সামনে ভবিষ্যৎ
রণেশ দাশগুপ্ত
জয় হয়েছে বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের। খাস ঢাকা নগরীতে স্থাপিত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী। সরকারের কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক দপ্তর। পাকিস্তানি সামরিক চক্র এবং তার ঔপনিবেশিক শাসনের কজা চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে, অপসারিত হয়েছে বাঙলাদেশের মাটি থেকে। এখন নতুন বাঙলাদেশ গড়বার পালা এসেছে। বাঙলাদেশের মানুষ যেমন মুক্তিযুদ্ধের সর্বস্ব পণ করে নেমেছিল, তেমনি এই গড়বার কাজেও লেগে যাবে। মুক্তিযুদ্ধে যেমন ছিল, তেমনি এই নতুন বাঙলাদেশ নির্মাণেও রয়েছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য।
লক্ষ্য চারটি : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, গােষ্ঠীনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি।
সুতরাং, দেশিনির্মাণের পালা হবে সুনির্দিষ্ট পালা। অর্থাৎ নির্দিষ্ট একটা খাত, থাকবে, যদিও উপচে পড়তে পারে কার্যক্রম কখনও বাঁয়ে, কখনও ডানে। নির্দিষ্ট বৈপ্লবিক কার্যক্রমে অনভ্যস্ত নয় বাংলাদেশের। মানুষ-জনগণ।
বস্তুতপক্ষে, অভ্যস্তই বলা যেতে পারে। কারণ গত চব্বিশ বছরের মুক্তিসংগ্রামে বাঙলাদেশের মানুষ যে কয়েকটা বড় বড় গণঅভ্যুত্থানে শরিক হয়েছে, সবগুলােতেই ছিল নির্দিষ্ট কার্যক্রম ও লক্ষ্য। যেমন একুশ দফা, ছয় দফা, এগারাে দফা।
মুক্তিসংগ্রামের লক্ষ্যকে এবার চারদফা হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এবং গােষ্ঠীনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি হলাে এই চারদফা। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বুকেররক্ত-ঢালা মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে জনগণ এই চারদফার সারসত্তাকেও বুঝে নিয়েছেন। এই চারদফা শেখাবার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পাঠশালা খােলার দরকার হবে না।
হাঁ করলেই বুঝতে পারা যাবে, বক্তব্যটা কী। দেশবাসী গত ২৪ বছরের মুক্তিসংগ্রাম আর দশ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পরস্পরের নিকটস্থ হয়েছেন। পরগাছাগুলাে খসে পড়েছে, দূর হয়েছে, দূর হবে। জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হচ্ছে চারটি শ্রেণীর সহযােগে। এরা হচ্ছে কৃষক, জাতীয় বুর্জোয়া, শ্রমিক এবং মধ্যবিত্ত। এদের পুরােভাগে রয়েছে বিপ্লবী ছাত্রসমাজ, যারা গত চব্বিশ বছরে পেয়েছে গণচরিত্র।
উপরােক্ত চারটি শ্রেণী এবং বিপ্লবী ছাত্রসমাজের পারস্পরিক বিন্যাসে রদবদল হবে দেশনির্মাণের কার্যক্রমের বাস্তবায়নের গতিধারায়। তবে চারদফার কাটছাঁট না করলে উপরােক্ত সমস্ত শক্তিগুলাে একত্রিত থাকতে পারবে।
একথা নিশ্চয়তা নিয়ে বলা যায় এজন্যে যে, গত চব্বিশ বছরে একুশ-দফা, ছয়-দফা এবং এগারােদফার বৈপ্লবিক সংগ্রামে উপরােক্ত বৈপ্লবিক শক্তিগুলাে একত্রিতভাবেই কাজ করেছে, যদিও এদের বিভক্ত করার জন্যে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকচক্র এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী মুরুব্বিরা এই ঐক্যকে ভেঙে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, কয়েকবার ভেঙেও দিয়েছে সাময়িকভাবে।
দেখতে হবে চারদফার যেন কাটছাঁট না হয়। এই দেখাটা হবে সামগ্রিকভাবে বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাসিন্দার প্রতিযােগিতামূলক দেখা।
সূত্র: সপ্তাহ, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১