You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.02.24 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | প্রগতি ও শান্তির পথ প্রশস্ত হোক | শান্তির শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৪শে ফেব্রুয়ারী, রোববার, ১২ই ফাল্গুন, ১৩৮০

প্রগতি ও শান্তির পথ প্রশস্ত হোক

বাংলাদেশ প্রশ্নে মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অবশেষে সত্যের কাছে আত্মনিবেদন করতে হলো। তিনি বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিলেন। স্বীকার করে নিলেন দক্ষিণ এশিয়ায় এই রাষ্ট্রটির সার্বভৌম অস্তিত্ব। পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য গভর্নর ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের এক যৌথ সভায় তিনি গত ২২শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা কালে বলেন এই স্বীকৃতি দান ছাড়া “আমাদের বাংলাদেশের ভাইদের” সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের আর কোন বিকল্প পথ নেই।
মিঃ ভুট্টোর বোধটা নূতন হলেও বক্তব্যটা পুরনো। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের হয়ে এসে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ভাষায় কথা বলেছিলেন, বৈরিতা নয় বরং সবার সঙ্গে বন্ধুত্বই আমাদের কাম্য। বিশ্বে বিশেষ করে আমাদের এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের একটি অত্যাবশ্যকীয় পূর্ব শর্ত। আর সেই উপলব্ধি থেকেই বাংলাদেশ, ভারত তথা উপমহাদেশের শান্তিকামী মানুষ তিনটি দেশের মধ্যে সার্বভৌমত্ব ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। বাংলাদেশ ভারত যুক্ত ঘোষণায় যে স্বদিচ্ছা প্রকাশ পায় তার বাস্তব প্রতিফলনও ঘটে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে লোক বিনিময়ের মাধ্যমে। সিমলা ও দিল্লি চুক্তি যোদ্ধা বন্দিবিনিময়ের পথ প্রশস্ত করে, ধাপে ধাপে এগিয়ে চলে শান্তিকামী প্রগতিশীল মানুষের জয়যাত্রা। বাধা এসেছে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির প্রয়াস চলেছে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্তকারীদের তরফ থেকে। ভুট্টোও খেলেছেন তাদের হাতে। লোক বিনিময় মন্থরতা, এ তাদেরই অন্যতম কৌশলী চাল। এই সেদিনও এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো শর্ত আরোপ করেছিলেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে। শর্ত তাকে তুলে দিতে হয়েছে, চাল-চক্রান্ত গুলোরও একদিন অবসান হবে আর সেই সম্ভাবনার পথেই শুরু হবে আমাদের নূতন জয়যাত্রা।
পাকিস্তান বাংলাদেশকে শর্তহীন স্বীকৃতি প্রদান করেছে। গত ক’দিনে কূটনৈতিক তৎপরতা এই পথেই অগ্রসরমান ছিলো। মুসলিম প্রধান দেশ গুলো স্বাভাবিকভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ইসলামিক সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের অপরিহার্যতার কথা। তারা সেটাকেই সম্ভব করে তোলার জন্য ছিল আগ্রহী। উপমহাদেশে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশকে মেনে নেয়ার আবশ্যকতা সম্পর্কে শান্তিকামী প্রগতিশীল মানুষের প্রতিধ্বনিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কন্ঠে। তারা ১৯শে ফেব্রুয়ারি অনতিবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি আহ্বান জানায় পাকিস্তানের কাছে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষের এই আহ্বান ও বাস্তববোধ থেকে মিঃ ভুট্টো অবশেষে মুখ ফিরিয়ে রাখতে ব্যর্থ হন।
আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলনে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনের যে প্রচেষ্টা কথা উল্লেখ করা হয়েছিল আমরা আশা করব বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এই দুই উন্নয়নশীল দেশের পারস্পরিক স্বীকৃতি লাভের পর তা বাস্তবায়নে অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকবে। বাংলাদেশ একটি জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে আলজিয়ার্স সম্মেলনের বক্তব্যকে স্বীয় বক্তব্য হিসেবে মনে করে। পাকিস্তান জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র না হলেও উন্নয়নশীল একটি দেশ। অন্যান্য উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের মতোই সেখানকার জনসাধারণের ভাগ্যোন্নয়ন তথা সমৃদ্ধি অর্জনে তাকে অবশ্য উন্নয়নশীল প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সদ্ভাব বৃদ্ধিতে আগ্রহী হতে হবে। আমরা শান্তির স্বার্থে, প্রগতির স্বার্থে এবং সাধারণ মানুষের সমৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থেই তা কামনা করি। উপমহাদেশের তিনটি রাষ্ট্র সেই শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধি অর্জনে আন্তরিকভাবেই পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের সচেষ্ট হবেন সেটাই আশা করা যায়।

শান্তির শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

সম্প্রতি সোফিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের সমাপ্তি অধিবেশনের এক প্রস্তাবে বিশ্বের শ্রমিক, বিজ্ঞানী, সংস্কৃতিকর্মী, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক দল এবং বিশ্ব শান্তির জন্য সংগ্রামব্রত শান্তি ও গণতন্ত্রের জন্য কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ইতিহাসের এক চরমতম যুগসন্ধিক্ষণের শান্তি পরিষদের আহবানে বলা হয়, বিশ্বের শান্তি ও প্রগতিবাদী শক্তির ঐক্য প্রতিষ্ঠার ফলশ্রুতিকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব সকলের উপর অর্পিত হয়েছে। ঠান্ডা লড়াই থেকে আন্তর্জাতিক উত্তেজনা প্রশমনের পথে বিশ্ব এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন সামাজিক পদ্ধতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি আজ নতুন সম্ভাবনার ভরপুর হয়ে উঠেছে। ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক, বিজ্ঞান ও কারিগরি ক্ষেত্রেও সহযোগিতার অগ্রগতি।
১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে মস্কোতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের কংগ্রেসে শান্তির স্বপক্ষে কর্মসূচি নেয়া হয়, তা ইতিমধ্যেই অনেকখানি সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। এতে পরিষ্কারভাবে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্দেশ্য প্রকাশ করা হয়েছিল।
সম্মেলনে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলি হামলার মার্কিনী সহযোগিতার নিন্দা ও প্যালেস্টাইনী আরব জনগণের অধিকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। এছাড়া চিলির সামরিক জান্তার অপরাধমূলক কার্যকলাপের অবসান কামনা করা হয়।
বিশ্বের প্রগতিবাদী ও শান্তিকামী এবং শান্তি ও প্রগতির জন্য সংগ্রামে নিয়োজিত রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রতি বিশ্ব-শান্তি পরিষদ যে আহ্বান জানিয়েছেন তা অত্যন্ত সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ এতে দ্বিমত সৃষ্টির অবকাশ নেই। কেননা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আর্থিক উন্নয়নের পূর্ব শর্তই হলো নিরবচ্ছিন্ন শান্তি। যুদ্ধের উত্তেজনার মধ্যে প্রগতির চিন্তা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর অন্যতম লক্ষ্যই হলো বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঠান্ডা লড়াই যুদ্ধের ইন্ধন জোগানো। পশ্চিম এশিয়ার সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার মাটিতে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের মধ্য দিয়েই উপলব্ধি করা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী মুখে শান্তির ললিত বাণী উচ্চারণ করুন না কেন কথা ও কাজের সমন্বয় সাধনের উদ্যোগ নিতে ওরা নারাজ। এটা ওদের ধাতে সয়না সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই শান্তির শত্রু প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব শান্তিকামী মানুষের উপর অর্পিত। এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট, শান্তিকামী জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে ওরা বিষাক্ত নখ থাবা থেকে বের হতে ভয় পায়। পিছিয়ে যায়। যেমনটি পিছু হটতে হয়েছে ভিয়েতনামের মাটিতে।
বিশ্বের শান্তিকামী জনতা ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মূল লক্ষ্যই হবে শান্তি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। অর্থনীতি, সামাজিক, রাজনৈতিক পার্থক্য থাকা সত্বেও একদিন সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের সেতুবন্ধ রচনা করে এগিয়ে যাবে প্রগতির পথে। প্রগতির জন্য তুলে ধরতে হবে শান্তির শ্বেতশুভ্র পতাকাকে। আজকের দিনে একথা যে শুধুমাত্র শ্লোগানেই নয় তার বিস্তারিত বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও -এই সত্য নিহিত রয়েছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি।
বিশ্ব শান্তি পরিষদ সম্মেলনে যে ডাক দিয়েছেন বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ তাতে অবশ্যই সাড়া দেবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ মনে প্রানে শান্তিকামী। সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণের পাশে বাংলাদেশ অতীতে ছিল, আজও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের শান্তিকামী জনতার সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন