You dont have javascript enabled! Please enable it!

1971.03.27 | মুক্তিযুদ্ধের ডায়রি থেকে | ডঃ তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীর বিক্রম

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩০ মার্চ ১৯৮৪

(১৯৭১ সনে আমি মেহেরপুরের এসডিও ছিলাম। প্রথমে অনেক আগ্রহ নিয়ে ডাইরি লিখতে শুরু করি। পরে সময়াভাবে কালেভাদ্রে লিখেছি। এই লেখাটা সেই ডাইরির অংশবিশেষ।)
২৭ শে মার্চ ১৯৭১ সালঃ২৫ শে মার্চ রাত ১১ টার সময় ফোন পেলাম এম এন এ জনাব মহিউদ্দীন এর কাছ থেকে।দেখা করতে চান আমার সাথে আমার বাসায় এসে জানালেন যে কুষ্টিয়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জের লোকেরা জানিয়েছে ঢাকায় বড় রকম গন্ডগোল হতে যাচ্ছে। ভুট্টো ও ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছে আমি সাথে সাথে থানায় গেলাম পুলিশের অফিসারের সাথে আলাপ করলাম পুলিশের ওয়ারলেস এ। ঢাকার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালালাম হঠাৎ একবার রাজারবাগ পেলাম একজন বলল ‘ঢাকার সব শেষ হয়ে গেল’ আমরা বিশদ জানতে চাইলে সে বলল আমি আর কিছু বলতে পারব না এরপর অনেক চেষ্টা। করেও তার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারিনি।
আনসার অ্যাডজুটেন্ট কে বললাম বললাম আজ রাতেই সব আনসারদের জোগাড় করতে। সারা শহরের লোকজন দিয়ে ডেকে উঠানো হলো যার যা অস্ত্র আছে তা নিয়ে তৈরি হতে বললাম।
ওই রাতে কিছু ছাত্ররা রওয়ানা দিল খলসা কুন্ডি ব্রিজ নষ্ট করতে লোকজনদের বলা হলো চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়া রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে ও পাহারা দিতে।
ভোরের মধ্যেই আনসারদের জোগাড় করে রাইফেল দিয়ে দেয়া হলো রাস্তায় অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হলো আনসার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে রওয়ানা দিল।দুপুর নাগাদ আমি সরেজমিনে তাদের তদারক করে এলাম।
আমাদের কাছে গোলাবারুদ খুবই অল্প ছিল তাই প্রত্যেক আনসারকে ৫ থেকে ১০ রাউন্ড গুলি দেওয়া হল।
আজ (২৭ শে মার্চ) ৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী ইপিআরের সেপাই ও এক জন বেসামরিক লোক কে সাধারণ লোকেরা ধরে নিয়ে আসে আমি তাদেরকে হাজতে পাঠিয়েছি।
আমরা মাঝে মাঝে মেজর খালেদ মোশাররফের বিজ্ঞপ্তি শুনছি তা দিয়ে ঘটনার একটা আন্দাজ রাখছি।
আজকে আমরা ইপিআরের সেক্টর কমান্ডার মেজর ওসমানের সাথে চুয়াডাঙ্গা টেলিফোনে কথা বললাম। ইপিআর আনসার ও মুজাহিদ নিয়ে কুষ্টিয়া আক্রমণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা ও মিরপুরের দিক থেকে কাল দুপুরের মধ্যে আমি একশ জন আনসার রাইফেলসহ পাঠাবো চুয়াডাঙ্গাতে।
ভারত থেকে কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ জোগাড়ের চেষ্টা করছি এখনো ওদের কাছ থেকে খবরের অপেক্ষায় আছি।
আমার সব অফিসারদের নিয়ে একটা মিটিং করে সবার নতুন দায় দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলাম।
২৮ মার্চ ১৯৭১ঃ ফরিদ ওর বউকে নিয়ে আমার এখানে আটকা পড়েছে। ওদের চুয়াডাঙ্গা পর্যন্ত পৌছে দিয়ে আমি মেজর ওসমানের সাথে দেখা করেছি। উনি এখন সব কিছুর দায়িত্বে কুষ্টিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা করছেন।
যুদ্ধের জন্য আমার সমন্বয়ে খুব দুর্বল এটা কারও দোষ না। মেজর ওসমান হেডকোয়ার্টার থেকে সবকিছু করছেন। তাকে সাহায্য করছেন ক্যাপ্টেন আজম চৌধুরী। Wireless আমাদের একমাত্র সম্বল। তাও গুটি কয়েক জায়গায় আছে ।আমি মেজর ওসমানকে পরিকল্পনা করতে সাহায্য করছি তাছাড়া সরঞ্জাম জোগাড় করা কম কথা নয়।
যদিও আমি সব কয়টা সীমান্ত ফাঁড়ি খালি করে সব ইপিআর-এর লোক একসাথে করার পক্ষপাতি কিন্তু মেজর ওসমান কিছু লোক ফাড়িগুলোতে রাখতে চাইলেন।
আগামীকাল ভোর চারটায় কুষ্টিয়া আক্রমণ করার কথা। দুদিক দিয়ে কুষ্টিয়ার তিন মাইল দূরে বারখান্দাতে আনসার ও ইপিআর যোগ দেবে। এদিকে অন্য একটা আক্রমণ হবে ঝিনাইদহের দিক থেকে। মাহবুব তার নেতৃত্ব দিচ্ছে। ক্যাপ্টেন আজম পুরো আক্রমণের দায়িত্বে আছেন। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের বিজয়ী করবেন এই অত্যাচার ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে।
আজ দুপুরেই আমার ১০০ জন আনসার নওয়াপাড়া পৌঁছে গেছে মেহেরপুর এলাকার ইপিআর জওয়ানরা চুয়াডাঙ্গা রওয়ানা দিচ্ছে ।

নদীয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। খবরও পাঠিয়েছি আশা করছি যে কোন সময় উত্তর পাবো। আমি বুড়িপোতা সীমান্ত ফাঁড়িতে আজ অপেক্ষা করেছিলাম খবর এলেযে ভারতের BSF (Border security force) বর্ডার তাদের উর্ধতনদের নির্দেশের অপেক্ষায় আছে।
কুষ্টিয়ার কিছু গোলাগুলির খবর এসেছে। লোকজনের মনোবল চরমে।
আমি underground base-এর কথাও চিন্তা করছি। যদি যুদ্ধে হেরে যাই! আজ রাত ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কাটবে. অনেক কাজ আজকাল দুটো অস্ত্র সাথে নিয়ে ঘুমাই।
২ ৯মার্চ১৯৭১ঃ কুষ্টিয়া আক্রমণের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।৩০ তারিখ ভোর পাঁচটায় আক্রমন করা হবে।
আমাদের কাছে খবর এসেছে খুলনা ও যশোর পতনের আশা করছি খবরটা যেন সত্যি হয়।
মাহাবুব ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছে চিঠি পাঠিয়েছে।
আজ বেতাই সীমান্ত ফাঁড়িতে BSF-এর ক্যাপ্টেন ইয়াদভ এর সাথে দেখা হলো।আমাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের যা প্রয়োজন তার একটা হিসাব তাকে দিলাম। ও জানালো যে সে তার উপরওয়ালাদের কাছে পাঠিয়ে দেবে। BSF-এর উর্দ্ধতন লোকদের সাথে একটা সাক্ষাতের বন্দোবস্ত হলো।
আমার চিঠিটা ভারতের যুগান্তর কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বেরিয়েছে। দিল্লিতেও নাকি এগুলো পৌঁছে গেছে।
আজকে বেতাই সীমান্ত ফাঁড়িতে স্টেটসম্যান অমৃতবাজার ও আরো কিছু কাগজের সাংবাদিকরা কলকাতা থেকে এসেছিলেন আমার সাক্ষাৎকার নিতে। গোপনীয়তা রক্ষার জন্য আমি তাদের সাথে আলাপ করিনি।
টেলিফোনে কলকাতার অবস্থানরত BSF-এর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে আলাপ হলো। তিনি ক্যাপ্টেন ইয়াদভের সাথে আমার আলাপ হয়েছে কিনা সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে চাইলেন।
৩০ শে মার্চ ১৯৭১ঃক্যাপ্টেন ইয়াদভ মিস্টার মুখার্জি (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নদীয়া)বর্ণালী চক্রবর্তী (কমান্ডার বিএসএফ) এদের সাথে সকাল সাড়ে ১১ টায় দেখা হল বেতাই সীমান্ত ফাঁড়িতে।আমাকে গার্ড অব অনার দিল অস্ত্রশস্ত্রের আলাপ হলো।
কর্নেল চক্রবর্তী, গেলক মজুমদার (ডেপুটি ডিরেক্টর বিএসএফ) দেখা করলেন সন্ধ্যে সাড়ে ছয়টায় চৌখালী চেকপোষ্টে। আমার সাথে জনাব তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও মাহবুব। ‘A day of coincidence’ ভোর পাঁচটায় মেহেরপুর ফেরত আসলাম।
৩১ শে মার্চ ১৯৭১ঃটঙ্গী সীমান্ত ফাঁড়িতে বিকাল ৬ টায় পৌছালাম। পাঁচটা ট্রাকে করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ভোরবেলা চুয়াডাঙ্গা এলাম।
১ লা এপ্রিল ১৯৭১ঃ সকাল সাড়ে দশটায় মেজর ওসমান ডেকে পাঠালেন। চৌখালী চেকপোষ্টে Bravo-এর (জনাব তাজউদ্দিন)সাথে আলাপ হল। বিশেষ করে ঝিনাইদহ আক্রমণ নিয়ে মেজর ওসমান তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন চুয়াডাঙ্গায়। হেডকোয়ার্টার্সের কেউ না থাকায় একটা panic সৃষ্টি হয়েছে ওখানে।
আমাদের জওয়ানদের ভারতীয় ব্রেন গানে ট্রেনিং নেওয়া পর্যন্ত আমি আর মাহবুব অপেক্ষা করলাম তারপর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চুয়াডাঙ্গা রওয়ানা দিলাম
রাত আটটার দিকে মাহবুব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝিনাইদহ চলে গেল আমরা ঝিনাইদহ-যশোর ফন্টে যুদ্ধের ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণ করছি পরে খবর এলো যে সৈন্যরা পালাতে শুরু করেছে।
আজ মাহবুব ও মেজর ওসমান কি একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
[এ সময় থেকে আর ডাইরি নিয়মিত লিখতে পারিনি।।
২৯ এপ্রিল কুষ্টিয়ার পতন হয় দুই কোম্পানিও অধিক Reconnaissance and Support Battalion এর পাকসৈন্যরা চরম পরাজয় বরণ করে। আতাউল্লাহ বন্দী হন কিছুসংখ্যক ৫০ হয়তো পালিয়ে যশোর পৌঁছায়। বাকি সবাই যুদ্ধে নিহত হয় ৩৫ গাড়ি অস্ত্র-গোলাবারুদ আমাদের দখলে আসে]

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!