You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বার্থপরতার পাকে অন্যান্য রাজ্য

উদ্বেগজনক সংবাদ। সীমান্তের দূরবর্তী অনেক রাজ্যই নিতে চাচ্ছে না বাংলাদেশের শরণার্থী। প্রথমে উড়িষ্যা নিম্বরাজী হয়েছিল। এখন সরাসরি ‘না’ বলে দিয়েছে। তামিলনাড়ুর দরজা একেবারেই বন্ধ। অন্যান্য রাজ্যের ভাবগতিক বিশেষ সুবিধার নয়। কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেবেন। শরণার্থীরা শুধু আশ্রয়ের সামান্য জায়গা নেবেন। ব্যবস্থা সাময়িক। সুযােগমত তারা নিজেদের বাড়িঘরে চলে যাবেন। একথা বুঝাতে চাচ্ছেন নয়াদিল্লী। কিন্তু বুঝতে চাচ্ছেন না রাজ্যগুলাে। এদিকে পশ্চিম বাংলার অবস্থা শােচনীয়। এখানে জমা হয়েছেন পঞ্চাশ লক্ষ শরণার্থী। আরও আসছেন। ত্রিপুরার জনসংখ্যা পনের লক্ষ। সেখানে ভীড় করেছেন সাত লক্ষ শরণার্থী। শিলং-এর দক্ষিণে ছােট শহর বালাত। লােকসংখ্যা মাত্র দু’হাজার। এখন তা ফেঁপে উঠেছে বাইশ হাজারে। এগুলাে সমস্যার ব্যাপকতা এবং জটিলতার নমুনামাত্র। স্থানীয় অধিবাসীদের ধারণা, বহিরাগতরা থেকে যাবেন তাদের রাজ্যে। আসাম এবং মেঘালয়ে চলছে উত্তেজনা। জনসাধারণের একাংশের মনােভাব অনমনীয়। শরণার্থীদের সঙ্গে তাদের ব্যবহার মানবতা-বিরােধী। খণ্ডজাতির যুবকেরা নানাভাবে হয়রানি করছেন দুর্গত মানুষগুলােকে। ওপারে এঁড়া খেয়েছেন ইয়াহিয়ার তাড়া। এপারে এসে খাচ্ছেন আসাম এবং মেঘালয়ের স্থানীয় অধিবাসীদের গলাধাক্কা। ভারতেই যদি বাংলাদেশের শরণার্থীরা পান এমনতর হৃদয়হীন ব্যবহার তবে বাইরের সহানুভূতি চাইবেন নয়াদিল্লী কোন মুখে?
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ছুটে গেছেন আসাম এবং মেঘালয়ে। আশ্বাস দিচ্ছেন জনতাকে শরণার্থীরা প্রয়ােজনের অতিরিক্ত একদিনও থাকবেন না তাদের আশ্রয়ে। সময় এলেই চলে যাবেন নিজেদের বাড়িঘরে। যে ক’দিন তারা থাকবেন, সে ক’দিন তাদের স্বস্তি দেওয়া অবশ্য কর্তব্য। এ আবেদন শুধু আসাম এবং মেঘালয়ের উপরই প্রযােজ্য নয়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যের উপরও প্রযােজ্য। প্রধানমন্ত্রীর নিজের ঘরের গলদও একেবারে কম নয়। নয়াদিল্লীর প্রশাসনের মধ্যেও সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির লােকের অভাব নেই। সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সমস্যার বিচারে অনেকেই অক্ষম। ওদের ধারণা, শরণার্থীদের দায়িত্ব একমাত্র পশ্চিম বাংলার। দুর্গত মানুষগুলাের অপরাধ, ওরা বাঙালী। নিজের গায়ে আঁচর লাগাতে অন্যান্য রাজ্য অনিচ্ছুক। স্বাধীনতার অমৃত আস্বাদন করবে ওরা, আর পশ্চিম বাংলার ভাগ্যে জুটবে শুধু হলাহল। এ ধরনের স্বার্থপরতা ভারতের অখণ্ডত্বের পরিপন্থী। বাঙালী-বিশ্বেষের নগ্নরূপ যদি শালিনতা এবং মানবতার সীমা ছাড়িয়ে যায়, তবে বেড়ে উঠবে সঙ্কীর্ণ বাঙালী জাতীয়তাবাদ। বাঁচার তাগিদেই বাঙ্গালীরা করবেন পাল্টা আঘাত। তার ফল হবে বিষময়। সম্ভাব্য এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির সমূল উৎপাটন আবশ্যক। ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিম বাংলাকে বাদ দিয়ে বাঁচতে পারবে না অবশিষ্ট ভারত। এখানে যে আগুন জ্বলবে অন্যান্য রাজ্যের চোখের জলে নিভবে না সে আগুন। গােটা ভারতের সামনে আজ অগ্নিপরীক্ষা। যেসব রাজ্য পিছু হটতে চাইবে তাদের জোর করে বসাতে হবে পরীক্ষায়। এই বাঞ্ছিত জবরদস্তির দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। নয়াদিল্লীর সঙ্কল্পের অভাব ডেকে এনেছে অনেক অনর্থ। তারা বলছেন যথা সময়ে স্বদেশে ফিরে যাবেন। শরণার্থীরা। যথাসময় কতদূর তা জানেন না জনসাধারণ এবং জানেন না কর্তৃপক্ষ। দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে নয়াদিল্লী ধৈর্য করেছেন ছ’মাসের মেয়াদ। এদিকে বাংলাদেশে নেই ইয়াহিয়ার শাসন অবসানের কোন লক্ষণ। মন্ত্রীরা করছেন বিদেশ সফর। চাচ্ছেন বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। সােভিয়েট রাশিয়া এবং পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলাে এই সমাধান বলতে বুঝেন ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুজিবুর রহমানের আপােষ। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন—এ ধরনের আপােষ অবাস্তব। নয়াদিল্লীর মতিগতি অপরিচ্ছন্ন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং পশ্চিম জার্মানিতে যা বলেছেন তা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী। তিনিও হয়ত চান—পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব বজায় রেখে ঢাকা-দিল্লী সমঝােতা। কথাগুলাের মধ্যে জড়িয়ে আছে কুয়াশার জাল। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলছেন না কোন স্পষ্ট কথা। বিদেশী রাষ্ট্রগুলােতে দূত পাঠিয়েছিলেন তিনি বাংলাদেশের সমস্যার আসল তাৎপর্য বােঝাতে। প্রকৃতপক্ষে কে কাকে বুঝিয়েছেন বলা মুস্কিল। বােঝাবার বদলে ভারতীয় দূতেরা নিজেরাই সব কিছু বুঝে ফিরবেন কিনা কে জানে। লক্ষণ দেখে মনে হয়, নয়াদিল্লী ক্রমে ক্রমে মত পাল্টাচ্ছেন। পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলাের সুরে গান ধরার উপক্রম করছেন। এ সন্দেহ যদি অমূলক হয়ে থাকে, তবে শরণার্থীদের অধিকাংশই অদূর ভবিষ্যতে ফিরতে পারবেন না বাংলাদেশে। অনির্দিষ্টকালের জন্য তারা থাকবেন ভারতে। যতই স্তোকবাক্য বলুন না কেন ইয়াহিয়া খান, তাকে বিশ্বাস করবে না কেউ। এ অবস্থায় বিভিন্ন রাজ্যের অধিবাসীরা যদি প্রধানমন্ত্রীর কথায় আস্থা না রাখেন এবং তারা। যদি মনে করেন যে, শরণার্থীদের মধ্যে এক বিরাট অংশ স্বদেশে ফিরবেন না, তবে তাদের দোষ দেওয়া। যায় না। চরম সঙ্কটের মধ্যে ঝাপ দিয়েছে ভারত। নয়াদিল্লীর সিদ্ধান্তহীনতা বাড়িয়ে দিয়েছে তার জটিলতা। কার দোষ কতখানি এ প্রশ্নের বােঝাপড়া হবে পরে। এখন দরকার সঙ্কটের মােকাবিলা। ভাগ করে নিতে হবে দায়িত্বের বােঝা। কোন রাজ্যই রেহাই পাবে না। সমস্যা সর্বভারতীয়। পশ্চিম বাংলা এবং পূর্বাঞ্চলের কাঁধে সব কিছু চাপিয়ে নিরাপদ স্থানে বসে থাকার অর্থ আত্মহত্যা। ভারতের কল্যাণের জন্যই দরকার গােটা জাতির অপমৃত্যুর প্রতিবন্ধক সৃষ্টি।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৩ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!