You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩১শে জানুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ১৭ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

প্রকাশনা শিল্পে সংকট

দেশের প্রকাশনা শিল্প আবার মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। সংকটটা এবার এমনি এক পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যে, এমনি ধারা চলতে থাকলে অদূরভবিষ্যতে এদেশে হয়তো বেসরকারী পর্যায়ের প্রকাশনা বন্ধই হয়ে যাবে। কেননা এই শিল্পের প্রধান উপকরণ কাগজ ও কালির দাম এবং মুদ্রণ খরচ আগের তুলনায় কমপক্ষে তিন থেকে চারশ’ ভাগ বেড়েছে। দাম বেড়েছে সরকারী নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত খুলনার নিউজপ্রিন্ট কারখানায় উৎপাদিত নিউজপ্রিন্টে, কর্ণফুলী কাগজের কলে উৎপাদিত বিভিন্ন মানের সাদা কাগজের, কার্টিজ পেপারের, পোস্টার পেপারের। দাম বেড়েছে দেশে উৎপাদিত এবং বিদেশ থেকে আমদানীকৃত সকল মানের ও রংঙের কালির। খরচ বেড়েছে কম্পোজিং এবং প্রিন্টিংয়ের সাথে সাথে বাইন্ডিংয়েরও। দাম বেড়েছে ব্লক তৈরীর উপকরণ, জিঙ্কশীটের, কাঠের। খরচ বেড়েছে ব্লক তৈরীর। এক কথায় এই শিল্পের সাথে জড়িত সবকিছুরই।
গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে যে, মাত্র দু’মাস আগেও ১০ ফর্মার ৩ হাজার কপির একটি গ্রন্থ প্রকাশ করতে বড় জোর খরচ পড়তো চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা, এখন সেই খরচ ১৩ হাজার টাকায় উন্নীত হয়েছে। স্বাধীনতার আগে যে নিউজপ্রিন্ট প্রতি রিমের মূল্য ছিল ১১ টাকা থেকে ১৫ টাকার মধ্যে স্বাধীনতার পর তার মূল্য দাঁড়িয়েছিল ২২ টাকায়। কিছুদিন আগে সরকার খুলনার নিউজপ্রিন্ট কারখানায় উৎপাদিত নিউজিপ্রিন্টের দাম হঠাৎ একতরফাভাবে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলেন। অর্থাৎ আগে প্রতি টন যেখানে ১১৭০ টাকায় বিক্রি হতো এখন তার দাম হলো ২২৪৫ টাকা। আগে যে এক রিম নিউজপ্রিন্ট ২২ টাকা ছিল এখন খুচরা দরে তা ৪৪ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কর্ণফুলী কাগজের কলে উৎপাদিত কাগজের দামও সরকারী পর্যায়ে আগের তুলনায় শতকরা ৫০ ভাগ বাড়ানো হলো এবং বাজারে বাড়লো শতকরা ৭৫ ভাগ হারে। অর্থাৎ সরকার ৫০ ভাগ বাড়ালেও বাকী ২৫ ভাগ বাড়িয়েছেন কাগজের কল কর্তৃপক্ষ ও জনসাধারণের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী কাগজের ডিলাররা। অথচ এর বিরুদ্ধে কোনো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যবস্থা নেই। দেশী কালি ও বিদেশ থেকে আমদানীকৃত কালির ক্ষেত্রেও সেই মধ্যম ব্যক্তির কারসাজিতে দাম বেড়েছে শতকরা প্রায় ২৫ ভাগের মতো। ব্লক নির্মাণের ক্ষেত্রেও সেই একই অবস্থা। স্বাধীনতার আগে যেখানে ব্লকের প্রতিবর্গ ইঞ্চিতে খরচ হতো ৮০ পয়সা এখন তা দাঁড়িয়েছে ২.৬২ পয়সায়। অর্থাৎ শতকরা তিনশত ভাগ বেড়েছে এখানটায়। ব্লক তৈরীর অন্যতম প্রধান উপাদান জিঙ্কশীট বিদেশ থেকে আমদানী করা হয় এবং আমদানীকারকদের অতিরিক্ত মুনাফালাভের চক্রান্তই এক্ষেত্রে এতটা মূ্ল্য বৃদ্ধির কারণ বলে মনে করা হয়। মুদ্রণ ক্ষেত্রে স্বাধীনতার আগে যেখানে ফর্মা ছিল ৯০ টাকা করে—এমনকি দু’মাস আগে প্রতি ফর্মা যেখানে দু’শত টাকা করে হতো এখন তা তিনশ’ টাকায় উন্নীত হয়েছে। মুদ্রণ যন্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ এবং টাইপের অভাবই এর কারণ বলে জানা গেছে। এই অভাবে অনেক ছাপাখানা এখন বন্ধ হবার উপক্রম। মুদ্রণ যন্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ এবং টাইপ ও টাইপের জন্যে ব্যবহৃত সীসাও বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয়। ফলে অসাধু আমদানীকারকদের অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের শিকারে পড়ে মুদ্রণ শিল্প এখন সংকটের আবর্তের নিপতিত।
এমতাবস্থায় দেশের সামগ্রিক প্রকাশনা শিল্পকে অচলাবস্থার রাহু থেকে মুক্ত করার জন্যে বাস্তব ও সঠিক কর্মসূচী নেয়া এবং উপরোক্ত কারণগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নেবার জন্যে আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি।

বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণই সার্থকতার চাবিকাঠি

যেকোনো কৃষি নির্ভরশীল দেশে সার্থক অর্থে সবুজ বিপ্লব ফলিয়ে সার্বিক সুখ সমৃদ্ধির সোনালী রোদ আনতে নিশ্চয়ই উদাত্ত আহ্বানমুখী জন-সমর্থন বা জন-সহযোগিতা কুড়াবারও যথেষ্ট প্রয়োজন আছে।
কিন্তু সেই সঙ্গে এ কথাও বিস্মৃত হলে চলবে না যে, শুধুমাত্র এক মুখরোচক আহ্বান দানের নিছক দায় পালন করে নিশ্চিন্ত বা নিস্ক্রিয় বসে থাকলে কোনো বিপ্লবই কোনোদিনও সম্ভব নয়। এ জন্যে সবচেয়ে বেশী যা’ দরকার তা’ হচ্ছে বিপ্লব সত্যিকারার্থে ফলপ্রসূ করার জন্যে যাবতীয় সার্বিক ও পর্যাপ্ত বাস্তব উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
কথাগুলো মনে পড়ে গেলো গত মঙ্গলবার সকালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের (আলীসদের) সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত একটি বৈঠককে উপলক্ষ করে। এতে বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ দেশে সবুজ বিপ্লব সার্থক করে তুলতে দেশবাসীর প্রতি এক উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। সভাপতিত্বে ছিলেন খোদ কৃষিমন্ত্রী মহোদয়।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য দেশে সবুজ বিপ্লব আনার ক্ষেত্রে আলীসদের এ উদ্যোগ ও আহ্বান নিঃসন্দেহেই সমগ্র দেশবাসীর অকুণ্ঠ প্রশংসার দাবী রাখে। এমন বৈঠক একবার নয় আরো বহুবারই প্রয়োজন আছে—সে সম্পর্কেও আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে একমত।
কিন্তু কথা হচ্ছে, আমাদের দেশের মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনানুসারে আলীসদকেই ‘মেও ধরতে’ এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য প্রথমেই প্রয়োজন বিস্তারিত ও চুলচেরা অভিজ্ঞ আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, বিভিন্ন বাধা-বিপত্তির কথা স্মরণ রেখে ও তা’ দূরকরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করে, বিগত ও অনাগত সব রকমের প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করে একটি বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা নেয়া এবং অযথা সময় নষ্ট না করে তৎসম্পর্কে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করা বা তা’ সম্পূর্ণ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছে দেয়া। তবে, এজন্যে প্রথমেই অন্ততঃ কয়েকটি দিকের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
প্রথমতঃ, এ বিপ্লবকে জাতিগতভাবে গ্রহণ করতে হবে এবং সমগ্র দলীয় রাজনীতি বা অন্যান্য কুটিল হিংসাবৃত্তির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। এ জন্য এ বিপ্লবে সমস্ত রাজনৈতিক দল, সমগ্র চাষীকুল, সরকারের সমস্ত প্রশাসনিক যন্ত্রসমূহ এবং দেশের আপামর জনসাধারণকে সত্যিকারের আন্তরিকতা ও আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে এবং যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
দ্বিতীয়তঃ, চাষীকূল সহ সবারই উচ্ছ্বাস, আগ্রহ ও প্রচেষ্টা যাতে সর্বক্ষণের জন্যে অকলুষ ও অব্যাহত থাকে সেজন্যে সার্বিক সজাগতা ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখতে হবে।
তৃতীয়তঃ, কৃষি ও কৃষকের যে সব সনাতন বা চিরাচরিত সমস্যা, অভাব বা বাধা-বিপত্তি আছে তার সবই দূরকরণের জন্য ব্যাপক ব্যবস্থা নিতে হবে।
চতুর্থতঃ, দেশের প্রত্যেকটি মানুষ যাতে নিজ নিজ গৃহে ছোটো-খাটো বা সম্ভব হলে বড় ফলনে উৎসাহী হয়ে অন্ততঃ নিজ প্রয়োজনে কিছু কিছু কৃষিকাজ করে সেজন্য তাকে যথেষ্টভাবে আগ্রহী রাখতে নানা রকমের সুযোগ-সুবিধা বা ‘ইনসেনটিভ’ও ব্যবস্থা করতে হবে।
পঞ্চমতঃ, ‘জমি যার লাঙ্গল তার’ এ মূলনীতিকে সর্বতোভাবে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে সর্বক্ষেত্রে পূর্ণমাত্রায় ও কঠোরভাবে প্রতিপালিত হবার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনো রকমের কোনোক্রমেই এ বিপ্লবকে নস্যাৎ করতে না পারে সেদিকে যথেষ্ট দৃষ্টি ও ব্যবস্থা রাখতে হবে। একমাত্র তখনি এদেশে সত্যিকার অর্থে সবুজ বিপ্লব সম্ভব হবে।
অথচ, আজো আমাদের কৃষককুলের কতোনা অন্তহীন সমস্যা : সময় মতো সার-বীজ-ওষুধ পাওয়া যায় না, পাওয়ার পাম্প থাকেনা, থাকলেও যন্ত্রাংশের অভাবে তা কার্যকরী হয়না। বন্যা, অনাবৃষ্টি, ড্রেনেজ অভাব, আর ডাকাতের দৌরাত্ম্যে ক্ষেতের ফসল ঘরে ওঠেনা, আরো কতো কি। কৃষকের এসব সমস্যা দূর করে তাকে সর্বতোভাবে কৃষি-সরঞ্জামে সজ্জিত করতে না পারলে সবুজ বিপ্লব সফল হবে না।

গ্রামীণ সংস্কৃতিতেই নিহিত আমাদের মৌলিক পরিচয়

বাংলা সাহিত্যে প্রখ্যাত সমালোচক ও নিবন্ধকার গোপাল হালদার সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ কর্তৃক আয়োজিত একটি বিশেষ আলোচনা মালায় অংশ গ্রহণ করার পর তিনি কয়েকদিন পূর্বে ঢাকায় এসেছেন। গত পরশুদিন বাংলা একাডেমী কর্তৃক আয়োজিত ‘বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও তার ভবিষ্যত’ শীর্ষক আলোচনায় তিনি আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন। বাংলাদেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে শ্রী গোপাল হালদার অভিমত পোষণ করেছেন যে, ‘বিজ্ঞানভিত্তিক ও জনগণতান্ত্রিক সংস্কৃতিই হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত সংস্কৃতি। সংস্কৃতিতে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বাংলা সংস্কৃতির সাথে বিশ্ব সংস্কৃতির সংযোগকে বিকশিত করে সব মানুষের সংস্কৃতির সাথে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। এজন্যে সংস্কৃতিকে করতে হবে সর্বাঙ্গীন ও সার্বজনীন।’ গোপাল হালদার দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চাহিদার বহিঃপ্রকাশও সংস্কৃতির মধ্যে কামনা করেছেন। এজন্য যে ব্যাপক শিক্ষার প্রসার প্রয়োজন সে কথাও তিনি জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু সুষম সমাজ বিন্যাস সমাজতন্ত্র ছাড়া সম্ভব নয় সেহেতু তার দিকে সুতীক্ষ্ম নজর রেখেই আমাদের সংস্কৃতিকে পর্যালোচনা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞানের সার্বিক চর্চা। সমগ্র ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগই হবে আগামীদিনের সংস্কৃতি চিন্তা। সংস্কৃতির সার্বঙ্গীনতার সাথে তাই অবশ্যই সার্বজনীনতা। যে সংস্কৃতি সার্বজনীন নয় তা মৃত। সংস্কৃতির বাস্তব মূল্যায়ন করে শ্রী হালদার যে বক্তব্য রেখেছেন তা অত্যন্ত জনমুখী। আমাদের সংস্কৃতি চিন্তা অবশ্যই দেশের সার্বিক জনগণকে নিয়ে করতে হবে। যেহেতু আমাদের অধিকাংশ মানুষ গ্রামীণ পরিবেশের সেহেতু সার্বজনীন সংস্কৃতি বলতে অবশ্যই আমাদেরকে গ্রামীণ সংস্কৃতি বুঝতে হবে। আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজনীতি সম্পূর্ণই গ্রামনির্ভর। সে কারণে সংস্কৃতিও হবে গ্রামীণ জীবনের হাসি-কান্না, ব্যথা-বেদনা, শিল্প, কলা, ভাস্কর্য, গাঁথা, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া প্রভৃতির মূর্ত প্রকাশে সমুজ্জ্বল।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!