বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩০শে জানুয়ারী, বুধবার, ১৯৭৪, ১৬ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
চারটি দেশের শিপিং কনফারেন্স
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাহাজ চলাচল, আভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন এবং বেসামরিক বিমান চলাচল দপ্তরের মন্ত্রী জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী গত সোমবার বাংলাদেশ-ভারত-শ্রীলঙ্কা-বার্মা শিপিং কনফারেন্স লাইনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে তিনি বলেছেন, এই শিপিং কনফারেন্স দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব জাতিকে শান্তি ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ করে প্রগতির পথে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। তিনি এই নতুন শিপিং কনফারেন্সকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জনগণের প্রয়োজনের উপরই সমধিক গুরুত্ব প্রদানের আহ্বান জানান। জাহাজ চলাচল ক্ষেত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বর্তমান অবস্থার কথা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেছেন যে, এই অঞ্চলে জাহাজ তৈরীর এবং মেরামতের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। যদিও এই অঞ্চলে প্রচুর প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, খাদ্য, খনিজ সম্পদ উৎপন্ন হয় এবং এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নতির সম্ভাবনা প্রচুর রয়েছে. তবুও এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক নেই বললেও চলে। আর এই অঞ্চলের কারো জাহাজের দরকার হলেই অন্য দেশে ছুটে যেতে হয় এবং ভাড়া করা সেই জাহাজ এই অঞ্চলেই ব্যবসার জন্যে যাতায়াত করে। এই কনফারেন্স গঠনের ফলে এর সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক অনুকূল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বস্তুতঃ বাংলাদেশ-ভারত-বার্মা-শ্রীলঙ্কা শিপিং কনফারেন্স বিশ্বের এই অনুন্নত এলাকার জাহাজ চলাচল ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রয়েছে। এই এলাকার উপর তাই যুগে যুগে হামলা হয়েছে সাবেক উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির। আজকের দিনেরও বৃহৎ শক্তিবর্গ এ এলাকার উপর থেকে তাদের প্রভাব এবং প্রভুত্ব বিস্তারের হাতকে সংযত করেনি। এ এলাকার উপর প্রভাব বিস্তার করে তারা আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও শক্তিমত্তার ভারসাম্য রক্ষার কাজে তৎপর ছিলো এখনো রয়েছে। ওরা এই এলাকা থেকে নিয়েছে অনেক কিছুই, দেয়নি কিছুই। তেমনি দেয়নি জলপথ বিধৌত এ এলাকার জলপথ উন্নয়নের কোনো ব্যবস্থা। অন্যান্য সব কিছুর মতো এ অঞ্চলের জলপথও ছিল তাদের প্রধান আয়ের একটি অন্যতম অংশ। এ এলাকার জাহাজ চলাচল কোনোদিনই উন্নতি লাভ করতে পারেনি বিশেষ করে ইউরোপীয় শিপিং কনফারেন্স লাইনের প্রতাপে। সেদিক থেকে এই শিপিং কনফারেন্স অন্ততঃ এই অঞ্চলে ইউরোপীয় শিপিং কনফারেন্সের প্রতাপ খর্ব করার পক্ষে কিছুটা সহায়ক হবে।
নতুন শিপিং কনফারেন্স এক্ষণে সে বাঁধা অতিক্রমের পক্ষে সহায়ক হবে বলে বিশ্বের এই এলাকার মানুষ বিশেষ করে ঐ চারটি দেশের মানুষ আশা করেন। এই কনফারেন্স বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বার্মার মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক সমঝোতা ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি এবং ঐ চারটি দেশের প্রগতির পক্ষে সহায়ক হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা এর সাফল্য কামনা করি।
মধ্যবিত্তের সংকট, সুদিন কত দূর?
দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সামনে আজ অন্তহীন সমস্যা, চরম হতাশার কালোছায়া এবং নৈরাজ্যের অন্ধকার পুঞ্জিভূত। দেশের সার্বিক প্রগতির পথে একটি অশুভ প্রতিক্রিয়াশীল নতুন বাণিজ্যিক পুঁজির ব্যাপক প্রসার, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। ফলে, দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে নানাবিধ সমস্যাবলীর জটাজাল। নতুন বাণিজ্যিক পুঁজি প্রসারের ফলে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজে দারুণ দুরবস্থার উদ্রেক হয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণী আজ চরম অর্থনৈতিক সংকটের অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। অথচ এই মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীই সুদীর্ঘ পঁচিশ বছরব্যাপী গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিশিখাকে প্রজ্জ্বলিত রেখেছিলেন। গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তরিত করার জন্য দেশের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সম্প্রদায়কে নানা নির্যাতন, নিপীড়িত ও দলননীতির যাঁতাকলে বারবার নিস্পেষিত হতে হয়েছে। সমস্ত অত্যাচার অবিচারের কঠোর অনুশাসন মাথা পেতে বরণ করে নিতে হয়েছে এবং আত্মত্যাগের সুমহান কর্তব্য থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী কখনো পিছু হটেনি, বরং দুর্বার শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে। স্বাধীনতার পর সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীই আজ অবজ্ঞা ও উপেক্ষার পাত্রে পরিণত হয়েছে, এ কথা দুঃখের সঙ্গে আমাদের স্বীকার না করে উপায় নেই।
গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এই অবক্ষয় লক্ষ্য করে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রেসিডিয়ামের চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনি সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে অঙ্গুলি নির্দেশ করে উচ্চারণ করেছেন যে, দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে হতাশার অন্ধকার থেকে আলোকে উত্তরণ করতে হবে। বিলুপ্তি এবং অবক্ষয়ের করাল গ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে। জীবন সংগ্রামে ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে দেশের মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তে অক্ষম, ঠিক সেই মুহূর্তে এই সোচ্চার বক্তব্য মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে চাঙ্গা করে তোলার জন্য একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলেই সর্বমহলে স্বীকৃতির দাবীদার। মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বঞ্চনা করে যারা আজ নতুন পুঁজির পাহাড় গড়ছেন, তাদের অবশ্য এই পদক্ষেপে নিদ্রাভঙ্গের কারণ ঘটবে। তা ঘটুক। কারচুপি ও অসৎ উপায়ে নব গজায়মান পুঁজিপতি শ্রেণীকে আর আস্কারা দেয়াটা এখন সম্পূর্ণ অনুচিত। স্বাধীনতার স্বাদ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে না পারলে সমাজের বুক থেকে তথা দেশের অর্থনৈতিক জীবন থেকে নৈরাজ্যকর বিপর্যয়ের অবসান ঘটানো সহজসাধ্য হবে না। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবন ব্যবস্থা উন্নয়নের সঙ্গে দেশের সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নটি গভীরভাবে সম্পৃক্ত। তাই মধ্যবিত্তের ম্লান, অনুজ্জ্বল ও মূক মুখে ভাষা দিতে হবে, আলো দিতে হবে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে দিনানুদৈনিক সংকটের শৃঙ্খল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে উপনীত করা দরকার। একশ্রেণীর কায়েমী স্বার্থবাদীরা আজ জাতীয়করণ বানচাল, দ্রব্যমূল্যের কৃত্রিম সংকট, কালো টাকার ছড়াছড়ি ও মুদ্রাস্ফীতি জাতীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করার চক্রান্তে মাতোয়ারা। এদের বিষদাঁত ভেঙে দিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে বিকশিত ও সংগঠিত হওয়ার সুযোগ দেয়া বাঞ্ছনীয়। চিরদিনের মার খাওয়া মধ্যবিত্ত সমাজে যদি এমনি করে ঘুণ ধরতে থাকে তাহলে সমাজে পঞ্চশীলতাই অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। তাই এবার দেশ পুনর্গঠনের সংগ্রামে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্মিলিত শক্তিকে যথার্থ গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগাতে হবে। হতাশার পংকেনিমজ্জমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে উদ্ধারের জন্যে সরকারকে নির্লিপ্ত হয়ে বসে থাকলে নৈরাজ্য বাড়বে, মধ্যবিত্তেরে বিরাজমান সংকট তীব্রতর হবে। অতএব, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে পৃষ্ঠপ্রদর্শন না করে পৃষ্ঠপোষকতায় মনোযোগী হোন।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে জাপানী সাহায্য
সম্প্রতি ৪১ সদস্যবিশিষ্ট জাপানী অর্থনৈতিক মিশন বাংলাদেশ সফর করছেন। গত রোববার এই মিশনটি শিল্প, কৃষি, যোগাযোগ ও জাহাজ চলাচল মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ৪টি পৃথক দলে বিভক্ত হ’য়ে মিলিত হয়ে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা করেছেন। এই প্রতিনিধিদলটি পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গেও সাহায্য-সহযোগিতার বিষয়টি আলোচনা করেছেন।
এছাড়াও প্রতিনিধিদলের নেতা মিঃ শিগো নাগানো বাংলাদেশের সকল প্রকল্পে জাপানের পূর্ণ সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দেন এবং বাংলাদেশের প্রথম যোজনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে সর্বতোভাবে পাশে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এই আলোচনার প্রেক্ষিতে সমঝোতা ও শর্তে একমত হতে পারলে জাপান বাংলাদেশে বড় রকমের পুঁজি বিনিয়োগ করতে পারে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। এর আঙ্কিক পরিমাণ ১৫০ থেকে ২০০ কোটি টাকা হতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাম্প্রতিক জাপান সফরের মধ্য দিয়ে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে সাহায্য ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে যে নতুন সম্ভাবনার সূচনা হয়েছিল—তারই ফলশ্রুতিস্বরূপ জাপানী অর্থনৈতিক মিশনের বর্তমান সফরকে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা যায়।
ভৌগোলিক অবস্থান ও সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোর দিক দিয়ে দু’টি দেশ যথাক্রমে সমুদ্র বিধৌত এবং কৃষি নির্ভর। তবে জাপান আজ শিল্প কারখানার দিকেও যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছে এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে নিজেদের দেশে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করে আজ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখন জাপানই একমাত্র দেশ, যে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে পুরোপুরি স্বনির্ভর।
সেই দৃষ্টিকোণ থেকে উন্নয়নশীল যেকোনো দেশকে সাহায্য প্রদানের ক্ষমতা তাদের আছে বলেই মনে করা যায়। বিশেষ করে আমাদের দেশে কারিগরি ও কৃষিক্ষেত্রে তাঁরা ব্যাপকভাবে সাহায্য করতে পারে এবং এদেশের কৃষি ব্যবস্থাকে বিজ্ঞাননির্ভর ও যন্ত্র-নির্ভর করার ক্ষেত্রেও সাহায্য ও সহযোগিতার ব্যাপক অবদান জাপান রাখতে পারে।
জাপানের ঋণদান পদ্ধতির অপর বৈশিষ্ট্য হ’লো—সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের মতো জাপানী সাহায্যের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক শর্ত আরোপ করা হয়না। সেদিক থেকেও নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এই বাংলাদেশ শঙ্কামুক্ত থাকতে পারছে।
অপরদিকে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রশ্নে দূরত্বটা একটা অন্তরায় হয়। এক্ষেত্রে সে প্রশ্নও প্রায় নেই।
অতএব বলা যায়, রাজনৈতিক শর্তহীন পুঁজি বিনিয়োগের সৌজন্যই শুধু উল্লেখযোগ্য নয়, বরং বহু প্রকার সাযুজ্য থাকার দরুণই সুবিধাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে এবং জাপানী সাহায্য ও সহযোগিতা বাংলাদেশে ফলপ্রসূ হতে পারবে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাবার শপথে দৃপ্ত। বন্ধুদেশগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা সেখানে অপরিহার্য। তাই আমরা গভীরভাবে প্রত্যাশা করছি যেন জাপানী প্রতিধিনিদলের এই উদ্দেশ্যমূলক সফর বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্পকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার সুস্পষ্ট রূপরেখা দিতে পারে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক