বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৫শে ফেব্রুয়ারী, সোমবার, ১৩ই ফাল্গুন, ১৩৮০
পাটচাষীরা কি ন্যায্যমূল্য পাবে?
মন প্রতি পাটের দাম ষাট টাকা করে নির্ধারণ, উৎপাদন লক্ষ্য সত্তুর লাখ বেল ও আরো একশ’ পাট ক্রয় কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্ত সহ গত পরশু পাট দপ্তরের মন্ত্রী আগামী জুলাই-জুন মৌসুমের পাটনীতি ঘোষণা করেছেন। জুলাই-জুন মওসুমের পাটনীতি স্বাভাবিকভাবেই আগামী জুলাই থেকেই কার্যকর হবে এবং বর্তমানে পাট ব্যবসা ও পাট শিল্প সংক্রান্ত সবকিছুই চলতি মওসুমের পাটনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। বর্তমান পাটমন্ত্রীর পূর্বসূরী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ চলতি মওসুমের পাটনীতি ঘোষণাকালে অর্থাৎ গত জুলাই মাসে বলেছিলেন উৎপাদনকারীদের স্বার্থকে সামনে রেখে পাঁচশত পাটকেন্দ্র খোলা হবে এবং পাট চাষিরা যাতে করে নির্ধারিত মূল্য লাভ করতে পারে সেজন্য সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আর পাট দপ্তরে নেই। নূতন এসেছেন শামসুল হক সাহেব। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি দেশের পাট শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগাকুল দিন কাটাচ্ছেন। চলতি মৌসুমে পাঁচশ’ কেন্দ্র খোলা সত্ত্বেও উৎপাদনকারীরা পাটের নির্ধারিত মূল্য পায়নি। আগামী মওসুমের জন্য কেন্দ্র আরো একশ’ বাড়ানোর কথা বলতে গিয়ে তাই বর্তমান মন্ত্রী বলেছেন অধিক পাট কেন্দ্র খুলেই শুধু পাট চাষীদের লাভের নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না।
নয়া পাট নীতি ঘোষণা করতে গিয়ে তিনি আরও বলেছেন, মওসুমে পাটচাষিরা যে নির্ধারিত মূল্য পায়নি সে ব্যাপারে সরকার সচেতন। আগামী মওসুমে যাতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে সম্পর্কে সরকার শুধু সজাগ দৃষ্টিই রাখবেন না প্রয়োজনবোধে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণের সরকার বদ্ধপরিকর।
সমস্যাটা সেখানেই। মন্ত্রীমহোদয়ের সেই ‘সম্ভাব্য সব ব্যবস্থার’ রূপ চরিত্র কি হতে পারে? কি সেই ব্যবস্থা যা ‘প্রয়োজনবোধেই’ মাত্র গ্রহণ করা হবে। আর তা গ্রহণ করলেই পাট চাষিরা নির্ধারিত মূল্য পাবে। গোটা একটি মওসুমে পাট চাষিরা নির্ধারিত মূল্য না পাবার পরও কি সেই ‘প্রয়োজনবোধ’ জাগরিত হবে না? আগের মন্ত্রী পাট চাষীদের ন্যায্যমূল্য লাভের আদৌ কোনো ব্যবস্থা খুঁজে পাননি আর তাই তার উত্তরসূরিকে স্বীকার করতে হয়েছে পাট চাষীদের বঞ্চনার কথা। বর্তমান মন্ত্রী ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে প্রয়োজন অনুভব করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে চান।
চলতি মওসুমে পাট উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির হয়েছিল ৫৫ লক্ষ বেল। আগের বছরের উদ্বৃত্ত ছিল ২২ লক্ষ বেল। সশ্রদ্ধা সরকারের হাতে এ মওসুমে পাট ছিল ৭৭ লক্ষ বেল। কথা ছিল ৩৩ লাখ বেল কাঁচাপাট বিদেশে রপ্তানি করা হবে, ৩৩ লাখ বেল যাবে দেশীয় কারখানায়। দেড় লাখ বেল পাট মানুষের সাধারণ ব্যবহারে লাগবার পর উদ্ধৃত থাকবে প্রায় সাড়ে নয় লাখ বেল। পাট দপ্তরের মন্ত্রী গতপরশু পাটনীতি ঘোষণাকালে বলেছেন, এ মওসুমে আমরা পাট বেঁচে বিদেশি মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাব। অর্থাৎ ধরে নেয়া যায় দুশ’ পঁচাত্তর কোটি টাকারও বেশি ঘরে আসছে মওসুমে। কিন্তু এতে করে কতটুকু উপকৃত হয়েছে সাধারণ কৃষকেরা? এ বছরে আড়াই লাখ একর জমিতে পাট বোনা হয়নি। আগামীতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ বর্তমান মওসুমে পাট চাষীদের যে নাস্তানাবুদ করা হয়েছে এর পরও তারা অধিক পাট উৎপাদনে আগ্রহী হবেন এমন কিছু নিশ্চয় করে বলা যায় না। শুধু কথায় চিড়ে ভেজে না আর বঞ্চিত হৃদয়ে দেশপ্রেমের উদাত্ত আহ্বান সাড়া জাগাতে এমনটিও আশা করা চলে না। এ মওসুমে পাট চাষিরা ৩০/৩২ টাকা মণ দরে পাট বেঁচেছেন ফড়িয়াদের কাছে। উৎপাদন ব্যয়টাও পোষাতে পারেনি তারা। আগামী মওসুমে যদি তাদের ন্যায্য মূল্য লাভের ‘সম্ভবনা ব্যবস্থা’ গ্রহণের প্রয়োজন বোধটা কর্তা ব্যক্তিদের মধ্যে জাগরিতনা হয় তবে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবন’ পাটের ভবিষ্যত নিশ্চিত ভাবেই সার্বিক অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে।
চোরাচালান বন্ধের কার্যকরী ব্যবস্থা চাই
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর সভাপতিত্বে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক চোরাচালান রোধকল্পে নতুন কার্যকরী পন্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দীর্ঘ আড়াই ঘন্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এ পর্যন্ত পরিচালিত চোরাচালান বিরোধী অভিযান পর্যালোচনা করে দেখা হয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন যে, সীমান্তে চোরাচালান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার জন্য তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণে বদ্ধপরিকর। এবং চোরাচালানীদের নির্মূল করার জন্য কতিপয় নতুন স্ট্রাটেজিও নেওয়া হয়েছে বলে তিনি সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করেন। সীমান্তে চোরাচালান অব্যাহত রয়েছে এবং চোরাচালান বন্ধ করার জন্য ইতিপূর্বে আমরা বহুবার বহুবার প্রকাশ করেছি, অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেখিয়ে দিয়েছি চোরাচালান এক ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাচালানের মূল হয়নি। এনিয়ে কাগজে কাগজে লেখালেখি হয়েছে অনেক। চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য সরেজমিনে তদন্ত করে আসার পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদকরা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পত্রস্থ করেছেন। কিন্তু এতেও কোন ফল আদায় হয়নি। চোরাচালানিরা তাদের কাজ করে গেছে। ব্রিগেডিয়ার খলিল বিডিআর-এর নতুন প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং এই দায়িত্বভার গ্রহণের অব্যাবহিত পরপরেই সীমান্তের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে চোরাচালান রোধের নব্য কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছেন। সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাচালান রোধের জন্য ইতিপূর্বে অনেক অভিযান পরিচালিত হয়েছে। যারা চোরাচালানের নির্মূল করার জন্য নিয়োজিত রয়েছেন তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিটিও কম বড় হয়নি। কাজেই আমরা আশা করতে পারি যে, সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাচালান বন্ধ করার জন্য অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বাস্তবভিত্তিক এবং কার্যকরী পন্থাই অনুসরণ করা হবে। চোরাচালান রোধকল্পে কি নব্য পন্থা অবলম্বন হবে তা আমাদের জানানো হয়নি। তা না জানানোই ভালো। আমরা কোন পন্থা কিংবা কোনো ‘কৌশল’ জানার ব্যাপারে আগ্রহী নই, আমরা শুধু এটাই দেখতে চাই যে, সীমান্তের বিশাল এলাকায় চোরাচালান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। চোরাচালানের সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি-অবনতি প্রশ্ন জড়িত। চোরাচালান সমগ্র দেশব্যাপী এক সংকটের চিত্রকে প্রকটতর করে চলেছে। দেশের এই উদ্ভূত সংকট মোচনের জন্য চোরাচালানীদের সমূলে উৎখাত করাটাই এখন আমাদের কাম্য।
দেশের বিভিন্ন সীমান্ত অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত খবরে আমরা জানতে পেরেছি যে, চোরাচালানীদের একটি সংঘবদ্ধ দল সক্রিয় রয়েছে। এবং এইসব অশুভ চক্রের সঙ্গে সমাজের প্রভাবশালী লোক, রাজনৈতিক নেতা এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একটা অচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। এইসব শক্তির ছত্রছায়ায় থেকেই চোরাচালানীরা সীমান্তে ব্যাপকভাবে চোরাচালান কর্মে লিপ্ত। চোরাচালানীদের খুঁটির জোর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করা দরকার। সীমান্ত প্রহরীদের সম্পর্কেও নানা রকম অভিযোগ আমরা শুনতে পাই। কাজেই অসৎ সীমান্ত প্রহরী দিয়ে আর যায় করা যাক না কেন, চোরাচালানীদের উৎখাত করা যাবে না। চোরাচালানীদের সঙ্গে যাদের যোগসাজশ রয়েছে এবং যাদের সহায়তায় চোরাচালানীরা সীমান্ত হীন কর্মের বেসাতি জাঁকিয়ে বসেছে, তাদের সম্পর্কেও সরকারকে সদাজাগ্রত থেকে বাস্তবানুগ ব্যবস্থা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আমাদের মনে হয় চোরাচালান রোধের ব্যাপারে সীমান্ত এলাকায় জনসাধারণের সহযোগিতাও একান্ত দরকার। চোরাচালানীরা সীমান্তবর্তী বাসিন্দাদের সহায়তায়ও এ কর্ম করে থাকে। সে জন্যই বলছি, সীমান্ত এলাকায় চোরাচালান বন্ধ করার জন্য গণপ্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সীমান্ত এলাকার লোকজনকে সংঘটিত করে চোরাচালানীদের ধরার জন্য সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিটি সৎ নাগরিককেই চোরাচালান বন্ধে আইন রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের সার্বিকভাবে সহায়তা করতে হবে। নইলে চোরাচালান যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থেকে যাবে। কোন নব্য পন্থাই এ ঘৃণ্য বেসাতির অবসান ঘটাতে পারবে না। আমরা সীমান্তে চোরাচালান বন্ধের জন্য কি কৌশল নেয়া হয়েছে, তা জানতে চাই না। আমরা চাই সীমান্তে চোরাচালান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার জন্য কার্যকরী কিছু করা হোক।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক