You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৩শে ডিসেম্বর, রোববার, ৭ই পৌষ, ১৩৮০

শ্রমিক শ্রেণীর প্রতিশ্রুতি

স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের বিভিন্ন মিল কারখানায় উৎপাদন হ্রাস পায় অত্যন্ত ব্যাপক ভাবে। কোন কোন মিল-কারখানায় এটা একেবারেই শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়ায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই দশা হয়। এর কারণও অবশ্য ছিল। বহুবিধ। প্রথমতঃ স্বাধীনতার আগে এদেশের প্রায় সব কটি বড় বড় মিল-কারখানার মালিক ছিল পাকিস্তানিরা। তারপর কিছু কিছুর মালিক ছিলেন বাঙালিরা। এদের মধ্যে অনেকেই আবার জন্মগতভাবে বাঙালি ছিলেন না। অন্য দিকে কিছু কিছু মালিক ছিলেন যারা পাকিস্তানে বিশ্বাস করতেন, বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতি তাদের কোনো সমর্থন ছিল না। অথচ দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে কাজেই সম্পদ রক্ষা করাটা তাদের কাছে বড় হয়ে দাঁড়ালো। তারাও বাঙালি দরদী হয়ে গেলেন।
স্বাধীনতার পর পরই দেশের শিল্প কারখানার মালিকানার যখন এ অবস্থা তখন বঙ্গবন্ধু জাতির প্রথম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে পাট, চিনি, বস্ত্র, ব্যাংক বীমা সহ সকল বৃহৎ কল-কারখানা জাতীয়করণের কথা ঘোষণা করলেন। জাতীয় করণের নীতি ঘোষিত হওয়ার সাথে সাথে দেশের জনগণ বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণী যখন খুশি হলেন, উল্লসিত হলেন ঠিক তার সাথে সাথে প্রমাদ গুণলেন শেষোক্ত মালিকের দল। সম্পদ তাদের হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক শ্রেণীর বিজয় আর সরকারি জাতীয়করণ নীতি বানচালের জন্য তারা উঠে পড়ে লাগলেন। কি করে সম্পদ ধরে রাখবেন বা অন্যত্র সরিয়ে নিতে সক্ষম হবেন, সে চিন্তাতেই তারা মশগুল হলেন। শুরু হল চক্রান্তের খেলা।
এই খেলাতে তারা সাথী হিসেবে পেলেন একদিকে কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারী অন্য দিকে কিছু কিছু পেশাদার শ্রমিক নেতাকে। জাতীয়করণের নীতি ঘোষিত হবার পর এখন জাতীয়করণকৃত এই সব কল কারখানা পরিচালনার জন্য যোগ্য লোক কোথায় পাওয়া যায়, সরকার যখন সে কথাটি ভাবছিলেন, তখন এই সরকারি কর্মচারীরা সাজেশন দিলেন জাতীয়করণকৃত কল-কারখানাগুলোর মালিকদের আপাততঃ প্রশাসক করে দিয়ে মিল কারখানাগুলো অন্ততঃ চালু করা হোক। পরে না হয় দেখা যাবে। কেননা এই সাবেক মালিকরা অভিজ্ঞ। তারা তাদের মিল-কারখানার সব কিছু বোঝেন। সরকার সাজেশন চাইলেন তথাকথিত শ্রমিক নেতাদের কাছে। তাদের অধিকাংশও একই মত দিলেন। সরকার ওদের সাজেশন মেনে নিলেন। এবং ভুলটাও করলেন এখানেই। ফল হলো সাবেক মালিকরা তাদের স্ব স্ব কারখানা হাতছাড়া হয়ে গেলেও আবার হ্রিত সম্পত্তি ফেরত পেলেন এবং ফেরত পেয়েই প্রথম কর্তব্য হিসেবে কল কারখানা চালু বা উৎপাদনের দিকে নজর না দিয়ে বরং নিজের পূর্ব বিনিয়োগকৃত পুঁজির যতটা সম্ভব সরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করতে থাকলেন।
এতে করে একদিকে যেমন দেশে শ্রমিক অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠতে থাকলো অন্যদিকে উৎপাদন না হওয়ায় জাতীয়করণকৃত কল-কারখানায় লোকসানের হার আকাশ-ছোঁয়া হয়ে দাঁড়াতে থাকলো। সাবেক মালিক ও বর্তমান প্রশাসকের পূর্বে বিনিয়োগকৃত পুঁজি কারখানার কাঁচামাল অন্যত্র পাচার এবং লোকসানের হার দেখিয়ে সরকারি কোষাগার থেকে ঘরে গিয়ে উঠতে থাকলো। পেশাদার ও তথাকথিত শ্রমিক নেতাদের বাড়ি, গাড়ি আর ব্যাংক ব্যালেন্স পেতে উঠতে শুরু করলো। দেশের শিল্প উৎপাদনে এবং শ্রমিক জীবনে সৃষ্টি হল এক নৈরাজ্যময় পরিবেশ। বদনাম হলো শ্রমিকরা কাজ করতে চায় না। কেবল বাড়তি বেতন বোনাস দাবি করে। অথচ কারখানার কাঁচামালের অভাবে ও প্রশাসকদের কুশাসন এবং ওই শ্রমিক নেতাদের উস্কানিতে যে উৎপাদন ব্যাহত হোল- সময়মতো বেতন ভাতা না পেয়ে শ্রমিকরা যে বিক্ষুব্ধ হলেন, সেই কারণগুলো কেউ বুঝতে চাইলেন না। কেউ ডেকেও শ্রমিকদের জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলেন না ওদের অসন্তুষ্টি কারণটা কি?
শেষটায় যা হোক শুভবুদ্ধি সম্পন্ন শ্রমিক নেতাদের থেকে আসল কথাগুলো বেরিয়ে এলো। সরকারের হয়তো বা কিছু টনকও নড়লো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোটা ব্যাপারটা উপলব্ধি করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন শ্রমিকরা কাজ করতে চায়। ওদের কোন দোষ নেই। ওদের কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। এবার থেকে এসব অন্তরায়গুলো দূর করার ব্যবস্থা হবে। বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের সাথে সাধারণ শ্রমিকরা সাড়া দিলেন। গত শুক্রবার ৩১জন শ্রমিক বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করলেন এবং কলকারখানায় কাঁচামালের ঘাটতি বিদ্যুৎ সরবরাহ ক্ষেত্রে অচলাবস্থা, প্রশাসক পরিচালকদের অব্যবস্থাপনা, শিল্প শ্রমিক মজুরি নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে তার সাথে আলোচনা করলেন। বললেনঃ আমরা কাজ করবো, কাজ করতে চাই। কিন্তু ওই বাধাগুলো দূর করতে হবে। বঙ্গবন্ধুও তাদের আশ্বাস দিয়েছেন। এক্ষণে শ্রমিকদের নিজেদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য যেমন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তেমনি বঙ্গবন্ধুর আশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার জন্যও সরকারকে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে।

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন প্রসঙ্গে

যেকোনো শিশুর ভবিষ্যৎ গঠনে তার মাতৃভাষা এবং যে কোনো দেশ বা জাতির জীবনে তার রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় ভাষার ব্যাপক ও অপরিহার্য প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দ্বিমত করার কোন অবকাশ নেই এবং এ সম্পর্কে বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই এক অনাদিকাল থেকে বহু ভাষাবিদ, বহু দার্শনিক এবং বহু বি-দগ্ধ লেখক বহু আলোচনা করে এসেছেন, দৃষ্টান্ত দিয়েছেন এবং মন্তব্য রেখেছেন। এখনো রাখছেন। আমাদের সদ্য স্বাধীন দেশ বিধির লিখনেই নিজেদের নানান দুর্বলতা বা অপরাধের কারণেই হোক, ইতিহাসের অধিকাংশ সময় পর্যন্তই বিদেশী বা বিজাতির কবলেই শাসিত ও শোষিত হয়ে কালাতিপাত করেছে। এজন্য, ওদের যুগ যুগের চক্রান্তে ও আমাদের প্রকৃতিগত সারল্যের কারণে আমরা দীর্ঘদিন পর্যন্ত ঠিক গণ বা জাতীয় পর্যায়ে আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলা ভাষার উপযোগিতা সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধির অধিকারী হতে সক্ষম হইনি। আমাদের জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় জীবনে বাংলার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের সত্যিকারের ব্যাপক ও বৈজ্ঞানিক উপলব্ধির জন্য যে উপনিবেশিকতা পাক আমলের ঘটনা, সে বিষয়ে মোটামুটি একমত হতে কেউ কুন্ঠিত হবেন না বলেই আশা করা যায়।
আরও বলা যায়, আমাদের বর্তমান জাতীয় চেতনাবোধ বা স্বাধীনতার মূল বীজ ইতিহাসের অন্যান্য পর্যায়কে অলক্ষ্য করে প্রথমত বা প্রধানতঃ পাকিস্তান জন্মের পর ভাষা চেতনাবোধ বা ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। দারুন বৈষম্যমূলক শোষণের ষ্টিম রোলিং, ভাষা চেতনাবোধ, ভাষা আন্দোলন, গণ-অভ্যুত্থান স্বাধিকার আন্দোলন, এক নদী রক্ত, কৃষ্ণচূড়া ও রক্ত পলাশ মোড়া একটি স্বাধীনতা সূর্যের জন্ম- সবই আজ ইতিহাসের পাতায় ছড়ানো। বাঙালি আজ মুক্ত একটি বিহঙ্গম, বাংলাদেশ একটি মহাবিস্ময়কর নবীন যোজনা ও সত্তা।
অথচ, দুর্ভাগ্য, আমরা এত নিবেদিত হয়ে, এত কষ্ট স্বীকার করেও, এত আত্মহুতি দিয়ে বিদেশি ও বিজাতিদের চির নির্বাসন দিয়েও, আজও পর্যন্ত আমাদের ভাষার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিতভাবে বিজাতীয় মুক্ত হতে পারিনি। বরং পুরোনো আত্মপ্রসাদ নিয়ে সমান ধারা ও গতিতে বিজাতিকেই আঁকড়ে ধরে আছি। অবশ্য, একদিনে বা রাতারাতি আমরা এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে পারিনা বা আমাদের ভাষাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে বা সম্পূর্ণ স্বকীয়তায় পরিমন্ডিত করতে পারিনা কিম্বা করতে যাবার মত নির্বুদ্ধিতা দেখানোও উচিত হবেনা, সে বিষয়ে সবাই মোটামুটি একমত পোষণ করেন। কিন্তু রাতারাতি সম্ভব নয় এই অজুহাতে কোন দিনে বা রাতেই যে আমাদের ভাষাকে বিজাতি প্রভাব মুক্ত করার আন্তরিক চেষ্টা করা হবে না তাও বা কেমন কথা?

টানাটানির ঘর খোদায় রক্ষা কর

টানাটানির ঘর খোদা রক্ষা কর বলে একটি অতি সাধারণ প্রবাদ বাংলাদেশে চালু রয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই প্রবাদ বাক্যটিই সত্যে পরিণত হল টিসিবির শীতবস্ত্র আমদানি নিয়ে। গতকাল ‘বাংলার বাণী’তে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, অর্থ বরাদ্দে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গড়িমসির ফলে টিসিবি’র মাধ্যমে বিদেশ থেকে ২৫ লাখ টাকার পুরনো শীতবস্ত্র আমদানি বিলম্বিত হয়েছে। জানা গেছে, আগামী বছরের জানুয়ারির শেষ অথবা ফেব্রুয়ারির আগে বাংলাদেশে কাপড় আসছে না। টিসিবি সূত্রে জানা গেছে, স্বল্পমূল্যে পুরানো শীতবস্ত্র আমদানির জন্য ২৫ লাখ টাকার টেন্ডার খোলা হয় গত অক্টোবর মাসে। গত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৫ লাখ টাকার শীত বস্ত্র আমদানীর লক্ষ্য স্থির করেন। অক্টোবর মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই অংকের পরিমাণ বাড়িয়ে ২৫ লাখে উন্নীত করেন। কিন্তু এই অর্থ বরাদ্দে বাণিজ্যমন্ত্রণালয় অস্বাভাবিক বিলম্ব করে।
মন্ত্রণালয়ের গড়িমসি ও বিলম্বের ফলেই কাপড় আমদানি বিলম্বিত হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ করতে মন্ত্রণালয়ের দেড় মাসেরও বেশি সময় নিয়েছে। সংশ্লিষ্ট মহল থেকে বলা হয়েছে, যথা সময়ে অর্থ বরাদ্দ করা হলে এ বছরের নভেম্বরের মধ্যে শীতবস্ত্র আমদানি করা সম্ভব ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থ বরাদ্দের গড়িমসিতে অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে তা হল এই ডিসেম্বরের বাঘ তাড়ানো শীতের মধ্যে ‘হায় কাপড়’ ‘হায় কাপড়’ করে জনসাধারণকে মাতম করতে হচ্ছে। বাজারে শীতের কাপড় বা উলের দাম শুনলে মাথার চুল খাড়া হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বদৌলতে জৈষ্ঠ্যের কাঁঠাল ভাদ্র মাসে পাকার মতো অবস্থারই সৃষ্টি হয়েছে। জৈষ্ঠ্যের কাঁঠাল ভাদ্রে যাতে না থাকে সে রকম ব্যবস্থা গ্রহণের পথ এখনো খোলা আছে কি না তার জবাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই দিতে পারবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!