You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.02.13 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | কথার যাদুকর আর নেই | হিংসার পথে মুক্তি নেই- | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৩ই ফেব্রুয়ারী, বুধবার, ১লা ফাল্গুন, ১৩৮০

কথার যাদুকর আর নেই

কথা যাদুকর ডঃ সৈয়দ মুস্তাফা আলী আর নেই। বরেণ্য সাহিত্যিক, বহুভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ ও পন্ডিত সৈয়দ মুস্তাফা আলী গত সোমবার আত্মীয় পরিজন ও উপমহাদেশের অসংখ্য অনুরাগীদের সুখের সাগরে ভাসিয়ে পরলোকে যাত্রা করেছেন।
সৈয়দ মুস্তাফা আলী একটি নাম। একটি ইতিহাস। বাংলা সাহিত্যের একটি অধ্যায়। তার মতো ভাষার যাদুকর সাহিত্যিকের তিরোধানে বাংলা সাহিত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। মজলিসে টংয়ে কাহিনী ফেঁদে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে, আর কৌতুকে মাৎ করে দেবার মত ক্ষমতা সৈয়দ মুজতবা আলী ছাড়া আর কারো ছিল না। নীরস ভ্রমণ-কাহিনী ও সরস ও রসালো বিষয়ে পরিণত হতে পারে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশে-বিদেশে’ গ্রন্থই তার প্রমাণ। ‘চাচা কাহিনী’ ‘পঞ্চতন্ত্র’-এ যে বক্তব্য তিনি সহজ-সরল ভাষায় রেখেছেন তা পাঠকদের মনে গেঁথে থাকবে চিরদিন।
কথার পর কথা সাজিয়ে পাঠক মনকে রসে আপ্লুত করে রাখাটা রীতিমতো দুরূহ কাজ। সেই কাজটি করেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। সবচেয়ে বড় কথা মোস্তবা আলী সাহিত্য রচনায় যে নিজস্ব ঢংয়ের প্রচলন করেছেন তা অনন্য ও অসাধারণ।
প্রতিভার যাদুকাঠি স্পর্শ করে তাই সোনায় পরিণত হয় বলে একটা সাধারণ কথা চালু রয়েছে। মুস্তাফা আলী রাঃ সাধারণ প্রতিভায় বাংলা সাহিত্যের ব্যঙ্গাত্মক রচনা সত্যিই খাটি সোনাতে পরিণত হয়েছে। লেখনীর জাদুকাঠি রেস্পন্সে তিনি দেখিয়ে গেছেন বলার মত করে বলতে পারলে তা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মন জয় করতে সক্ষম হয়।
জীবনের চলার পথে চলতে গিয়ে তিনি যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, যা দেখেছেন তাকে মনের মণিকোঠায় কৃপণের ধরে না রেখে সকলের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর নামটি উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে একটি সুদর্শন কান্তির রসিক ও আড্ডা বাজ মানুষের ছবি ভেসে ওঠে। দুঃখ, দারিদ্র আর আশা-নিরাশার দোলায় দোলায়িত মানুষের জীবনে যেন এক টুকরো আশা আর শান্তির বাণী বই এনে দেহমনকে সজীব করে তোলে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদে ধন্য সৈয়দ মুস্তাফা আলী রচনা ঐতিহ্যটিকে ধরে রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। এ শ্রদ্ধায় তাকে অনুপ্রাণিত করেছে কথার মালা সাজাবার। সারাজীবন তিনি কথার পর কথা গেছে মালা সাজিয়েছেন। উপহার দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের রস পিপাসুদের।
সৈয়দ মুজতবা আলীর মৃত্যুতে মরহুমের পত্নী বেগম রাবেয়া আলীর কাছে এক শোকবাণী পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গত সোমবার আজিমপুর পুরাতন গোরস্থানে বাংলা সাহিত্যের এই কৃতী সন্তানকে দাফন করা হয়েছে। কাছেই রয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদ আবুল বরকত ও শফিকুর রহমানের কবর। এ যেন এক আশ্চর্য যোগাযোগ। সৈয়দ সাহেব মনেপ্রাণে বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য আজীবন তিনি সাধনা করে গেছেন। মহান একুশের দিনগুলোতে শহীদ আবুল বরকত ও শফিকুর রহমানের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে বাংলা ভাষা অনুরাগীদের চোখে পড়বে বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিতপ্রাণ সৈয়দ সাহেবের কবরের উপর। সেই শুভক্ষণের যদি দু’একটা ফুল সৈয়দ সাহেবের কবরের উপরে পড়ে তাহলে তার আত্মা শান্তি পাবে।
তিনি নেই এ কথা ভাবতেই ব্যাথায় বেদনায় মনটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তবুও বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। ‘জন্মিলে মরিতে হবে’ এ চিরন্তন সত্যকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

হিংসার পথে মুক্তি নেই-

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, অরাজকতা পূর্ণ ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা যায় না- যেতে পারে না। যারা জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করার জন্য অরাজগতা পূর্ণ ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে এবং যারা স্বাভাবিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত শ্রমিক শ্রেণীর ওপর হামলা চালায় তারা কোনমতেই জনগণ ও শ্রমিক শ্রেণীর বন্ধু নয় এবং হতেও পারে না। পরন্তু তারা দেশকে এক নৈরাজ্যের পথে ঠেলে নিয়ে যেতে চায়। এবং এ নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের সর্বযুগের সর্বদেশের দেশ ও জাতির শত্রু বলে বিবেচিত হয়- হয়েছেও। বস্তুতঃ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপরোক্ত বক্তব্যে একটি মূল্যবান ও ঐতিহাসিক সত্যকেও উদ্ধৃত করেছেন। এ সত্য চিরন্তন ও সর্বকালের।
একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে যে কোনো মহলেরই যে কোন হিংসাত্মক ও অরাজকতাপূর্ণ কার্যকলাপ চালানো সব সময়ই নিন্দনীয়। বিশেষ করে সেসব কাজে যদি দেশের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, নিরুদ্বেগ রাত্রিযাপন এবং জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে অচলাবস্থা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তবে দেশের মানুষ অবশ্যই সে সব কাজকে ঘৃণা চোখে দেখবে এবং প্রয়োজনবোধে তা প্রতিহত করার কাজেও এগিয়ে আসবে। এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। এটাই তো ইতিহাসের শিক্ষা। প্রাচীন আমল থেকেই বিশ্বের সকল দেশের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র তাদের হীন স্বার্থ সিদ্ধির জন্য দেশে হিংসাত্মক কার্যকলাপের সৃষ্টি করেছে- মানুষকে অতিষ্ঠ ও দিশেহারা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। নিজেদের হিংসার আগুনে- নিজেদের অরাজকতার বিষবাষ্পে নিজেরাই দগ্ধীভূত হয়েছে- নিঃশেষিত হয়েছে। তেমনি ইতিহাসের পথ বেয়ে কালের চাকার ঘূর্ণনের সাথে সাথে আমাদের দেশেও বহুকাল বহুবার বহুলোকই হিংসার পথে এগিয়ে গিয়েছিল নিজেদের হীন স্বার্থ চরিতার্থ করা ছাড়াও রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের চেষ্টাও করেছিল- কিন্তু কেউ কোনদিন পূর্ণাঙ্গভাবে তো নয় আংশিকভাবে এতোটুকু সফলতা অর্জন করেছিল কিনা, ইতিহাস তো তার কোনো সাক্ষ্য বহন করে না- ইতিহাসের বুকে তো তার কোন প্রমাণ নেই- খুঁজে পাওয়া যায় না।
এই উপমহাদেশেও কিন্তু হিংসার রাজনীতি, হত্যার রাজনীতির নজির কম নয়। স্মরণাতীত কালের কথা বাদ দিলেও স্মরণকালের মধ্যেও আমাদের প্রতিবেশী ভারতের অন্যতম অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবাংলায় একদল লোক শ্রেণী সংগ্রামের নামে এই কিছুদিন আগে যে হিংসাত্মক, অরাজকতা পূর্ণ ও হত্যার রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছিল পেরেছিল তারা তাদের সেসব কার্যকলাপের মাধ্যমে নিজেদের বঞ্চিত লক্ষ্যে উপনীত হতে? পেরেছিল তারা শ্রেণিসংগ্রাম চালাতে বা কোনো রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পেতে? পারে নি। কেননা শ্রেণিসংগ্রামই হোক বা অন্য কোনও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হোক হিংসার পথে, অরাজকতার পথে হত্যার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় না- যেতে পারে না। তবে এতে করে সাময়িকভাবে দেশের সাধারণ মানুষের মনে ভয়-ভীতি, আতঙ্ক ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করা যায় মাত্র। আর কোন ফল হয় না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দেশের উত্তরাঞ্চলে এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সেই একই কায়দায় কোন কোন গুপ্ত সংগঠনের গুপ্তঘাতকের দল সেই একই হিংসাত্মক, অরাজকতা পূর্ণ ও হত্যার রাজনীতির মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরতে কিছু কিছু অপচেষ্টা চালিয়ে ছিল। কিন্তু যেহেতু ওরা এসেছে হিংসাত্মক পথে, হত্যার পথে তাই দেশের মানুষও ওদের ঠাই দেয়নি- দেশের উত্তরাঞ্চলে তাই ওরা আজ নিশ্চিহ্ন, অবশ্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একমাত্র আমাদের পুলিশ বিভাগের অবহেলায় এখনো বেশ সচেষ্ট- কিন্তু কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যে ওরা পৌঁছুতে পারবে কি? পারবে না। কেননা দেশের সকল রাজনৈতিক শক্তির উৎস। সে জনগণের মধ্যে থেকে কাউকে হত্যা করে, জনমনে ভয়-ভীতি, সন্ত্রাস আর আতঙ্কের সৃষ্টি করে জনগণকে সাথে পাওয়া যায় না- এবং জনগণকে সাথে পাওয়া না গেলে কোনো রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানও হতে পারে না।
যারা বন্দুকের নল সকল ক্ষমতার উৎস মনে করে জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক শক্তির মালিক হতে চান তারা এ বিংশ শতাব্দীতেও বোকার স্বর্গে বাস করেন। তাই হিংসার রাজনীতি নয়, হত্যার রাজনীতি নয়, অরাজকতার রাজনীতি নয়- জনগণের রাজনীতিতেই সকল রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তি দের মনোনিবেশ করা উচিত বলে ইতিহাস যে রায় দেয় আমরা সেই রায়কে মেনে নেবার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাই। আমরা মনে করি এতেই মানুষের মুক্তি আসবে। আসতে পারে। অন্য কোন পথে নয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন