বাংলার বাণী
ঢাকা: ১লা ডিসেম্বর, শনিবার, ১৫ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সংস্থা ও প্রাসঙ্গিক কথা
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার চেয়ারম্যান গত পরশুদিন এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করেছেন যে, তার সংস্থা বর্তমানে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এক ফিরিস্তি দিয়ে তিনি মাসিক তেইশ লাখ টাকা এবং আঠারো লাখ টাকা ব্যয়ও দেখিয়েছেন। এটা আমাদের কাছে অত্যন্ত আশার কথা। বর্তমানে কতগুলো বাস চলাচল করছে এবং কতগুলো বিকল হয়ে আছে তারও একটি হিসাব চেয়ারম্যান সাহেব পেশ করেছেন। অন্যদিকে চেয়ারম্যান উল্লেখ করেছেন, গত বছর অকেজো পুরানো বাস বিক্রির দরুন সংস্থা প্রায় পাঁচ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে। ১২১টি বাস এভাবে নিলামে বিক্রি করা হয়েছিল। প্রতিটি বাস এক থেকে দেড় হাজার টাকায় বিক্রি হয়। চেয়ারম্যান সাহেব নিজেই জানিয়েছেন যে, তৎকালে বাজারে কম করে হলেও পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকায় প্রতিটি বাস বিক্রি করা যেতো। এবং তার দাম নাকি সাত আট হাজার টাকা হবে। উল্লেখিত এ সকল হিসাব বি, আর, টি,সির চেয়ারম্যান সাহেবের নিজেরই দেওয়া। এই হিসাব প্রসঙ্গে তিনি অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে আবার বলেছেন- একটি বাসের গড় ওজন সাত আট টনের মতো।
কাঠ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম বাদ দিলেও পাঁচ টনের মতো শুধু লোহাই থেকে যায়। জানা গেছে, বৎসর খানেক পূর্বে লিট লোহার প্রতি টন মূল্য ছিল প্রায় তেইশ-শ’ থেকে পঁচিশ শ’ টাকা এবং বর্তমানে তার মূল্য প্রায় চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা। পুরোনো বাসের লোহা শিট লোহার সমান মূল্য না পেলেও প্রতিটি বাসের দাম পাঁচ টাকার অনেক বেশি যে হতো এ ব্যাপারে আমরা নিঃসন্দেহ। এছাড়াও স্ত্রু, বল্টু, স্প্রিং, কাচ প্রভৃতির দামও ভিন্ন ভিন্ন ভাবে তখনও অনেক বেশি ছিল। একটি সংবাদে জানা গেছে সড়ক পরিবহণ সংস্থার যে বাসগুলো তৎকালে নিলামে জলের মূল্যে বিক্রি করা হয়েছিল তার অনেকগুলোই নাকি বর্তমানে শহরে চলাচল করছে। অথচ বিক্রি করা হয়েছিল সম্পূর্ণ অচল ও ধ্বংসপ্রাপ্ত বলে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সংস্থার যে যথেষ্ট ঘাপলা রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অতীতে যে সকল অনাসৃষ্টি এই সংস্থায় হয়েছে তার তদন্ত হওয়া দরকার ভবিষ্যতে ভালোর জন্যে। বর্তমানের চেয়ারম্যান সাহেব তাঁর দক্ষতা বা যোগ্যতা প্রমাণ করতে তখনই পারবেন যখন অতীতের কীর্তিকলাপকেও তিনি আবিষ্কার করে দোষীদের শাস্তি প্রদান করতে সক্ষম হবেন। আরো দক্ষতা ও শ্রম ব্যয় করে এই সংস্থাটিকে অবিরাম লাভজনক প্রতিষ্ঠানরূপে যখন তিনি দাঁড় করাতে পারবেন ঠিক তখনই বাংলাদেশের এই বৃহৎ লাভজনক প্রতিষ্ঠানের প্রতি ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের প্রতি মানুষের আস্থা প্রদর্শিত হবে।
চিনিতে স্বনির্ভর হতে হলে
স্বাধীনতা উত্তরকালে অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে চিনির মূল্যও বৃদ্ধি পেয়েছে সমানতালে৷ এই মূল্য বৃদ্ধির পশ্চাতে কারণও ছিল যথেষ্ট। স্বাধীনতা যুদ্ধে মিলগুলোর ব্যাপক ক্ষতি, আখ চাষে অসুবিধার দরুণ পর্যাপ্ত আখ সরবরাহের অভাব, যোগাযোগের অব্যবস্থা, প্রশাসনিক নানা ঘাপলা ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এতদিনে সে সব সমস্যা সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠা না গেলেও চিনি কলগুলোতে যতটুকু স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে তাতে করে আগামী বছরের মধ্যে চিনিতে দেশ স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারবে৷ শিল্পমন্ত্রীও অল্প কিছুদিন আগে বলেছেন দেশের প্রায় সব ক’টি চিনিকলে পূর্ণোদ্যমে উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং এর ফলে আগামী বছরের মধ্যে দেশ চিনিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে।
কিন্তু পত্রিকান্তরে চিনিকল এলাকায় গুড় উৎপাদন নিষিদ্ধ হওয়া সত্বেও বেআইনী গুড় তৈরি হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে চিনিতে স্বয়ংসম্পূর্ন হওয়া দূরে থাক চলতি বছরের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানো যাবে কিনা সে বিষয়ে আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে। গুড় তৈরি করার ফলে কিছুসংখ্যক গুড় উৎপাদনকারী এবং আখচাষী লাভবান হচ্ছে সত্য, কিন্তু এতে করে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে অসুবিধা ভোগ করতে হচ্ছে। আখ উৎপাদনকারী চাষীদের অভিযোগ, চিনিকল কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে ক্ষেত থেকে নিতে পারছেনা বলেই তারা গুড় তৈরি করতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া গুড় তৈরিতে মণ প্রতি আখের অধিক মূল্যে প্রাপ্তিতে আরেকটি কারণ।
মিল কর্তৃপক্ষ একশ্রেণীর রেলওয়ে কর্মচারীদের দুর্নীতি ও ঘুষের প্রবণতা জন্য ঠিকমত রেলওয় ওয়াগণ পাচ্ছেন না, চিনি কলে আন্তঃবিভাগীয় সহযোগিতা ও সমঝোতার অভাব, রক্ষণাবেক্ষণের অব্যবস্থা ইত্যাদিও যথার্থভাবে চিনিকলগুলোতে উৎপাদন না হবার কারণ বলে জানা যায়। সুতরাং চিনি কলগুলোতে উৎপাদন ব্যাহতের কারণ এবং কল এলাকায় বেআইনি গুড় তৈরির প্রবণতা ইত্যাদি বিষয়গুলো আরো গভীরভাবে বিবেচনা করে চিনিকলগুলোতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছুবার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার৷ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নিশ্চল থাকবেন না বলেই আমাদের বিশ্বাস।
আবাসিক সমস্যা সমাধানের পথ
রাজধানী ঢাকা নগরী ও দেশের বিভিন্ন এলাকার বর্তমান আবাসিক সংকটের প্রেক্ষিতে সরকার স্বল্প আয়ের লোকদের জন্য স্বনির্ভরতার ভিত্তিতে গৃহনির্মাণ কল্পে একটি কর্পোরেশন গঠনের কথা চিন্তা করেছেন বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে। প্রকাশিত ওই খবরে বলা হয়েছে যে, রাজধানী ও দেশের অন্যান্য এলাকায় চরম আবাসিক সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সমবায় দফতর, একশত কোটি টাকার এক ব্যাপক গৃহ নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য শিগগিরই একটি সমবায় গৃহনির্মাণ কর্পোরেশন গঠন করা হবে। এ সমবায় গৃহনির্মাণ কর্পোরেশনের উদ্দেশ্য হবে স্বনির্ভরতার ভিত্তিতে স্বল্প আয়ের ব্যক্তিদের জন্য গৃহ নির্মাণ করা। এই প্রকল্প অনুযায়ী শহর অঞ্চলের ব্যাপক এলাকায় বহুতলা বিশিষ্ট গৃহনির্মাণ করা হবে৷ প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সময় এই একশত কোটি টাকার সম্পূর্ণ অঙ্ক ব্যয় করা হবে।
বর্তমানে বাসস্থান সমস্যায় জর্জরিত রাজধানী ঢাকা নগরী ও দেশের অন্যান্য শহরাঞ্চলের স্বল্প আয়ের তথা সাধারণ মানুষের জন্য বাসোপযোগী এই ধরনের বাড়ি নির্মাণের এই প্রকল্প নিঃসন্দেহে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি মহতী প্রকল্প বলেই পরিগণিত হবে- যদি যে মহৎ উদ্দেশ্যে এটা প্রণীত হচ্ছে সে উদ্দেশ্যের বাস্তবায়নে কর্মকর্তার সঠিক এ বাস্তব সম্মত উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সর্বোপরি এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ভার যেসব সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপর ন্যস্ত হবে তাঁরা যদি আন্তরিকতার সাথে কাজে এগিয়ে আসেন, তবেই এই মহৎ উদ্দেশ্য সফল হতে পারে। কেননা বর্তমানে দেশ অন্যান্য সব কিছুর মতোই চরম আবাসিক সংকটে জর্জরিত এটা একান্ত বাস্তব সত্য। এই সত্যকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করে বঙ্গবন্ধুর সরকার বহু আগেই সাধারণ মানুষের বাসোপযোগী আবাসিক গৃহ নির্মাণের কথা বলেছিলেন।
কিন্তু কিছু দিন আগে সেই কথার সূত্র ধরে সাধারণ মানুষের বাসোপযোগী গৃহনির্মাণের ছদ্মাবরণে গৃহনির্মাণ ঋণদান সংস্থা নগদ টাকায় ফ্ল্যাট বিক্রির যে বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রে দিয়েছেন- তা কেবল সাধারণ মানুষেরই ক্রয়ক্ষমতার ঊর্ধ্বে নয়, পরন্তু অসাধারণ মানুষের অনীহা সৃষ্টিরও কারণ বটে। কেননা এদেশের কোন মানুষের পক্ষে প্রথমতঃ ৮০ হাজার টাকায় ফ্ল্যাট কেনা দ্বিতীয়তঃ প্রথম দফায় ৫ হাজার টাকা জমা দেয়া এবং তৃতীয়তঃ ছয় কিস্তিতে ৭৫ হাজার টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। কারণ অধিকাংশেরই সামর্থ্য নেই। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের সাধ নেই। এমতাবস্থায় এক্ষণে গঠিতব্য এই কর্পোরেশন এমন কোন মাথাভারী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন না যা মানুষের মনে সমবায় ও স্বনির্ভরতা সম্পর্কে অনীহা সৃষ্টি করতে পারে। এটাই আমরা কামনা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক
পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন