ভারত সীমান্তে গুপ্তচরদের নাশকতা
পশ্চিম বাংলার সীমান্ত বানপুর-রাণীঘাট বিভাগে মাজদিয়া ও গেদের মধ্যে ডিনামাইটে রেল লাইন। বিস্ফোরণের ঘটনায় নাশকতাকারীদের তৎপরতার দিকে সকলের দৃষ্টি নিশ্চিতই আকৃষ্ট হয়েছে। পুলিশী সূত্রে বলা হয়েছে, এই নাশকতা পাকিস্তানি গুপ্তচরদের কাজ। রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার হয়ে এসে রেল লাইনের ওপর ডিনামাইট পেতে রেখে যায় তারা। বাংলাদেশ সীমান্তের ঘটনা। সৌভাগ্যক্রমে ওই লাইনে। ড্রাইভারে তৎপতায় লােকাল ট্রেন উড়ে গেলেও ট্রেনের ক্ষতি হয় নি এবং কোনাে প্রাণহানি হয়নি। নাশকতাই এর লক্ষ্য এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। এবং পাকিস্তানি গুপ্তচরদের নাশকতা হওয়াই সম্ভাবনা বেশি। কারণ, সীমান্ত অঞ্চলে গােলযােগ ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য পাকিস্তানিরা এখন নানাভাবেই ষড়যন্ত্র করবে। বাংলাদেশ থেকে সত্তর লক্ষ লােক বিতাড়ন করেও পাকিস্তানি শাসকরা চুপ করে বসে নেই। ভারতকে নানাভাবে বিব্রত ও ব্যতিব্যস্ত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকরা এখন চেষ্টা করে চলেছে। ভারতের সঙ্গে একটা সামরিক সংঘর্ষ বাধাবার জন্য পাকিস্তানি জঙ্গী শাসকরা উন্মুখ। বাংলাদেশের গণহত্যার কলঙ্ক চাপা দেবার জন্য তারা এই মুক্তি আন্দোলনকে ভারত-পাক সমস্যা বলে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে আন্তর্জাতিক দরবারে। ভারতকে এক বিরাট বােঝা বহন করতে হচ্ছে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ার। লক্ষ লক্ষ নরনারী সর্বস্ব খুইয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। এতে পাকিস্তানি শাসকদেরই লাভ হচ্ছে। পাকিস্তানি শাসকরা এদের বিতাড়নের ব্যবস্থা করছে তাদের সেনাবাহিনীর সাহায্যে এবং এই সেনাবাহিনীকে কাজ করতে সাহায্য করছে কিছু সংখ্যক বিশ্বাসঘাতক, দালাল শ্রেণীর লােক এবং মুসলীম লীগের চর। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা এই চরদের দিয়েই চাইছে বাংলাদেশের মাটিতে আবার পাকিস্তানি বিষবৃক্ষ রােপণ করতে। গত মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ব্যাপক গণ-অভ্যুত্থানে যে গাছ মূলশুদ্ধ উপড়ে ফেলেছিল বাংলাদেশের মানুষ। এই জঘন্য কাজ করতে হলে দু’টি কাজ তাদের করতে হবে। প্রথম হল অবাঞ্ছিত উৎসাদন এবং দ্বিতীয় হল ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্ররােচনা জইয়ে রাখা। প্রথম কাজটা তারা খুব সহজেই করতে পেরেছে। বন্দুক বেয়নেটের রাজত্বে দরিদ্র, দুর্বল মানুষ বাস করতে পারে না। তাই তারা কাতারে কাতারে সীমান্ত পার হয়ে চলে এসেছে ভারতে। এই জনস্রোত সহজে বন্ধ হবে না। কারণ, পাকিস্তানি শাসকরা অবাঞ্ছিতদের সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত না করে থামবে না। এরই সঙ্গে তারা চালিয়ে যাবে নানা রকম নাশকতা, উস্কানিমূলক কার্যকলাপ এবং সীমান্তে বিশৃংখলা সৃষ্টির প্রয়াস। শরণার্থীদের জন্য আমাদের সীমান্ত উন্মুক্ত। মাবিকতার কারণেই এই শরণার্থীদের কোনাে প্রকার বাধা দেবার প্রশ্নই ওঠে না। তার ফলে সীমান্তে গুপ্তচরদের চলফেরারও সুযােগ হয়ে গেছে। এ সম্পর্কে আমাদের সীমান্তরক্ষী ও পুলিশ বাহিনীর অবশ্যই তৎপর ও সজাগ হওয়া দরকার। নাশকতাকারীরা যে ধরনের ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী ডিনামাইট ব্যবহার করেছে তা কোনাে অর্ডন্যান্স ফ্যাকটরি থেকে অপহৃত হয়েছে বলে পুলিশ সন্দেহ করছে। অপহৃত মাল যদি ভারতের হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, পাকিস্তানি গুপ্তচররা এই রাজ্যেও তাদের জাল বিস্তার করেছে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ও গােয়েন্দা বিভাগের ওপর আর এমন ভরসা করা যায় না যে তারা এই গুপ্তচর নয়। আরও বড় রকমের নাশকতা এদের দ্বারা হতে পারে। এবং যতই আমরা সীমান্তে শিথিলতা দেখাব ততই এদের তৎপরতা বাড়বে। পশ্চিমবাংলার নিজস্ব উৎপাত তাে আছেই। তার সঙ্গে যদি পাক-গুপ্তচরদের দীর্ঘ বাহু এসে যােগ দেয় তাহলে তাে সােনায় সােহাগা। অবিলম্বে এ সম্পর্কে তদন্ত করে আগে ঠিক ভাবে জানা দরকার যে, এই নাশকতা কাদের দ্বারা হয়েছে এবং তাদের সম্ভাব্য আনাগােনার পথ কী। গােটা সীমান্ত এলাকায় কঠোর সতর্কতা ছাড়া এ ধরনের ঘটনার পুণরাবৃত্তি রােধ যে সম্ভব নয় তা আমরা সরকারকে স্বরণ করিয়ে দিতে চাই। ঘটনা ঘটে যাবার পর লােক দেখানাে সতর্কতায় বৃহত্তর বিপদ এড়ানাে যাবে না। কারণ, পাকিস্তানি নাশকতাকারী গুপ্তচররা শুধু একবার লাইন উড়িয়েই চুপ করে থাকবে না। ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকদের সংকল্প আরও কঠোর এবং নির্মম। এবং তাদের সহযােগীরও অভাব নেই। সুতরাং এখনই সাবধান হওয়া প্রয়ােজন।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৫ জুলাই ১৯৭১