টুঙ্কুর মধ্যস্থতার প্রস্তাব অবাস্তব
পুনর্বাসনমন্ত্রী শ্রীখাদিলকার বলছেন—শরণার্থীর সংখ্যা এক কোটিতে পৌছবে। বিচলিত হয়ে পড়েছেন টুঙ্কু আবদুল রহমান। মালয়েশিয়ার এই মহান নেতা ইসলামের সেবায়েত। স্বেচ্ছায় ছেড়েছেন তিনি রাজনীতি। আন্তর্জাতিক ঐশ্লামিক দপ্তরের সেক্রেটারী জেনারেলের গুরুদায়িত্ব নিয়েছেন নিজের কাঁধে। টুঙ্কু এখন সফর করছেন পাকিস্তান। শীঘ্রই আসবেন ভারতে। দেখবেন শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা এবং শুনবেন তাদের কাহিনী। তার কানে কানে ইয়াহিয়া খান কি বলেছেন, জানা নেই। টুঙ্কু হয়ত নিজের দায়িত্বেই করেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব—শরণার্থী সমস্যা সমাধানে তিনি পাক-ভারতের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে রাজী। তার সদিচ্ছায় হয়ত সন্দেহ নেই অনেকের। তবু প্রশ্ন উঠবে টুঙ্কু যে ঐশ্লামিক সংস্থার সেক্রেটারী জেনারেল তার স্তম্ভ কারা? অবশ্যই তুরস্ক, ইরান, সৌদী আরব এবং পাকিস্তান। আর সবাই ছােট শরিক। বাংলাদেশের প্রশ্ন রাজনৈতিক। গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরেছেন ইয়াহিয়া খান। তার সৈন্যদল চালিয়েছে গণহত্যা। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী পাঠিয়েছ ভারতে। তুরস্ক, ইরান এবং সৌদী আরব ইসলামাবাদের স্বৈরাচারীদের মদতদাতা। ওরা সবাই ঐশ্লামিক সংস্থার সেক্রেটারী জেনারেল কতখানি নিরপেক্ষ হতে পারবেন তা নিয়ে গভীর সংশয় দানা বেঁধে ওঠা খুবই স্বাভাবিক।
টুঙ্কুর প্রস্তাবিত দৌত্য কার্যকর করতে হলে প্রথমেই দরকার তার স্বীকারের সৎসাহস। ইসলামের উপর আছে টুঙ্কুর অগাধ আস্থা। বাংলাদেশে পাক-চমুর গণহত্যা, লুঠপাট, নারীধর্ষণ এবং মানুষ বিতাড়ন ঐশ্লামিক ধর্মসম্মত কিনা তার স্পষ্ট জবাব দিতে হবে টুঙ্কু আবদুল রহমানকে। তিনি কোনমতেই এড়াতে পারেন না এ প্রশ্নের উত্তর। সরাসরি জবাব যদি মেলে তার কাছ থেকে তবে কিছুটা ভাঙ্গবে জনগণের সন্দেহ। রাজনীতি ছেড়েছেন টুঙ্কু, কিন্তু হারান নি রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। মুজিবুর রহমান এবং তার আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সত্যিকারের প্রতিনিধি। গত নির্বাচনের ফলাফল তার জ্বলন্ত প্রমাণ। উঁইফোড় ডিকটেটর ইয়াহিয়ার দৃষ্টিতে আওয়ামী নেতারা রাষ্ট্রদ্রোহী। তাদের জন্য নাকি চলছে বিচারের আয়ােজন। টুঙ্কুর আগে বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে দফায় দফায় এসেছেন উঁচু পর্যায়ের প্রতিনিধিদল। তারা ঘুরেছেন বাংলাদেশ। দেখেছেন সেখানে ধ্বংসের ব্যাপকতা। লক্ষ্য করেছেন জনগণের চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। তারা মিশেছেন ভারতের পূর্বাঞ্চলে আগত শরণার্থীদের সঙ্গে। শুনেছেন বহু মর্মান্তিক কাহিনী। সবাই বলেছেন বাংলাদেশের অবস্থা শােচনীয়। সেখানে চলছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। এ অবস্থায় শরণার্থীরা ফিরতে পারেন না স্বদেশে। তাদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবার নেই কোন বিশ্বাসযােগ্য প্রশাসন। এদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার কায়েম হয়েছেন মুক্ত অঞ্চলে। গেরিলারা চালাচ্ছেন। অবিশ্রান্ত লড়াই। বাংলাদেশ থেকে দখলদার পাক-বাহিনীর উচ্ছেদ ছাড়া করবেন না তার অস্ত্রসম্বরণ। ইয়াহিয়ার উপর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই শরণার্থীদের। যাঁর ঘাতকদল পাইকারী হাবে করেছে নরহত্যা, জ্বালিয়ে দিয়েছে বিস্তৃত জনপদ এবং লক্ষ লক্ষ নরনারী এবং শিশুকে ঠেলে পাঠিয়েছে ভারতে তার আশ্রয়ে এদের ফিরে যেতে বলা বাস্তববােধের লক্ষণ নয়। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে যদি সত্যিই থেকে থাকে টুঙ্কুর আন্তরিকতা তবে তার উচিত ইয়াহিয়ার কান্ডজ্ঞান ফিরিয়ে আনা। বাংলাদেশ থেকে পাক-বাহিনীর অপসারণ এবং সেখানে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ছাড়া মিলবে না ইসলামাবাদের সম্বিত ফিরে আসার প্রমাণ। বাস্তবের মােকাবিলা না করে টুঙ্কু যদি পাশ কাটাতে চান, তবে তার দৌত্যের প্রস্তাব মাঠে মারা যেতে বাধ্য।
নয়াদিল্লী স্পষ্টই বলেছেন—শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রথম শর্ত বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। এই সমাধান বলতে তারা বুঝেন জনপ্রতিনিধি মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের শাসন কায়েম। তা না হলে নেকড়েদের মুখে যেতে চাইবেন না কোন শরণার্থী। টুঙ্কু কি মেনে নেবেন এ প্রস্তাব? তার ঐশ্লামিক সংস্থার অন্যতম প্রধান চাই ইয়াহিয়া খান কি দেবেন তাতে সমর্থন? যদি ইসলামাবাদের মন জিতাতে না পারেন টুঙ্কু আবদুল রহমান তবে সমস্যা সমাধানের নিশ্চিত ইঙ্গিত আসবে মুক্তিফৌজের রাইফেল থেকে। টুঙ্কুর জানা উচিত, বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশের সঙ্গে জড়িত শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্ন। আওয়ামী লীগের গ্রহণযােগ্য একটি ফরমূলা ছাড়া কিসের ভিত্তিতে টুঙ্কু করবেন নয়াদিল্লী এবং ইসলামাবাদের মধ্যে মধ্যস্থতা? বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে হতে পারে না কোন ফয়সালা। মিথ্যাবাদী এবং শয়তান ইয়াহিয়ার প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট নয়। টুঙ্কু দেখা করুন বন্দী মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। শুনুন বাংলাদেশের সত্যিকারের নেতাদের কথাবার্তা। দেখুন ইয়াহিয়ার মতামতের সঙ্গে কোথাও আছে কিনা তাদের মতের মিল। যদি না থাকে তবে ব্যর্থ হবে তাঁর সাহায্য। জনগণের মনে বাড়বে সন্দেহ টুঙ্কু প্রস্তাবিত দৌত্যের প্রস্তাব পাকিস্তানেরই ফাঁদ। ওটার নেই কোন বাস্তব মূল্য। পাক-প্রচারের হাতিয়ার সৃষ্টিই তার উদ্দেশ্য। ব্যক্তি হিসাবে টুঙ্কু যত সদাচারীই হােন না কেন, বাংলাদেশ বিরােধী ঐশ্লামিক জোট থেকে তিনি আলাদা নন।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ জুলাই ১৯৭১