাটি গঠিত হয় তার পক্ষ থেকে শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে পরবর্তী নভেম্বর মাসে প্রদেশব্যাপী ‘শিক্ষা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই দিবসটি পালনের জন্যে সেপ্টেম্বর ২১ তারিখে গণ শিক্ষা পরিষদের সম্পাদকমন্ডলী একটি বিবৃতির মাধ্যমে দেশের সকল ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবী ও জনসাধারণের কাছে আবেদন জানান।১[গণশিক্ষা পরিষদ কর্তৃক আহুত এই ‘শিক্ষা দিবস’ শেষ পর্যন্ত পালিত হয় নাই। খুব সম্ভবতঃ ১৯৫০ সালের এই সময় একদিকে প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘট এবং অন্যদিকে সংবিধানের মূলনীতি বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠায় শিক্ষা সম্মেলনের উদ্যোক্তা এবং শিক্ষা পরিষদের কর্মকর্তারা আন্দোলনের সাথে জড়িত হয়ে পড়েন এবং তার ফলে ‘শিক্ষা দিবস’ এর কাজে আত্মনিয়োগ করা তাঁদের দ্বারা সম্ভব হয় না।]
গণশিক্ষা পরিষদের দ্বারা অবশ্য শিক্ষা আন্দোলন কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া মোটেই সম্ভব হয় নাই। ১৯৫১ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, বিশেষতঃ প্রাপ্ত বয়স্কদের নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য পরিষদ কর্তৃক সরকারের কাছে প্রদত্ত একটি স্মারকলিপি২ থেকে দেখা যায় যে, এই পরিষদে সরকার সমর্থক ও আধা-সরকারি ব্যক্তিদের সমাবেশ ঘটেছে এবং সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে তারা এক লক্ষ টাকা সাহায্য প্রার্থনা করেছেন। গণশিক্ষা পরিষদের এই পরিণতি সত্ত্বেও ১৯৫১ সালের বিভিন্ন আন্দোলনে শিক্ষা সম্মেলনের মূল উদ্যোক্তাদের ভূমিকা অবশ্য অন্যরকম ছিল।
৫। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীর কাছে বুদ্ধিজীবীদের স্মারকলিপি
১৯৫১ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ ও ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন সহ বহু সংখ্যক পূর্ব বাঙলা পরিষদ সদস্য, গণপরিষদ সদস্য, অধ্যাপক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মচারী, লেখক, শিল্পী, ছাত্রনেতারা পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে বাংলা ভাষাকে পরবর্তী ১লা এপ্রিল থেকে সরকারি ভাষা রূপে চালু করার জন্য একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।১ এই স্মারকলিপিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করার সময় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে ডঃ শহিদুল্লাহ ইব্রাহিম, কাজী মোতাহার হোসেন অন্যতম। স্মারকলিপিটি মূল বক্তব্য হলো,
পূর্ববাংলার জনসাধারণ শতকরা একশত ভাগই বাংলা ভাষাভাষী এবং এই ভাষা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। প্রায় পাঁচ কোটি জনসাধারণ যাহারা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ সেই হিন্দু এবং মুসলমানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষা উন্নতিসাধন করিয়াছে এবং পূর্ব বঙ্গ সরকার যদি বাংলাকে সরকারি ভাষা রূপে এতদিন গ্রহণ করিয়া লইতেন তবে আরও উন্নতি সাধন করিত।
১৯৪৮ সালে খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন পূর্ববঙ্গ পরিষদে বিনা বাঁধায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার পরিবর্তন করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। তিন বৎসর অতিবাহিত হইয়া গেল কিন্তু তাহা কার্যকর হয় নাই।
আগামী ১৯৫১ সালের পহেলা এপ্রিল হইতে সমস্ত সরকারি কর্মচারীদের কার্যাদি বাংলা ভাষায় শুরু হউক। কারণ বাংলা ভাষায় সুচারুভাবে তাহাদের কার্য সম্পন্ন করিতে পারিবে। যে সকল কর্মচারী বাংলা ভাষাভাষী নহেন তারা একটা নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত ইংরেজিতে কার্যাদি করিতে পারিবেন। কিন্তু তাহা এক বৎসরের অধিক হইবে না। ইহার মধ্যে বাংলা ভাষা শিক্ষা করিয়া ফেলিতে হইবে।
সরকারি কর্মচারীরা চলতি বাংলা ভাষা অথবা পূর্ববাংলার সংস্কার করা সহজ বাংলা যে কোনো একটি বর্তমানে ব্যবহার করিতে পারিবেন। ইহা উল্লেখ করা যাইতে পারে সংস্কার সাধিত সহজ বাংলায় সহজেই টাইপ রাইটার তৈরি করিতে সমর্থ হওয়া যায়।
এই স্মারকলিপি প্রদানকারীরা বলেন যে, বাংলার জনসাধারণের নিজস্ব ভাষা বাংলাতে সরকারি কাজ-কর্ম শুরু হলে দেশবাসীর মধ্যে বিশেষ উদ্দীপনা সৃষ্টি হবে এই জন্যই তাঁরা দেশ বাসীর পক্ষ থেকে সরকারের কাছে স্মারকলিপি পেশ করছেন।২
প্রধানমন্ত্রীর নুরুল আমিন স্মারকলিপি পেশ করার সময় উপস্থিত বুদ্ধিজীবীদেরকে বলেন যে, বহু সরকারি কর্মচারী আছেন তাদের পক্ষে বাংলায় নোট দিতে অসুবিধা হতে পারে। এর জবাবে স্মারকলিপিকারদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, থেকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সরকারি নোট দেওয়ার রীতি প্রবর্তন করা হোক তবে এই সময়ের মধ্যে বাংলা না জানা সরকারি কর্মচারীদেরকে বাংলা শিখে নিয়ে এ ক্ষেত্রে নিজেদের অক্ষমতা দূর করতে হবে।৩
নুরুল আমিন এই আলোচনা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেন যে, পূর্ববাংলার সরকারি কর্মচারীদের কাজের জন্যে যদি বাংলা অবিলম্বে প্রবর্তন করতে হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড, মিউনিসিপালিটি সমূহ, জেলা বোর্ড ইত্যাদিতে বাংলা প্রবর্তন করা হয় না কেন? এর জবাবে সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ডের চেয়ারম্যান ইব্রাহিম খাঁ নুরুল আমিনকে জানান যে, উক্ত বোর্ডকে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় নোট দেওয়ার জন্যে অবিলম্বে নির্দেশ দেওয়া হবে।(৪)
৬। পূর্ব পাকিস্তান সংস্কৃতি সম্মেলন
১৯৫১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি চট্টগ্রামে একটি সাংস্কৃতিক সম্মেলন আহ্বান করা হয়। এই সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম শওকত ওসমান ও শয়ীদুল হাসান পূর্ব বাংলার শিল্পী সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদেরকে সম্মেলনে যোগদান ও সাফল্যমন্ডিত করার উদ্দেশ্যে একটি বিবৃতির মাধ্যমে আবেদন জানান।(১) এর আবেদন প্রসঙ্গে বিবৃতিটিতে তাঁরা বলেন,
পাকিস্তানের শিল্পী সাহিত্যিকও সংস্কৃতিসেবীদের একত্রিত করাই আমাদের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যের পেছনে যে তাগিদ অনুভব করেছি, আমাদের বিশ্বাস কল্যাণকামী পাকিস্তানের সকল সংস্কৃতিসেবীদের বিচ্ছিন্নভাবে হলেও, অন্তরে একই তাগিদ রয়েছে।
আমাদের যে সুপ্রাচীন ও সুমহান সংস্কৃতি, আলাওল, দৌলত কাজীর কাব্য-সুষমা থেকে শুরু করে, ভাটিয়ালি, বাউল, কীর্তন এবং সূফী-দরবেশের সংগীত ধারায় সিঞ্জিত হয়ে, গ্রাম্যগাঁথা এবং লোকসংস্কৃতির প্রাণ রসে বেড়ে উঠেছিল, যে ধারার ছায়ায় জন্ম রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের তারঐ ঐতিহ্য বহনকারী উত্তরাধিকারী আমরা।
এ বিবৃতিতে তাঁরা জানান যে, ১৯৫১ সালের ১৬ থেকে ১৯শে মার্চ এই চার দিন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনকে সফল করার জন্য চট্টগ্রামের বিশিষ্ট সাহিত্যিক, শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি অভ্যর্থনা সমিতির গঠন করা হয়েছে এবং অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন অধ্যাপক আবুল ফজল। সম্মেলনের মূল সভাপতি হিসাবে কার্য পরিচালনা করবেন প্রধান সাহিত্যিক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ। সম্মেলনকে যে কয়টি বিভাগে ভাগ করার কথা বিবৃতিতে বলা হয় সেগুলো হলোঃ কথা সাহিত্য, কাব্য, নাটক, সংগীত, লোকসংস্কৃতি, ভাষাতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও সংবাদপত্র। এছাড়া শিল্প প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কথাও বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
ঘোষণা অনুযায়ী সম্মেলন ১৬ই মার্চ তারিখে চট্টগ্রামে শুরু হয়। ঢাকার কয়েকটি সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা সত্বেও পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে বহু প্রতিনিধি সম্মেলনে যোগদান করেন। কলকাতা থেকে দৈনিক সত্যযুগের সম্পাদক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ও রবিউদ্দিন আহমদ, সিলেটের নওবেলাল পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদ আলী এবং ঢাকা থেকে বেগম সুফিয়া কামাল, আলাউদ্দিন আল আজাদ-সহ অনেক শিল্প ও সাহিত্য সম্মেলনে উপস্থিত হন এবং অংশগ্রহণ করেন। (২)
সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বেগম সুফিয়া কামাল। এই উপলক্ষে তিনি তাঁর ভাষণে বলেন,
আজ বিশ্ব সাহিত্য কথা আন্তর্জাতিক সাহিত্যের ঢেউ আমাদের চিত্তে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, এই সবই ভালো কথা। বিশ্বের সঙ্গে, সকল জাতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় যত নিবিড় হবে, তাতে আমাদের মনের সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামি দূর হবে, হলে আমাদের সাহিত্য হবে সুদুরপ্রসারী ও বহুবিস্তৃত। কিন্তু মানুষতো ত্রিশঙ্কুর মত শূন্যে ঝুলে নেই -একটা দেশের মাটিতে তার জন্ম হয়েছে একটা পরিবেষ্টনের মধ্যে সে লালিত পালিত হয়েছে, – তার দেহ মন খোরাক সংগ্রহ করেছে এক বিশেষ ভৌগোলিক সংস্থান থেকে। কাজেই সেখানকার ভাষা, সেখানকার সাহিত্য, সেখানকার ঐতিহ্য তার মনের সঙ্গে; প্রাণের সঙ্গে; অঞ্চলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে মিশে গিয়েছে, তাই সেই সবকে বাদ দিয়ে তাঁর মনের কখনো বিকাশ হতে পারে না, মনের ভাবের কোন ফুলই ফুটতে পারে না। এ কে না জানে, মনের বিকাশ ও প্রকাশই হচ্ছে সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতি। তাই আগে দেশের ভাষাকে, দেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে জানতে হবে, -এককথায় যে ঘোড়া গ্রহণ করে মন ও অন্তর বেড়ে ওঠে তার আবিষ্কার করতে হবে। সর্বাগ্রে নিজের অন্তরকে যদি আবিষ্কার করতে পারেন, তবে আন্তর্জাতিক হতে আপনার এতোটুকু বেগ পেতে হয়না। নিজেকে না জেনে, নিজের মনকে না যেন হঠাৎ আন্তর্জাতিক হতে যাওয়া, লম্ফ দিয়ে সমুদ্র লঙ্ঘনেরই মত হাস্যস্পদ কাণ্ড নয় কি? মানুষ বিচিত্র কিন্তু তার মন এক, -এদেশে, বিদেশে; কন্টিনেন্টে সর্বত্রই মানুষের চিরন্তন মনই সৃষ্টি করেছে সাহিত্য ও শিল্প। ঘরকে আগে জানুন, তারপর বাহির আপনার পক্ষে সহজ হয়ে যাবে। নিজের দেশের দিকে তাকান, দেশের প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখুন, দেশবাসীর সুখ দুঃখের সঙ্গে পরিচিত হউন, তাদের ভালোবাসুন, -তবে তাদের হাসি ও অশ্রুময় জীবন আপনার লেখনি মুখে ধরা দেবে। সৃষ্টির জন্য ভালোবাসার চেয়ে যাদু মন্ত্র আর নেই। ঘৃণা করে, বিদ্বেষ করে, হিংসা পোষণ করে এবং তা দিয়ে সাহিত্য বা শিল্প কিছুই সৃষ্টি হতে পারে না। ভালোবাসার সহস্র স্রোত বেয়ে সাহিত্য ও শিল্পের পথ আপনার সামনে খুলে যাবে। তাই ফের বলছি – ভালোবাসুন, দেশকে ভালোবাসুন, দেশের শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ভালবাসুন; আজকের দিনে আমার মতে সাহিত্যিক, শিল্পী, সাংবাদিক এক কথায় বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিবানদের সামনে এই ভালোবাসার মন্ত্র ছাড়া কোন মন্ত্র নেই, এই ভালোবাসার শপথ ছাড়া কোন শপথ নেই। দেশের মানুষকে যে ভালবাসতে পারে, একমাত্র সেই বিদেশের মানুষকে ভালোবাসতে পারে -বিশ্ব মৈত্রী বা বিশ্ব মানুষের ভ্রাতৃত্ব একমাত্র তার মুখেই শোভা পায়। নদী যদি একবার তার গতিপথের সন্ধান পায়, তবে তার সাগরে গিয়ে পড়তে বেশি আর দেরি লাগে না। (৩)
বেগম সুফিয়া কামালের এই উল্লেখযোগ্য ভাষণটিতে দেশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে, আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির সাথে দেশীয় জাতীয় সংস্কৃতির যোগসূত্র সম্পর্কে, দেশপ্রেম ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে যে সমস্ত বক্তব্য উপস্থিত করা হয় তার মধ্যে তৎকালীন পরিস্থিতিতে সারা পূর্ব বাঙলা বাংলাব্যাপী মে একটি নতুন সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিলো সেই চেতনাই বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়।
বেগম সুফিয়া কামালের উদ্বোধনী ভাষণ এর পর প্রথম দিনের অধিবেশনে সংস্কৃতি সম্মেলনের মূল সভাপতি আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অভিভাষণ পাঠ করা হয়। (৪) পুঁথি সাহিত্যের উপর গবেষণা করে ঐতিহ্য সম্পর্কে নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধির আলোকে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক সংকট উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তিনি ঐতিহ্যের ভূমিতে দাঁড়িয়ে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির আহ্বান জানান। ইসলামী সংস্কৃতির নামে যারা দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা অবজ্ঞা ও দমন করতে নিযুক্ত তাদের উদ্দেশ্যে সাহিত্যবিশারদ তাঁর অভিভাষণে বলেন,
ঐতিহ্যের পটভূমির সহিত যাহাদের যোগ নাই, তরুলতার ক্ষেত্রে যেমন পরভোজী শব্দ ব্যবহার করা হয় -এখানে ঐ জাতীয় ব্যক্তিদের জন্য তেমন বিশেষণই আরোপ করা চলে। সমাজ জীবনেও দেখিবেন ইহারা পরভোজী। মানবতার সহিত তাহাদের কোন সম্বন্ধ নাই। জনসাধারণের মস্তকে কাঁঠাল ভাঙিয়া দিনাতিপাত করেন। এই জাতীয় ব্যক্তিদের উপদেশ কোনদিন গ্রহণ করিবেন না।
জাতীয় বিকাশের ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের মূল্য ও গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন,
ভুলিয়া যাইবেন না, অতীত আমাদের ভবিষ্যতের পথ প্রদর্শন করে। সেই আলোকে আমাদের বর্তমান নিয়ন্ত্রিত হইতে পারে। এজন্য ঐতিহ্যের কথা বারবার স্মরণ রাখা দরকার।
ঐতিহ্যহীন কোন কিছু করিতে গেলে আপনারা ভুল করিবেন। সাধনা পন্ডশ্রম হইবে মাত্র। অথবা জাতীয় বিকাশের পথ রুদ্ধ করিয়া দিবে। এই কথা আমি বারবার স্মরণ করাইয়া দিতে চাই। কারণ অনেকেই এই সোজাকথা হৃদয়াঙ্গম করিতে পারেন না। হঠাৎ নতুন কিছু করার প্রয়াস অথবা স্বার্থ-সিদ্ধি তাহাদের এষনার মূলে থাক না কেন, এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। ঐতিহ্য হইতে তাহারা দূরে সরিয়া যাইতে বলে। মনে রাখবেন ঐতিহ্য হইতে দূরে সরিয়া যাওয়ার অর্থ জীবন হতে দূরে সরিয়া যাওয়া। জীবন হতে দূরে সরিয়া যাওয়ার অর্থ পাঠশালের বলিকও জানে -মৃত্যু।
ঐতিহ্যের সহিত দেশের ইতিহাস, ধর্ম, ভাষা, লৌকিক আচার, গাছপালা এমনকি তরুলতা পর্যন্ত জড়িত। বুকে দেশপ্রেম না থাকিলে তাহা কাহাকেও বুঝাইয়া দেওয়া মুশকিল। অনেকের সবগুলি মানেন না। দেশের কেন একটি বিশেষ অঙ্গের উপর জোর দেন। এমন ক্ষেত্রে দেশ অঙ্গস্ফীতি পীড়ায় ভুগিবে। কোন একটি অঙ্গের উপর জোর দিলে তা হয়তো মোটা দেখাইতে পারে -অন্যগুলি শুষ্ক হইয়া যাইবে। ইহার স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয় – স্বাস্থ্যের অভাবের লক্ষণ।
ইসলামী সংস্কৃতির সরকারি ধারক-বাহকরা বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে বস্তুতঃপক্ষে এদেশকে বিদেশ মনে করে যেভাবে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি পূর্ববাংলায় গঠন করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন সে দিকে ইঙ্গিত করে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বলেন,
অনেকে ঐরূপ কাজে অগ্রসর হইয়া দেশের মাটিকে পর্যন্ত অস্বীকার করেন। ইহা বাতুলতা। অবশ্য এমন বাতিলেরা সাময়িকভাবে জাতীয় জীবনের বিকাশ পথে নানা অমঙ্গল ডাকিয়া আনে। উদাহরণ দেয়া যাক। ইঙ্গ-ভারতীয় সমাজ বা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান সমাজ অবিভক্ত ভারতে দেড়শত বৎসর আমাদের সহিত বাস করিয়া আসিতেছিল। তাহারা কোন কৃষ্টি সৃষ্টি করতে পারে নাই। দেড় শত বৎসর একটি সমাজের পক্ষে কম সময় নয়। ইহার কারণ তাহারা এই দেশকে নিজের দেশ বলিয়া মনে করে নাই। তাহারা মনে করিত, তাহাদের জন্মভূমি ইংল্যান্ড। মহারানী ভিক্টোরিয়া তাহাদের পিতামহী কি মাতামহী। দেশের জলবায়ু ও ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে গমন করিল সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গমন করিলেন এমনই দুর্দশা ঘটে। সুধীগণের নিকট এই ইঙ্গিতই যথেষ্ট।
মধ্যযুগীয় বাঙালি কবিদের ঐতিহ্য চেতনা ও সৃষ্টিশীলতার সম্পর্কে তিনি বলেন,
মধ্যযুগীয় বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল। তিনি কোনদিন ঐতিহ্যকে অস্বীকার করেন নাই। তাই বিশিষ্ট কবি রুপে নয়, বিশিষ্ট ধারার প্রবর্তকরূপে বাংলা সাহিত্যে তিনি অমর ও চিরস্মরণীয় হইয়া রহিবেন। বলা বাহুল্য, দেবতা নয় মানুষই তাঁর কাব্যের উপজীব্য হয় প্রথম। সাহিত্যের স্বর্গ হইতে এই মর্তে অবতরণ মধ্যযুগের এক বিরাট অগ্রগতি। তাঁর কাব্যে বৈষ্ণব প্রভাব আছে‌। ইহা লজ্জার বিষয় নয়। দেশের ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করিতে গেলে ঐতিহ্যের নিয়ম পালন করিতে হয়। এইভাবেই নূতন ধারার বিকাশ লাভ ঘটে।
পাকিস্তানে শাসক শ্রেণী কর্তৃক ভাষা নিপীড়ন ও বাংলাদেশের জনগণের সংস্কৃতি দমননীতি এবং উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার নীতির প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মধ্যযুগীয় মুসলমান শাসকদের উদার নীতির উল্লেখ করে তিনি বলেন,
শাসকদেরও এ ঐতিহ্য হইতে শিক্ষনীয় কিছু ছিল। হুসেন শাহ, পরাগল খাঁ , ছুটি খাঁ ও অন্যান্য বহু খান- খানান, পাঠান নৃপতিগণ ইহা হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন মে রাজত্ব স্থায়ী করিতে হইল দেশের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকা উচিত। ইহা তাঁহারা উপলব্ধি করিয়াছিলেন বলিয়াই নিজেদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা সাহিত্য রচনায় উৎসাহ দিয়েছিলেন। ভাষার নিপীড়ণ আরম্ভ করেন নাই, অন্য ভাষা চাপাইয়া দেওয়ার নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করেন নাই। এমন নিপীড়ণ চালাইলে পাঠান মোগল শাসন অনেক আগেই ধ্বংস হইয়া যাইত -কয়েক শতাব্দী অস্তিত্ব থাকিত না।
ভাষা নিপীড়নকারী শাসকশ্রেণীর ধ্বংস অনিবার্য এই বক্তব্যটি ঐতিহাসিক তুলনার মাধ্যমে সুন্দরভাবে প্রকাশ করার পর সাংস্কৃতিক বিকাশ সম্পর্কে সাহিত্যবিশারদ বলেন,
ঐতিহ্যের এমনই শক্তি। ইহার শক্তিকে স্বীকার করিতে হইবে। কিন্তু স্বীকার করিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে না। তাহা হইবে গতানুগতিকতা। আর গতানুগতিকতার অর্থ শিল্প-সংস্কৃতির মৃত্যু। ঐতিহ্যকে স্বীকারের পর তার প্রবাহকে অগ্রসর করিয়া লইয়া যাইতে হইবে। সংস্কৃতির বিকাশের সার্থকতা সেইখানে।….. ঐতিহ্যকে একদিকে স্বীকার ও অন্যদিকে অস্বীকার এই টানাপোড়ানই সংস্কৃতির অগ্রগতি সম্ভব।
সমাজ ও সংস্কৃতির গ্রগতির দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়াটিকে অপূর্ব নৈপুণ্যের সাথে এইভাবে বর্ণনা করার পর শিল্পী ও সমাজ চেতনা সম্পর্কে নিজের বক্তব্যকে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন,
বিদ্যাপতি খুব বড় কবি নিঃসন্দেহ। কিন্তু আরও নানা কবি ও নানা রকমের কবিতার সৃষ্টি না হইলে, এতদিন কবি লক্ষীর মৃত্যু গঠিত। কারণ গতানুগতিকতার অর্থ শিল্প-সংস্কৃতির মৃত্যু।
পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি। আমি কঙ্কালের ব্যবসায়ী, পুরাতন পুঁথি কঙ্কালেরই মত। কিন্তু আমি তার ভেতর যুগ-যুগান্তরের রক্ত ধমনী ও নিঃশ্বাসের প্রবাহ ধ্বনি শুনিয়াছি। আমার বিশ্বাস সে যুগের শিল্প শ্রমিকদের পক্ষে যা সত্য ছিল, আজ তার বিশেষ ব্যতিক্রম ঘটে নাই। এই জন্য কয়েকটি কথা বলা দরকার।
প্রাচীন মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য ও অন্যান্য কাব্যরীতির সাধকদের মূল প্রেরণা ছিল সমাজ। দৈনন্দিন জীবনই ছিল রসের উৎসবক্ষেত্র। তাই কোথাও দেখা যায়, কবি দেবতার ছবি আঁকিতেছেন কিন্তু অজ্ঞাতসারে তা তদানীন্তন বাংলার সমাজ চিত্র হইয়া গিয়াছে। আপনারাই ইহাকে শিল্পীর কৌশল বলিতে পারেন। কিন্তু একথা ধ্রুবসত্য, সমাজের দিকে তারা চোখ খোলা রাখিয়াছিলেন বলিয়া এমন অংকন দক্ষতা লাভ করিয়াছিলেন। তার আস্বাদ যুগ-যুগান্তর অতিক্রম করিয়া আজও অবিকৃত অম্লান রহিয়াছে। আপনারা পূর্বসূরিদের এই কৌশল বা দক্ষতা যাই বলুন -আজও অবহেলা করিতে পারেন না। সমাজেই জীবন। জীবনের শিল্পী কি সমাজকে অস্বীকার করিতে পারে?
‘জীবনের শিল্পী কি সমাজকে অস্বীকার করিতে পারে?’….. এই বলে একদিন সাম্রাজ্যবাদের দালাল একশ্রেণীর কলাকৈবল্যবাদীদের বক্তব্য এবং অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতাবাদী তথাকথিত পাকিস্তানি সংস্কৃতির প্রবক্তাদের বক্তব্যকে আশ্চর্য দক্ষতার সাথে খন্ডন করতে গিয়ে সমাজের গতিশীলতা সম্পর্কে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁর ভাষণে আরও বলেন,
যুগে যুগে সমাজে নানা পরিবর্তন ঘটিয়াছে। এক যুগের শিল্পরীতি দিয়া অন্য যুগের সমাজকে আঁকা চলে না। রীতিও তেমন পরিবর্তিত হইয়াছে। নক্ষত্রের গতিশীলতা দেখিয়ে জ্যোতির্বিদগণ পৃথিবীর গতিশীলতা স্থির করিয়াছেন। আমরা শিল্পরীতি দেখিয়া সমাজের গতিশীলতা বুঝিতে পারি। আবার সমাজের কলেবর দর্শনেও শিল্পরীতির গতিশীলতা অনায়াসে ধরা পড়ে। প্রাচীন শিল্পীগণ তা ভালভাবে উপলব্ধি করিয়াছিলেন। সমাজের দিকে দৃষ্টি ছিল বলিয়া মধ্যযুগের সার্থক কবিগণ লোকসংস্কৃতি অগ্রাহ্য করেন নাই। মঙ্গলকাব্য গুলি সাধারণতঃ দরবারী, রাজসভা ঘেঁষা। কিন্তু ইহার ভেতরও পল্লীজীবনের ঝংকার স্পষ্ট। ‘বারোমাস্যার’ সুর কেহই বাদ দেন নাই। প্রকৃত কবি মানবতার দুঃখ-বেদনার শরীক, তাহা বাদ দিতে পারে না। আবার স্থানবিশেষে তদানীন্তন রাজ্যসভা ও পল্লীর আসর -দুই জায়গায় দুই রকম রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। কিন্তু দুইয়ের ভিতর মিতালীও স্পষ্ট। চৈতন্য, মঙ্গল চৈতন্য, ভগবত ইত্যাদি মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব কবিতা -দুয়ের সুরের রূপ আলাদা, যদিও দুয়ের রচনার অনুপ্রেরণা এক জায়গা হইতে আসিয়াছে। এইভাবে স্থান-কাল ভেদে সাহিত্যের আদর্শ পরিবর্তনশীল। ইহা লক্ষ্য করিবার জন্য সমাজের দিকে দৃষ্টিপাত ছাড়া অন্য কোন উপায় নাই।
সেই জন্য দৃষ্টিশক্তির সাধনার প্রয়োজন আছে। প্রাচীন কবিরা তাঁরও পথ দেখাইয়াছেন। তাহা একটি শব্দে বলা যায় -উদারতা। যে যত উদার, তার দৃষ্টি ততো স্বচ্ছ। কারণ হৃদয়ও দর্শনের মতো স্বচ্ছ হইয়া আসে। ইহার উপরই তো সমাজের প্রতিবিম্ব পড়ে। দর্শনের স্বচ্ছতার উপর প্রতিবিম্বের স্পষ্টতা নির্ভর করে। এখানে শিল্পী কোন চাতুরির প্রশ্রয় লইতে পারে না। বাংলার প্রাচীন গাঁথা ময়মনসিংহ গীতিকার ভেতর যে সৌন্দর্য লীলায়িত তা কি উদার হৃদয়ের বীনা ধ্বনি নয়? আউল-বাউল মুর্শিদ্যা গানের ভেতর বিশ্বচরাচর ব্যাপ্ত যে রূপের আলোকচ্ছটা তা কি উদার প্রাণের পৃথিবীগ্ৰাসী দর্শনের (ফিলোজফীর) পুরনিকেতন নয়?
এরপর নিজের অভিভাষণের শেষদিকে মধ্যযুগীয় কবিদের অসম্প্রদায়িক চরিত্র ও তাঁদের বিরুদ্ধে হিন্দু মুসলমান শাস্ত্রকারদের আক্রমণের সাথে সমসাময়িককালের সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি চর্চার প্রচেষ্টা ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের তুলনা করতে গিয়ে সাহিত্যবিশারদ বলেন,
‘ আমার পথ ঢাইক্যাছে মন্দিরে মসজেদে
ওরে ও পরম গুরু সাঁই
তোঁর পথ দেখতে না পাই
আমায় রুখে দাঁড়ায় গুরুতে মুরসেদে’
প্রাচীন বাউল কবির মুখে সহজেই এই মনোহারিণী বাণীর উদয় হইয়াছিল। অশিক্ষিত, অজ্ঞাতকুলশীল কবির হৃদয়ের আর্তনাদ আজও কানে আসে। মানুষের মানুষের ঐক্যের প্রচেষ্টা ছিল তাঁদের সাধনা। উদারতার এই এক অদ্বিতীয় সংজ্ঞা। কিন্তু প্রাচীন কবির বাণী আজও সার্থক হয় নাই। ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব, হানাহানি, লোভ, জিঘাংসা; অন্যান্য জঘন্য চিত্র আজও আমাদের দৈনন্দিন ঘটনার পটভূমি। সাম্প্রদায়িকতা মহামারী বীজের মত শত শত মানুষের নীড় ধ্বংস করিয়াছে। তাই এই জাতীয় দুর্দিনে সে প্রাচীন সাধক কবিদের পথের হদিস ভালরূপে জানা দরকার আছে। মানুষে মানুষে বিভেদ আছে সত্য। এই বিভেদকে জয় করাই সংস্কৃতি। সংস্কৃতি ঐক্যের বাহন। বিভেদের চামুণ্ডা নয়।
নিজের মূল বক্তব্যকে এই ভাবে উপস্থিত করার পর আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ সাহিত্য সম্মেলনে সমবেত সংস্কৃতিসেবী ও সুধীবৃন্দের আবেগপূর্ণ আহ্বান জানিয়ে বলেন,
প্রগলভতা বৃদ্ধজনের নিন্দার শেরোপা। আপনাদের সময় বৃথা নষ্ট করিব না। শুধু আর একবার বলিতে চাই, তরুণ বন্ধুগণ অগ্রসর হউন। সর্বমানবের সংস্কৃতি আপনারা গড়িয়া তুলুন। মধ্যযুগের কবি যে স্বপ্ন দেখিয়াছিল। তার সার্থক রূপায়নে অগ্রসর হউন। তাহাদের পথে বাধা ছিল অনেক। জ্ঞান-বিজ্ঞান আপনাদের সহায়। আপনারা সফল হইবেন। চারশ বছরের সংস্কৃতির সম্পদে আজ আপনারা ঐশ্বর্যশালী। আপনারা সফল হবেন। অগ্রসর হউন। জোর কদম।
আমার কদমে আজ জোর নাই। আমার শারীরিক উপস্থিতি দিতে পারিব না। আমার মন আপনাদের সঙ্গী। বয়স্ক গৃহস্থ যেমন বাতায়ন পাশে বসিয়া দূরাভিসারী সৈনিকের কুচকাওয়াজের দিকে চাহিয়া থাকে, আমিও তেমনি অরুণোদয় কাফেলার দিকে চাহিয়া থাকিব।
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ এর এই অমূল্য ভাষণটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সংস্কৃতি সম্মেলনের জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী সম্মেলনের উপর একটি প্রতিবেদন প্রবন্ধে বলেন, ‘সভাপতির ভাষণের সময় বিপুল জনতা তাদের অর্ধশতাব্দীর সংস্কৃতির ধারক ও বাহক এই জ্ঞানবৃদ্ধের বাণী অন্তরে অন্তরে সঞ্জীবিত করছিল। একটি জীবন্ত অস্তমান মানুষ তাঁর জীবনব্যাপী সাধনার সম্পদ তাঁর উত্তরাধিকারী জনতার সামনে তুলে ধরলেন। আর জনতা তাকে আপনজন বলে গ্রহণ করে তাঁর নিজের চলমান পথ বেগবান করলো।'(৫)
১৯৫১ সালের ১৬ই মার্চের পরবর্তী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ইতিহাসের দিকে তাকালে প্রত্যক্ষদর্শীর এই প্রতিবেদনের সত্যতাই আশ্চর্যভাবে প্রতিভাত হয়। চট্টগ্রাম সংস্কৃতি সম্মেলনের পর থেকে পূর্ব বাংলায় বিশ বছর কাল ধরে যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বিকাশ ঘটে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের এই অভিভাষণের আন্দোলনের ঘোষণা বললে বিন্দুমাত্র অত্যুক্তি হয় না।[ চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলন এর অল্পকাল পরই সাহিত্য বিশারদ এর মৃত্যু হয়। ]
১৬ই মার্চ অর্থাৎ সম্মেলনের প্রথম দিনেই সন্ধ্যার পর চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার নিয়াজ মহম্মদ খান সম্মেলনের দ্বারা আয়োজিত একটি চারুশিল্প প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন। এই উপলক্ষে তিনি বলেন যে, ইসলাম চিত্রশিল্পের বিরোধী বলে যারা প্রচার করে তিনি তাদের নিন্দা করেন।(৬) আবেদিন, সফিউদ্দিন আহমদ, কামরুল হাসান, আনিসুল ইসলাম, একরামুল হক, জামাল আক্তার, আমিনুর রহমান, শফিক আহমদ প্রমুখের চিত্র প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়। (৭)
এই একই দিন সন্ধ্যায় একই প্যান্ডেলে নিয়াজ মোহাম্মদ খান পূর্ব পাকিস্তান সংগীত সম্মেলনের উদ্ভাবন করেন এবং নিজের উদ্বোধনী ভাষণে সঙ্গীতচর্চা প্রসারের জন্য পূর্ণ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। এই সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন মিসেস ফরিদা হাসান ও তাঁর দল। (৮)
১৭ই মার্চের অধিবেশনে কলকাতা থেকে আগত দৈনিক সত্যযুগ পত্রিকার সম্পাদক সত্যেন মজুমদার একটি ভাষণ দেন। তাঁতে তিনি সাম্প্রদায়িকতার উল্লেখ করে বলেন যে, সে পথে দেশের কোনো কল্যাণ নেই। কলকাতা থেকে যে সমস্ত শিল্পী অতিথিরা এসেছিলেন তাঁরা শান্তি ও সাম্প্রদায়িক মিলনের উপর সংগীত পরিবেশন করেন। সম্মেলনের শেষ দিন অর্থাৎ ১৯শে মার্চ চট্টগ্রামের বিখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীল ও তাঁর দল আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনের উপর কবিগান করেন।(৯)
চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সাংস্কৃতিক সম্মেলনে বিভিন্ন বিষয়ে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। (১০) জনগণের বাস্তব জীবনের সাথে সংস্কৃতির সম্পর্ক বিষয়ক প্রস্তাবটিতে বলা হয়,
মানুষের ভালো করার, মানুষের মঙ্গল করার সদিচ্ছাকে অঙ্গীভূত করে যে সাহিত্য শোষণের বিরুদ্ধে, এক দেশের উপর আরেক দেশের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে, মানুষের উপর মানুষের জুলুমের বিরুদ্ধে, যুদ্ধের বিরুদ্ধে, সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে আমরা মতবাদ নির্বিশেষে মানবতার নামে সে সাহিত্যেরই অনুসারী। আমরা বিশ্বাস করি আজ এ সাহিত্যই জনসাধারণের একমাত্র কাম্য।
আমরা বিশ্বাস করি -সাহিত্য জীবনের নিছক প্রতিফলন নয়, সাহিত্য সমাজ উন্নয়নের শক্তিশালী অবলম্বন ক্ষুধা বেকারী -এবং অশান্তির হাত থেকে সমাজজীবন কে রক্ষা করা তার গতিশীলতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পবিত্র দায়িত্ব আজ শিল্পী সাহিত্যিকের। দুর্ভিক্ষে বাংলাদেশের ৩৫ লক্ষ নর-নারীর মৃত্যু, গত মহাযুদ্ধে জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভাঙ্গন -যে ধ্বংস, আজকের দৈনন্দিন জীবনে আমাদের যে অর্থনৈতিক সংকট -অভাব-অনটন -জীবনের এই যে বাস্তব সত্য -তাকে যদি দিয়ে সমস্যাকে এড়িয়ে কোন সাহিত্যই মানুষের কল্যাণ করতে পারে না। অতএব বিভিন্ন মতবাদের শিল্পী সাহিত্যিকের এ সম্মেলনে আমরা প্রস্তাব করছি -মানুষের কল্যাণের জন্য যে সাহিত্য -সমাজের গতিশীলতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে সাহিত্য আমরা সে সাহিত্যের প্রতি আস্থাশীল।
শান্তি ও সংস্কৃতি চর্চার সম্পর্কিত একটি প্রস্তাবে বলা হয়,
নিরবচ্ছিন্ন শান্তি ব্যতীত কোন দেশের সাংস্কৃতিক উন্নতি সম্ভব নয়, মাত্র কতিপয় ব্যক্তি ছাড়া দল-মত-নির্বিশেষে যুদ্ধ প্রত্যেক মানুষেরই স্বার্থবিরোধী। গত যুদ্ধের ধ্বংস ভয়াবহতা যারা প্রত্যক্ষ করেছে, যারা দেখেছে কচি কচি ছেলে মেয়েদের বোমার আঘাতে রক্তাক্ত দেহ ঢলে পড়তে তারা কোন দিনই আর একটি মহাযুদ্ধ চায় না। অতএব শান্তিকামী শিল্পী-সাহিত্যিকদের এই সম্মেলনে আমরা প্রস্তাব করি -ভবিষ্যতে কোন যুদ্ধকে আমরা বরদাস্ত করব না। আক্রমণকারী যেই হোক না কেন তার বিরুদ্ধে আমরা জনসাধারণের পাশে এসে দাঁড়াবে এবং সকল প্রকার যুদ্ধ প্রচারণাকে আমরা মানবতাবিরোধী জঘন্য কাজ হিসেবে নিন্দা করবো।
বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবি জানিয়ে একটি প্রস্তাবে বলা হয়,
তিন বছর আগে আমাদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বর্তমান গভর্নর জেনারেল মাননীয় খাজা নাজিমুদ্দিন জনসাধারণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে পাকিস্তানে সাড়ে চার কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হবে। এই তিন বছরের মধ্যে উক্ত প্রতিশ্রুতিকে কার্যকরী করার কোনো চেষ্টাই অবলম্বন করা হচ্ছে না দেখে আমরা উৎকণ্ঠায় আছি। অধিকন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ করে অক্ষর পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষার মূলে আঘাত করার যে নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে এবং মূল নীতি নির্ধারক কমিটির রিপোর্টে বাংলা ভাষার দাবীকে কোন প্রকার প্রাধান্য দেওয়া হয়নি দেখে আমরা অত্যন্ত দুঃখ প্রকাশ করছি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা দাবী করছি অবিলম্বে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হোক।
সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রস্তাবে বলা হয়,
আমরা বিশ্বাস করি খুনি বাংলা বাংলাদেশের আসল পরিচয় নয়। বিগত দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ভাইয়ের হাত কলুষিত হতে দেখে প্রত্যেক শিল্পী-সাহিত্যিকই অত্যন্ত পীড়া অনুভব করেছেন, কারণ এটা বাংলাদেশের ঐতিহ্যের উপর চরম কলংক লেপন করে দিয়েছে। তাঁরা পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাহসের সাথে লড়াই করেছিলেন। তাই শিল্পী-সাহিত্যিকদের এ সম্মেলনে আমরা প্রস্তাব করছি -যে সাম্প্রদায়িকতা সকল প্রকার সংস্কৃতি বিরোধী, যে সাম্প্রদায়িকতা সমাজের গতিশীলতাকে আটকে দেয়; যে সাম্প্রদায়িকতা বাংলা সাহিত্যের ঐতিহ্য বিরোধী – মানবতাবিরোধী -আমরা শিল্পী-সাহিত্যিকরা তার বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক অভিযান চালিয়ে যাবো, এ সম্মেলনের পক্ষ থেকে আমরা সমস্ত সদবুদ্ধিসম্পন্ন শিল্পী-সাহিত্যিকদের কাছে হিন্দু মুসলমান ঐক্যের ভিত্তিতে শিল্প সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।
জনশিক্ষা সম্পর্কে একটি প্রস্তাবে বলা হয়,
সংস্কৃতির মূল উৎস শিক্ষা, শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ছাড়া জাতীয় সংস্কৃতির মান উন্নয়ন অসম্ভব। এই দেশের গরিব শিক্ষকদের বাঁচার ন্যূনতম দাবিকে অস্বীকার করে জনশিক্ষার প্রসার কোনমতেই হতে পারে না। অতএব এ সম্মেলন সাধারণ ছাত্র ও শিক্ষকদের অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছে।
চিন্তার স্বাধীনতার দাবি করে অপর একটি প্রস্তাবে বলা হয়,
সংস্কৃতি বিকাশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা না পেলে কোন জাতি ক্রমশ পঙ্গু হয়ে পড়তে বাধ্য। শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্র ও ভাস্কর্য ইত্যাদি সংস্কৃতির অবদানগুলোর উৎকর্ষ ও পরিপূর্ণতা সাধন না হলে জাতীয় জীবনের কোন প্রকার অগ্রগতি সম্ভব নয়। আমাদের সংস্কৃতি বিকাশের জন্য আজ পরিপূর্ণ স্বাধীনতা একান্ত প্রয়োজন। এ না হলে জাতীয় জীবনের অগ্রগতি ব্যাহত হবে, কুসংস্কারের নাগপাশে আমরা চিরদিন জড়িত হয়ে থাকব, মানবতামুখী কোন নতুন চিন্তা ধারাকে আমাদের মহান জাতীয় ঐতিহ্যের রসে সঞ্জীবিত করে গ্রহণ করার মত মানসিকতা আমরা হারিয়ে ফেলব, নতুনকে পরিহার করে পুরাতনের জীর্ণতার আবর্জনা স্তূপে আমরা নিমগ্ন হয়ে পড়ব। তাই আজ গতিশীল জীবনের জন্য একান্ত প্রয়োজন সাংস্কৃতিক বিকাশের স্বাধীনতা। অতএব শিল্পী-সাহিত্যিকদের এ সম্মেলন দাবি করে -যাবতীয় সৃষ্টিশীল কল্যাণধর্মী শিল্প সাহিত্য প্রকাশ ও প্রচারের, পুস্তক পত্র-পত্রিকা প্রকাশের, সংগীত ও নাট্যানুষ্ঠানের এবং সকল নতুন চিন্তাধারার ব্যাপক আলোচনার অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হোক।
ছাত্র ও শিক্ষকদের স্বাধীন সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ দাবি করে প্রস্তাব করা হয়,
‘দেশের সমস্ত শিক্ষায়তনগুলি সংস্কৃতির অন্যতম বাহন রূপে কাজ করে। কিন্তু আমরা দেখেছি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও ছাত্রের স্বাধীনভাবে, আপন আপন বিশ্বাস অনুযায়ী সংস্কৃতি প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করার সুযোগ থেকে সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছে। এতে জাতিকে হয়তো শিক্ষিত করে তোলা হয় কিন্তু সভ্য করে তোলা হয় না। অতএব শিল্পী-সাহিত্যিকদের সম্মেলন প্রস্তাব করে -সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও ছাত্রদের অধিকার ও সুযোগ প্রদান করা থেকে যেন তারা আপন আপন বিশ্বাস অনুযায়ী সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাধাপ্রাপ্ত না হয়।’
এ প্রস্তাবগুলি ছাড়া কবি নজরুল ইসলামকে প্রয়োজনীয় অর্থসাহায্য ও তাঁর চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েও একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।
১৯৪৭-৪৮ সালে (৩১ডিসেম্বর -১ জানুয়ারি) সরকারের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনের [ পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি প্রথম খন্ড দ্রষ্টব্য। ] পর চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনই হলো পাকিস্তান উত্তর পূর্ব বাঙলার দ্বিতীয় সাংস্কৃতিক সম্মেলন। কিন্তু চরিত্রগত দিক দিয়ে প্রথম সম্মেলনের সাথে চট্টগ্রাম সম্মেলনের ছিল মূলগত পার্থক্য। ঢাকার সম্মেলনের উদ্যোক্তারা মূলতঃ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন এবং সম্মেলনকে যথাসম্ভব সেইভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৫১ সালের চট্টগ্রাম সম্মেলনের উদ্যোক্তারা পূর্ববাঙলায় একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির আন্দোলন গঠন করে তাকে বেগবান করার উদ্দেশ্যেই এই সম্মেলন আহ্বান করেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী সম্মেলনের কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। এজন্য এই সম্মেলনের বক্তব্যসমূহ যে শুধু তথাকথিত পাকিস্তানি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়েছিল তাই নয়, নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ অনেক ছাত্র যুবকের সমাবেশও এতে ঘটেছিলো। এই ধরনের ছাত্র-যুবকেরাই পরবর্তী পর্যায়ে পূর্ব বাঙলার গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
৭। পূর্ববঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ অধ্যাপক সম্মেলন
১৯৫১ সালের ১৬ই মার্চ কুমিল্লায় পূর্ব বাঙলা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাঙলার পরিবর্তে উর্দু প্রবর্তনের চেষ্টা সে সময় পূর্ব বাঙলার ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণভাবে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তাদের প্রতিধ্বনি করে ডঃ শহীদুল্লাহ শিক্ষকদের সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণে বলেন,
‘শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের উপর বাংলা ভাষা ব্যতীত যদি অন্য কোন ভাষা আরোপ করা হয় তবে ইহার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো আমাদের উচিত। এমনকি প্রয়োজন হলে ইহার বিরুদ্ধে আমাদের বিদ্রোহ করা উচিত। বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব। নতুন ভাষা আরোপ করা পূর্ববঙ্গের গণহত্যারই শামিল হইবে।’
স্কুল ও কলেজ শিক্ষার মাধ্যম যথাক্রমে বাংলা ও ইংরেজি হওয়ার ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে অসঙ্গতি দেখা দেয় সে বিষয়ে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন,
আমাদের রাষ্ট্রভাষা নির্ধারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতে উচ্চশিক্ষার পাঠ্য তালিকা ও পরিবর্তিত হইবে। তবে ১০ -২০ বৎসর পর্যন্ত আমাদের কলেজের ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকায় ইংরেজি রাখিতে হইবে। শিক্ষার মাধ্যম ও অধ্যয়ন সম্পূর্ণ আলাদা কথা। আমাদের দেশে বর্তমানে স্কুলসমূহে শিক্ষার মাধ্যম বাংলা এবং উহা বেশ ভালোভাবেই চলিতেছে। কিন্তু স্কুলের সঙ্গে কলেজের যে তফাৎ রহিয়াছে তাহা খুবই বেশি। ইহার ফলে অধিকাংশ ছেলের ভবিষ্যৎই পঙ্গু হইয়া যায়। কারণ স্কুলে বহুদিন পর্যন্ত বাংলার মাধ্যমে লেখাপড়া করিয়া ছেলেগণ হঠাৎ যখন কলেজে আসিয়া ইংরেজির মাধ্যমে সম্মুখীন হয়, তখন অধিকাংশ ছেলের ভবিষ্যৎ পঙ্গু হইয়া যায়।
দুই শিক্ষা মাধ্যমের টানাপোড়নে পরীক্ষায় বিপুল সংখ্যক ছাত্রের অকৃতকার্যতা এবং বেকার সমস্যা এড়ানোর উপায় নির্দেশ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
‘যে সকল ছাত্র উচ্চশিক্ষালাভের অনুপযুক্ত তাহাদিগকে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান করা উচিত। আর এতদুদ্দেশ্যে দেশের সর্বত্র অধিক সংখ্যক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক স্কুল বা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দিকে এখন সরকার ও জনসাধারণের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। আর দেশকে শিল্পায়িত করিয়া এই সকল কারিগরকে চাকরি প্রদানের ব্যবস্থা করা সরকারের উচিত। এই সম্পর্কে আরেকটি প্রস্তাব করা যাইতে পারে যে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স পর্যন্ত শিক্ষার মাধ্যম বাংলা করা যায়, তবেও এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।’
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করা উচিত। একথা বলে তিনি প্রস্তাব করেন যে, স্কুল-কলেজে বিভিন্ন -ধর্মাবলম্বী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য তাদের নিজস্ব ধর্ম গ্রন্থ পাঠকে বাধ্যতামূলক করা উচিত। শিক্ষক ব্যতীত অন্য কাউকে প্রাইভেট পরীক্ষা দিতে না দেওয়ার নীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন যে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে যাঁরা রয়েছেন তাঁদেরকে পরীক্ষা দেয়ার সমান অধিকার প্রদান করা দরকার। সাধারণ মানুষের নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্যে অভিযান পরিচালনার জন্যে ছাত্র সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তার উপরও ডঃ শহীদুল্লাহ তাঁর ভাষণে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করেন।
৮। পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার কমিটি
পূর্ববাংলা সরকার ১৯৫১ সালে প্রদেশের ২৩ জন শিক্ষাবিদকে নিয়ে পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার কমিটি নামে একটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি নিযুক্ত করেন।১ মাওলানা মোঃ আকরাম খান এই কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হন। পূর্ববাংলার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেশের পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে এবং ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত করা সম্পর্কে সরকারকে পরামর্শ প্রদান এই কমিটির দায়িত্ব নির্ধারিত হয়।
সরকারের কাছে কমিটি বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করেন তার মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্যে সুপারিশ করা হয়। কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি ও প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের সুপারিশ করেন।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও পূর্ববাংলা সরকার আরবি হরফ শিক্ষার মধ্যে দিয়ে মুসলমান শিশুদের শিক্ষার হাতেখড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট জেলা অফিসারদেরকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করেন। নতুন ব্যবস্থা অনুযায়ী স্থির হয় যে, শিশুরা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে আরবি অক্ষর পরিচয় শিক্ষা করবে, তৃতীয় শ্রেণীতে তাদেরকে আমপারা (কোরআনের প্রথম পারা) শিক্ষা দেওয়া হবে এবং চতুর্থ শ্রেণি ও তার ওপরের শ্রেণীগুলোতে তাদেরকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে উর্দু পড়ানো হবে।২
পূর্ববাংলা সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ ও নিন্দা করে ‘পূর্ববঙ্গ শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার কমিটির’ চেয়ারম্যান মাওলানা আকরাম খান একটি বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন যে, সরকার তাঁদের কমিটির সুপারিশের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা অবলম্বন করেছেন।৩
৯। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নতুন ধারা
১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক নতুন প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দেয়। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাংস্কৃতিক সম্মেলনের পর সারা পূর্ব বাংলায় নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলের মৃত্যু জয়ন্তী, ইকবালের মৃত্যু বার্ষিকী, সুকান্তের মৃত্যু বার্ষিকী ইত্যাদি উপলক্ষে একের পর এক বহু সাংস্কৃতিক সভা অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এই ধরনের প্রায় প্রত্যেক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি ও গান-বাজনার জলসা অনুষ্ঠানগুলিকে করে প্রাণবন্ত করে তোলে।
এই সকল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে যে ধারা বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল সামন্তবাদী সংস্কৃতির বিরোধিতা, বাংলা ভাষার ওপর গুরুত্ব আরোপ ও বাঙালির হাজার বৎসরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মূল্যায়নের প্রচেষ্টা।
এই সময় থেকে যে সমস্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হতে থাকে সেগুলোর অধিকাংশই ছাত্র-যুবকদের দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংঘটিত হলেও এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন সর্বাপেক্ষা সংগঠিতরূপে নির্দিষ্ট দিক ও গতিলাভ করে নব প্রতিষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের মাধ্যমে।’ [পঞ্চম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য।]
১০। জনৈক প্রাথমিক শিক্ষকের কাহিনী
আমি মিউনিসিপ্যাল কে বি মিঞা মক্তবের প্রধান শিক্ষক।গত ১০ বৎসর যাবত আমি শিক্ষকতা কাজে ব্রতী আছি। বিগত ১৯৪৭ ইংরেজির এপ্রিল মাসে আসাম প্রদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘটের পর হতে আমরা অনিয়মিতভাবে মাসিক মাহিনা পাইতেছি।
মূল বেতন ১৫ টাকা আর মাগগী ভাতা ৮ টাকা মোট ২৩ টাকা আমার মাসিক প্রাপ্য। ইহাই আমার সংসারের ব্যয় নির্বাহের প্রধান উপজীবিকা। ধানের জমি মাত্র চার কেদার। অতএব মাসিক মাহিনা আজ এই আর্থিক সঙ্কটের দিনে উপজীবিকা নয়, ইহাই জীবিকার প্রধানতম পথ।
গত অক্টোবর মাস হইতে মাহিনা পাইতেছিনা সেপ্টেম্বরে পাইয়াছিলাম সাত মাস অতিবাহিত হইয়া যাইবার পর। যখন চালের দর ২৮ টাকা হইতে ৪০ টাকার মধ্যে তখন কিভাবে যে এই অনিয়মিত বেতন প্রাপ্তিতে আমাদের কাটাইতে হয় তাহা একমাত্র আমার মত দুস্থরাই জানেন আর জানেন খোদা।
চেয়ারম্যান সাহেবের নিকট গেলে শুনিতে হয় ভান্ডার নাকি শূন্য। এই হায় হায় রবের মধ্যে আমরা তো আমাদের অস্তিত্বকে নাই বলিতে পারি না কারণ ক্ষুধা বারবারই অস্তিত্বকে মনে করাইয়া দিতেছে। গ্রামের আমার মতো অনেক আছে যাহাদের অবস্থা আমারই মত। সরকারও তাহাদের অভুক্ত পেটে এক মুষ্টি দানা দেবার ব্যবস্থা করেন নাই।
যখন মিউনিসিপ্যাল বোর্ডও আমাকে দেন না, সরকারও গ্রামের দুঃস্থদের খাদ্য দিবার দায়িত্ব নেন না, তখন বাধ্য হইয়া নিজেদের দিকে ফিরিয়ে চাহিলাম, বাঁচিয়া থাকিতে হইবে, বাঁচিবার স্বাভাবিক তাগিদে। চাহিদা দেখিলাম গ্রামের জমিদার বিপিনচন্দ্র পাল, অবস্থাপন্ন কৃষক হাকিমুল্লাহ, কানাইরাম পাল, বঙ্কুবিহারী পাল, অচিন্তপুরের ইয়াকুবউল্লাহ, ইসবউল্লাহ, সফর আলী, আজিজউল্লাহ মোড়ল, রাজার গাঁওয়ের মহিদউল্লাহ, ইমান আলী প্রভৃতি রোজই ধান বিক্রি করিতেছে। গ্রামে আরো ধান মওজুদ ছিল, এই ধানের মালিক লক্ষণশ্রী গ্রামের বড় জোরদার মতসিন আলী।
গ্রামবাসীদের একটি সভা হইল। সভাপতিত্ব করিলেন – আব্দুল করিম, সভাস্থল -আজিজউল্লাহ মোড়লের বাড়ি। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হইলো তিনটি গ্রামের দুস্থদের জন্য ধান সংগ্রহ আমাদের উল্লিখিত তিনটি গ্রামের অবস্থাসম্পন্নদের নিকট হইতে কর্জ হিসাবে নিবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। তদানুসারে পরদিন আমাদের কয়েকজন বিপিনবাবু প্রকৃতিকে জানাই। ইহা ছাড়া জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ ও জমিদারদের অতিলোভী শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও গ্রামে আলাপ আলোচনা হয় -যাহাতে চিরস্থায়ীভাবে জমি কৃষকদের হাতে আসে এবং দুর্ভিক্ষের হাত হইতে চিরতরে রক্ষা পাইতে পারি।
পাকিস্তান গড়নের পূর্বে এবং নির্বাচনের সময় আমরা শিক্ষকরাও গ্রামে গ্রামে প্রচার করিয়াছি ভোট দিলে আমরা জিতিব; আর জিতিলে কিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি উচ্ছেদ করা হইবে, কৃষক মজুর রাজ্য কায়েম হইবে।
আমি কয়েকদিন আগে ২৮শে ফেব্রুয়ারি বোর্ড অফিসে মাহিনার জন্য লোক পাঠাই। সে ফিরিয়া আসিলে শুনিতে পাইলাম চেয়ারম্যান সাহেব নাকি ‘পে-চেকে’ নাম সহি করিতে রাজি হন নাই এবং বলেন -“একে বেতন দেয়া যায় না, তাহার চাকরি যাইবে। সে ১০৭ ধারার আসামি এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কমিউনিস্ট।”
আমার অপরাধ কি? খাদ্য আর জমির সমস্যা নিয়া কি আমাদের কোন কথা বলার অধিকার নাই? তবে কি নির্বাচনের সময় সাহেবদের ভোটের বাক্স পূর্ণ করার জন্যই কেবল গ্রামের সরল প্রাণ কৃষকদিগকে ঠকানোর জন্য বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারী প্রথা উঠানোর আওয়াজ তোলা হয়? এখন কি খাদ্য আর জমির কথা বলিলেই কমিউনিস্ট হইতে হইবে?
আমরা পাকিস্তান কাহাদের জন্য এবং কি জন্য গড়িয়াছি? না খাইয়া মরার জন্য? শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার জন্য? জমি হইতে উচ্ছেদ হওয়ার জন্য?
আমি আশা করি দেশবাসী এই অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাইবেন। প্রাথমিক স্কুল শিক্ষকদের নিকট এই কথাই বলিতে চাই, যাহারা আমাদের মাসিক মাহিনা দিতে অপারগ তাহারা কিভাবে চাকরি হইতে বরখাস্ত এত তাড়াতাড়ি করিতে পারে তাহা ভাবিয়া দেখিবেন। আজ আমার উপর যে অবিচার হইতেছে কাল আপনাদের উপরও হইবে।
গণতন্ত্রের প্রতিটি দুর্গকে আজ আমাদের সকলের সম্মিলিতভাবেই রক্ষা করিতে হইবে। সকলের প্রতিবাদ ধ্বনি উত্থিত হোক!
ইতি –
তারিখ মোহাঃ আবুল মজহর খান,
৬/৩/৪৯ ইং। গ্ৰাম -বৈঠাখালী
জনৈক প্রাথমিক শিক্ষকের কাহিনী।(১) এই শিরোনামে প্রকাশিত উপরে উদ্ধৃত সিলেট জেলার একজন প্রাথমিক শিক্ষকের এই পত্রটি থেকে শুধু যে প্রাথমিক শিক্ষকদের আর্থিক দুর্গতির বিষয়ই জানা যায় তাই নয়। কৃষক সমাজের সাথে পূর্ববাংলার প্রাথমিক শিক্ষকদের জীবনে নিবিড় সংযোগ, কৃষকদের জমি ও ফসলের আন্দোলনের সাথে তাদের একাত্মতা এবং তাদের উপর সরকারি নিপীড়নের বিষয়ে বক্তব্যের দিক থেকেও পত্রটি খুবই উল্লেখযোগ্য।
প্রাথমিক শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থান সম্পর্কে ১৯৪৮ সাল থেকেই সংবাদপত্রে অনেক লেখালেখি হয়, প্রাথমিক শিক্ষকরা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকায় সভা-সমিতি করেন এবং তাঁরা নিজেদের অবস্থা বর্ণনা করে পত্র-পত্রিকায় অনেক চিঠিপত্র দেন। এই চিঠি পত্র গুলির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষকরা নিজেরাই নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট ভাষায় বর্ণনা করেন। সে জন্যে এই চিঠিগুলিই হলো তৎকালীন প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থান সম্পর্কে সবথেকে নির্ভরযোগ্য দলিল।
১১। প্রাথমিক শিক্ষক সম্মেলন ১৯৪৯
১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের পর থেকে প্রাথমিক শিক্ষকরা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন এলাকায় কিছু কিছু সভা-সমিতি করে নিজেদের অবস্থা পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে নিজেদের দুর্দশার অবসানের দাবি জানাতে থাকেন। কিন্তু পূর্ব বাংলা সরকার শিক্ষকদের এইসব দাবি-দাওয়ার প্রতি কোন ভ্রুক্ষেপই করেন না। কাজেই প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থার কোন উন্নতি না হওয়ায় দিন দিন তার অবনতিই ঘটতে থাকে।
প্রাইমারি শিক্ষকদের অবস্থা এবং সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে ১৯৪৮ সালের ১৫ ই অক্টোবর পাবনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক আহমদ হুসেন একটি বিবৃতিতে বলেন,
নতুন স্কিম চিজটি কি তাহা খুলিয়া বলিলেই থলি হইতে বিড়াল বাহির হইয়া পড়িত। আসলে ডিপিআইএর নির্দেশ ছিল যে, ১৯৪১ সালের আদমশুমারি হিসাবমতো প্রতি দুই হাজার লোকের জন্য একটি স্কুল রাখিয়া বাকী স্কুল উঠাইয়া দিতে হইবে। এই হিসাবমতো সিরাজগঞ্জ মহাকুমায় মোট স্কুলের সংখ্যা থাকিবে ৪৯৩ । বর্তমানে স্কুল বোর্ড পরিচালিত স্কুলের সংখ্যা ৬৪১। ইহার পর সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল, বালিকা স্কুল,এমই স্কুল এবং মাদ্রাসা সংলগ্ন প্রাইমারী বিভাগের সংখ্যা মোটামুটি ১৩৭ । সুতরাং সরকারি নির্দেশ মত ২৭৫টি স্কুল তুলিয়া দিতে হইবে।
মোটামুটি উপরোক্ত স্কিমের দৌলতে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ প্রাথমিক স্কুল তুলে দেওয়া হয়। একমাত্র নাটোর মহাকুমায় ৪০০ । উপরোক্ত হিসাব থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, কত হাজার প্রাইমারি শিক্ষক বেকার হয়ে পড়ে পথে দাঁড়ান। অপরদিকে প্রাইমারি শিক্ষক এর বেতনের হারঃ তৃতীয় শিক্ষক, মাসিক ১৯/=; দ্বিতীয় শিক্ষক, মাসিক ২৭; প্রথম শিক্ষক, মাসিক ২৯ ।
প্রাইমারি শিক্ষকদের প্রতি সরকারের চূড়ান্ত অবহেলার প্রত্যক্ষ ফল চট্টগ্রামের ঈদগাঁও স্কুলের শিক্ষক নাজিমুদ্দিনের অনাহারে হাসপাতালে মৃত্যু। মৃত্যুকালে তাঁর তিন মাসের মাহিনা বাকি ছিল। ওই জেলাতেই অনুরূপ কারণে আরও চারজন প্রাথমিক শিক্ষকের মৃত্যু দু’জনের আত্মহত্যা।
এই অবস্থায় ১৯৪৯ সালের ২৭শে মার্চ ঢাকায় পূর্ববাংলার প্রাথমিক শিক্ষকদের একটি সম্মেলন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন উদ্বোধন করেন মাওলানা মোঃ আকরাম খান এবং তাতে সভাপতিত্ব করেন আব্দুর রহমান খাঁ। পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় আড়াই হাজার প্রাথমিক শিক্ষাকে এই সম্মেলনে যোগদান করেন। (২)
সম্মেলনের সভাপতি আবদুর রহমান খাঁ তাঁর অভিভাষণে বলেন,
‘আমাদের শিক্ষা পরিকল্পনার কৃতকার্যতা নির্ভর করবে উপযুক্ত শিক্ষকের উপর। উপযুক্ত শিক্ষক পেতে হলে উপযুক্ত বেতন দিতে হবে।…… আজকাল সাধারণ কুলিও দৈনিক দুই টাকা উপার্জন করে। না করলে তার সংসার চলে না। প্রাথমিক শিক্ষককেও অন্যূন তা দেওয়া উচিত।
পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল ফজল তার নিম্নলিখিত কার্যবিবরণী উপস্থিত শিক্ষকদের সামনে পেশ করেনঃ
“গত দুর্ভিক্ষে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে পল্লীর বহু প্রাথমিক শিক্ষক মৃত্যু বরণ করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় ২০ হাজারেরও অধিক পল্লী শিক্ষক একেবারে দুস্থ ভিখারি শ্রেণীভূক্ত হয়েছেন। ৮০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষক অর্থাৎ এই প্রদেশের প্রায় সমস্ত শিক্ষক গোষ্ঠী সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়েছেন। প্রদেশের অন্যান্য অধিবাসীরই মতো তাঁরা ভেবেছিলেন -যুদ্ধাবসানে বিপদ খানিকটা কেটে যাবে, কষ্টের কিছু লাঘব হবে। কিন্তু কই, কিছুই হলো না। তাঁরা যা রোজগার করেন তাতে তো তাঁদের একজনের এক বেলার মতনও খাদ্য জোটে না; জিনিসপত্র এখনো অগ্নিমূল্যই রইল। চারগুণ মূল্য দিয়ে চোরা বাজারে না গেলে অন্নবস্ত্র বা রোগের ওষুধপথ্য জোটে না। পক্ষান্তরে কাজে লাগাবার কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না করে শুধু সার্জেন্ট স্কিমের লোভনীয় প্রস্তাব বা পে-কমিশনের লোভ দেখাইয়া দেশের শিক্ষকদের ধাপ্পা দেবার চেষ্টা মাত্র চলেছে। সবদিক দিয়ে শিক্ষকদের বেশি নিরাশ করা হয়েছে। সমস্ত সরকারি বেসরকারি কর্মচারী এমনকি ধাঙ্গড়, মজুররাও যখন যুদ্ধ ভাতা আদায় করলো -প্রাথমিক শিক্ষকদের ভাগ্যে তখন কি জুটেছে? চিরদিন মুখ বুঁজে সহ্য করে এসেছেন বলে তাদের প্রতি এই অবজ্ঞা, এই অবজ্ঞার জন্য তাঁরা গত ১০ বৎসরের মধ্যে একমুষ্টি অন্নের সন্ধানে বিভিন্ন বৃত্তি অবলম্বন করেছেন। যাঁরা আজও শিক্ষকতাকে আঁকড়ে ধরে আছেন তাঁরা বুঝেছেন গ্রামের মধ্যে শিক্ষার ক্ষীণতম আলোক বর্তিকাকে দুর্ভাগ্যের হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব তারা নিয়েছেন। সেই কর্তব্যের গুরুত্বকে সঙ্গী করেই সর্বদা প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে তাঁরা লড়াই চালাচ্ছেন। তাঁরা ভীরু নন, তাঁরা দুর্বল নন। বিশ্বযুদ্ধের যে বিরাট পরিবর্তন সমস্ত পৃথিবীর অর্থনৈতিক ভিত্তির গোড়ায় আঘাত করেছে। বাঁচার তাগিদে যে সামাজিক চেতনা আজ প্রত্যেক শ্রেণীর লোকের মনে জেগেছে। তাতে কেউ আজ নিরবে মুখ বুঁজে অবজ্ঞা অবিচার সইতে পারেনা। তাই শিক্ষক সমাজের এই নবজাগরণ।
এতদিন পর্যন্ত সরকার সমিতিকে কোন গ্ৰাহ্যের মধ্যেই আনেন নাই। কেবল উপেক্ষাই করিয়াছেন। সমিতি ধর্মঘটের নোটিশ দিলে সরকার তাঁদের তাবেদার সংবাদপত্র ও শিক্ষা বিভাগের শাসনযন্ত্রকে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করিয়া তাঁহাদের শক্তি ও সংহতিকে চূর্ণ করিবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁহাদের সমস্ত অপচেষ্টাই ব্যর্থ হইয়াছে। ইহা হইতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় সমিতি এক বিরাট শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে।
১৬ -৩ -৪৮ ইং তারিখে ঢাকাতে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কার্যকরী সভায় গৃহীত ২ নং প্রস্তাবানুসারে পূর্ববঙ্গ সরকারকে এই মর্মে এক চরমপত্র দেওয়া হয় যে যদি বর্তমান বাজেটে সরকার প্রাথমিক শিক্ষকদের সর্বনিম্ন দাবিগুলো তানিয়া না লন তবে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষকদের বিশেষ সম্মেলন আহ্বান করিয়া তাহাতে বাধ্য হইয়াই পূর্ব-পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষকদের চরমপন্থা গ্রহণের নির্দেশ দিবেন।
আমাদের ডেপুটেশনের নিকট শিক্ষামন্ত্রি শিশু রাষ্ট্রের অজুহাত দেখাইয়া আরো কিছুকাল অপেক্ষা করিবার উপদেশ দেন। ইতিপূর্বে ঢাকা জেলার শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি পত্নীতলা, ধামরাইহাট, পোর্ষা এই তিনটি থানার শিক্ষকগণের বেতন সম্বন্ধে সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট, অন্যান্য মেম্বারগন তিনবার ডেপুটেশন দেন। প্রত্যেক ডেপুটেশনেই সরকার আমাদেরকে আশ্বাস বাক্যে পরিতুষ্ট করে বিদায় দিয়েছেন। পরে সরকার ইহার কোন প্রতিকার করিয়াছেন বলিয়া কোনো প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে না। পোর্ষা, ধামরাইহাট, পত্নীতলার শিক্ষকগণ প্রায় দুই বছর পর্যন্ত বেতন পাইতেছেন না, ইহা হইতে দুঃখ আর কি হইতে পারে?
এইতো গেলে ডেপুটেশনের কথা। এ পর্যন্ত বিভিন্ন কাগজে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ও বিভিন্ন সমিতিতে জোর আন্দোলন করা হইতেছে। তবুও আমাদের সরকার সে সব শুনিয়াও শুনেন না, দেখিয়াও দেখেন না।…. পূর্ব-পাকিস্তানবাসী দরিদ্র কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলিয়া যে পাট উৎপন্ন করে, সেই পাট শুল্ক অন্য কোন খাতে খরচ না করিয়া এই দরিদ্র চাষীদের ছেলেমেয়েদের জন্য ব্যয় করা কি উচিত নহে? যে জমিদারি প্রথার কল্যাণে একদল শোষক এদেশের কৃষক কুলের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের অর্জিত সম্পদের বিরাট অংশ অযথা শোষণ করিতেছেন সে জমিদারি প্রথা উঠাইয়া দিয়া তাহার আয় হইতে দরিদ্র চাষীদের ছেলেমেয়ের ব্যবস্থা করা কি অন্যায় হইবে? মোট কথা, ‘ ইচ্ছা থাকলে উপায় হইবেই।’……
এরপর প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবুল ফজল শিক্ষকদের কাছে নিম্নলিখিত ভাষায় আন্দোলনের আহ্বান জানানঃ
‘বন্ধুগণ ! কাকুতি-মিনতি আবেদনের পালা শেষ হইয়াছে, ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে আপনাদের ভাগ্যে জুটেছে শুধু অবহেলা আর অবজ্ঞা, মনে রাখতে হবে দুর্বলকে কেহ শ্রদ্ধার চোখে দেখে না। সমিতির নির্দেশ মতে দৃঢ়তার সহিত অগ্রসর হোন। আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী।’
১২। ধর্মঘটের পথে প্রাথমিক শিক্ষক
১৯৫০ সালের ২৭শে এপ্রিল ময়মনসিংহ ছায়াবানী হলে পূর্ব-পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। (১) ময়মনসিংহ জেলা স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুল মোনায়েম খাঊ অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতিরূপে সম্মেলনের সমস্ত স্থানীয় আয়োজনের তত্ত্বাবধান করেন। এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। শিক্ষা মন্ত্রী আবদুল হামিদ এবং সভাপতিত্ব করেন পূর্ব বাংলা মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ইব্রাহিম খাঁ।
পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে বহুসংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষক এই সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনের নতুন বৎসরের জন্য অধ্যাপক মোঃ আজিমউদ্দিন সভাপতি এবং আবুল ফজল সম্পাদক নির্বাচিত হন।
প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় শিক্ষা ক্ষেত্রে যে সংকটজনক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং সরকারকে সতর্ক করে নওবেলালের একটি সম্পাদকীয়তে এই সময় বলা হয়।’
পূর্ব পাকিস্তানের ৮০ হাজার অসহায় প্রাথমিক শিক্ষকদের চরম দূর্দশার কথা আমরা পূর্বেও আমাদের সংবাদপত্রের মারফতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার চেষ্টা করিয়াছি।….. পূর্ব পাকিস্তান সরকার আগামী ১০ বৎসরে ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে সমগ্র দেশে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করিবার মৌলিক নীতি গ্রহণ করিয়াছেন। এবং ১৯৫০ -৫১ সাল হইতে তাহার প্রারম্ভিক কার্য শুরু হইবে বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। কিন্তু কোথায়? সরকারপক্ষ হইতে তেমন আশাপ্রদ সাড়া দেখা যাইতেছে না।….. আমরা মনে করি এই প্রাথমিক শিক্ষকদের রক্ষা করা – দেশকে রক্ষা করা, জাতিকে রক্ষা করা। এখানেই সত্যিকারের ডিফেন্স। এই প্রায় এক লক্ষ শিক্ষকের ১৫ টাকা হইতে ৩২ টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতন পাইয়া থাকেন। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হইতে চাউলের দাম যে প্রকার ধাঁধা করিয়া বর্ধিত হইতেছে তাহাতে স্ত্রী-পুত্র পরিবার লইয়া কিভাবে এই হতভাগ্যরা জীবন যাপন করিতেছেন তা সহজেই অনুমেয়। এই শিক্ষকদের দাবি ছিল শুধু কেন্দ্রীয় সরকারের পে-কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী পিয়ন পেয়াদা চাপরাশীদের সমান মাহিনা। -এবং জীবন সন্ধ্যায় যাহাতে প্রভিডেন্ট ফান্ড হইতে কয়েকটা টাকা লইয়া জীবনের শেষ দিনগুলি কাটায়া যাইতে পারেন তার ব্যবস্থা। এমনি নিম্নতম দাবি। দীর্ঘদিন হইতে আদর্শের মোহে আজও ঝড়ের দিনে জাতির কান্ডারী হিসেবে হাল ধরিয়া এই শিক্ষকরা আছেন। অবর্ণনীয় অর্থনৈতিক নিষ্পেষণে তাদের আদর্শের মর্মমূলচ্যূত করিতে পারে নাই। আজ কিন্তু হিতির গভীরে নাড়া পড়িয়াছে। সরকারের সজাগ দৃষ্টি প্রয়োজন।(২)
দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক শিক্ষকদের বহু আবেদন-নিবেদন সত্বেও সরকার তাদের দুরবস্থা অবসান অথবা কোনো বাস্তব পদক্ষেপ না নেয়ায় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কার্যকরী কাউন্সিল ১৯৫০ সালের ২৭শে অক্টোবর চাঁদপুরে এক বৈঠকে মিলিত হন।(৩) এই বৈঠকে স্থির হয় যে পরবর্তী ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে পূর্ববাংলা সরকার যদি তাঁদের ন্যায্য দাবি-দাওয়াসমূহ পূর্ণ না করেন তাহলে ১৯৫১ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে প্রাথমিক শিক্ষকরা প্রদেশব্যাপী ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এই বৈঠকে আরো স্থির হয় যে, পরবর্তী ২রা ডিসেম্বর তারা পূর্ববাংলার সর্বত্র ‘প্রাথমিক শিক্ষক দিবস’ পালন করবেন। এ জন্যে কার্যকরী কাউন্সিল সিদ্ধান্ত নেন যে, প্রতি জেলায় ৯ জন সদস্য নিয়ে এক একটি ‘সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হবে। এছাড়া শিক্ষক সমিতির সভাপতি ,সম্পাদক হাজী সৈয়দ সুলতান (চট্টগ্রাম), আব্দুল গনি (রংপুর), ফাত্তাহ খান (ময়মনসিংহ), মোহাম্মদ জাহেদ আলী (ঢাকা), মোঃ মোতাহার উদ্দিন আহমদ (বরিশাল), মোঃ সাখাওয়াত আলী (ত্রিপুরা) এবং আহমদ হোসেন (পাবনাকে) নিয়ে একটি প্রাদেশিক সংগ্রাম পরিষদও এই বৈঠকে গঠিত হয়।
শিক্ষক সমিতির কার্যকরী কাউন্সিলর চাঁদপুর বৈঠকের পর একদিকে পূর্ববাংলার সর্বত্র ধর্মঘটের প্রস্তুতি শুরু হয় এবং অপরদিকে পূর্ববাংলা সরকার সেই পরিস্থিতির মোকাবিলার উদ্দেশ্যে নানা কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। এর মধ্যে একটি হল শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া ও শিক্ষক সমিতির বক্তব্য সম্পর্কে এক সরকারি প্রেস নোট। এই প্রেসনোটের জবাবে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোঃ আজিম উদ্দিন একদিকে সরকারি প্রেসনোটের বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য প্রচারণা এবং অপরদিকে শিক্ষকদের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে একটি বিবৃতির মাধ্যমে নিম্ন লিখিত বক্তব্য প্রদান করেন –
‘শিক্ষাসংক্রান্ত প্রেসনোটটিতে প্রথমেই শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারী ঔদাসীন্যের সমালোচকদের সম্পর্কে বলা হইয়াছে যে, সকল সমালোচনাই স্রেফ অজ্ঞতাপ্রসূত এবং ধ্বংসাত্মক। তবে প্রেসনোটে এমনই সব ভ্রান্তিমূলক বিষয়ের অবতারণা করা হইয়াছে যাহাতে দেশবাসী প্রদেশের শিক্ষার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার সুযোগ পাইবেন না। বরং অনেকের মনেই একটা বিভ্রমের সৃষ্টি হইতে পারে।
প্রেসনোটে এমন কতকগুলি কৃতিত্ব কাহিনীর উল্লেখ করিয়া শিক্ষা বিভাগের যোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হইয়াছে, যেগুলির পুনঃ পুনঃ উল্লেখের ফলে তাহারা প্রায় পৌরাণিক কাহিনীর পর্যায়ে উন্নীত হইয়াছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ মেডিকেল কলেজ স্থাপন, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলকে কলেজের পর্যায়ে উন্নয়ন প্রভৃতি কীর্তিকাহিনী কথা দেশবাসী পূর্বেও বহুবার শুনিয়াছে। নিজেদের দুর্বলতা ও অযোগ্যতার প্রকাশকে ঢাকিবার জন্য আমাদের শিক্ষা বিভাগ রূপকথার শিয়াল পন্ডিতের বুদ্ধি অবলম্বন করিয়া দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করিতেছেন। নতুবা সিন্ধু ও সীমান্তের মতো অনগ্রসর প্রদেশ দুইটি যেক্ষেত্রে পাকিস্তান অর্জনের পর স্ব স্ব এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছে সেক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের শিক্ষাবিভাগ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা সম্প্রসারণ করতঃ প্রদেশের গোটাকয়েক কলেজের পরীক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা এবং দুই একটি নতুন কলেজ স্থাপন করিয়া কি এমন গৌরব দাবি করিতে পারে? এই পরীক্ষা গ্রহণের ফলাফল প্রকাশ করিতেই আবার বৎসর শেষ হইয়া যায়।
শিক্ষা পরিকল্পনা সম্পর্কেই পূর্ববঙ্গের শিক্ষা বিভাগ সর্বাপেক্ষা বেশি ব্যর্থতার পরিচয় দান করিয়াছেন। তবুও প্রেসনোটে গোটা দুই শিক্ষা সংস্কার কমিটি স্থাপন ও তাহাদের কার্যের উল্লেখ করা হইয়াছে। এই কমিটিগুলির কার্যকারিতা সম্পর্কে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের খেয়াল-খুশিমতো কতকগুলি প্রশ্ন তৈরি করা হইয়াছে।
ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান এম এল এ প্রমুখ বিশিষ্ট (?) শিক্ষাবিদের মতামত সংগ্রহ করতঃ শিক্ষা বিভাগের অফিসের ফাইল চাপা দিয়ে রাখা হইয়াছে। শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের সমবায়ে আজ পর্যন্ত কোন কমিটি গঠিত হয় নাই এবং আজ পর্যন্ত কোন কমিটিই পল্লী বাংলার অভ্যন্তরে ভ্রমণ করতঃ শিক্ষার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না।
শিক্ষা বিভাগের শৈথিল্যের দরুন প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাই সর্বাপেক্ষা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হইয়াছে। দেশে অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হইবার পর এই সর্বপ্রথম আলোচ্য প্রেসনোটে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব সরাসরিভাবে অস্বীকার করলেন। জাতি গঠনের প্রথম সোপান প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার মতো জরুরি ব্যাপার নিয়ন্ত্রণের ভার ন্যস্ত রাখিয়াছে স্কুল বোর্ডগুলির স্কন্ধে। জেলা স্কুল বোর্ডগুলি একশ্রেণীর রাজনীতি ব্যবসায়ীদের কুচকাওয়াজের আখড়ায় পরিণত হইয়াছে। সভ্যগণের অধিকাংশের প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনার যোগ্যতা নাই। আসল ব্যাপার হইতেছে এরূপ অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুলের বেতনের হার নির্ধারণ করা, স্কুল ও শিক্ষক ছাঁটাইয়ের নির্দেশ দান করা, পাঠ্যতালিকা স্থির করা, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা ইত্যাকার সকল‌ কার্যই সরকারি শিক্ষা বিভাগ করিয়া থাকেন। তাহা ছাড়া সরকারের মুখপাত্ররূপে জেলায় প্রধান পরিদর্শক কর্মচারী পদাধিকারবলে স্কুল বোর্ডের সেক্রেটারি হইয়া থাকেন। প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার অধিকাংশ দায়িত্ব বহন করিয়াও শিক্ষাবিভাগ প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব এড়াইতে চাহিতেছেন কেন?
প্রাথমিক শিক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব এড়াইয়া শিক্ষা বিভাগ চট্টগ্রাম, বরিশাল, পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী প্রকৃতির জেলায় স্কুল ও শিক্ষক ছাঁটাইয়ের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব অস্বীকার করার ফন্দি আঁটিয়াছেন মাত্র।
কিন্তু কয়েকটি জেলায় আটটি প্রচলিত ট্রেনিং কেন্দ্র উঠাইয়া দিয়া তাদের স্থানে একটি করিয়া ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপন করা হইতেছে। এই আটটি কেন্দ্রে যে স্থলে পূর্বে দুই-তিনশত ট্রেনিং পাইতেন সে স্থলে একটি কেন্দ্রে মাত্র একশত শিক্ষকের জন্য ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা হইতেছে। যাইহোক, শিক্ষা বিভাগের কর্তারা কি আজ পর্যন্ত বুঝিতে পারেন নাই যে, প্রাথমিক শিক্ষকদের জীবিকা নির্বাহের উপযোগী পারিশ্রমিক না দিয়ে শুধু নূতন নূতন ট্রেনিং কেন্দ্র স্থাপন করিলেই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি হইবে না।
শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের স্মরণ রাখা উচিত যে, বাক্যের অপেক্ষা কার্যের সমাপন অনেকাংশে শ্রেয়ঃ। প্রচার প্রপাগান্ডার দ্বারা সাময়িক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা সম্ভব হইলেও ইহার পরিণাম ভাল হয় না।(৪)
শিক্ষক সমিতির কার্যকরী কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২রা ডিসেম্বর, ১৯৫০, তারিখে পূর্ব বাংলার সর্বত্র ‘প্রাথমিক শিক্ষক দিবস’ উদযাপিত হয়। এই দিবস উদযাপনকালে প্রাথমিক শিক্ষকরা এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেন যে পরবর্তী ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার তাঁদের দাবি-দাওয়া স্বীকার করে না নিলে তাঁরা পহেলা জানুয়ারি থেকে ‘চরমপন্থা’ অবলম্বন অর্থাৎ ধর্মঘট করবেন।
১৫ই ও ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৫১, তারিখে রংপুর টাউন হলে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।(৫) এই সম্মেলনের নির্বাচিত সভাপতি আবুল মনসুর আহমদ অসুস্থতাবসতঃ অনুপস্থিত থাকায় তাঁর লিখিত অভিভাষণটি পাঠ করে শোনানো হয়। সম্মেলনে প্রথমদিন সভাপতিত্ব করেন ময়মনসিংহের প্রাথমিক শিক্ষক আবদুর রহমান এবং দ্বিতীয় দিন সভাপতিত্ব করেন বরিশালের প্রাথমিক শিক্ষক মোতাহেরুদ্দিন আহমদ। পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত পূর্ব বাংলার সকল জেলা থেকে প্রায় এক হাজার শিক্ষক প্রতিনিধি রংপুর সম্মেলনে যোগদান করেন।
শিক্ষক সম্মেলনের ধর্মঘট সম্পর্কে ১৫ই ফেব্রুয়ারি নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি গৃহীত হয়ঃ
সরকার কর্তৃক প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া বারবার উপেক্ষিত হওয়ায় এবং মুসলিম লীগের শরণাপন্ন হওয়া ও ব্যর্থ হওয়ায় সম্মেলন ধর্মঘট করার সিদ্ধান্ত করিতেছে। আগামী ৪ঠা, ৫ই ও ৬ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষকগণের প্রতীক ধর্মঘট করিবেন এবং পহেলা এপ্রিল হইতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট চালাইয়া যাইবেন।
অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে সরকার ও সরকারি দলের জুলুম সম্পর্কে গৃহীত নিম্নলিখিত প্রস্তাব দুটি উল্লেখযোগ্যঃ
ময়মনসিংহ স্কুল বোর্ডের সভাপতি সাহেব (আব্দুল মোনায়েম খান) বিগত ২রা ডিসেম্বর ‘প্রাথমিক শিক্ষক দিবস’ পালন করার অজুহাতে বহু প্রাথমিক শিক্ষকের বিল বন্ধ করিয়া এবং শিক্ষকগণকে বিভিন্ন প্রকার ভীতি প্রদর্শন করিয়া যে জুলুম শুরু করিয়াছেন তৎপ্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অবিলম্বে প্রতিকার দাবি করা হয়।
ফরিদপুর জেলা স্কুল বোর্ডের নন-মেট্রিক আন-স্ট্রেইন্ড প্রাথমিক শিক্ষকদের ছাঁটাই করার নির্দেশ দিয়া যে অন্যায় জুলুমবাজী শুরু করিয়াছে তাহার তীব্র প্রতিবাদ করা হয় এবং একাদিক্রমে যে সকল শিক্ষক তিন বৎসর যাবত শিক্ষকতা করিতেছেন তাঁহাদিগকে স্ব স্ব পদে বহাল রাখার দাবি জানানো হয়।৬
রংপুর সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকরা পূর্ব বাংলার সমস্ত স্কুলের ৪-৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতীক ধর্মঘট পালন করেন। কোন কোন স্থানে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি জানিয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়।৭ এই উপলক্ষে শিক্ষকরা যে সকল সভা-সমিতি করেন তাতে পহেলা এপ্রিল থেকে সাধারণ ধর্মঘট অনির্দিষ্টকালের জন্যে চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তের সমর্থনে শিক্ষকরা ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তোলেন।
৪ঠা থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত তিনদিন স্থায়ী প্রতীক শিক্ষক ধর্মঘটের পরে এ সম্পর্কে সাপ্তাহিক নওবেলাল ‘ চরমপন্থা’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধেঃ ৮ বলেন
পূর্ব বাংলার প্রাইমারি শিক্ষকরা চরমপন্থা গ্রহণ করিবার জন্য আয়োজন শেষ করিয়াছেন। সমগ্র পূর্ব বঙ্গের হাজার হাজার শিক্ষকেরা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ হইতে তাহাদের ন্যূনতম দাবির ভিত্তিতে ধর্মঘট শুরু করিবেন।
পাকিস্তান অর্জনের প্রথম দিন হইতে অসহায় শিক্ষকদের দাবিদাওয়াগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, যাহারা বর্তমানে পাকিস্তানের কর্ণধার তাহারা দেশের জনসাধারণের সন্তান-সন্ততির শিক্ষা চাহেন না। এবং এই কয়েক হাজার শিক্ষক গলায় কলম বাঁধিয়া নদীতে ঝাঁপ দিলেও রাষ্ট্র কর্ণধারগণের বিশেষ আসে যায় না। মাঝে মাঝে পরিষদে, ভোজসভায়, বিভিন্ন জমায়েতে মন্ত্রীগণকে এই অসহায় শিক্ষকদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করিতেও দেখা গিয়াছে। আবার কাহাকে কাহাকে ইহাও বলিতে শুনা গিয়াছে, পাঠশালার শিক্ষকেরা, নাকি নিজের অন্তরের তাগিদে এই ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত করেন নাই, তাহা বাহিরের মানুষের উস্কানিতে বিভ্রান্ত হইয়া করিয়াছেন। আমরা জিজ্ঞেস করি, পেটের ক্ষুধা কি জিনিস তাহা কি মন্ত্রীরা সম্পূর্ণ ভুলিয়া গিয়াছেন?
ধর্মঘটের পূর্বে প্রাথমিক শিক্ষকদের আবেদন-নিবেদন সম্পর্কে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয়ঃ
প্রাইমারি শিক্ষকরা দেশের এক প্রান্ত হইত অপর প্রান্ত পর্যন্ত সমস্ত সুধীজনকে তাহাদের দুঃখ এবং দুর্দশার কথা বারবার জানাইয়াছেন। আজাদ দেশের সরকারের ছিন্নপত্রের ঝুলিতে কয়েক লাখ আবেদন পত্র পড়িয়া রহিয়াছে। প্রাইমারি শিক্ষকরা জীবন এবং মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়াইয়াছে- তাহাদের অন্য কোন উপায় নাই।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র সাড়ে তিন বৎসরের মধ্যে পূর্ববাংলায় যে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা এবং আন্দোলনের পরিস্থিতি বিরাজ করছিল সেই প্রেক্ষিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘট সরকারের জন্যে যে সংকটময় পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে সে বিষয়ে নওবেলাল এই সম্পাদকীয়টিতে যা বলেন সেটা খুবই উল্লেখযোগ্যঃ
দেশ শাসনে অনভিজ্ঞ মন্ত্রীগণ কালোমেঘের রুদ্ররূপ নিরীক্ষণ করিতে পারিতেছেন না। ঝড়ের বাতাস যে শুরু হইয়াছে তাহাতে খরকুটা সব ভাসিয়া যাইবে। সেই মহানিশা অবসানের দায়িত্ব সম্পর্কে জনসাধারণ সজাগ হইয়া উঠিয়াছেন। প্রাইমারি শিক্ষকদের আসন্ন ধর্মঘটের সহিত জনসাধারণের মুক্তি আন্দোলনের একটি নিবিড় সম্পর্ক রহিয়াছে তাহা অনস্বীকার্য। প্রাইমারি শিক্ষকরা তাদের স্ব-স্ব দাবিকে ভিত্তি করিয়া , তাহাদের ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থাগুলি তাদের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বন্ধন মুক্তির আন্দোলন করিতেছেন। একটির সহিত অন্যটির প্রকৃতিগত সম্পর্ক রহিয়া গিয়াছে। রাষ্ট্র পরিচালকগণ মানবীয় বৃত্তিগুলি বিসর্জন দিতে পারেন। কিন্তু নির্যাতিত জনগণের আন্দোলনের গতিধারাকে রোদ করিয়া নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করিবার জন্য আঘাত না দিয়া আসন্ন প্রাইমারি শিক্ষকদের ধর্মঘটের কারণ নিবারণ করা প্রয়োজন। যথাসময়ে রাস্ট্র কর্ণধারগণকে সজাগ হইবার জন্য আমরা বলিতেছি। বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থা বিবেচনা না করিলে একটা বিরাট সংকট দেখা দিবে।….. প্রাইমারি শিক্ষকরা তাহাদের চরমপন্থা কার্যকরী করার পূর্বেই বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করি আমরা আশা করি সরকার দেশে অশান্তির আগুন প্রজ্জ্বলিত হইতে দিবেন না।
১৩। ধর্মঘট বানচালের উদ্দেশ্যে সরকারি ঘোষণা
আসন্ন প্রাথমিক শিক্ষক ধর্মঘটের মোকাবিলা করার অন্যতম উপায় হিসেবে পূর্ববাংলা সরকার মার্চ মাসের শেষ দিকে একটি প্রেসনোটের মাধ্যমে শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি সম্পর্কিত একটি ঘোষণা প্রকাশ করেন।১ এতে বলা হয় যে, যে সমস্ত এলাকাতে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তিত হবে সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে সরকার নিম্নলিখিত হারে ভাতা সহ বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত করেছেনঃ (ক) প্রধান শিক্ষক, স্ট্রেইন্ড ম্যাট্রিক ও তদুর্ধ যোগ্যতাসম্পন্ন ৫০||.-১-৬৫||.; (খ) সহকারী শিক্ষক, স্ট্রেইন ম্যাট্রিক ৪৫||.-১-৫৫||.; (গ) সহকারি শিক্ষক, স্ট্রেইন্ড নন-ম্যাট্রিক অথবা আন-স্ট্রেইন্ড ম্যাট্রিক ৩৫||.-১-৫০||. ।
প্রেসনোটটিতে বলা হয় যে, পরবর্তী দশ বৎসরের মধ্যে পূর্ববাংলার সর্বত্র বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হবে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইতিমধ্যে প্রবর্তিত হয় নাই। সে রকম এলাকায় যে সমস্ত উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক বর্তমানে কাজ করেছেন, তাঁরাও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তিত হলে নয়া হারের সুবিধা পাবেন। তবে বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তিত এলাকায় সকল শিক্ষক যে নতুন হারে বেতন পাবেন তা নয়।
প্রেসনোটটির মাধ্যমে সরকার আরো ঘোষণা করেন যে, প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি বদলীর যোগ্য করা হয়েছে। কোন এলাকায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তিত হলে সেখানকার অধিকাংশ চাকরিই বাধ্যতামূলক বদলীর আওতায় পড়বে এবং অপরাপর এলাকার অর্থাৎ যেখানে বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তিত হয় নাই সেখানকার শিক্ষকদের অনেককেই বদলীর ব্যবস্থা করা হবে।
যে সমস্ত এলাকায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা এখনো প্রবর্তন করা হয় নাই সেই সব এলাকার শিক্ষকদের বেতন নিম্নলিখিত হারে বৃদ্ধির কথা প্রেসনোটটিতে বলা হয়ঃ প্রধান শিক্ষক ২||. ; সহকারী শিক্ষক ১||. । এই বেতন বৃদ্ধির ফলে সরকারের বাৎসরিক ১৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে এবং তা পরবর্তী ১লা এপ্রিল অর্থাৎ ধর্মঘট যে তারিখে শুরু হওয়ার কথা সেই তারিখ থেকেই কার্যকর করা হবে।
যেসকল যোগ্যতাসম্পন্ন প্রধান শিক্ষক বর্তমানে কাজে নিযুক্ত রয়েছেন তাঁদের মধ্য থেকে অনেকেরই নব প্রবর্তিত সহকারি সাব-ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ এবং অদূর ভবিষ্যতে এই সব সরকারি সাব-ইন্সপেক্টর শিক্ষা বিভাগের পরিদর্শকের উচ্চতর পদে নিয়োগের সম্ভাবনার কথাও এই সাথে প্রেসনোটটিতে বলা হয়।
সরকারি প্রেসনোটে বেতন বৃদ্ধির যে কথা ঘোষণা করা হয় তা এতই সামান্য যে প্রাথমিক শিক্ষকদের পক্ষে তার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তার থেকে বেশি বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তাঁরা তাঁদের চাকরি বদলীযোগ্য করায় নিজ নিজ এলাকায় প্রাথমিক শিক্ষকদের কিছু কিছু প্রভাব ছিল। এই প্রভাবকে বিনষ্ট করার জন্যই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বিপুল অধিকাংশ প্রাথমিক শিক্ষকই মাইনে অতি অল্প হওয়ার জন্যে নিজ নিজ এলাকায় কৃষিকার্য অথবা অন্যকোন অর্থকরী কাজে লিপ্ত থাকতেন। তাঁদেরকে তাঁদের নিজ নিজ এলাকা থেকে বদলি করার অর্থই ছিল তাদের জীবিকার ভিত্তিকে সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করা। কাজেই এই সরকারি সিদ্ধান্ত যে ধর্মঘটীদেরকে ধর্মঘটের পথ থেকে নিরস্ত করে তাদেরকে আরও নিশ্চিত ভাবে ধর্মঘটের দিকে ঠেলে দেবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। এবং বস্তুতঃপক্ষে ঘটেছিলও তাই। প্রধান শিক্ষকদেরকে প্রলুব্ধ করার জন্য যে সম্ভাবনার কথা প্রেসনোটটিতে বলা হয়েছিল তারও ভাঁওতাপূর্ণ চরিত্র সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষকদের মনে কোন সন্দেহ ছিল না। এসবের ফলে সরকারি প্রেসনোটটি ধর্মঘটে আগ্রহী শিক্ষকদের ঐক্যকে বিনষ্ট করতে তো পারেইনি, উপরন্তু তার ফলে তাঁদের ঐক্য জোরদারই হয়েছিল।
এই প্রেসনোটটি প্রকাশিত হওয়ার পর প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কার্যকরী কমিটি তেইশে মার্চ ঢাকা ৩২ নম্বর পুরানা মোগলটুলীতে এক বৈঠকে মিলিত হন। প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোঃ আজিমউদ্দিনের সভাপতিত্বে এই বৈঠকে শিক্ষক সমিতির সহ-সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম সহ বিভিন্ন জেলার প্রায় ৪০ জন সদস্য উপস্থিত থাকেন।২
এই বৈঠকে সমিতির কার্যকরী কমিটি প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে পহেলা এপ্রিল ধর্মঘট শুরু করে অনির্দিষ্টকালের জন্য তা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। পূর্ববাংলা সরকার বাধ্যতামূলক এলাকার বাইরের প্রাথমিক শিক্ষকদের মাসিক ১||.-২|. হারে বেতন বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন তাতে তাঁরা প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদার পক্ষে হানিকর বলে অভিহিত করেন। তাঁরা এই বৈঠকে সুস্পষ্ট দাবি জানান যে জীবিকা নির্বাহের উপযোগী বেতন বৃদ্ধি না করা পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষকদেরকে এলাকা থেকে বদলি করা চলবে না।
১৪। প্রাথমিক শিক্ষক ধর্মঘট
পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতির কার্যকরী কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী পহেলা এপ্রিল থেকে পূর্ববাংলার সর্বোচ্চ প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘট শুরু করেন। ধর্মঘট সফল করার উদ্দেশ্যে কার্যকরী কমিটি প্রাথমিক শিক্ষকদের নিম্নলিখিত কার্যক্রম অবলম্বনের নির্দেশ দেনঃ
(ক) ৫ই এপ্রিল প্রত্যেক মহাকুমা শহরে মহকুমার সকল শিক্ষক সমবেত হইয়া মিছিল ও সভার এন্তেজাম করিবেন (খ) ৭ই এপ্রিলের মধ্যে প্রত্যেক জেলা সমিতি সংগ্রামের এক-চতুর্থাংশ কেন্দ্রীয় সমিতির নিকট পাঠাইয়া দিবেন (গ) ধর্মঘট কালে সর্বত্র সভা-সমিতি করিয়া জনসাধারণকে ধর্মঘটের কারণ বুঝাইয়া বলিতে হইবে। (ঘ) আগামী ১৫ই এপ্রিলের মধ্যে জেলা সমিতিকে মঞ্জুরি গ্রহণ করিতে হইবে। (ঙ) আগামী ১৫ এপ্রিল সর্বত্র প্রাথমিক শিক্ষক দিবস পালন করিতে হইবে। এই উপলক্ষে জনসাধারণের নিকট হইতে ধর্মঘট তহবিলে চাঁদা আদায় করিতে হইবে এবং হরতাল, মিছিল ও সভার এন্তেজাম করিতে হইবে। শহর এলাকাগুলিতে এই দিবস পালনের জন্য বিশেষ মনোযোগ দিতে হইবে।১
প্রাথমিক শিক্ষকদের এই ধর্মঘট জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন লাভ করে। পূর্ববাংলার সর্বস্তরের জনগণ বিশেষ করে প্রগতিশীল ছাত্র ও যুবসমাজ এই ধর্মঘটকে সক্রিয় ভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।২ ২৭-২৮শে মার্চ ঢাকায় যে পূর্ব পাকিস্তান যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে আসন্ন প্রাথমিক শিক্ষক ধর্মঘট কে সমর্থন জানিয়ে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটির গৃহীত হয়ঃ
‘সম্মেলন অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি ন্যায় ও যুক্তিসংগত মনে করে এবং প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রস্তাবিত পহেলা এপ্রিল হইতে ধর্মঘট আরম্ভ করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানায় এবং সরকারকে তাঁহাদের দাবি মানিয়া লইবার দাবি জানায়।’৩
এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে এই যুব সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ নামের নতুন যুব সংগঠনটি গঠিত হয় তার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন অলি আহাদ।১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় যে শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তিনি ছিলেন তার মূল উদ্যোক্তাদের একজন এবং সম্মেলনের অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি। শিক্ষার সমস্যা ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় তাঁরা এ বিষয়ে ইতোপূর্বে আন্দোলন শুরু করেছিলেন এবং এজন্য প্রাথমিক শিক্ষক ধর্মঘট সম্পর্কে যুব সম্মেলনের সমর্থন নিষ্ক্রিয় নয়, যথেষ্ট সক্রিয়ই ছিল।
প্রাথমিক শিক্ষকরা নিজেরা ধর্মঘটকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য সভা, সমিতি, মিছিলে তাঁদের সংগঠিত করে চলেন এবং জনগণও বিভিন্ন সভা সমিতির মাধ্যমে পূর্ববাংলার সর্বত্র তাকে সমর্থন জানান।৪
১৮ এপ্রিল আগানগর (জিনজিরা, ঢাকা) প্রাথমিক স্কুলে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতির কার্যনির্বাহক সমিতির একটি বৈঠক হয়। সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আজিম উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে শিক্ষক ধর্মঘটে আশানুরূপ সাড়া দেওয়া সন্তোষ প্রকাশ করা হয় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ২রা মে সর্বত্র ‘প্রাথমিক শিক্ষক দিবস’ পালন করা হবে। ১১ই মে চাঁদপুরে পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতির একটি বিশেষ সম্মেলন আহবান এর সিদ্ধান্তও এই বৈঠকে গৃহীত হয়।৫
২৭শে এপ্রিল তারিখে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘটের সমর্থনে একটি জনসভা আহ্বান করেন। ওই দিনেই পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ প্রাথমিক শিক্ষকদের সমর্থনে নিম্নলিখিত বিবৃতি প্রদান করেনঃ
জীবিকার উপযুক্ত বেতনের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষকেরা পহেলা এপ্রিল থেকে ধর্মঘট করছেন। এ ধর্মঘটের ফলে হাজার হাজার প্রাথমিক স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে এবং শিশুদের জন্য শিক্ষার দ্বার বন্ধ হয়েছে। শিক্ষকদের দাবির প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একথা মনে হয় যে, জনগণের শিক্ষার জন্য কোন পরোয়া না করাই সরকারের ইচ্ছাকৃত নীতি। দেশের জনগণের শিক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে সরকারকে অল্পসংখ্যককে সীমিত সুযোগদানের নীতিই অনুসরণ করতে দেখছি। শিক্ষাকে রক্ষা করতে গেলে এই নীতিকে যেকোন মূল্যেই প্রতিরোধ করতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি দাওয়ার প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ আরমানিটোলায় একটি জনসভা আহ্বান করেছে। আমরা যুবলীগের কর্মীরা শিক্ষকদের দাবি দাওয়ার প্রতি সর্বান্তকরণে সমর্থন জানাচ্ছি এবং জনসাধারণের কাছে আবেদন করছি যাতে তারা সরকারের শিক্ষা উচ্ছেদ নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তোলেন।৬
ধর্মঘট চলাকালে ‘প্রাইমারি শিক্ষক’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধে ঢাকার ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার বলেন যে, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা পরিকল্পনা সারাদেশব্যাপী চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ তখনই পাওয়া যেতে পারে যদি সরকার বাংলা ভাষায় আরবি অক্ষর চালু করার মতো সব আজগুবি পরিকল্পনায় অর্থব্যয় না করতো।৭
পাকিস্তান অবজারভার এর এই বক্তব্যের একটি প্রতিবাদে ওই পত্রিকাতেই ২৫ শে মে প্রকাশিত হয় যাতে বলা হয় যে, সরকারি মহল থেকে জানা গেছে যে এই সব অভিযোগ ভিত্তিহীন এবং তাদের অর্থ বিভ্রান্তিকর। প্রাদেশিক সরকার বাংলা ভাষায় আরবি অক্ষর চাল পরীক্ষার জন্য কোন অর্থ ব্যয় করে না। পরিকল্পনাটি কেন্দ্রের দ্বারা গৃহীত এবং তার জন্য কেন্দ্রের বাৎসরিক ব্যয় হয় ৫০ হাজার টাকা।
কেন্দ্রের সম্পূর্ণ তাবেদার প্রাদেশিক সরকারের পরিবর্তে কেন্দ্র নিজে বাংলা ভাষায় আরবি অক্ষর প্রচলনের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয় করে সরকারি প্রতিবাদের এই বক্তব্য যে অভিযোগের মূল বক্তব্যটিকে মোটেই নাকচ করে না তা বলাই বাহুল্য। আসল কথা হচ্ছে সে সময় প্রাথমিক শিক্ষাকে সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করে সরকার সে কেন্দ্রীয় অথবা প্রাথমিক যাইহোক কতগুলি উদ্ভট ও গণবিরোধী পরিকল্পনার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে যাচ্ছিল। তাদের এই অপব্যয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয়সংকোচ যে একই গণবিরোধী নীতির অন্তর্গত ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘটের সমর্থনে এবং সরকারি নীতি ও বক্তব্যের প্রতিবাদ করে ১৭ই মে, ১৯৫১, তারিখে নওবেলাল ‘কথামত’ শীর্ষক একটি সম্পাদকীয়তে বলেন,
পূর্ব পাকিস্তানের ৮০ হাজার প্রাথমিক শিক্ষকদের নিম্নতম বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘটের ৪৩শ দিনে আমাদের স্বনামধন্য শিক্ষা মন্ত্রী আবদুল হামিদ সাহেব সংবাদপত্রে এক নাতিদীর্ঘ বিবৃতি মারফত প্রাথমিক শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে যেসব কথামৃত বর্ষণ করিয়াছেন তাহাতে ধর্মঘটের অবসান না হলেও তাহাদের মহাবুভুক্ষার কিছুটাও নিরসন করবে নিঃসন্দেহে!
শুরুতেই মহাপ্রাণ মন্ত্রী বাহাদুর এই ‘অযৌক্তিক’ ধর্মঘটের জন্য দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন, ‘সরকারি চাকুরীয়াদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করা অপরাধ নহে। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মঘটের আশ্রয় গ্রহণ করা কিছুতেই ন্যায়সঙ্গত হইতে পারে না।’অতঃপর তিনি নানা অবান্তর কথা উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন যে, উপযুক্ত শিক্ষকের অভাবে বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা খাতে যে ২ কোটি টাকা ব্যয় হইতেছে তা অপচয় হইতেছে মাত্র। সেজন্য তিনি আগামী ‘দশ বছরের স্বল্পকাল’ মধ্যে সমস্ত প্রদেশব্যাপী উপযুক্ত শিক্ষক দ্বারা প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা করিয়াছেন। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রতি বৎসর প্রদেশের এক-দশমাংশ উপকৃত হতে থাকিবে, যে পর্যন্ত না দশ বৎসরের শেষে সারা প্রদেশ শিক্ষিত হইয়া উঠিবে। অপর দিকে শিক্ষামন্ত্রি হিসাব করিয়া দেখাইয়াছেন যে, সম্প্রতি সরকার শিক্ষকদের জন্য আড়াই টাকা ওদের টাকা বৃদ্ধির আশ্বাস দেয়া যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছিলেন তাহা কার্যকরী করিলে খাজাঞ্চিখানা হইতে ১৪ লক্ষ টাকার উপর ব্যয় হইয়া যাইবে। অর্থাৎ মন্ত্রী বাহাদুর এই কথা বলিতে চাহিয়াছেন যে, প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি পেয়ে যদি ১৪ লক্ষ টাকা সাবাড় হইয়া যায় তাহা হইলে সরকারের অন্য খরচ চলিবে কি করিয়া!
শিক্ষামন্ত্রী এইখানেই থামিয়া যান নাই। তিনি পরাধীনতা যুগের যুদ্ধকালীন মহার্ঘতার নজির টানিয়া দেখাইয়াছেন যে, তখনকার অবস্থা হইতেও বর্তমান অবস্থা অনেকাংশে ভালো, কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষকদের ধর্মঘট করার কুবুদ্ধি তখন হইলো না। জাতীয় সরকারের পক্ষে জনাব আব্দুল হামিদ, যখন শিক্ষামন্ত্রীত্বের গদীতে সমাসীন তখনই তাঁহাদের সুযোগ উপস্থিত হইল।….
এসব অমূল্য কথামৃতের পরও যদি গুমরাহের দল শিক্ষালাভ না করে তাহা হইলে জনাব ওজিরের তা’লিম শিক্ষকদের পরলোকগত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারের অভ্রান্ত নীতির কথা স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন এবং বজ্রকঠোর কন্ঠে আহ্বান জানাইয়াছেন ‘প্রাথমিক শিক্ষকগণ কাজে যোগ দাও।’……
কিন্তু মানুষকে আর শুধু কথায় ভুলাইয়া রাখা সম্ভব হইবে না। মানুষ আজ ভাবিতে শুরু করিয়াছে। তাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হইতেছে। ফাঁকিবাজিতে আর তাহারা ভুলিবে না। স্বাধীনতার পূর্ণ আস্বাদ গ্রহণ করিতে তাহারা বদ্ধপরিকর। যেখানেই তাহাদের বঞ্চিত করিবা সামান্যতম পরিলক্ষিত হইবে সেখানেই প্রতিবিধানের জন্য তাহারা মাতিয়া উঠিবে।
তাই সময় আসিয়াছে শিক্ষামন্ত্রীও তাঁহার সহযোগীদের বাস্তবকে উপলব্ধি করার এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়া সম্মুখপানে দ্রুত আগাইয়া যাওয়ার। অন্যথা জনসাধারণ তাহাদের প্রাপ্য আদায় করিবেই।
১৫ই মে চাঁদপুর টাউন হলে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির একটি বিশেষ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচিত সভাপতি ফয়েজ আহমেদের অনুপুস্থিতিতে হাতেম আলী খান সভাপতির কাজ পরিচালনা করেন। বিভিন্ন জেলার প্রায় পাঁচশ শিক্ষক প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যোগদান করেন।(৮)
শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোঃ আজিম উদ্দিন প্রথমে শিক্ষক ধর্মঘটের কারণ বর্ণনা করেন এবং তারপর জনসাধারণের পক্ষ থেকে বক্তৃতা দেন আব্দুল আউয়াল, আবু বকর সিদ্দিক, সিদ্দিকুর রহমান ও কোবাদ আহমদ। শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে বক্তৃতা করেন শিক্ষক প্রতিনিধি আব্দুল গনি। (৯)
চাঁদপুরে অনুষ্ঠিত শিক্ষক সম্মেলন ধর্মঘট সম্পর্কে নিম্নোলিখিত চারটি প্রস্তাব (১০) গ্রহণ করেনঃ
১। প্রাথমিক শিক্ষক উন্নতি, বিশেষ করিয়া প্রাথমিক শিক্ষকগণের জীবনধারণ উপযোগী বেতন, ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রভৃতি দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে এক মাস ১৫ দিন যাবত পূর্ব-পাকিস্তানের প্রাথমিক শিক্ষকগণ ধর্মঘট করিয়া আসিতেছেন। সম্প্রতি পূর্ববঙ্গের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রাথমিক শিক্ষক ধর্মঘট সম্পর্কে যে বিবৃতি দিয়াছেন তাহা সহানুভূতিশীল, নৈরাশ্যজনক ও সমস্যার সমাধানের পরিপন্থী বিধায় এই সম্মেলন পূর্ব পাক প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি কর্তৃক উত্থাপিত দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বা সম্মানজনক শর্তে মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত ঐকান্তিক নিষ্ঠা, দৃঢ়তা ও ঈমানদারীর সহিত ধর্মঘট চালাইয়া যাওয়ার জন্য প্রাথমিক শিক্ষকদিগকে নির্দেশ দান করিতেছে।
২। পূর্ব পাক প্রাথমিক শিক্ষকগণের এই সম্মেলন ১৬ইমে ও ১৭ই মে ঢাকায় আহুত জেলা স্কুল বোর্ড প্রেসিডেন্ট সমিতির সভায় প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করিবার জন্য পূর্ব পাক প্রাদেশিক শিক্ষক সমিতির কর্মপরিষদকে ক্ষমতা অর্পণ করিতেছে।
৩। এই সম্মেলন পূর্ব পাক প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কর্মপরিষদকে সমিতির পক্ষ হইতে বর্তমান জরুরি অবস্থায় সমস্ত কার্য চালাইয়া যাওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণ করিতেছে।
৪। এই সম্মেলন আগামী ২৫ শে মে শুক্রবারে প্রাথমিক শিক্ষকদের রুটির লড়াইয়ে সাফল্য লাভের উদ্দেশ্যে সর্বত্র ‘মোনাজাত দিবস’ প্রতিপালন করিবার জন্য শিক্ষক ও জনসাধারণকে অনুরোধ জানাইতেছে।
‘ধর্মঘটী শিক্ষকদেরকে আর্থিক সাহায্যদানের জন্যে পূর্ববাংলার অনেক জায়গায় জনগণের পক্ষ থেকে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অর্থ সাহায্যের আবেদন জানান এবং তার জন্য সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন।’ বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষক ধর্মঘটের সমর্থনে জনসভাও অনুষ্ঠিত হতে থাকে।( ১২)
১৫। ধর্মঘটের অবসান
কিন্তু এসব সত্ত্বেও ২রা জুন প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল ফজল ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি বিবৃতির মাধ্যমে ধর্মঘট প্রত্যাহার করে শিক্ষকদেরকে কাজে যোগদানের নির্দেশ প্রদান করেন। তিনি তাঁর বিবৃতিতে জানান যে, ময়মনসিংহ জেলা স্কুল বোর্ডের সভাপতি আব্দুল মোনায়েম খানের মধ্যস্থতায় পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নুরুল আমিন শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সেই অনুযায়ীই শিক্ষকদেরকে কাজে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ধর্মঘটী শিক্ষকদের কোন কোন দাবি সরকার পূর্ণ করতে সম্মত হয়েছেন সে বিষয়ে আবুল ফজল তাঁর বিবৃতিতে কিছু উল্লেখ করেননি। তবে ধর্মঘটী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হবে না, এই মর্মে তিনি তাঁর বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করেন। (১)
প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক আবুল ফজল কর্তৃক এইভাবে ধর্মঘট প্রত্যাহার যে সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আপোষ এবং শিক্ষক ধর্মঘটের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শামিল ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। আব্দুল মোনায়েম খান ময়মনসিংহ জেলা স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে ধর্মঘটী শিক্ষকদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালান এবং যাঁর বিরুদ্ধে ধর্মঘটী শিক্ষকরা নিজেদের সভায় প্রস্তাব পর্যন্ত গ্রহণ করেন তাঁরই মধ্যস্ততায় ধর্মঘটের এই অবসান যে শিক্ষকদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হবে না, তা বলাই বাহুল্য। এজন্যে শিক্ষকদের কোন মূল দাবী যে সরকার কর্তৃক ধর্মঘটের পর স্বীকৃত হয়নি তাই নয়। সরকার শিক্ষকদেরকে ধর্মঘটকালীন বেতন দেওয়ার ব্যাপারেও অনেক বিলম্ব ও হাঙ্গামা করে।
মোনায়েম খানের মধ্যস্থতায় শিক্ষক সমিতির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নুরুল আমিনের সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষকদের কোন দাবি-দাওয়া আদায় করতে সম্মত হননি একথা ধর্মঘট প্রত্যাহার সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পরই স্পষ্টভাবে বোঝা যায়। তাই শিক্ষক ধর্মঘট ও তার অবসান সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সাপ্তাহিক সৈনিক ৩রা জুন তারিখেই একটি সম্পাদকীয়তে বলেনঃ
প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীর সহিত শিক্ষক প্রতিনিধিগন চাঁদপুর সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আলাপ-আলোচনা করিয়া মীমাংসায় আসিয়াছেন এই খবরসহ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের বিবৃতি আমাদের হস্তগত হইয়াছে। বিবৃতিতে তিনি ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা করিয়াছেন।
নানা কারণে এই ধর্মঘট বিশেষ গুরুত্ব লাভ করিয়াছে। দেশের শিক্ষা জীবনের মেরুদন্ড ৮০ হাজার শিক্ষকের এত দীর্ঘদিন ধরিয়া ধর্মঘট সত্যিই এক বিরাট ব্যাপার।
প্রাথমিক শিক্ষক আন্দোলনে গরীব শিক্ষকদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাক প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির অবদান অতুলনীয়।….. বর্তমানে প্রতি থানায় একটি ইউনিয়নে বর্ধিত যে বেতনে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হইতেছে এবং কয়েক বৎসরের মধ্যেই বাধ্যতামূলক করা হইবে বলিয়া সরকার যে ঘোষণা করিয়াছেন তাহাও এই সমিতির আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফল।
তবুও প্রশ্ন জাগে এই ধর্মঘট সব দাবি আদায় করিতে পারিল না কেন?
ধর্মঘটের অবসানের পর প্রাথমিক শিক্ষকরা বিভিন্ন জায়গায় ধর্মঘটকালীন বেতন ইত্যাদির দাবিতে সভা সমিতি করতে থাকেন। (২) রংপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সম্পাদক আব্দুল গনি মিঞা অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে একটি সংবাদপত্র বিবৃতিতে বলেন যে, আজ পর্যন্ত সরকার ও প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির মধ্যে ধর্মঘটের সময় যে চুক্তি হয়েছিল তা কার্যকর করার কোনো লক্ষণ নেই। সবাই নিষ্ক্রিয় এবং নিশ্চুপ রয়েছেন।(৩) দীর্ঘ দুই মাস ধর্মঘটের পর প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কর্মকর্তারা সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ধর্মঘট প্রত্যাহারের পর মে শিক্ষক মহলে এই ধরনের নিষ্ক্রিয়তা দেখা দেবে সেটাই স্বাভাবিক।
এই অবস্থা বেশ কিছুদিন চলতে থাকার পর ৫ই অক্টোবর ঢাকায় ৩২ নম্বর পুরান মোগলটুলীতে পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির কার্যকরী সংসদের একটি বৈঠক হয়। তাতে সভাপতিত্ব করেন সমিতির সভাপতি অধ্যাপক (অস্পষ্ট) বৈঠকে আশ্বাসদান সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ…. (অস্পষ্ট)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!