মুদ্রাস্ফীতি রোধঃ একটি প্রচেষ্টা প্রসঙ্গে
– জামশেদুজ্জামান
বাংলাদেশ ব্যাংক ১৯৭৪ সালের মুদ্রাস্ফীতি রোধে জুলাই মাস থেকে মুদ্রাস্ফীতি রোধের একটি পদক্ষেপ হিসেবে ব্যাংক রেট পাঁচ থেকে আটে বাড়িয়ে দেয়। যার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ বেড়ে যায় সুদের হার। আমাদের এ আলোচনা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ প্রচেষ্টাকে বিশ্লেষণ করবে এবং তার সার্থকতা করবে নিরুপণ।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ কনিস তার ‘টিট্রাইজ অন মানি’ বইতে ব্যাংক রেট পরিবর্তনের তিনটি ফলাফল ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। প্রথমটি অনুসারে অর্থ পরিক্রমণের আয়তন সীমিতকরণের উদ্দেশ্যে ব্যাংক রেট বাড়ানো যেতে পারে। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ব্যাংক রেট বাড়িয়ে অর্থবৃদ্ধি রোধ করা যায় না। তার কারণ ব্যাংক রেট প্রত্যক্ষ ভাবে অর্থ আয়তনকে প্রভাবিত করে না, করে পরোক্ষভাবে। যে অর্থনীতি উন্নয়নশীল, সেখানে পরোক্ষ প্রভাব এতো কম যে তা অর্থবৃদ্ধিকে রোধ করতে পারে না৷
দ্বিতীয় ধারণা অনুসারে, রাষ্ট্রের মজুদ সোনা রক্ষা এবং বিদেশী ঋণকে প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে ব্যাংক রেট বাড়ানো যেতে পারে।
তৃতীয় ধারণা অনুসারে, সঞ্চয়ের তুলনায় বিনিয়োগ বাড়াতে বা কমাতে চাইলে ব্যাংক রেট হেরফের করা যায়।
বাংলাদেশে সুদের হার বাড়লেও বিনিয়োগ সহজে প্রভাবিত হবে না, কেননা প্রান্তিক উৎপাদন অনেক বেশি এবং যে কোন ক্ষেত্রে বিনিয়োগ লাভজনক। সুতরাং বিনিয়োগকে নিয়ন্ত্রণের জন্য অযথা যে দেশে সোনা নেই সে দেশে ‘সঞ্চিত ‘ সোনাকে রক্ষা করার জন্য ব্যাংক রেট বাড়ানো হয়নি। ব্যাংক রেট বাড়ানোর কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে অর্থ মন্ত্রী বলেছেন, অন্যান্য ব্যবস্থার সঙ্গে এ ব্যবস্থা অপ্রয়োজনীয় খাতে ঋণদানকে অনুৎসাহিত করবে, সঞ্চয়কে বাড়াবে, সময় আমানতের স্তরকে করবে অধিকতর উন্নত। শিল্প কারখানার পরিচালকদের খরচা সম্পর্কে সচেতন করবে। মজুদ করা থেকে ব্যবসায়ীদের করবে বিরত। এক কথায় মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হল এর মূল উদ্দেশ্য।
ব্যাংক রেট বাড়ালে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণদান ক্ষমতা কমে যায়। এবং অন্য দিকে, যে রাষ্ট্রের আমদানী রফতানী ভারসম্য প্রতিকূলে, সে রাষ্ট্রের জন্য ব্যাংক রেট বৃদ্ধির ফলে বিদেশী মুদ্রার বিনিময়হার দেশের পক্ষে সুবিধাজনক হয়। ফলে আমদানীকৃত দ্রব্যের বাজার সংক্ষিপ্ত হয় এবং উজ্জ্বলতর হয় রফতানীর সম্ভাবনা।
ব্যাংক রেট বৃদ্ধির উদ্দেশ্য বর্ণনার পর আমাদের বিচার করতে হবে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃত বর্ধিত হার’ সত্যিই ঋণদান সংযত, সঞ্চয় বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতিতে লাগাম দিতে পেরেছে কিনা।
ব্যাংক রেট বৃদ্ধির ফলে সঞ্চয়ের জন্য সুদের হারও বেড়ে গেছে। সুদ বেশি হলে সঞ্চয় বেড়ে যাবে৷ (সঞ্চয়কে দু ভাগে ভাগ করা হয়, চাহিদা আমানত ও সময় আমানত) অতিরিক্ত সঞ্চয় যখন ‘ সময় আমানত ‘ হতে পারে, তার জন্য ‘চাহিদা আমানতের তুলনায় সময় আমানতের সুদের হার করা হয়েছে তুলনামূলক ভাবে বেশি৷ সময় আমানত, সঞ্চয় বাড়লে, সজ্ঞা অনুসারে, মূল্যবৃদ্ধি কমে যাবে। কমে যাবে মুদ্রাস্ফীতি।
সুদ বাড়ার আগে এবং সুদ বাড়ার পরে সময় আমানতের বৃদ্ধি কতটুকু হয়েছে, তার তুলনামূলক একটি তালিকা তৈরী করে দেখা যাক, সুদ বৃদ্ধির ফল কি হয়েছে।
সঞ্চয় আমানত
সময়
|
১৯৭৩-৭৪
সুদ বৃদ্ধির পূর্বে |
(কোটি টাকায়)
১৯৭৪-৭৫ সুদ বৃদ্ধির পর |
জুন | ২৯৩.০৮ | ৩৮৮.৭৫ |
জুলাই | ৩২১.৬৫ | ৪১৪.৭৫ |
আগস্ট | ৩১৪.৪৮ | ৪২৬.১৯ |
সেপ্টেম্বর | ৩১৭.৭১ | ৪২৩.৯৪ |
অক্টোবর | ৩২০.৮৯ | ৪২৯.৩৭ |
নবেম্বর | ৩৪০.৩৫ | ৪২৯.২২ |
ডিসেম্বর | ৩৪৪.৪৬ | ৪৩০.৫৩ |
এ ধরণের তালিকা থেকে আমরা কোনকিছু প্রমাণ করতে পারি না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, সুদের হর বাড়ার ফলে সময় আমানত সঞ্চয় বেড়েছে৷ কিন্তু, তা নাও হতে পারে। ১৯৭৩-৭৪ এর তুলনায় ১৯৭৪-৭৫ সালের এ বৃদ্ধি শুধু সময় আমানতেই হয় নি বরং চাহিদা আমানতেও হয়েছে। সুদ দায়ী না হয়ে নিরপেক্ষ কোন কিছুর প্রভাবও এ বৃদ্ধির পেছনে কারণ হয়ে থাকতে পারে। যেমন সময়। সময়ের সঙ্গে প্রায় সবকিছু বৃদ্ধি পেয়েছে। সুতরায় গণিত শাস্ত্রের এক বিশেষ প্রকৌশল দিয়ে আমরা দেখবো সুদ সময় আমানতকে কতটুকু প্রভাবিত করেছে। ঐ প্রকৌশল সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। পদ্ধতিটি হচ্ছে টাইম সিরিজ। যে কোন সময়ের সঙ্গে উথ্বান পতনের ‘কার্ভকে’ টাইম সিরিজ (ন্যানো বর্গ পদ্ধতি) একটি সরল রেখায় রূপান্তরিত করতে পারে। এই গ্রাফে এই সরল রেখাকে বসালে তা উর্ধ্বমুখী না অধোমুখী তা দেখা যায়। উর্ধ্বমুখী হলে কি হারে তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাও আমরা গ্রাফের মাধ্যমে বুঝতে পারি। সুতরাং সময় আমানতের হিসাবকে আমরা টাইমসিরিজে রূপান্তরিত করি।
সঞ্চয় আমানতের টাইম সিরিজ
সময় | ১৯৭৩-৭৪
ব্যাংক রেট যখন পাঁচ |
(কোটি টাকায়)
১৯৭৪-৭৫ সূদ বৃদ্ধির পরে |
জুলাই | ৩১৪.৪০ | ৪১৯.৭৮ |
আগস্ট | ৩১৮.২০ | ৪২২.৮৩ |
সেপ্টেম্বর | ৩২২.৯৫ | ৪২৫.২৭ |
অক্টোবর | ৩২৬.৭৫ | ৪২৭.৭১ |
নবেম্বর | ৩৩১.৫০ | ৪৩০.৭৬ |
ডিসেম্বর | ৩৪৪.৪৬ | ৪৩০.৫৩ |
ব্যাংক রেট যখন পাঁচ ছিল তখন মাসিক সময় আমানতের টাইম সিরিজ বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৮০। ব্যাংক রেট বাড়িয়ে দিয়ে যখন শ্যুট হল তখন টাইম সিরিজ বৃদ্ধির হার তো বাড়লোই না বরং কমে ২.৪৪ হয়ে গেছে৷ অতএব গণিতের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাংক রেট বাড়িয়ে সময় আমানতের ট্রেন্ডকে বাড়াবার উদ্দেশ্যে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ব্যর্থ হয়েছে। ইতিমধ্যে এ ট্রেন্ডের কোনরূপ পরিবর্তন না হলে ভবিষ্যতেও কোন উন্নতি আশা করা যাচ্ছে না। এ ভবিষ্যদ্বাণী আমরা টাইম সিরিজের মাধ্যমেই করতে পারি। ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হয় কিনা তা পুরাতন ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করে দেখা যাক।
১৯৭৩ সালের সময় আমানতকে নিয়ে বিশ্লেষণ আরম্ভ করা যেতে পারে। জানুয়ারী থেকে ডিসেম্বর, ১৯৭৩ এর প্রতি সপ্তাহের আমানতের তালিকা নেওয়া হল৷ ১৯৭৩ সালের প্রতি সপ্তাহের সময় আমানতের তালিকা নেওয়া হলো। ৫২ টি সংখ্যা পাওয়া গেল। এ তালিকাকে ন্যূন বর্গ পদ্ধতিতে টাইম সিরিজে রূপান্তরিত করা হল৷ সারা বছরের তালিকাটি না দেখিয়ে জুলাই থেকে ডিসেম্বরের হিসাবটাকে নীচের তালিকার দুই নম্বর সারিতে লেখা হল। এখানে টাইম সিরিজের লিনিয়ার কার্ডটির ঢাল বা লোপ পাওয়া গেল ১.৬২।
এবারে ১৯৭৩ এর জানুয়ারী থেকে জুন পর্যন্ত সময় আমানতের তালিকা নিয়ে আবার তাকে টাইম সিরিজে রূপান্তরিত করি। এখানে ঢাল বা লোপ হলো ১.৮০। আগেরটির চেয়ে এই টাইম সিরিজ কম সময়কে কেন্দ্র করে করা বলে ০.১৮ পার্থক্য বা ভুল হল। এ সামান্য ভুলকে ভুলে যাওয়া যাক৷ জুন পর্যন্ত গৃহীত সংখ্যা থেকে এখন ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় জুলাইতে টাইম সিরিজ কত হবে, আগস্টও, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বরে কত হবে। কেননা, ১.৮০ লোপ আমরা পেয়ে গেছি
সময় আমানতের টাইম সিরিজ
সময় | ভবিষ্যদ্বাণীকৃত
সময় আমানতের টাইম সিরিজ |
যখন ব্যাংকরেট ৫
প্রকৃত সময আমানতের টাইম সিরিজ |
জুলাই ৬, ১৯৭৩ | ৩০২.৯৭ | ৩০২.২৮ |
জুলাই ১৩, ১৯৭৩ | ৩০৪.৭৭ | ৩০৩.৯০ |
জুলাই ২০, ১৯৭৩ | ৩০৬.৫৭ | ৩০৫.৫২ |
জুলাই ২৭, ১৯৭৩ | ৩০৮.৩৭ | ৩০৭.১৪ |
আগস্ট ৩, ১৯৭৩ | ৩১০.১৭ | ৩০৮.৭৬ |
আগস্ট ১০, ১৯৭৩ | ৩১১.৯৭ | ৩১০.৩৮ |
আগস্ট ১৭, ১৯৭৩ | ৩১৩.৭৭ | ৩১২.০০ |
আগস্ট ২৪, ১৯৭৩ | ৩১৫.৫৭ | ৩১৩.৬২ |
আগস্ট ৩১, ১৯৭৩ | ৩১৭.৩৭ | ৩১৫.২৪ |
সেপ্টেম্বর ৭, ১৯৭৩ | ৩১৯.১৭ | ৩১৬.৮৬ |
সেপ্টেম্বর ১৪, ১৯৭৩ | ৩২০.৯৭ | ৩১৫.২৪ |
সেপ্টেম্বর ২১, ১৯৭৩ | ৩২২.৭৭ | ৩২০.১০ |
সেপ্টেম্বর ২৮, ১৯৭৩ | ৩২৪.৫৭ | ৩২১.৭২ |
আক্টোবর ৪, ১৯৭৩ | ৩২৬.৬৭ | ৩২৩.৩৪ |
আক্টোবর ১১, ১৯৭৩ | ৩২৮.১৭ | ৩২৪.৯৬ |
আক্টোবর ১৮, ১৯৭৩ | ৩২৯.৯৭ | ৩২৬.৫৮ |
আক্টোবর ২৫, ১৯৭৩ | ৩৩১.৭৭ | ৩২৮.২০ |
নবেম্বর ১, ১৯৭৩ | ৩৩৩.৫৭ | ৩২৯.৮২ |
নবেম্বর ৮, ১৯৭৩ | ৩৩৫.৩৭ | ৩৩১.৪৪ |
নবেম্বর ১৫, ১৯৭৩ | ৩৩৭.১৭ | ৩৩৩.০৬ |
নবেম্বর ২২, ১৯৭৩ | ৩৩৮.৯৭ | ৩৩৪.৬৮ |
নবেম্বর ২৯, ১৯৭৩ | ৩৪০.৭৭ | ৩৩৬.৩০ |
ডিসেম্বর ৬, ১৯৭৩ | ৩৪২.৫৭ | ৩৩৭.৯২ |
ডিসেম্বর ১৩, ১৯৭৩ | ৩৪৪.৩৭ | ৩৩৯.৫৪ |
ডিসেম্বর ২০, ১৯৭৩ | ৩৪৬.১৭ | ৩৪১.১৬ |
ডিসেম্বর ২৪, ১৯৭৩ | ৩৩৭.৯৭ | ৩৪২.৭৮ |
টাইম সিরিজ বৃদ্ধির হার (চ) | ১.৮০ | ১.৬১.৮২২ |
উপরের তালিকা থেকে দেখা যায় প্রতি মাসের সত্যিকারের টাইম সিরিজ ও ভবিষ্যতবাণীকৃত টাইম সিরিজ বেশ কাছাকাছি। অতএব ঠিক একইভাবে ১৯৭৪ সালের পর থেকে (ব্যাংক রেট যখন থেকে বেড়ে গেছে) প্রাপ্ত সময় আমানতের তথ্যাদি নিয়ে আমরা ভবিষ্যতবাণী করতে পারি ভবিষ্যতেও আমাদের সময় আমানত বাড়ছে না৷ কেননা এ সময় স্লোপ বা ঢাল মাত্র ০.৬১ (অবশ্য কিছুটা ভুলকে এর থেকে বিয়োগ করে নিতে হবে)।
সময় আমানতের টাইম সিরিজ
সময় | (যখন ব্যাংক রেট ৮)
ভবিষ্যতবাণীকৃত সময় আমানতের টাইম সিরিজ |
ডসেম্বর ১৯৭৪ | ৪৩৩.২০ |
জানুয়ারী ১৯৭৫ | ৪৩৬.২৫ |
ফেব্রুয়ারী ১৯৭৫ | ৪৩৮.৬৯ |
মার্চ ১৯৭৫ | ৪৪১.১৩ |
এপ্রিল ১৯৭৫ | ৪৪৩৫৭ |
মে ১৯৭৫ | ৪৪৬.৬২ |
জুন ১৯৭৫ | ৪৪৯.০৬ |
জুন ১৯৭৬ | ৪৮০.৭৮ |
ব্যাংক রেট বাড়াবার পর সময় আমানতের টাইম সিরিজের বৃদ্ধির হারকে বাড়ানো তো গেলই না বরং তা আরও কমে যাচ্ছে। অতএব বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রাস্ফীতি রোধের এ প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় পেল।
এখানে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করতে গেলে সামান্য কিছু স্বার্থকতার কথা উল্লেখ না করা অন্যায়। ১৯৭৪-৭৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত হিসাব থেকে দেখা যায় যে চাহিদা আমানতের তুলনায় তুলনামূলক ভাবে সময় আমানত বেড়েছে৷ এটি একটি ভাল লক্ষ্মণ। সময় / চাহিদা আমানতের অনুপাত ১৯৭৩-৭৪ সালে বর্তমান অবস্থার চেয়ে কম ছিল। এই উন্নতি যদিও ভাল লক্ষণ তবু এ বৃদ্ধির হার এত কম যে মুদ্রন বৃদ্ধির প্রবল বেগকে প্রশমিত করার জন্য তা একেবারেই নগণ্য। অতএব ব্যাংক রেট বৃদ্ধিকে কেবল আংশিক সাফল্যের মর্যাদাই দেওয়া যেতে পারে।
সময় আমানত / চাহিদা আমানতের অনুপাত
১৯৭৩-৭৪ | |
জানুয়ারী | ০.৭৮ |
ফেব্রুয়ারী | ০.৭৮ |
মার্চ | ০.৭৬ |
এপ্রিল | ০.৭৮ |
মে | ০.৮১ |
জুন | ০.৮২ |
১৯৭৪-৭৫ | |
জুলাই | ০.৮৫ |
আগস্ট | ০.৮৮ |
সেপ্টেম্বর | ০.৯০ |
অক্টোবর | ০.৮৮ |
নবেম্বর | ০.৮৪ |
ডিসেম্বর | ০.৮০ |
এবারে আসা যাক ব্যাংক ঋণ প্রসঙ্গে। ১৯৭৪ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে ১২০.৮৫ কোটি টাকা। এ বৃদ্ধির বিরাট অংশ ঘটিয়েছে ব্যাংক ঋণ। সুতরাং ব্যাংক ঋণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সমগ্র মুদ্রাস্ফীতি পরিস্থিতির কোনই উন্নতি হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ব্যাংক রেট বাড়িয়ে দেব্র অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অপ্রয়োজনীয় ও স্বল্প প্রয়োজনীয় খাতে ব্যাংক ঋণের সংকোচন। ব্যাংক রেট বেড়ে গেলে ঋণদান সূদ রেটও বেড়ে যায়৷ ১৯৭৪ সালের জুলাইয়ের পূর্বে সাধারণের জন্যে সূদ রেট ছিল ১০%, এখন তা হয়েছে ১২-১৩%। বিশেষ উদ্দেশ্য যেমন, পাট, পাটজাত দ্রব্য ও চায়ের জন্য ঋণদকন সূদ ধার্য করা হয়েছে ১০.৫%। এ বৃদ্ধির ফলে ব্যাংক ঋণ কমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৯৭৪ – ৭৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ব্যাংক ঋণ বেড়েছে ১৪৫.৯৫ কোটি টাকা যেখানে গত বছর ওই একই সময় বেড়েছিল ১৩০.০১ কোটি টাকা। এখনও আমরা টাইম সিরিজ পদ্ধতিকে ব্যবহার করে ১৯৭৪ – ৭৫ সালের যে ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধির যে হার বা স্লোপ পাচ্ছি তা হচ্ছে ৪.৭৫, যেখানে গত বছরের হিসেব করলে টাইম সিরিজের লিনিয়ার কার্ভের স্লোপ ছিল ১.৯৭। সুতরাং আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি, ব্যাংক রেট বাড়িয়ে ঋণের সংকোচন তো হয় নি উপরন্তু তার বৃদ্ধির হার বিপদ সীমার বহু ওপরে। এ মুহূর্তে ব্যাংক রেট বৃদ্ধির মাধ্যমে মুদ্রাস্ফীতি রোধের পরিকল্পনা যে ব্যর্থ হয়েছে তা মেনে নেওয়া উচিৎ। এবং অন্য কোন সত্যিকারের পথ খুঁজে বের করা উচিৎ যা বাংলাদেশকে এ মনন্তর থেকে রক্ষা করতে পারে৷
ব্যাংক রেট বাড়িয়ে ব্যাংক ঋণ সংকোচন করা যায় নি এবং ভবিষ্যতেও যাওয়ার লক্ষ্মণ নেই, এ কথা বলেই ক্ষান্ত হওয়া যাবে না। বৃহত্তর কল্যাণের জন্য আমাদের খুঁজে বের করতে হবে ব্যাংক ঋণ সংকোচনে ব্যর্থতার কারণ কি।
১৯৭৪ – ৭৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ব্যক্তিগত খাতে যে ঋণ পাওয়া গেছে তা মোট ঋণ বৃদ্ধির ২৭.৯৯%। গণ ও সরকারী(পাবলিক সেক্টর) খাতে গেছে তার সামান্য অংশ প্রকৃত অর্থনৈতিক কারণে প্রাপ্ত, উল্লেখযোগ্য অংশই গেছে অনঅর্থনৈতিক ক্ষেত্রে। এর পেছনে হয়তো রাজনৈতিক ক্ষতার প্রাধান্যই দায়ী ছিল। যেহেতু তাদের অনেকেই প্রকৃত ব্যবসায়ী নন, অতএব এ ঋণ অর্থনৈতিক উন্নতিতে কোন কাজেই আসেনি, তা মুদ্রাস্ফীতিতে ইন্ধন যুগিয়েছে।
ব্যাংকঋণ বৃদ্ধির ৭২.০১% অংশকরণই হল গণখাত। এ সম্পর্কিত তথ্যাবলী নীচের তালিকা থেকে দেখা যেতে পারে।
তপসীলভুক্ত ব্যাংকের ঋণদান (শিল্প ও কৃষি ব্যাংক বাদ দিয়ে)
(কোটি টাকায়)
১৭ই ডিসেম্বর,
১৯৭১ |
জুন
১৯৭৪ |
নবেম্বর
১৯৭৪ |
স্বাধীনতা থেকে
নবেম্বর ’৭৪ পর্যন্ত পরিবর্তন |
জুন ’৭৪ থেকে
নবেম্বর ‘৭৪ পর্যন্ত পরিবর্তন |
|
ব্যাক্তিগত খাত | ২০৩.৫৯ | ২০৩.৫৭ | ২৩৭.৪১ | +৩৩.৮২
(৮.০৯%) |
+৩৩.৮৪
(২৭.৯৯%) |
গণ খাত | ৩৯৫.৯৪ | ৩৯৫.৯৪ | ৪৮৩.০২ | +৩৮৪.১৫
(৯১.৯১%) |
৮৭.০৮
(৭২.০১%) |
মোট | ৫৯৯.৫১ | ৫৯৯.৫১ | ৭২০.৪৩ | +৪১৭.৯৭
(১০০%) |
+১২০.৯২
(১০০%) |
তালিকা থেকে আমরা সুস্পষ্ট ভাবেই দেখতে পারছি যে ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধির সর্ব বৃহৎ কারণই হচ্ছে গণখাত। গণখাতের আবার বেশিরভাগই জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠানাদি। এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান ঋণ বৃদ্ধি তো ঘটিয়েছেই অন্য দিকে উৎপাদন বাড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।
যেহেতু দেশের সর্ব বৃহৎ ঋণগ্রহনকারী গণখাত, সুতরাং সুদের হার হের – ফের ঋণকে প্রভাবিত করবে না কেননা সুদ যাই হোক না কেন গণখাত ঋণ নেবেই। তার যে দেশে জাতীয়কৃত প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিচালক গণ জানেন যে লোকসান হলেও ঋণ নেওয়া যাবে সেসব পরিচালক সরকারী অর্থকে অনভিজ্ঞের মত ব্যবহার করতে পিছপা হবেন কেন? তাছাড়া পরিচালক হিসেবেও তাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে৷ ব্যাংক রেট বাড়িয়ে ঋণ কমানো যায় সেখানেই, যেখানে পুঁজির খরচা বাড়লে পুঁজির চাহিদা কমে বা পুঁজির আরও সঠিক ব্যবহার হয়। অর্থাৎ পুজির চাহিদা তার খরচের সাথে স্থিতিস্থাপক৷ পুঁজির চাহিদা স্থিতিস্থাপক হয় তখনই যখন অর্থনীতিতে ব্যাক্তিগত খাত প্রধান হয় অথবা গণখান অত্যন্ত দায়িত্ব পূর্ণ ও অভিজ্ঞ হয়। সেখানেই ব্যাংক রেট বৃদ্ধি ঋণ সংকোচনে কার্যক্ষম। কিন্তু যেহেতু আমাদের অর্থনীতিতে গণখাতই প্রধান এবং যেহেতু গণখাত অনভিজ্ঞ ও প্রচুর সমস্যায় জর্জরিত সেহেতু পুঁজির চাহিদা অপেক্ষাকৃত অস্থিতিস্থাপক, বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ সুযোগ গ্রহন করবেই এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবে না, তা ব্যাংক রেট পাঁচ অথবা আটই হোক না কেন। অতএব ব্যাংক রেট সংবেদনশীল করার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
*সমস্ত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রবন্ধে লেখকের মতামত সম্পূর্ণ ব্যাক্তিগত।
ইউনিকোডে টাইপ – Maruf Muktadir Khan
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/02/1975.02.21-bichitra.pdf” title=”1975.02.21 bichitra”]