বাংলার বাণী
ঢাকা: ২২শে ডিসেম্বর, শনিবার, ৬ই পৌষ, ১৩৮০
শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে-
বাংলাদেশে আনরবের কার্যকাল আগামী ৩১শে ডিসেম্বর শেষ হতে চলেছে। গত পরশুদিন বাংলাদেশের আনরব প্রধান মিঃ ফ্রান্সিস লোকেষ্টে জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের অব্যবহিত পর থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশে আনরব শুরু করে। প্রেসক্লাবে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে আমরা প্রধান মিঃ লোকেষ্টে উল্লেখ করেছেন যে, ‘বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় এবং সে এখন নিজ পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম। তবু বাংলাদেশের স্বয়ম্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আরো কিছু দিনের জন্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, পরামর্শ ও সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে।’ জানা গেছে আনরবের কাজ শেষ হলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিশ্ব ব্যাংক, বিশ্ব শিশু সাহায্য তহবিল প্রভৃতি তাদের কাজ অব্যাহত রাখবে। মিঃ লোকেষ্টে তার বক্তৃতার একাংশে বলেন, আনরব বাংলাদেশে যে সাহায্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল জাতিসংঘের ইতিহাসে তা সর্ববৃহৎ। বাংলাদেশকে সাহায্যের মোট পরিমাণ হল দু’শো কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ষাট ভাগ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে বাকি চল্লিশ ভায় আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এসে পৌছুবে বলেও জানা গেছে। আনরবের মাধ্যমে গত দু’বছরে বাংলাদেশ ৪৮লক্ষ টন খাদ্য শস্য সাহায্য হিসেবে পেয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত আনরব প্রধান দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশে ইতিমধ্যেই ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে সমর্থ হয়েছে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কোন মহামারী বা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়নি এমনকি অনাহারে কোন লোকও মৃত্যুবরণ করেনি। একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত ও সমস্যাসঙ্কুল জাতি বাঁচার জন্য যে সংগ্রাম চালিয়েছে তাতে বাংলাদেশ সফলতা অর্জন করেছে।
দেশের কোথাও কোন সমস্যা দেখা দিলে আনরব দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে পাকিস্তান থেকে লোক বিনিময়ের ব্যাপারেও জাতিসংঘ তার তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। মিঃ লোকোষ্টে সাংবাদিক সম্মেলনে যে ভাষণটি দিয়েছেন তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সুদূর অর্থবহ। স্বাধীনতা যুদ্ধের ধ্বংস ও বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার ব্যাপারে বাংলাদেশে আনরব যে ভূমিকা গত দু’বছরে পালন করেছে তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
দেশের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ ও মহামারী কাটিয়ে উঠার ব্যাপারেও আনরবের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত আন্তরিক ও উদার। দক্ষতার সঙ্গে তারা দেশের পুনর্গঠনের কাজে সাহায্য করেছে। বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনায় আনরবের যে সুদূর প্রসারী দৃষ্টিকোণ রয়েছে তা অনস্বীকার্য। এদেশের সত্যিকার অবস্থা কি, এর স্থায়িত্ব ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আনরবের মন্তব্যই বা কতটুকু বাস্তবানুগ তা যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যাবে উল্লেখিত আনরব প্রধান মিঃ লোকোষ্টের মন্তব্য অত্যন্ত অর্থবহ। বাংলাদেশ সম্পর্কে আজো যেখানে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিরূপ সমালোচনা রয়েছে সেক্ষেত্রে জাতিসংঘের প্রতিনিধির এই সম্ভাবনাময় মন্তব্যটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে বলে আমরা মনে করি।
আমরা প্রথম থেকেই আশাবাদী ছিলাম এই ভেবে যে দেশের জনগণ যদি ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের সমূহ বিপদ থেকে মুক্তি পাবার জন্যে সংগ্রাম চালিয়ে যায় তাহলে বিপদ যতবড় এবং ভয়াবহ হোক না কেন তা উত্তরণ করা সম্ভব হবে। তাছাড়া জাতির প্রিয় নেতা যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সেখানে বিপদ কাটিয়ে উঠা অবশ্যই সম্ভবপর বলে আমাদের পূর্বাপর বিশ্বাস৷ আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলোও দেশের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য সাড়া দিয়েছে। বিশেষ করে মানবতার ডাকে জাতিসংঘ ও তার বিভিন্ন শাখা সংস্থাগুলো যেভাবে এগিয়ে এসেছিল তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করা যায়না। আমরা বিশ্বের যে কোন দুঃস্থ ও নির্যাতিত মানুষের সাহায্যে জাতিসংঘেরর দ্রুত কার্যকরী ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাবো এবং আনরব যেভাবে বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানের জন্য এগিয়ে এসেছিল ঠিক তেমনি ভাবে বিশ্বব্যাপী তাদের ভূমিকা ব্যাপ্তি লাভ করুক এটা আমরা কামনা করি। আনরবের প্রতি গোটা বাঙালী জাতি কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের যে কোন বিপদের দিনে ভবিষ্যতেও তাদের শুভদৃষ্টি আমাদের উপর বর্ষিত হবে এটাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে মিঃ লোকোষ্টে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের একজন মানুষও না খেয়ে মরেনি। শুধু তাই নয় বাংলাদেশে নানান প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বাংলাদেশ যে শনৈ শনৈ অগ্রগতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে মিঃ লোকোষ্টের বক্তব্যই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সম্মেলন
সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় অবশেষে শুরু হয়েছে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সম্মেলন ৷ এ শান্তি সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যে পঁচিশ বছরব্যাপী বিবদমান যুদ্ধ, সংঘাত ও জটিলতর সমস্যা সমাধানের সাফল্য কতটুকু হবে এখনই তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। জেনেভা শান্তি সম্মেলনে অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে এক বিরাট অনিশ্চয়তা ও অচলাবস্থার উদ্রেক হয়েছিল। সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইন এ শান্তি সম্মেলন বর্জন করেছে। কিন্তু তবুও নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মিসর ও ইসরাইল ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো জেনেভায় শান্তি সম্মেলনের বৈঠকে সামনা-সামনি মিলিত হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইম এই শান্তি সম্মেলনকে আরব-ইসরাইল বিরোধ মীমাংসার একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সম্পর্কিত জেনেভা শান্তি সম্মেলনের যুগ্ম চেয়ারম্যান হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
জাতিসংঘ এ শান্তি সম্মেলনে একটি দক্ষ যন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে বলে মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ডহেইম আশা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সম্মেলনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার লক্ষণও একেবারে ম্রিয়মান হয়ে যায়নি। সৈন্য প্রত্যাহার নিয়ে মিসর ও ইসরাইল পরস্পরবিরোধী বিবৃতি প্রচার করেছে। আরব ইসরাইল সতেরো দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিরতির পরও ইসরাইলী সৈন্য প্রত্যাহার এবং প্যালেস্টাইনী জনগণের হ্রিত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিয়ে শান্তি আলোচনায় অচলাবস্থা উদ্রেক হওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ জর্দানের বাদশা হোসেনের কাছে জানিয়েছেন যে, সিরিয়া নিজের স্বার্থের চেয়ে আরবদের বৃহত্তর স্বার্থেই জেনেভা শান্তি সম্মেলনে বর্জন করেছে। বাদশা হোসেন জানিয়েছেন, জর্দান সিরিয়ার পক্ষে থাকবে। ওদিকে লেবাননের আল-নাহার পত্রিকায় বলা হয়েছে যে, পরিস্থিতি ঘোলাটে দেখলে শেষাবধি মিসরও শান্তি সম্মেলন থেকে সরে পড়তে পারে এবং সম্মেলনে প্রথম পর্যায়ে সকল আরবদের’ পক্ষ থেকে বক্তব্য পেশ করবে, যাতে পরবর্তী পর্যায়ে সিরিয়া ও প্যালেষ্টাইনী প্রতিনিধিরা হয়তো যোগদান করতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সম্পর্কিত শান্তি সম্মেলনের সাফল্য এবং ব্যর্থতা সম্পর্কে এখন বিভিন্নমুখী জল্পনা-কল্পনা সরব হয়ে উঠেছে। মোদ্দা কথায়, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার এখন যা পটভূমি, তাতে শান্তির সন্তান রীতিমতো এক জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। ইসরাইল চিরাচরিত গোয়ার্তুমীতে অনড়। তবুও যখন শান্তি সম্মেলন বসেছে, তখন আমাদের শান্তির আশা করাটা কি খুব দূরাশা? আমরা সব সময়ই শান্তির প্রত্যাশা করি। শান্তি সম্মেলনের উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাতেও আমাদের কোন কার্পণ্য নেই। আমাদের যতো ভয় সব ওই ইসরাইলী টালবাহানায়। ইসরাইল যদি সম্মেলনে আরব স্বার্থ বিরোধী দরকষাকষিতে অবতীর্ণ হয় এবং তার মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি মদত দান অব্যাহত রাখে তাহলে জেনেভা শান্তি সম্মেলনের সাফল্য সুদূরপরাহত হতে বাধ্য বলেই আমাদের বিশ্বাস।
ইসরাইল যদি জেনেভা সম্মেলনের নামে সময় অতিক্রান্তির চাল ভেলে থাকে, তাহলে জেনেভা সম্মেলনও প্যারিস সম্মেলনের পরিণতিতেই বরণ করবে। আরবদের তৈলাস্ত্রের আঘাতে ইসরাইল ও তার মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা খুবই সঙ্গীন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যদি এ সম্মেলনকে সাফল্যমন্ডিত করার সত্যি সত্যি সক্রিয় উদ্যোগ নেয় এবং ইসরাইল নতুন করে কোন টালবাহানার অবতারণা না করে, তাহলে জেনেভা শান্তি সম্মেলনের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমরা অনায়াসে আশাবাদী হতে পারি। মার্কিন সিনেট ইসরাইলী আগ্রাসনকে চাঙ্গা করে তোলার জন্য এখনো নতুন করে অস্ত্র সাহায্য বরাদ্দ করে চলেছে।
অস্ত্রের ভাষা যারা এখনো সমানে প্রয়োগ করে তারা যে প্রকৃতপক্ষে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, এ বিশ্বাস করার কোন যৌক্তিকতা নেই। ধূর্ত মার্কিন কূটনীতিক ডঃ কিসিঞ্জার আরব-ইসরাইল যুদ্ধ বিরতির সময় যে আশ্বাস দিয়েছিলেন তা ফলপ্রসূ হয়নি। কাজেই শান্তি সম্মেলনে আরব স্বার্থ পরিপন্থী কোন উপসর্গ দেখা দিলে এ সম্মেলন ব্যর্থতাকেই আলিঙ্গন করবে। তবুও আমরা শান্তির আশাই করবো, কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সুদীর্ঘ কালের সমস্যায় শান্তিপূর্ণ সমাধানই আমরা কামনা করি কায়মনোবাক্যে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক