You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৯শে জানুয়ারী, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ১৫ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

স্বাগতম যুগোশ্লাভিয়ার জনক মার্শাল টিটো

আজ যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল জোসেফ রোজ টিটো বাংলাদেশ আসছেন। জোটনিরপেক্ষ নীতির অন্যতম প্রবক্তা বাংলাদেশের বিশিষ্ট বন্ধু মার্শাল টিটোকে প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জানাবার জন্য বাংলাদেশের মানুষ উন্মুক্ত হয়ে আছে।
তেতাল্লিশের যুদ্ধে বিধ্বস্ত যুগোশ্লাভিয়াকে প্রাচুর্য্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অগ্রদূত মার্শাল টিটো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালীন সক্রিয়ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করছেন। তিনি মনে প্রাণে কামনা করেছেন বাংলাদেশের নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্ত হোক। বাংলাদেশের বিশ্বস্ত বন্ধু সমাজতান্ত্রিক যুগোশ্লাভিয়ার জনক মার্শাল টিটো শুধুমাত্র আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়েই নীরব থাকেননি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও এগিয়ে এসেছেন সাহায্য ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে।
যুগোশ্লাভ প্রধানমন্ত্রী মিঃ বিয়েদিচের বাংলাদেশ সফর এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যুগোশ্লাভিয়া সফরের মাধ্যমে দু’দেশের বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হয়েছে। যে ক’টি দেশ স্বাধীনতার একমাসের মধ্যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়েছেন যুগোশ্লাভিয়া তার অন্যতম। স্বীকৃতিদানের পর থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছেন যুগোশ্লাভিয়া।
জাতিসংঘে বাংলাদেশে সদস্যভুক্তির প্রশ্নে যুগোশ্লাভিয়ার ভূমিকা কারো অজানা নয়। যুগোশ্লাভিয়া মনে প্রাণে কামনা করেন যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করুক।
মার্শাল টিটো ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেন।
কথায় বলে বিপদে বন্ধুর পরিচয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সংকটকালীন দিনগুলোতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে যুগোশ্লাভিয়া প্রকৃত বন্ধুর পরিচয়ই দিয়েছেন।
স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ ও সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। যুগোশ্লাভিয়াও একই মত ও পথের অনুসারী। বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশ সব সময়েই নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের পাশে রয়েছে। বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ ও সহ-অবস্থানের নীতিই দূরকে করেছে আপন পরকে করছে ভাই।
ভ্রাতৃপ্রতিম যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো ও বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে রয়েছে অসাধারণ সাদৃশ্য। দু’জনেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে এনে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন শান্তি ও প্রগতির পথে।
প্রেসিডেন্ট টিটোর এ সফর নানান দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ উপমহাদেশে এখনো স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে সুগম হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ক্রীড়নক পাকিস্তানের এখনো পর্যন্ত শুভ বুদ্ধির উদয় হয়নি। চীন এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে আসছে। মধ্যপ্রাচ্য ও ভিয়েতনামে এখনো পর্যন্ত শান্তির কপোত নির্বিঘ্নে ডানা মেলে উড়তে পারছে না। এমনি পটভূমিতে শান্তির অগ্রদূত বঙ্গবন্ধু জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রবক্তা মার্শাল টিটোর মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভ্রাতৃপ্রতিম যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর শুভাগমন বাংলাদেশের পক্ষে পরম গৌরবের কথা। আনন্দের কথা। বাংলাদেশের মানুষ বাংলার পরম বন্ধু মার্শাল টিটোকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে উৎসারিত আবেগ ও অনুভূতি নিয়ে তাঁকে সম্বর্ধনা জানাবে। সবার কন্ঠে ধ্বনিত হবে মার্শাল টিটো দীর্ঘজীবী হোন। বাংলাদেশ-যুগোশ্লাভিয়া মৈত্রী অমর হোক।

সাম্রাজ্যবাদ আজ মারের মুখে

গত পরশুদিন আমাদের আইন ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী শ্রী মনোরঞ্জন ধর প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে-সাম্রাজ্যবাদ আজ একটি ক্ষয়িষ্ণু সত্যে পরিণত হতে চলেছে। তার মতে, সেদিন আর বেশী দূরে নয়, যেদিন বিশ্বের মুক্তিকামী জনতা শান্তি, স্বাধীনতা ও প্রগতির দুশমন সাম্রাজ্যবাদের মৃত্যুঘন্টা বাজবে। সাম্রাজ্যবাদ আজ তার মৃত্যু পরোয়ানা দেখতে পাচ্ছে—তাই সে শেষ রক্ষার চেষ্টা করছে—কিন্তু সে শেষ রক্ষা আর হবে না। বিশ্বের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভিয়েতনাম উজ্জ্বলতর আলোক স্তম্ভ—এ কথা উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী শ্রী ধর আরো বলেছেন—‘ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পরাজয় ঘটেছে। সাম্প্রতিক কালের প্যারিস চুক্তির মাধ্যমে ভিয়েতনাম তথা সারা বিশ্বের শান্তি, স্বাধীনতা ও প্রগতিকামী মানুষের সংগ্রামের বিজয় সূচিত হয়েছে।’ বাংলাদেশের কে শত্রু আর কে মিত্র তা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কালেই নির্ধারিত হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গে তাই তিনি বলেন, ‘আমাদের সহায়ক শক্তি সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া। তার নেতৃত্ব দিচ্ছে মহান বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন। এ কারণে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা নিরাপদ ও স্থায়ী রাখার জন্য সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সাথে সহযোগিতা ও ঐক্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যেতে হবে।
ভিয়েতনামে যুদ্ধ বন্ধ ও প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন স্তব্ধ হয়ে গেছে। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতির যে পরাজয় ঘটেছে তা বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের কাছে আজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন যেভাবে মার খাচ্ছে তা অবশ্যই লক্ষণীয় বিষয়। ভারত উপমহাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির কাছ থেকে সে একটা উল্লেখযোগ্য আঘাত পেয়েছে। কম্বোডিয়ায়ও তার আগ্রাসনের পতন আজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভিয়েতনাম থেকে মার খেয়ে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরের প্রতিও তাদের আগ্রহ আজ সবার সামনে ধরা পড়েছে। অর্থনৈতিকভাবে আজও মার্কিনরা যে সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে তা সমাজবাদী অগ্রগতির কাছে এসে মার খাচ্ছে। অনতিবিলম্বে অর্থনৈতিক নিষ্পেষণের সুযোগও তাদের বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। আমরা নতুন জাতি হিসাবে যেমন প্রগতিশীল সমাজবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েমের জন্যে সংগ্রামরত রয়েছি তেমনি বিশ্বের বহু দেশও এই ধরনের প্রগতিশীল সমাজনীতি গ্রহণ করেছে। এর ফলে মার্কিন অর্থনীতির একচেটিয়া অনুপ্রবেশ বন্ধ হয়ে গেছে। প্রত্যক্ষভাবে এবং সমর সজ্জার মাধ্যমে তাদের যে ক্ষমতা বিস্তারের মোহ ছিল তাও আজ নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। সেখানে বিজয়ের মুখে আজ সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের প্রগতিশীল ও আত্মনির্ভর অর্থনীতি।

আবেদন-নিবেদনে কাজ হবে না

একমাত্র ঢাকা শহরে নিউমার্কেট ও মিরপুর এলাকা বাদেই প্রায় দুই সহস্রাধিক বেআইনীভাবে দখলকৃত ও পরিত্যক্ত দোকানপাট ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান আছে বলে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার জানিয়েছেন। তিনি আরো বলেন যে, গত দুই বছরে পরিত্যক্ত দোকানপাটের সঠিক পরিসংখ্যান ও মূল্যায়ন না হওয়ায় সরকারকে যথেষ্ট ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়েছে এবং হচ্ছে।
এরই প্রেক্ষিতে তিনি দোকানপাটের বেআইনী দখলদারদের উচ্ছেদ সাধন করে সরকারী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারে জনগণের একান্ত সহযোগিতা তিনি কামনা করেন। অপরদিকে বেআইনী দখলদারদের প্রতি অবিলম্বে পরিত্যক্ত দোকানপাট জেলা পরিত্যক্ত সম্পত্তি (বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান) পরিচালনা বোর্ডের নিকট সমর্পণ করার জন্যও আহ্বান জানান।
এই আবেদনের সূত্র ধরে আরো বলা হয় যে, সব বেআইনী দখলদার স্বেচ্ছায় পরিত্যক্ত দোকানপাট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সমর্পণ করবে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, বরং সম্পত্তি বরাদ্দের সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিষয় বিবেচনা করার অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, পূর্বতন সম্পত্তি পরিচালনা বোর্ড সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যাপারে খুব একটা তৎপরতা দেখাতে পারেনি। ফলে পরবর্তী পর্যায়ে প্রশাসন কর্তৃপক্ষের আওতায় জেলা পরিত্যক্ত সম্পত্তি (বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান) বোর্ড গঠন করা হয়। কিন্তু তাতেই বা কি ফল হয়েছে?
এই সকল সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রশ্ন একটি নয়—অনেক। প্রথম—পরিত্যক্ত সম্পত্তি বোর্ড কেন কাজ করতে পারেনি। তার অক্ষমতা কোথায়? দ্বিতীয়—বর্তমানে শহরের পরিত্যক্ত দোকানপাট সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ও জরিপ কাজ চালানোর ব্যাপারে চারটি জোন করে বলা হয়েছে যে প্রত্যেকটি জোনে একজন দায়িত্বশীল অফিসারকে নিয়োগ করা হয়েছে। তাহলে এতকাল যাবত পরিত্যক্ত সম্পত্তি বোর্ডে কি কোনো দায়িত্বশীল অফিসার ছিলেন না? তৃতীয় কতটা দোকানপাটও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সত্যি আজও বেদখলকৃত অবস্থায় আছে তার সুষ্ঠু ও নির্ভুল পরিসংখ্যান স্বাধীনতার দু’বছর পরও নেই কেন? এখনও অনুমান! সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এই অক্ষমতার সন্তোষজনক কোনো কৈফিয়ৎ কি সত্যি দেয়া সম্ভব? এতএব বলতে হয়, জনকল্যাণমূলক কাজে প্রয়োজন বোধে কঠোর হতে হবে। এখানে আবেদন-নিবেদন, পুরস্কারের লোভ, শাস্তি মওকুফের আশ্বাস, একটার পর একটা বোর্ড বা তার অধীনে জোন খুলে খবর সংগ্রহের মহড়া দিয়ে কিছুই হবে না। কথায় বলে, খাজনার চেয়ে বাজনা বড়—শুধু সেই প্রবাদই আবার সত্য বলে প্রমাণিত হবে যা এতকাল হয়েছেও। তাই বাগাড়ম্বর না করে সততার সঙ্গে কাজ করে গেলে পরিত্যক্ত দোকানপাট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সংক্রান্ত খবর সংগ্রহ করার কাজ যে বহু আগেই শেষ হয়ে যেতো তা বলাই বাহুল্য। তবু আমরা আশা করছি সংশ্লিষ্ট মহল এবার শক্ত হাতে কাজ করবেন এবং এই অবাঞ্ছিত ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে সরকারকে রেহাই দেবেন। এবং জনগণও দুর্নীতি প্রত্যক্ষ করার কুপ্রভাব থেকে মুক্তি পাবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!