You dont have javascript enabled! Please enable it! 1982.04.16 | জেনারেল এরশাদের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার | ‘জনবিরোধী রাজনীতি সমর্থন করবো না’ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৬ এপ্রিল ১৯৮২ - সংগ্রামের নোটবুক

জেনারেল এরশাদের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার | ‘জনবিরোধী রাজনীতি সমর্থন করবো না’
সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ১৬ এপ্রিল ১৯৮২

আমাদের প্রশ্ন ছিল ‘আপনার জীবনের সুখকর ও দুঃখময় মুহূর্ত কোনটি?’ প্রশ্ন শুনে একটু হেসেছিলেন। তারপরই ভাবতে হয়েছে প্রশ্নের জবাব নিয়ে। হাসতে হাসতে বলেছিলেন ‘সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব দেয়া কষ্টকর। আমাদের জীবনের প্রতিটি দিনই সুখ-দুঃখের সমাহার। কোনটি দিনটি বিশেষ ভাবে বলব।’
কথা হচ্ছিল প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এরশাদের সঙ্গে—তারই সচিবালয়ে। সামরিক পোশাক পরিহিত জেনালে বসেছিলেন তারই চেয়ারে। দীর্ঘ আলাপের ফাঁকে ফাঁকে কখনো তার চেহারায় ফুটে উঠছিল বিরক্তি, কখনো উষ্মা, কখনো দৃঢ়তা, কখনো এক ধরনের আকুতি। তিন সপ্তাহের দায়িত্ব তাঁকে নতুন এক অভিজ্ঞতা দিয়েছে—সে অভিজ্ঞতা জটিল এবং আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা।
সাক্ষাৎকারের প্রায় শেষ পর্যায়ে আমরা তার কাছে রেখেছিলাম উল্লিখিত প্রশ্নটি। জবাব ছিল মানবিক অনুভূতি জড়িত। ‘যেদিন প্রধান সেনাপতি হিসেবে পদোন্নতি ঘটেছে, সম্ভবতঃ সেদিনটিই আমার জীবনের সবচে সুখকর। একজন সৈনিকের জীবনে এর চেয়ে বড়ো পাওনা আর কিছুই হতে পারে না। আমার ত্রিশ বছরের সৈনিক জীবনে এটাই সবচে বড়ো পাওনা। সবয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা। আর দুঃখের কথাই যদি বলতে হয়, তা’হলে সেটা ব্যক্তিগত দুঃখের। আমার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমি তখন ভারতে। ১৯৭৫ সালের ঘটনা। এ সময় আমার বাবা মারা যান। বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। তিনি যেমনটি চেয়েছিলেন, তেমনটি হতে পেরেছিলাম বলেই তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এতো গভীর। বাবার মৃত্যুতে যে দুঃখ পেয়েছি, তেমনটি আর কখনো হয়নি।’ ৫২ বছরের জেনারেল, রংপুরের সন্তান, এরশাদের জীবনে এটাই সবচে বড় দুঃখ।
মায়ের চেয়েও বাবার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা ছিল জেনারেল এরশাদের। তাই বাবার মৃত্যু এখনো তাঁকে পীড়া দেয়। যেমনিভাবে পীড়া দেয় দেশে বিরাজমান দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক অব্যবস্থা।
জেনারেল এরশাদ একসময় কবিতাও লিখতেন। কিছুদিন আগেও লিখেছেন। কখনো কখনো নিঃসঙ্গ মুহুর্তগুলো তাঁকে কবিতা লিখতে সাহায্য করে। এখন অবিশ্যি তার কবিতা লেখা হয়ে ওঠেনা। সেসময়ে নেই। সকাল সাতটা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়। ‘কিন্তু আমার কোন ক্লান্তি নেই। এই একটানা কাজে কোন অবসাদ আমাকে গ্রাস করেনা।’
সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর, ২৪ মার্চের বেতার ভাষণে জেনারেল এরশাদ যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তারই বিস্তৃত বাস্তবায়ন এখন তাঁর লক্ষ্য। এজন্যে একটি সময়সীমাও তিনি নির্ধারিত করেছেন। অনেকটা যুদ্ধ পরিকল্পনার মতো। তাঁর বিশ্বাস দু’বছরের মধ্যে সম্ভব হবে এসব পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্যের বাস্তবায়ন। প্রাথমিক পর্যায়ে ৫টি ক্ষেত্রে বিস্তৃত হবে ঐ পরিকল্পনা। এসব হচ্ছে ব্যাপকভাবে কৃষি, শিল্প, জনসংখ্যা, প্রশাসন ও দুর্নীতি। কতিপয় প্রশ্নে জাতীয় বিতর্কও অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম বিতর্ক হবে ভূমি সংস্কারের প্রশ্নে।
পরবর্তী পর্যায়ের যে বিতর্কগুলো হবে, স্বভাবতঃই জাতীয় জীবনে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণের প্রশ্নটি সেখানে প্রাধান্য পাবে। প্রশ্ন উঠবে, কোন ধরনের সরকার আমাদের জন্য প্রযোজ্য। জেনারেল এরশাদ মনে করেন ‘এমন এক গণতন্ত্র আমরা চাই যা জনগণের জন্য ন্যায় বিচার নিশ্চিত করবে। যাতে কোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত উচ্চাভিলাষ সে প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে না পারে।’
জেনারেল এরশাদ আগামী দু’বছরের মধ্যে একটি জনমুখী সরকারের ভিত্তি তৈরীতে আগ্রহী। সম্ভবতঃ এ প্রয়োজনে ভবিষ্যতে কোন এক সময় রাজনীতিবিদদেরও মতামত গ্রহণ করা হবে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে তার সন্দেহ প্রচুর। (সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য।) তার মতে, শুধু ক্ষমতাদখলের জন্যই রাজনৈতিক দলের জন্ম। তাদের মধ্যে আদর্শগত মতভেদ খুবই সীমিত। অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে তিনি ‘সামরিক ইউনিফর্মে’ রাজনীতিতে উৎসাহী নন। রাজনীতি করতে হলে, অবসর গ্রহণ করেই রাজনীতি করবেন।
০০০

প্রশ্ন : সামরিক আইন জারির সময় আপনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন। এ ব্যাপারে কি ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
উত্তর : দেশে এমন এক সময় সামরিক আইন জারি করা হয়েছে যখন দুর্নীতি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে গেছে ব্যাপকভাবে, জাতীয় অর্থনীতি হয়েছে বিধ্বস্ত, সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা, তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি হয়েছে সুদূরপরাহত। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভ্রান্তনীতি গ্রহণ, দক্ষ পরিচালনার অভাব, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর জনগণের মধ্যেকার ব্যবধান বাড়িয়ে তুলেছে। কল-কারখানা, ব্যাংক, অফিস-আদালত, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানায় চরম অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি এবং লুটতরাজ চলছিল বাধাহীন গতিতে। এই অবস্থার আশু অবসান প্রয়োজন। তাই দুর্নীতিকে আমরা এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছি। যেখানেই দুর্নীতি এবং অব্যবস্থা আছে সেখানেই আঘাত হানা হবে। এই আঘাত কারো বিরুদ্ধে উইচ হান্টিং নয়। ইতিমধ্যে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, আমলা ও ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক বিধি অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দিতে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। দুর্নীতি আরো অনেকেই করেছেন। তাদের সবাইকে বিধি অনুযায়ী শাস্তি পেতে হবে। জনগণের অর্থ নিয়ে যারা ছিনিমিনি খেলেছে, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেনি, উৎপাদনশীল খাতে ঋণ নিয়ে তা বিলাসী জীবন যাপন ব্যয় করেছে (যার পরিণতিতে জাতীয় অর্থনীতিতে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে) জাতীয় স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে এদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। সমাজ থেকে দুর্নীতি ক্রমশঃ উচ্ছেদ করতে হবে। তা না হলে জাতীয় জীবনে অগ্রগতি আসবে না। সে কারণেই আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছি।

প্রশ্ন : দুর্নীতি সম্পর্কে কি কোন শ্বেতপত্র প্রকাশিত হবে?
উত্তর : অর্থনৈতিক দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক দুর্নীতি উভয় ব্যাপারেই শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হবে।

প্রশ্ন : প্রত্যক্ষ আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। কিন্তু প্রমাণ নেই অথচ রাজনৈতিক অঙ্গনকে দূষিত করেছে, রাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল করে দিয়েছে এমন ব্যক্তিদের ব্যাপারে আপনাদের পদক্ষেপ কি হবে?
উত্তর : রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সমাজ জীবনকে যারা কলুষিত করেছে তাদের সামরিক বিধি অনুযায়ী শাস্তি দেয়া হবে।

প্রশ্ন : জানা গেছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ৪ হাজার ১শ’ কোটি নিয়েছে, যার অধিকাংশই ফেরৎ পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
উত্তর : এটা একটা বড় রকমের দুর্নীতি। এভাবেই জনগণের টাকা নিয়ে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের ভাগ্য গড়েছেন, রাতারাতি হয়েছে কোটিপতি। এরাই দেশের এক নম্বর শত্রু। এদের সামরিক বিধি অনুযায়ী কঠোর শাস্তি দেয়া হবে।

প্রশ্ন : ব্রীফকেস ব্যবসায়ী, আদম ব্যাপারী, শিশু পাচারকারী প্রভৃতিরা সমাজ জীবনকে নানাভাবে কলুষিত করেছে, তাদের ব্যাপারে কি করবেন?
উত্তর : ব্রীফকেস, ব্যবসায়ী, আদম ব্যাপারী প্রমুখ সমাজ জীবনে কলুষতা ছড়িয়েছে। শিশু পাচার একটি ঘৃণ্য এবং অমানবিক কাজ। সমাজকে দুর্নীতি ও কলুষমুক্ত করার প্রক্রিয়ায় এদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রশ্ন : বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ ও ব্যবহারে আপনাদের নীতি কি হবে?
উত্তর : আমি আমার নীতি নির্ধারণী বক্তৃতায় পরনির্ভরশীলতা কাটানোর কথা বলেছি। বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহ ও ব্যবহারের প্রশ্নে আমাদের অগ্রাধিকার নির্ণয় করতে হবে। আমাদের ঠিক করতে হবে কয়েকশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্মিত হবে না সমপরিমাণ অর্থে কর্মসংস্থানের সুযোগসহ কল-কারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক করতে হবে রাস্তায় নিয়ন বাতি জ্বলবে না হাসপাতাল হবে। আমরা আধুনিক স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়তে চাই, কিন্তু জাতীয় মর্যাদার বিনিময়ে নয়। ভিক্ষার অর্থে জীবন ধারণ করা যায়; কিন্তু মেরুদন্ড সোজা করে বাঁচা যায় না। সাহায্য পাব বলেই বিদেশের কাছে হাত পাততে হবে এমন কোন কথা নেই। আমরা মনে করি না এই মুহূর্তেই বিদেশী সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশ চলতে পারবে। তবে সে সাহায্য যাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিকে জন-প্রয়োজনীয় খাতে ব্যয় করা হয় সে দিকে লক্ষ্য করা হবে।

প্রশ্ন : দুর্নীতির জন্য একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জনগণ তার প্রশংসা করেছেন। কিন্তু নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও কেউ কেউ গ্রেফতার হয়নি কেন?
উত্তর : অনেকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ আছে। খোঁজ-খবরও নেয়া হচ্ছে। কাউকেউ রেহাই দেয়া হবে না। জনগণের টাকা নিয়ে যারা বিলাসিত করেছে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে, এটা ভাবছেন কেন? আমি জানি কেউ কেউ বিদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদেরও শাস্তি পেতে হবে। যদি এরকম কেউ ইতিমধ্যে গোপনে দেশ ত্যাগ করার কথা ভাবেন তবে তাকে বাড়তি শাস্তি পেতে হবে। আমি জানি দুর্নীতিবাজ কারা। সকলকেই ধরা হবে। আপনারা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করুন। নির্ভীক সাংবাদিকতার প্রমাণ আপনারা দিয়েছেন। আমি চাই আমার সঙ্গে আপনারা সহযোগিতা করবেন দুর্নীতি উচ্ছেদে এবং দুর্নীতিবাজদের ধরতে। আপনাদের এবং জনগণের পরামর্শ অবশ্যই আমাকে সাহায্য করবে।
০০০

প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর মর্যাদা স্বীকার করে নিলে এবং জন প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর অংশ গ্রহণ মেনে নিলেই এ সমন্বয় সাধন সম্ভব….

জনগণের টাকা নিয়ে কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের ভাগ্য গড়েছেন, রাতারাতি হয়েছেন কোটিপতি এরাই দেশের এক নম্বর শত্রু।

আমাদের ঠিক করতে হবে কয়েকশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে জাতীয় সংসদ নির্মিত হবে না সমপরিমাণ অর্থে কর্মসংস্থানের সুযোগসহ কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হবে..
০০০

প্রশ্ন : রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা কি হবে?
উত্তর : রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশ্নটিকে আমাদের জাতীয় বাস্তবতার আলোকে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী পূর্বের মত উপনিবেশিক সেনাবাহিনী নয়। বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের সঙ্গে, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে এই সেনাবাহিনী জড়িত। উপরন্তু সেনাবাহিনীর সদস্যরা দেশের বিভিন্ন শ্রেণীর বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণী থেকে আগত। স্বাভাবিকভাবে চিন্তার জগতে এরা জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ঘটনাপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না। এ কারণেই অতীতে বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনী জাতীয় প্রয়োজনে তার যথাযথ ভূমিকা পালন করেছে। তাই সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন জাতীয় কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা যুক্তিসঙ্গত হবে না। আমি মনে করি রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনী সহযোগী ভূমিকা পালন করবেন। যেখানে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে, প্রশাসনে সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ হবে প্রাতিষ্ঠানিক। সেনাবাহিনী অবশ্যই সরাসরি রাজনীতির অংশীদার হবে না, কিন্তু জনবিরোধী রাজনীতিকে সমর্থনও করবে না।

প্রশ্ন : সামরিক শাসনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সমন্বয় ঘটাবেন কি করে?
উত্তর : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ঘটনা ঘটেছে। এটা নতুন কিছু নয়। সমন্বয় ঘটেছে প্রেক্ষিত অনুসারে, প্রেক্ষিতেই নির্ধারিত হয়েছে সমন্বয়ের মাত্রা। এ প্রশ্নটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামরিক (politco-military) বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত। প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর মর্যাদা স্বীকার করে নিলে এবং জন প্রক্রিয়ায় (Populist process) সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ মেনে নিলেই সমন্ব্য় সাধন সম্ভব।

প্রশ্ন : বিচারপতি সাত্তারের নির্বাচনে আপনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এ বাস্তবতা মেনে নিলে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণকে কিভাবে বিচার করা হবে?
উত্তর : এ প্রশ্নকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। আমি একজন সৈনিক। বর্তমানে যে দায়িত্ব পালন করছি, তার জন্যে আমাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়। সেনাবাহিনীকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত করতে চাইনি। চেয়েছিলাম, ক্ষমতাসীন সরকারই দায়িত্ব পালন করে যাক। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে শাসনতন্ত্র তৈরি হয়েছিল এক ব্যক্তির জন্যে এবং সে ব্যক্তিই ছিলেন অনুপস্থিত। যাঁকে সেই শূন্য আসনে বসানো হবে তাঁকে সে ধরনের ব্যক্তি হতে হবে। কিন্তু তিনি তেমন ছিলেন না। আমাদের সে সময় তেমন লোকও ছিল না। তিনি সম্মানীয় ব্যক্তি হলেও, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। তার উচিত ছিল, মন্ত্রী পরিষদকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা।
আমি ইচ্ছাকৃতভাবে এ দায়িত্ব নেইনি। আমি আমার জওয়ান ও অফিসারদের বলে দিয়েছি, অতীততে এ সেনাবাহিনী অনেক ভুল করেছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে ইতিহাসে অবদান রাখার, ঐতিহ্য সৃষ্টির আমরা ক্ষমতা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি। আবার সুষ্ঠুভাবে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়ে চলে যাব। তার জন্যে প্রয়োজন হবে নতুন শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, গণতন্ত্র সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন।

প্রশ্ন : কিন্তু শাসনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে কি সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছেড়ে দেবে?
উত্তর : সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। আমার মনে হয় এটা ঠিক অংশগ্রহণ নয়, অংশগ্রহণের মানসিকতা। যেমন আজকে সেনাবাহিনীর সৈনিক জওয়ানরা রয়েছে, তার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশীদার। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। তারা রক্ত দিয়েছে নিজেদের পছন্দ মোতাবেক রাষ্ট্র কায়েমের জন্য। যেখানে সুখী সুন্দর ও সমাজ কায়েম হবে। কিন্তু তারা যখন দেখে এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি, তখনই তারা তাদের আশাভঙ্গের কারণ হয়। হতাশা থেকে বিদ্রোহ করতে চায়। তাই, আপনারা তাদের সঙ্গে নেন। বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের সৎ পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। ভালো না হলে তার দায়িত্বও আমরা গ্রহণ করব। তাছাড়া আমরা একটি সংগঠিত শক্তি। যে কোন অসামরিক কাজে আমরা সাহায্য করতে পারি। তাতে আমার জওয়ানরা গর্ববোধ করবে—জাতীয় নির্মাণের অংশীদার হতে পেরে। আমরা জনগণেরই অংশ। এতে বর্তমানে যে দূরত্ব রয়েছে তা দূর করতে হবে। এ দূরত্ব যাতা কলে, আমরা যে এক জাতি তা কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না। আমি জাতির কাছে যে অঙ্গীকার করেছি তা যথাসময়ে পূরণের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তারপরে আমি আমার স্থানে ফিরে যাব। আমার নিয়তি কি হবে তা আমি জানি না। কিন্তু এ আসনে বসে, এ পোশাকে আমি রাজনীতি করবো না, আমার প্রতিষ্ঠানকে হেয় করবো না। আমি অনেকের মতোই উচ্চাভিলাষী নই। ত্রিশ বছর ধরে আমি সেনাবাহিনী প্রধান হওয়ার জন্য কাজ করেছি, অন্য কিছুর জন্য নয়।

প্রশ্ন : সাধারণ নির্বাচন কবে দেবেন? সময় কি অনুমান করা যায়?
উত্তর : সাধারণ নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি উপাদান। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আমার শ্রদ্ধার প্রমাণ অতীতে পেয়েছেন। সামরিক আইন জারি করে জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া প্রথম ভাষণেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি আমার আস্থার কথা বলেছি। পরিস্থিতি জনগণের স্বার্থের অনুকূল হলেই সাধারণ নির্বাচন দেয়া হবে। এ জন্য দু’বছর কিংবা তার বেশি সময় দরকার হতে পারে, কিন্তু অনুমান করাটা বড় কথা নয়।

প্রশ্ন : ফারাক্কা ও তালপট্টি সমস্যা সমাধানে সরকারী নীতিতে কি কোন পরিবর্তন হবে?
উত্তর : এ সব সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সরকারী নীতিতে উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন আসবে না। তবে এখানে একটি কথা পরিষ্কার করে দিতে চাই, তা’হলো এসব প্রশ্নে জাতীয় প্রয়োজন ও স্বার্থকে বিসর্জন দেয়া হবে না। ছোট দেশ হলেও আমরা কখনোই চাপের মুখে নতি স্বীকার করিনি। আমি মনে করি এসব সমস্যা সমাধানে ভারত সৎ প্রতিবেশীসুলভ মনোভাব দেখাবে এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর প্রয়োজন বিবেচনা করবে। আমি আরো মনে করি ভারত সরকার এমন কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না যাতে প্রতিবেশীদের মনে অকারণ সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে।
০০০

ভিক্ষার অর্থে জীবন ধারণ করা যায়, কিন্তু মেরুদন্ড সোজা করে বাঁচা যায় না

ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ হবে যাতে গ্রামগুলো বঞ্চিত না হয়, যাতে গ্রামে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে

ব্যাপক মানুষকে বঞ্চিত করে কিছু লোকের সুখ সুবিধে নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীনতা আসে নি

এরা (রাজনীতিবিদরা) ক্ষমতার পেছনে ঘোরে, ক্ষমতা দখল করতে চায় যে কোন ভাবে
০০০

প্রশ্ন : দ্রুত বেড়ে ওঠা শহুরে জনসংখ্যার একটি অংশ, গ্রামে ফিরে যাচ্ছে। গ্রামে কোন কাজ না পেলে তারা আবার শহরে এসে সমস্যার সৃষ্টি করবে। এদের কাজের কি ব্যবস্থা করা হবে?
উত্তর : এটা অর্থনীতির পুশ-পুল (pull-push) প্রক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল। বাহাত্তর-চুয়াত্তর সালে যখন গ্রামে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় বন্ধ ছিল তখন গ্রামের মানুষেরা ছুটে এসেছিলেন শহরে খাদ্য ও কাজের আশায়। তার পরিণতির কথা আমরা জানি। পরবর্তীতে ’৭৫-এর পর যখন গ্রামে অর্থনৈতিক প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে তখন মানুষ আবার গ্রামে ফিরে যেতে শুরু করে। অর্থনীতির এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আমরা যদি গ্রামে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারি, শহরের কিছু কিছু সুবিধে গ্রামেও সম্প্রসারিত করতে পারি, তাহলে এ সমস্যা দেখা দেবে না। বাংলাদেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতি যে গ্রাম নির্ভর, সে সম্পর্কে আমরা সচেতন। ভবিষ্যতে আমাদের লক্ষ্য হবে যাতে গ্রামগুলো বঞ্চিত না হয়, যাতে গ্রামে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। এজন্য শহরের মানুষদের কষ্ট স্বীকার করতে হবে, জাতীয় বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে।

প্রশ্ন : জাতীয় জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা সাধনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে?
উত্তর : জাতীয় জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে আমরা কৃচ্ছ্রতা সাধনের উদযোগ নিয়েছি। ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে কিছু কিছু পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য হবে অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতাকে ত্যাগ করা। যে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক দরিদ্র সীমার নীচে বাস করে, সেখানে কোন বিলাসিতাই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এ ব্যাপারে সবচে জরুরী হচ্ছে মানসিকতার পরিবর্তন। আমাদের মিথ্যা ভনিতা থেকে মুক্ত হতে হবে। ব্যাপক মানুষকে বঞ্চিত করে কিছু লোকের সুখ সুবিধে নিশ্চিত করার জন্য স্বাধীনতা আসেনি। এ সত্য মেনে না নিলে, বাংলাদেশ কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারবে না।

প্রশ্ন : রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজনৈতিক ব্যর্থতায় আপনি কি বি, এন, পি’কে দায়ী করেন না সমগ্র রাজনৈতিক ইন্সটিটিউটশনকে?
উত্তর : শুধু বি, এন, পি, কেন হবে? এ ব্যর্থতা গত কয়েক দশকের। প্রত্যেক দলের একটি আদর্শ থাকে। আদর্শের মধ্যে ভিন্নতাও থাকে। কিন্তু এখানে যে দলগুলো আছে, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শগত পার্থক্য কোথায়? এরা বিভিন্ন পন্থী হিসেবে পরিচিত। আবার একই দলের ভেতরে বিভিন্ন উপদল আছে। মত পার্থক্য আছে। তাই এদের প্রচেষ্টা সমন্বিত নয়, বা একটি লক্ষ্যে ধাবিত হয় না। তাই এরা জনসমর্থন আদায় করতে পারে না। মৌলিকভাবে, এরা ক্ষমতার পেছনে ঘোরে, ক্ষমতা দখল করতে চায় যে কোনভাবে হোক। আর বি, এন, পি রাজনৈতিক দল হিসেবেই গড়ে ওঠেনি, ফ্রন্টের মত ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে এরা জাতীয়তাবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে, প্রচার করে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ কোন আদর্শ নয়। এটা জনচেতনার একটি স্বতস্ফূর্ত প্রক্রিয়া, আমরা সবাই বাংলাদেশী বা জাতীয়তাবাদী হতে বাধ্য। এর কোন ভিন্নতা হতে পারে না দলগত ভিত্তিতে।

প্রশ্ন : এদেশে ক্ষমতার স্থায়িত্ব চালের দামের ওপর নির্ভরশীল। বাজারে যে হারে চালের দাম বাড়ছে তাকে আপনারা এ বাস্তবতার আলোকে কিভাবে দেখছেন?
উত্তর : চালের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে উদ্বেগের কোন কারণ নেই। সরকারের হাতে যথেষ্ট পরিমাণ চাল মওজুদ আছে। মনে রাখবেন, এটা আমাদের হিসেব, অসামরিক সরকারের নয়। দেশে দুর্ভিক্ষের কোন সম্ভাবনা নেই এবং কারো না খেয়ে মরার প্রশ্ন ওঠেনা। চালের মূল্য বৃদ্ধির একটা অন্যতম কারণ, খাদ্য চলাচলের উপর আকস্মিক নিয়ন্ত্রণ। এ দোষ আমাদের নয়, পূর্ববর্তী সরকারের। তারা একটা আতংক সৃষ্টি করেছিল—দুর্ভিক্ষ হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তব তার উল্টো। এ আতংকে খাদ্যশস্য চলাচল হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। সরবরাহ ঠিক হলেই দাম কমে যাবে, কমতে বাধ্য। ব্যক্তিগতভাবে আমি মোটেও এজন্য শংকিত নই। পরিস্থিতি মোটেও সংকটজনক নয়। সংকটজনক হলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।

প্রশ্ন : ব্যাংক পরিচালনার অব্যবস্থা সম্পর্কে প্রচুর অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে সামরিক সরকার কি ব্যবস্থা নেবে?
উত্তর : ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের টাকার যথেচ্ছ অপব্যবহার হয়েছে। কোটি কোটি টাকার ঋণ অনাদায়ী পড়ে আছে। ব্যাংকগুলো চলেছে কতিপয় লোক ও রাজনীতিকে সন্তুষ্ট করার জন্য। এ অবস্থা চলতে পারে না। ব্যাংক পরিচালনার ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

প্রশ্ন : প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার বেসরকারী তদন্ত রিপোর্ট কি প্রকাশিত হবে?
উত্তর : আমরা জনগণকে এটা জানতে দেব। এ রিপোর্টে মূলতঃ শান্তিশৃংখলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও ব্যর্থতার কথা আলোচিত হয়েছে।

সাক্ষাৎকার/আলোকচিত্র
শাহাদত চৌধুরী/মাহফুজউল্লাহ
০০০

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/05/1982.04.16-bichitra.pdf” title=”1982.04.16 bichitra”]