You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২রা ডিসেম্বর, রবিবার, ১৬ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০

রুশ-ভারত ঘোষণা

সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান মিঃ লিওনিদ রেজনেভের ভারত সফর শেষে প্রকাশিত যুক্ত ঘোষণায় এই উপমহাদেশে স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য পাকিস্তানের প্রতি স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানানো হয়েছে। মিঃ রেজনেভ ও শ্রীমতি গান্ধী স্বাক্ষরিত যুক্ত ঘোষণায় এশীয় পরিস্থিতিতে অগ্রগতিমূলক পরিবর্তনকে অভিনন্দন জানিয়ে বলা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল এলাকা এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো সকলের চেষ্টার মাধ্যমে দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি ও পরস্পরের স্বার্থে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উপর উভয় দেশই বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য আরোপ করেছে।
এই ঘোষণায় ভিয়েতনাম প্রশ্নে বিগত ২৭শে জানুয়ারী প্যারিসে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তি কঠোরভাবে বাস্তাবায়িত করার স্বপক্ষে দুটি দেশের অভিমত ব্যক্ত করা হয়। ঘোষণায় কম্বোডিয়ার জনগণের স্বার্থের অনুকূলে অবিলম্বে কম্বোডিয়ার ন্যায়সঙ্গত নিষ্পত্তির আহ্বান জানানো হয়।
ঘোষণায় আরো বলা হয় যে, উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণে এবং এই এলাকার সাম্প্রতিক সংকটজনিত অসুবিধাগুলো দূর করার ক্ষেত্রে দিল্লী চুক্তির অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। দুই দেশ মনে করে উপমহাদেশের এখনো যে সব সমস্যা আছে বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সে সব সমস্যার নিষ্পত্তি হতে পারে এবং তাই করতে হবে। সিমলা চুক্তির আলোকে এসব সমস্যার মীমাংসা হলে তা এই এলাকার সব দেশের জনসাধারণের জন্য কল্যাণকর হবে। ১৯৭৩ সালের ১৭ই এপ্রিল ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি ঘোষণা এবং গত ২৮শে আগষ্ট ভারত-পাকিস্তান চুক্তি এ উপমহাদেশে পরিপূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ ঘোষণায় উল্লেখ করা হয় যে, ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়ন একটি ১৫ বছর মেয়াদী অর্থনৈতিক সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
এশিয়ার অনুন্নত দেশগুলোর জন্য আজকের দিনে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা। যে কোন বিষয় নিয়ে পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত হলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে এবং তার অর্থই হবে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি। বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী নিজস্ব স্বার্থেই এশিয়া তথা এ উপমহাদেশে অশান্তির আগুন জ্বালিয়ে রাখতে চায়। সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ঘৃণ্য চক্রান্তের ফলে এখনো পর্যন্ত ভিয়েতনামের মাটিতে পরিপূর্ণ শান্তি আসেনি এবং কম্বোডিয়ার বুকে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। পাকিস্তানও সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর ক্রীড়ানকে পরিণত হয়ে স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে।
সিমলা চুক্তি ও দিল্লি চুক্তির পর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের আরো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হওয়া উচিত ছিলো কিন্তু তা বাস্তবে এখনো হয়নি। বাংলাদেশ ভারত যুদ্ধ ঘোষণার পর বাংলাদেশের ও পাকিস্তানের মনোভাবের পরিবর্তন হবে এটাই সকলে আশা করেছিলেন কিন্তু তা হয়নি। পাকিস্তান বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়া দূরে থাকুক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ উদ্ভুদ্ধ তথাকথিত সাম্যবাদী চীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির বিষয়ে বাধা দিচ্ছে। পাকিস্তানের জ্ঞান চক্ষু এখনো উন্মোচিত হয়নি। ঘরে-বাইরে সমস্যা ও সংকটে জর্জরিত হওয়া সত্বেও পাকিস্তান এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতাকে বিঘ্নিত করছে।
রুশ ভারত যুক্ত ঘোষণার পর আমরা আশা করবো এশিয়ার অনুন্নত দেশগুলো বিশেষতঃ পাকিস্তানের চৈতন্যদয় হবে। একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, এ উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তি ও স্থিতিশীলতা, বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের উপর নির্ভরশীল।

ভুট্টোর প্রতি শেখ আবদুল্লাহর পরামর্শ

রাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো উপমহাদেশে সবিশেষ পরিচিত। এবার তিনি নতুন খেলায় মাতোয়ারা হয়ে উঠেছেন। জনাব ভুট্টো আজাদ কাশ্মীরকে পাকিস্তানের অন্তঃপুরে ঢোকানোর জন্যে নানা রকম ফন্দি ফিকির আঁটতে শুরু করেছেন। কিছু দিন আগে ভুট্টো সাহেব কাশ্মীর সফরে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ভারতের কাশ্মীরীদের উদ্দেশ্যে যে কোন শুক্রবার হরতাল পালনের জন্যে উস্কানী দিতেও কসুর করেননি। এই উস্কানী যে আন্তর্জাতিক সমস্ত আইন কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে তাতে ভুট্টো সাহেব তেমন গা করেন নি। নিজের দেশে যখন চারদিকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের দাবি তীব্র হয়ে উঠেছে, জ্বলে উঠেছে বিক্ষোভের আগুন, তখন তিনি সবকিছু ভুলে গিয়ে বেসামালের মতো কাশ্মীরেও আগুন নিয়ে খেলতে দ্বিধা করেন নি। কিন্তু শেখ আব্দুল্লাহ সম্প্রতি পাকিস্তানের চতুর প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো সাহেবকে এই কুটিল রাজনৈতিক খেলার ব্যাপারে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন যে, ভুট্টো সাহেব যেনো নিজের চরকায় তেল দেন। কাশ্মীরের ব্যাপারে তার মাথা ঘামানো শোভা পায়না।
জনাব ভুট্টো কাশ্মীরিদের হরতাল পালনের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, শেখ আব্দুল্লাহ তার কঠোর সমালোচনা করেছেন এবং তিনি কাশ্মীর রাজ্যের পাকিস্তানের পন্থীদের সমালোচনা করতেও ছাড়েননি। শেখ আব্দুল্লাহ ঐতিহাসিক হযরতবাল মসজিদে জুম্মার নামাজ শেষে এক সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি তাঁর ভাষণে একটি মহিলা কলেজের নাম জওয়াহের লাল নেহরু রাখা নিয়ে যে দাঙ্গা হয়ে গেছে, তাকে কায়েমী স্বার্থবাদীদের চক্রান্ত বলে অভিহিত করেছেন। শেখ আব্দুল্লাহ কাশ্মীরে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হয়েছেন।
শেখ আবদুল্লাহ সোচ্চার কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, যার কাশ্মীরে স্থিতিশীলতার বিরোধী তারাই কলেজের নাম পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। কাশ্মীরী নেতা শেখ আবদুল্লাহর বক্তব্য জলের মত পরিস্কার। তিনি পাক-প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর প্রতি যে পরামর্শ দিয়েছেন, তাও নিছক কথার কথা নয়। বরং তিনি একটি চরম সত্যের প্রতিই অঙ্গুলী নির্দেশ করেছেন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সিন্ধু-বেলুচিস্তান ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠেছে। পাকিস্তানি ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে উচ্চারিত হচ্ছে ব্জ্রনির্ঘোষ। ভুট্টো সাহেব নিজের ঘরই সামলাতে গিয়ে খাবি খাচ্ছেন, কিন্তু তিনি আবার কিনা কাশ্মীর নিয়েও মাথা ঘামাতে শুরু করেছেন।
এই সত্যের আলোকে শেখ আবদুল্লাহ জনাব ভুট্টোকে যে পরামর্শ দিয়েছেন তা খুবই প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয় কাশ্মীরিদের চোখ খুলে দিয়েছে। তাই তারা কাশ্মীরকে পাকিস্তান গ্রাস করে নিক এটা কিছুতেই চায় না। তবুও ভুট্টো সাহেব আসরে অনৈতিকভাবে অবতীর্ণ হয়েছেন- যার ফলে আজ শেখ আবদুল্লার মতিগতির পরিবর্তন হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকেও মুখ খুলতে হয়েছে।

অশুভ প্রবণতাকে রুখতে হবে

সরকারের খাদ্যশস্য সংগ্রহ করার কর্মসূচি ব্যাখ্যা করার অপপ্রয়াস চালছে বলে খবর প্রকাশ। এর পেছনে জোর চক্রান্ত এক শ্রেণীর মজুদদার, মুনাফাখোর এবং চোরাকারবারীর। কোন কোন ক্ষেত্রে খাদ্য শস্য সংগ্রহ অভিযানে লিপ্ত কর্মচারী এবং মজুদদারদের গোপন যোগসাজশ রয়েছে বলেও প্রকাশ। আবার কোন কোন জায়গায় প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার পথে। খবর পাওয়া যাচ্ছে মজুদদাররা সরকার নির্ধারিত মূল্যের চাইতে চড়া দামে খাদ্যশস্য ক্রয় করছে ফলে চাষীরা সরকারি খাদ্য সংগ্রহ কেন্দ্রে তাদের শস্য বিক্রি না করে অধিক মূল্যে সেই সব মজুদদারদের কাছে শস্য বিক্রি করছে। এবং এধরনের কাজ ক্রমান্বয়ে ব্যাপকতর হতে শুরু করেছে সীমান্ত এলাকা গুলোতে।
খাদ্য সংগ্রহ কর্মসূচি ঘোষণার সময় আমরা এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে সম্ভাব্য অন্তরায়ের বিষয়গুলো সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি রেখে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছিলাম। সে সময়ে উদ্ভূত সমস্যা ও চিন্তাগুলোর কথাও আমরা উল্লেখ করেছি। অথচ কেন এ সব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পূর্ব সাবধানতা অবলম্বন করেননি তা আমরা বুঝতে পাচ্ছি না। যাইহোক এখনো সময় আছে। সুতরাং আর এতোটুকু কালবিলম্ব না করে খাদ্যশস্য সংগ্রহ কর্মসূচি সফল করে তোলার জন্য বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছেন খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান বানচাল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা সে কথারই পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’- সুতরাং কেবলমাত্র সতর্কবাণী উচ্চারণ করে থাকলেই চলবেনা।
এই কর্মসূচিকে যে কোন মূল্যে সফল করে তোলার প্রেক্ষিতে উদ্ভূত সমস্যা ও পরিস্থিতি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যালোচনা করে অনতিবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক। নচেৎ এই অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আর যদি কোন কারণে সত্যি সত্যি এ অভিযান ব্যর্থ হয় তাহলে তার পরিণতি কি ভয়াবহ হবে সে কথা বলাই বাহুল্য। তাই দেশের ও দশের বৃহত্তর স্বার্থেই এই অশুভ প্রবণতাকে রুখতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!