You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.28 | একাত্তরের যুদ্ধঃ হানাদার বাহিনীর বন্দিশিবির | মেজর এম জাহাঙ্গীর হোসেন | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২২ মার্চ ১৯৮৫ - সংগ্রামের নোটবুক

একাত্তরের যুদ্ধঃ হানাদার বাহিনীর বন্দিশিবির | মেজর এম জাহাঙ্গীর হোসেন

সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২২ মার্চ ১৯৮৫

(অস্পষ্ট) । সকাল আনুমানিক নয়টা। হঠাৎ গোলাগুলির তীব্র আওয়াজে কেঁপে উঠল যশোর সেনানিবাস। আমাদের ৭ ফিল্ড এম্বুলেন্সের কাছাকাছি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইউনিট থেকেই রাইফেল, এল এম জি এস এম জি প্রভৃতি আগ্নেয়াস্ত্রের মুহুর্মুহু আওয়াজ ফেটে পড়ছিল। ২৫ শে মার্চ এর কাল রাতে পূর্ব বাংলার আপামর নিরীহ নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল নারকীয় হানাদার বাহিনী। আত্মহুতি দিলে লক্ষ প্রাণ। ডুকরে কেঁদে উঠল জীবন বাস্তব মানবতা। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা জয়দেবপুর সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে। (অস্পষ্ট)।
সকাল ৮ টায় আমাদের ইউনিট অস্ত্রাগার থেকে সশস্ত্র পশ্চিমা সৈন্যরা অস্ত্রগুলো ট্রাকে করে নিয়ে চলে গেছে। সৈনিকদের পান্ডুর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না। ‘স্যার, আমাদের কাছ থেকে যখন ওরা হাতিয়ার ছিনিয়ে নিয়ে গেলো তখন আর আমাদের সৈনিক জীবনের মূল্য রইলো কোথায়’? এই ছিল তাদের দারুন ক্ষোভ ও অভিযোগ। ভীষণ উৎকণ্ঠা ও চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হল সৈনিকদের মাঝে। সেই সময় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে আসে ২৭ বেলুচ। ব্রিগেডিয়ার এস এ দুররাণী বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জলিলকে সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ ২৭ বেলুচকে অর্পণ করার নির্দেশ দিলেন। ব্যাটালিয়ন ফ্লাগ নামিয়ে ফেলা হলো। ঐ রাতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা এক্সারসাইজ থেকে ফিরে আসে। ভোরেই আবার বাইরে যাওয়ার নির্দেশ অনুযায়ী প্রস্তুত হচ্ছিল। কিন্তু অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করে নিয়েছিল পশ্চিমা সৈন্যরা। সুবেদার-রোকনউদ্দিন প্রথমে কুড়াল দিয়ে অস্ত্রাগারের দরজা ভেঙে ফেলেন। কয়েক মুহুর্তেই গোলাবারুদ বাঙালি সৈনিকদের হাতে এসে গেল। ৭ ফিল্ড আম্বুলান্স এর সৈনিকরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যোগ দিয়ে বীরত্বের সাথে মোকাবিলা শুরু করল। মর্টার, মেশিনগান, কামানের গুলি বর্ষণে দিক বিদিক কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এরই মধ্যে আমাদের অফিস ঘরের উপর বৃষ্টির ধারার মতো গুলিবর্ষণ শুরু হয়ে গেল। সামনে ২৭ বেলুচ পিছনে ২২ এফএফ এবং অন্যান্য দিক থেকে ক্রস ফায়ারিং এর মধ্যে অফিস ঘরের মধ্যে আমরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়লাম কয়েকজন সৈনিকসহ ৮/৯ জন অফিসার। গোলাগুলির আঘাতে ভীষণভাবে কেঁপে কেঁপে উঠেছিল গোটা ঘরটা। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল বিল্ডিংটি বিধ্বস্ত হয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে এবং আমাদের প্রাণের স্পন্দন চিরদিনের মতো ভাঙাচোরা ইট-সুরকির নিচে নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। ক্যাপ্টেন কে এম ইসলাম (বর্তমানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) এবং আমি বাইরের পাশে যে ঘরটাতে আটকা পড়ে ছিলাম গোলাগুলির আঘাতে সেটা প্রায় ধ্বসে পড়ার উপক্রম হল। সেখানে দেয়াল সেটে শুয়ে প্রতিমুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় দুই ঘন্টা কাটালাম। আর থাকা সম্ভব হলো না ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ও ভগ্নপ্রায় এ ঘরে। লাফিয়ে ভিতরের সংলগ্ন দরজার ছিটকিনি খুলে ভিতরে ঢুকলাম। প্রথমে নজরে পড়ল সেলে আহত বেঙ্গল রেজিমেন্টের যন্ত্রণাকাতর এক সৈনিককে। মুখ ও শরীরের অধিকাংশ জায়গায় পুড়ে গেছে। আমাদের অফিসার এবং কয়েকজন সৈনিক করিডোর এবং সিও ও টু-আই-সি অফিসের মেঝেতে অজানা আশঙ্কা এবং দারুণ উৎকণ্ঠার সাথে প্রতিমুহূর্ত গুনছিলেন। আমাদেরকে এতক্ষণ পর ভিতরে ঢুকতে দেখে সকলে আশ্বস্ত হলেন। অধিনায়ক কর্নেল হাই কে বারবার কম্পিত কন্ঠে টেলিফোন করে দেখছিলাম ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য কিছু কৃত্রিম আশ্বাসবাণী ছাড়া আর কিছুই হলো না। মর্টারের আঘাতে ছাদ ফেটে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল। বারবার করে ঝরে পড়ছিল ইটের টুকরো ও চুন সুড়কির গুড়ো। সঙ্গে কাচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ছিল এদিক-ওদিক।বেলা আনুমানিক আড়াইটার দিকে গোলা বর্ষণ‌ থেমে গেল সুযোগমতো বাঙালি সৈনিকদের পশ্চাদাপসরণ করে সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হল। এদের সাথে ছিলেন লেফটেন্যান্ট হাফিজ (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত মেজর)। লেঃ আনোয়ার মণ্ডলসহ শহীদ হলো অনেক সৈনিক। ধরা পড়ল অনেকে বর্বরদের হাতে। পাশবিক উল্লাসে উন্মত্ত পশ্চিমা সৈন্যরা আমাদের অফিস ঘরের চারদিক ঘিরে পজিশন নিল।
এবার কাছে থেকেই গুলি বর্ষিত হচ্ছিল আমাদের ঘরের মধ্যে। বাইরে বহু উন্মত্ত কন্ঠের হুংকার ‘আনদার কৌন হ্যায় বাহার নিকলো। হাতিয়ার ডাল দো। নেহিতো গলিমারকে খতম কার দেংগে’। আমরা স্থির নিশ্চিত ছিলাম এই আমাদের জীবনের চরম মুহুর্তে। বাইরে থেকে দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করছে তারা। কেঁপে উঠল কর্নেল ভাইয়ের গলা -‘ এখানে এভাবে থেকেও তো রক্ষা নেই। ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলবেই। তবুও চলুন সবাই বেরিয়ে যাই। কপালে যা আছে তার সম্মুখীন হতেই হবে। হ্যান্ডস আপ অবস্থায় সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। সর্বকনিষ্ঠ অফিসার হিসেবে আমি সবার পিছনেই ছিলাম। কর্নেল হাইয়ের নির্দেশমতো ক্যাপ্টেন শেখকে দেখলাম শুধুমাত্র ছিটকিনি পর্যন্ত হাত উঠাতে। সেই সাথে সাথে দড়াম করে দরজা খোলার শব্দ অস্ত্রধারী কয়েক জনের ভিতরে প্রবেশ কর্নেল হাই ও ক্যাপ্টেন শেখের গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মেঝেতে পড়ে যাওয়া ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে কিসের এক ধাক্কায় সিওর অফিসে আমাদের ছিটকে পড়া মুহূর্তের মধ্যেই যেন ঘটে গেল সব কিছু। একটু প্রকৃতির ছোঁয়া হয়েছে দেখি সটান শুয়ে আছি কক্ষটির উত্তর দেয়ালের সাথে গাঁথা তাকের নিচে। লেফটেন্যান্ট নুরুল আলম (বর্তমানে ক্যাপ্টেন অবঃ) লেঃ আমিন (শহীদ) ও একজন জোয়ানের চাপে আমার তখন আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। দক্ষিণ দেয়াল ঘেঁষে স্টিলের আলমারিটার আড়ালে ছিলেন মেজর সুলতান (বর্তমানে কর্নেল) ও লেঃ ফাহিম (বর্তমান লেঃ কর্নেল)। মেজর শাহাবুদ্দিন (বর্তমানে কর্নের অবঃ) ক্যাঃ খন্দকার নূরুল ইসলাম প্রমুখ আরও তিন চারজন করে পাশের একটা কামরাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এবার আমাদের কামরার পশ্চিম দিকে জানালা বরাবর মাত্র কয়েক গজ দূরে তৎকালীন নির্মীয়মাণ সি এম এইচ বিল্ডিংয়ের পিছনের চত্বরে পজিশনে নিয়েছে ২২ এফএফ রেজিমেন্টের সৈন্যরা। লেঃ মমতাজের নির্দেশে তারা জানালা দিয়ে সরাসরি আমাদেরকে গুলিবর্ষণ শুরু করলো। বিপরীত পাশের দেয়ালে ও কাঠের দরজায় বিধে যাচ্ছিল গোলাগুলি। গোলার টুকরো, ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে পড়ছিল এদিক সেদিক। ছোট একটা পাপোষ এবং ছোট একটা টিপয় জানলার দিকে আড়াল করে ধরে জীবন বাঁচাবার চেষ্টা করছিলাম। প্রতিমুহূর্তে কাটছিল মৃত্যুর আশঙ্কায়। লেঃ মমতাজ চিৎকার করে ক্যাঃ শেখকে উদ্দেশ্য করে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিচ্ছিল। কিন্তু ক্যাপ্টেন শেখ ও কর্নেল হায় ততক্ষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। করিডোরে রক্তপ্লাবিত মরণোন্মুখ দুটো মানুষের করুণ কাতর আর্তধ্বনি শেষবারের মতো আমাদের কানে এসেছিল। তারপর সব স্তব্ধ। ‘ডোন্ট কিল আস উই আর ডক্টরস’ -কর্নেল হাইয়ের এই শেষ অনুরোধও বর্বর পশুদেরকে নিরস্ত্র করতে পারেনি। স্বামীর জন্য মিসেস শেখের প্রতীক্ষার অবসান আর কোনও দিন শেষ হবে না। কর্নেল হাইও আর কোনও দিন ফিরে যাবেন না তার পরিবার পরিজনদের কাছে। আচমকা ডান উরুতে তপ্ত গুলির আঘাত ঝাকুনি দিয়ে উঠলো শরীরটা। উরুতে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। মাঝে মাঝে মাইক্রোফোনে আত্মসমর্পণের নির্দেশ আসলেও আমরা দরজা খুলি নি। জানি আগের নাটকের পুনরাবৃত্তিই হবে। তবুও যত সময় জীবন টাকে ধরে রাখা যায়।
আনুমানিক বেলা ছয়টায় কক্ষটির একমাত্র দরজার উপর আঘাত পড়ল। ‘দরওয়াজা খোল দৌ’ তীক্ষ্ণ স্বরে চিৎকার করে উঠল দস্যু সেনারা। ভাবলাম আর একটা মুহূর্ত মাত্র। ছিটকিনিতো খুলে দিতেই হবে। তারপর ওরা আমাদেরকে মেরে ফেলবেই। লেঃ ফাহিম দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে ছিটকিনি খুলে দিল। সামনে চকচক করে উঠল উদ্ধত এলএমজির নল। গান পয়েন্টে আমাদেরকে বের করে নিয়ে এলো সামনের খোলা জায়গায়। পিঠে বহুবার গোলা উদগীরণকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের উষ্ণ নলের স্পর্শ। দীর্ঘ নয় ঘণ্টা ব্যাপী জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামের পর বাইরে আলো বাতাসের স্পর্শ পেলাম। কিন্তু কতক্ষণের জন্য? আমাদেরকে ঘিরে তাক করেছিল অনেকগুলো স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে। আর তার সাথে একজোড়া করে হিংস্র ও তীক্ষ্ণ চোখ। আমাদের ব্যাটম্যানরাও তার সাথে ছিল। তীক্ষ্ণ কন্ঠে আদেশ দেওয়া হলো ‘লেট যাও’ –বলির পশুর মত শুয়ে পড়লাম। অনুভূতি শক্তি যেন লোপ পেয়ে গেছে। ভয় হচ্ছিল না মোটেই। শুধু চোখদুটো বন্ধ করলাম। নিঃশ্বাস পড়ছিলো না। অনুভব করছিলাম এই মুহূর্তেই হয়তো অগ্নিপিণ্ডের মতো গুলি এসে প্রত্যেককে থেঁতলে পিষে স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে সুবেদারের ভারী গলার আওয়াজ কানে এলো। ‘ইউনিট মে লে চলো’। অসাড় দেহটাকে টেনে তুলে দাড় করালাম। ওরা আমাদেরকে হ্যান্ডস আপ করিয়ে বেয়নেটের স্পর্শে ২২ এফ এফ-এর কোয়ার্টার গার্ডে এনে বন্দী করে রাখল। কোয়ার্টার গার্ড ২২এফ এফ-এর লেঃ রেজাউল করিমকে (বর্তমানে লেঃ‌ কর্নেল) আগেই বন্দি করে রেখেছে। আপাতত বাঁচলাম ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। একটু পানি চেখে শুষ্ক অন্তর আত্মাটাকে একটু ভিজিয়ে নিলাম। আমাদের পিছু পিছু একজন সৈনিক ও বেশকিছু বেসামরিক লোককে হ্যান্ডস আপ করিয়ে নিয়ে আসতে দেখলাম। তাদেরকে ঘাসের উপর উপুড় করে শোয়াতেও দেখেছি। জানিনা আজ ও তাদের উষ্ণ নিঃশ্বাস এ পৃথিবীর বুকে পড়ছে না সেই দিন তাদের বুকের রক্তে লাল হয়েছে সেনানিবাসের সবুজ দূর্বা চত্বর।
সন্ধ্যার অন্ধকারে ট্রাকে উঠিয়ে সশস্ত্র প্রহরায় আমাদের নিয়ে গেল ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে। ব্রিগেডিয়ার দুররানি কর্নেলহাট ও ক্যাপ্টেন শেখের মৃত্যুর জন্য কৃত্রিম সান্ত্বনার বানী শুনাতে ভুললেন না। আমার আহত স্থানের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা হলো না। গোলাগুলির আওয়াজ তখনও হচ্ছিল। তাই জানানো হলো হাসপাতালে যাওয়া তখন নিরাপদ নয়। সশস্ত্র প্রহরায় বিনিদ্র রাত ও এক সময় কেটে গেল অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে এবং অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে। সকালে সকলকে ওরা মেসে নিয়ে এলো। আমাকে নিয়ে এল সি এম এইচে। পথে মনে হচ্ছিল ড্রাইভার আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে গুলি করে চলে যাবে। হাসপাতালে পরিবেশ তখন উত্তেজনাময় ও চাঞ্চল্যকর। এয়ারপোর্টে সৈন্যদের ফ্যামিলি দেশে পাঠাবার ভীড়। হাসপাতালের স্টাফের সমস্ত বাঙালি অফিসার লেঃ কর্নেল কুদ্দুস (বর্তমানে কর্নেল অবঃ), মেজর ওবায়দুল হক (বর্তমানে লেঃ কর্নেল), মেজর খালেদ (বর্তমানে লেঃ কর্নেল অবঃ), মেজর এম এম আলী, মেজর হুদা (বর্তমানে লেঃ কর্নেল), এবং শফিউল ইসলাম (বর্তমানে কর্নেল), এবং লেঃ (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) হোসনে আরা খান সবাই দারুন উৎকন্ঠিত উদ্বিগ্ন। কোন নিশ্চয়তা নেই বেঁচে থাকার। যেকোনো মুহূর্তে ঘেরাও করে সবাইকে খতম করে দেওয়াটা একটুও তখন ওদের কাছে অস্বাভাবিক ছিল না। অপারেশন থিয়েটারে আমাকে নেয়া হলো। অবাঙালি সার্জিক্যাল স্পেশালিস্ট মেজর আসিফ আমার ডান উরুর থেকে স্পিন্টার বের করেন। ভর্তি করা হল আমাকে। একই ওয়ার্ডে আহত পাঞ্জাবি অফিসারও ছিল। অফিসার ও সৈনিকরা তাদের দেখতে আসছিলো। আর আমার উদ্দেশ্য ছুড়ে মারছিলো অশ্লীল গালিগালাজ -‘ইয়ে শালে বাঙালি আভিতক জিন্দা হ্যায়। ইসকো বিলকুল তাবা করদো।শালে নিমক হারাম তোমনে হাতিয়ার উঠায়া?’
ঢাকা থেকে আগত অফিসাররা বড় আত্মতৃপ্তির সাথে তাদের জঘন্য কীর্তি গল্প আউড়িয়ে যাচ্ছিল। ঢকে মে শহীদ মিনার, রোকেয়া হল বিলকুল মিট্টিমে সধ মিলা দিয়া, সব কুছ তাড়া করদিয়া ‘ইত্যাদি’। অন্ধকার রাত গুলোকে মূর্তিমান বিভীষিকার মত মনে হচ্ছিল। হাসপাতালও নিরাপদ মনে হলো না। কয়েক দিন পরে চলে এলাম ম্যাচে। ভাবলাম মরতে যদি হয় বাঙালি অফিসারদের সাথে একত্রে মরবো। নিজস্ব রুমে উঁকি দিয়ে দেখি কিছুই নেই। জি/৪ এ ঢুকে মেঝেতে ঢালাই চাদর পেতে দারুণ আশঙ্কার সাথে সবাই মুহূর্ত কাটাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার কোন ঠিক ছিল না। ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান (বর্তমানে লেঃ কর্নেল) তার পাঞ্জাবি ব্যাটম্যান আজফ্বারকে দিয়ে খাবার আনানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। যৎসামান্য কিছু রুটি ও ডাল আমাদের জন্য পাঠানো হতো। চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে এমনি দুই এক দিন কাটার পর ইঞ্জিনিয়ার্সের মেজর কমর, ক্যাঃ ইউসুফ ও আরও কয়েকজন সৈনিককে নিয়ে আমাদের দেখতে আসে। বর্তমানে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার অজুহাত দেখিয়ে দুই তিন জনকে এক এক রুমের সশস্ত্র প্রহরায় বন্দী করল। জি-১১ রুমে ঢুকলাম আমি এবং ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান, লেঃ মান্নান (বর্তমানে ক্যাঃ অবঃ ও শিশু বিশেষজ্ঞ) ও লেঃ গোলাম নবী (অবসরপ্রাপ্ত)। পাশেই জি-১২ তে ঢোকা হলো মেজর শাহাবুদ্দিন লেঃ আমিন ও লেঃ নুরুল আলমকে। বাইরের সাথে সংযুক্ত বাথরুমের দরজার উপর বাইরের থেকে বড় তক্তা মেরে সটান এটে দেয়া হল। পিছনের দিকের ঝোপঝাড় কেটে সাফ করে সিকিউরিটি বাল্ব জ্বালিয়ে রাখা হলো। সান্ত্রীকে নির্দেশ দেওয়া হলো -‘কৈ আদমি বাহার জানেকে লিয়ে কোশেশ করেগা তো গোলী মারদৌ’। তাছাড়া কোন পর্দা রাখতে দিত না এবং আলোও নিভাতে দিত না সান্ত্রী। দয়া পরবশ হয়ে ক্যাঃ জামানের সেই ব্যাটম্যান আজফারই খাবার এনে দেয়। আমাদের চরম দুর্দিনে তাঁর এই মহৎ সেবার জন্য আমরা তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ। খাবার আসত দুই টুকরো শুকনো রুটি আর খানিকটা আধাসেদ্ধ ডাল। রাতের রুটি রেখে দিয়ে সকালে খেতাম। শুকনো রুটি পানির সাথে জোর করে গলার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতাম। বাঁচতে কে না চায়।
চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে নিজেদের পরিণতির কথা চিন্তা করে নিজেরাই শিউরে উঠতাম । সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ যেখানেই ঘটেছে সেখানেই ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা, ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রভৃতি নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক শাস্তিবিধানের ইতিহাস কারোও অজানা ছিলনা। আমাদের মৃত্যুও তো অবধারিত। তবে নিতান্ত যদি বাঁচিয়ে রাখে তবে ১০ বছর জেল তো হবেই এই সব ভেবে ভীষণ মর্মাহত হতাম। আবার এই ভেবে শান্তনা পেতাম যে, আমাদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে পূর্ব দিগন্তে সূর্য – দেশ হবে স্বাধীন। মাঝে মাঝে কালবৈশাখীর ঝড় ও বৃষ্টি হয়। এবারের কালবৈশাখী ঝড় যেন আরো রুদ্রমূর্তিতে এসেছে। ঝড়ের দাপট সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় অসংখ্য রক্তিম কৃষ্ণচূড়া লুটোপুটি খাচ্ছে। এ যেন এবারের মহাদুর্যোগ বিধ্বস্ত এ দেশের লাখো লাখো প্রাণের জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি।
আমাদের ধারণা ইন্টেলিজেন্স আমাদের উপর অকথ্য নির্যাতন করবে। ৩০ শে মার্চের ঘটনার জন্য সবার বিরুদ্ধে চার্জ তাদের তৈরি করাই আছে। স্টেটমেন্ট সাজিয়ে জোর করে সই নিয়ে নেবে। নতুন নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করে শারীরিক অত্যাচার চালাবে। নিজেদেরকে নিয়ে এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতির বেদনাদায়ক পরিণতির কথা যখন চিন্তা করছিলাম সেই সময় বাস্তবিকই নির্যাতনের শিকার হতে হল। সেদিন সকালে নাস্তার সামান্য রুটিটুকুও খেয়ে শেষ করে উঠতে পারিনি। দরজা খুলে গেল খট করে। হাতুড়ির ঘা মারলো যেন অন্তরের মধ্যে। গার্ড কমান্ডার এসে জানালো পাশের ঘরে যেতে হবে। ভাবলাম হয়তো এফ আই ইউ থেকে এসেছে ইন্টারোগেশনের জন্য। নিজে ও লেঃ মান্নান আগে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। পাশের রুমে যেয়ে দেখতে পেলাম কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে আমাদের অভ্যর্থনার জন্য। কারও হাতে হকিস্টিক, কারও হাতে বেল্ট, কারও হাতে রাইফেলের সিলিং এবং কারও কাছে নারকেল পাতার দন্ড তার দুপাশের পাতা অসমান ও তীক্ষ্ণ করে ছাটা। ‘লেট যাও’ হুংকার দিয়ে উঠল একজন জোয়ান। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম দুজন তারপর সমানে ডানে-বামে দুজনের প্রায় নগ্ন শরীরের উপর চলল কয়েকজন পশুর সমবে নগ্ন হামলা। আঘাতের পর আঘাত। হাড় গুলো যেন গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছিল। মাংস পাশাপেশি যেন দলা পাকিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল একটা থেকে আরেকটা। ফুলে ফুলে উঠেছিল গোটা শরীরটা। মুখে কাপড় দিয়ে ঢাকা যে ব্যক্তি বুকের পাঁজরে, তলপেটে, পিঠে বুট দিয়ে জোরে জোরে লাথি মার ছিলো তাকে ২২-এফ এফ-এর লেঃ মমতাজ বলে চিনতে আমাদের আদৌ ভুল হয়নি। হকিস্টিক, সিলিং-এর আঘাত পড়ছিল গিরায় গিরায়, পায়ের তলায় এমনকি মাথায়ও। অসহ্য যন্ত্রণায় প্রথম প্রথম আমাদের মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছিল গোঙানির আওয়াজ। একসময় চিৎকার করার শেষ শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেললাম। এক পর্যায়ে এসে প্রায় লোপ পেল সমস্ত অনুভূতি। শুধু এতোটুকু অনুভব করতে পারছিলাম যেন আমাদের আধমরা দেহ নিয়ে কাড়াকাড়ি আর ছেড়াছেড়ি করে চলেছে কয়েকটি হিংস্র শকুন। মারতে মারতে অনেককে মেরে ফেলে এমন কথাও শুনেছি। কিন্তু নিজেদেরকে সেই চরম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মরতে হবে তাকি কখনও ভেবে ছিলাম? এখানেই আমাদের জীবনের সমাপ্তি ঘটবে এছাড়া তখন বাস্তব সত্য বলে মনে করার আর কিছুই ছিলনা । ‘শালে বাংলাদেশ বানাওগে? শেখ মুজিব তোমহারা বাবা হ্যায়? উও তো ইন্ডিয়ান আর্মিমে জেনারেল থা। উসকো দাদা হিন্দু থা। আভি তুমকো বেয়নেটছে খতম করি দোঙ্গা’ -এই গালির সাথে সাথে মমতাজ মারছিল বুটের আঘাত। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ভাবছিলাম এই মুহূর্তে বুঝি তীক্ষ্ণ বেয়নেট পিঠে আমূল বিদ্ধ হবে। বর্বর পশুদের রুক্ষ কঠিন আওয়াজ ও আমাদের আর্তচিৎকারে সে এক বীভৎস দৃশ্যের অবতারণা করেছিল। ওরা আমাদের মাথাটা উঁচু করে ধরে সজোরে মাটিতে ঠুকে দিচ্ছিল। জীবনটা হয়তো ভিতরে ভীষণ দাপাদাপি করছিল বের হয়ে যাবার জন্য। কিন্তু তারা হয়তো আমাদেরকে একবারে না মেরে তিলে তিলে যন্ত্রণা দিয়ে মারতে চায় । তাই আধমরা দেহটাকে হেচড়াতে হেচড়াতে টেনে এনে পাশের ছোট অন্ধকারময় ঘরের ভিতরে ফেলে দিল। আমাদের জায়গায় আবার নিয়ে এলো মেজর শাহাবুদ্দিন লেঃ আমিনকে। এমনিভাবে ওদের নির্দয় আঘাতে পিষ্ট হলো ক্যাঃ নুরুজ্জামান, লেঃ তোফাজ্জল (বর্তমান লেঃ কর্নেল), গোলাম নবী ও লেঃ নুরুল আলম। থ্যাতলানো রক্তাক্ত দেহ তাকে ঠেলে ঠেলে এনে যার যার ঘরে ফেলে দিয়ে গেল কুকুরের দল। সাথে সাথে সমস্ত গায়ে এসে গেল ভীষণ উত্তাপ। সবার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জমাট বাঁধা রক্তের কালো দাগ ফুলে ফুলে উঠা শক্ত মাংসপিণ্ড। মেজর শাহাবুদ্দিনের দিবস ফ্রাকচার হয়ে গিয়েছিল। দুঃসহ বেদনায় ক’কিয়ে ক’কিয়ে উঠছিলেন তিনি। লেঃ নুরুল আলমের এলবো জয়েন্ট ডিসলোকেশন হয়ে গেল। দিয়ে গেল সেই রুটি ডাল। কিন্তু খাবে কে? জ্বর আর অসহ্য ব্যাথায় টনটন করছিল সমস্ত শরীর। এবারে আমাদের জীবনে বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশাটুকুও নিভে গেল নির্যাতনের সূচনা যখন একবার হয়েছে তখন ওরা আর আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে না। যখন তখন আমাদের তারা নতুন নতুন কৌশল প্রয়োগ করে নির্যাতন করবে। নখের মধ্যে সূচ ফোটানো, পায়ে জলন্ত সিগারেট চেপে ধরা, সাঁড়াশি দিয়ে দাঁত উপড়িয়ে ফেলা ইলেকট্রিক শক প্রভৃতি নানা প্রকার শারীরিক নির্যাতনের বিভীষিকা কল্পনা করে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম সকলে। রাতে পালাবার পথ খুঁজতে লাগলো সবাই। ধারণা হলো ওই রাতেই আমাদেরকে বেয়নেট চার্জ করে মারা হবে। বাঁচার তাগিদে চামচ দিয়ে জানালার স্ক্রু খোলার চেষ্টা ব্যর্থ হলো। পশ্চিমা অফিসাররা অপারেশনে যেয়ে কত মানুষ হত্যা করে এসে মদ খেয়ে মাতলামি করে আমাদের রুমের অপরপাশে। জানলা দিয়ে উঁকি দিয়ে মাঝে মাঝে অশ্লীল গালি দিতে থাকে আমাদেরকে। রাতের অন্ধকারের বুক চিরে ভয়-ভীতি যেন চারিদিক থেকে অক্টোপাশের মত কঠিন বন্ধনে বেঁধে ফেলে। আতঙ্কিত হৃদয় ঘড়ির প্রতিটি টিক টিক শব্দ অতিক্রম করতে হয়। অবস্থা এমনই ছিল যে গভীর রাতে জেগে এসে জানলা দিয়ে আমাদেরকে নির্বিঘ্নে খতম করে দিতে পারে। ক্ষত,বিক্ষত, থেঁতলানো শরীরের উপর আবার কোন মুহূর্তে পাশবিক অত্যাচার শুরু হবে এই আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠেছিলাম। তাই দ্বিতীয়বারের জন্য কিছুটা প্রস্তুতি নেওয়ার আশায় গার্ডের কাছে ব্যথা উপশমের জন্য অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট চাইলাম। এলার্জিতে ক্যাঃ জামানের সমস্ত শরীর ফুলে গেছে। তার জন্য আন্টিসটিন কেউ এনে দিল না। আমাদের দুঃসহ যন্ত্রণা দেখে পাঠান গার্ড কমান্ডার রাত প্রায় একটার দিকে চুপিসারে হট ওয়াটার বোতল এনে দিল। সান্ত্রীকে লুকিয়ে লুকিয়ে পিঠের নিচে চেপে ধরে অল্প অল্প তাপ লাগিয়ে নিলাম সবাই। মেজর শাহাবুদ্দিনের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেয়ার আবেদন গ্রাহ্যই করল না । আমার হেমাচুরিয়া (রক্ত প্রস্রাব) দেখা দিল। পরদিন থেকে খাবার বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিল‌ লেঃ মমতাজ। কিছুই খেতে দেয়নি সারাদিন। সন্ধার দিকে গতদিনের পরিত্যক্ত চামড়ার মত শক্ত রুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেলাম কয়জনে। রাত একটার দিকে সেই গার্ড কমান্ডার গোপনে পাক করিয়ে আধা সিদ্ধ চাল আর ডাল এনে দিল। বাস্তবিকই গার্ড কমান্ডারকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমাদের ছিল না। চুয়াডাঙ্গা থেকে পালিয়ে আসা ২৭ বেলুনের কয়েকজন সৈনিক আমাদেরকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল আর বিশ্রী রকম গালি দিচ্ছিল। ইপিআর পুলিশ ও ছাত্র জনতার দূর্বার আক্রমণের মুখে কোম্পানি কমান্ডার মেজর সোয়েবসহ ক্যাপ্টেন আসলাম, ক্যাপ্টেন সামাদ এবং প্রায় গোটা কোম্পানি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। হিংসাত্মক প্রতিশোধ নিশ্চয়ই তারা আমাদের উপর দিয়ে নেবেই। মরতে তো প্রস্তুত ছিলাম তবে অসহ্য অত্যাচারের পরিবর্তে গুলি করে আমাদের শেষ করে দিক সেই দাবি তাদের কাছে আমরা করেছিলাম।
দৈহিক নির্যাতনের পরদিনই ইউনিফর্ম পরিয়ে মেডিকেল কভারের জন্য লেঃ নুরুল আলম , লেঃ মান্নানকে বাইরে নিয়ে গেল। মেডিকেল কভার শেষে আবার বন্দি করে খোয়াড়ে ঢুকিয়ে দিল ওরা। কয়দিন পরে আবার অমানুষিক নির্যাতন এমনভাবে নিয়ে নিয়ে পিষ্ট করে টেনে ফেলে রেখে যেত সেলে। কুষ্টিয়ার জীবননগরে বন্ধু রাজ্জাককে কবরে শুইয়ে পিস্তলের গুলিতে হত্যা, মানুষকে দিয়ে কবর খুঁড়ে সেখানে জীবন্ত কবর দেয়া, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, বাপকে বেঁধে রেখে সামনে মেয়ের উপর পাশবিক উল্লাস প্রভৃতি মর্মান্তিক ঘটনার কথা শুনতাম লেঃ মান্নান লেঃ নুরুল আলমের কাছ থেকে। হৃদয়বিদারক কাহিনী শুনে সবার চেহারা হয়ে যেত ভাবলেশহীন অনুভূতিশূন্য।
‘আপলোগোকা ফায়সালা কারণে কেলিয়ে জেনারেল সাব নে তাসরিফ‌ লয়া’ -একদিন সন্ধায় জেনারেল টিক্কা খানের সফর সম্পর্কে গার্ড কমান্ডারের এই মন্তব্যের অর্থ আগেই জানা ছিল আমাদের। ফয়সালা অর্থাৎ ফায়ারিং স্কোয়াডে উড়িয়ে দেয়া ছাড়া আর কি। পার্টির কোরমা-পোলাও খেয়ে জীবনের শেষ খাবার খাওয়ার আত্মতৃপ্তি বোধ করলাম। নিজের চোখের ভাষা নিজে পড়তে না পারলেও অন্যের চোখের চাহনিতে চরম শূন্যতা ছাড়া আর কিছু খুঁজে পেলাম না। চরম মুহূর্তের জন্য প্রতীক্ষা করে অবশেষে সূর্যের মুখ দেখতে পেলাম । এইভাবে যতটুকু সময় বেঁচে থাক ছিলাম ততটুকুই স্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল। একদিন ৭ ফিল্ড এম্বুলান্সের নতুন অধিনায়ক কর্নেল কাদির আসলেন আমাদের দেখতে। আমরা সকলেই বিশেষভাবে ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামানের এলার্জির জন্য ওষুধের আবেদন জানালাম । অন্যান্য দুর্দশার কথা তাকে জ্ঞাত করানো হলো। তিনি বাস্তবিকই ইউনিটে যেয়ে কিছু ঔষধপত্র পাঠিয়ে দিলেন। তার চেষ্টায় আমাদের খাওয়া-দাওয়ারও কিছু পরিবর্তন হল। মাঝে মাঝে এফ আই ইউ থেকে ডাক পড়তো। দুইজনকে নিয়ে রেখে আসবার পর কাউকে নিতে আসলে মনে হতো আগের দুজন হয়তো ততক্ষণে বেঁচে নেই। শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে ক্ষীণ হয়ে পড়ল সকলে। আমাদের বিরুদ্ধে তারা অনেক চার্জ খাড়া করেছিল। ওদের অস্ত্রাগারের যে গোলাবারুদ অনুসন্ধান করা হয়েছে, কারও অফিসের ড্রয়ারে পিস্তল ও গুলির সন্ধান পাওয়া গেছে এবং কর্নেল হাইয়ের ডায়েরিতে ৩০ শে মার্চের অপারেশনের পূর্ব পরিকল্পিত সমস্ত তথ্য উদঘাটন হয়েছে ইত্যাদি। হাসপাতালে সব বাঙালি ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ব্লাড এবং মেডিসিনে পয়জন মিশ্রিত করার অভিযোগ আনা হলো। পরিবার-পরিজন নিয়ে যেসব অফিসাররা ছিলেন তাদের দুর্দশা সম্পর্কে যা শুনলাম তা বর্ণনাতীত। তাদের শিশুদের খাদ্যাভাবে বাঁচিয়ে রাখা খুবই কষ্টকর ছিল। স্ত্রী-কন্যার ইজ্জত রক্ষারও নিশ্চয়তা ছিল না। লেঃ কর্নেল কুদ্দুস, লেঃ কর্নেল জলিল, মেজর খালেদ, মেজর হুদা, মেজর আলী, মেজর মান্নান, ক্যাপ্টেন শফি ,ক্যাপ্টেন আবুবকর ও অন্যান্য অফিসাররা পরিবার-পরিজন নিয়ে দুরাবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। পরে তাদের ফ্যামিলি বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। অভিভাবকহীনা বিধবা মিসেস শেখও ভীষণ বিপদে ছিলেন। পরে তাকেও মাদারীপুরের বাড়িতে চলে যেতে দেওয়া হয়।
চরম সংশয়ের মধ্যে কেটে গেল কয়েক মাস। হঠাৎ একদিন দরজা খোলার শব্দে ভাবলাম নির্যাতন কক্ষে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমাদেরকে আর সেলে বন্দী করে রাখা হবে না। কর্নেল কাদিরের বাসায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি জানালেন তার সুপারিশেই নাকি আমাদের জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বন্দি না থাকলেও রীতিমতো সশস্ত্র প্রহরায় আমাদেরকে অফিসে আনা নেয়া করা হত। বাইরে নিয়ে গেলেও সেই একই অবস্থা। বাইরের আলো বাতাসে তবু প্রাণভরে নিঃশ্বাস নেয়ার কিছু সুযোগ হত। দেখতাম শ্মশানের মাঝেও বর্ষার সবুজ হয়ে ওঠে চারিদিক। কিন্তু ওই সবুজের নিচে যে কত রক্ত তার হিসেব নেই। ভাবতাম আবার এদেশে কোনদিন কি সবুজ প্রাণের সাড়া জেগে উঠবে না?
বাঙালি সৈনিকদেরকে বন্ধ করে রেখেছিল দাউদ পাবলিক স্কুল। তাদের দিয়ে ঘাস কাটানো, মাটিকাটানো আরও অন্যান্য অমানুষিক পরিশ্রম করাতো। নির্যাতনের ফলে অনেকের শরীরের ক্ষত ফ্র্যাকচার হয়ে যেত। হাসপাতালের নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্টও নিষ্কৃতি পায় নাই। সবাই তো বন্দি। কেউ ঘরে, কেউ বাইরে। কারও হাতে শিকল আর কারও পিঠের কাছে উদ্ধত বেয়নেট। গোটা দেশটারই তো এই অবস্থা। প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টে প্রমাণিত হলো আমার প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাচ্ছে। সম্ভবত বুটের আঘাতের ফল দীর্ঘদিন ধরে এর চিকিৎসা করতে হয়েছিল।
আমাদের মধ্যে থেকে অনেককে কড়া নিয়ন্ত্রণে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কেউ পারিবারিক সমস্যার কারণে মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার খাতিরে চরম অনিশ্চয়তার মাঝে নিজেকে ঠেলে দিয়ে পশ্চিমে যেতে বাধ্য হল। কাউকে ভবিষ্যতের সমূহ বিপদ মোকাবিলা করার জন্য কড়া প্রহরায় লাঞ্ছনা সহ্য করে এখানেই থাকতে হয়।
দীর্ঘ দুই বছর পাকিস্তান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে (মানছেন ক্যাম্প- ক্যাম্বেলপুর, পাঞ্জাব এবং আফগানিস্থান সীমান্তের কিছু দূরে সাঘাই ফোর্ট – উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) বন্দী থাকার পর ফিরে এসে আবার যোগ দিলাম ৭৪ এর জানুয়ারি মাসে সেই একই স্থানে -৭ ফিল্ড এম্বুলেন্সে। একে একে পুরনো সব স্মৃতি ভেসে উঠলো মনে। অন্তরের পুঞ্জিভূত রুদ্ধ আবেগ যেন কান্নার ন্যায় ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইলো। সেই বিধ্বস্ত প্রায় অফিস ঘরটার একদিকের দেয়ালে তখনও কামানের সেলের আঘাতে সৃষ্ট হাঁ করে থাকা বিরাট গত সাক্ষ্য দিচ্ছে সেই ৩০শে মার্চের ঘটনার। ভিতরে গোলাগুলিতে আগুন লেগে জ্বলে যাওয়ার চিহ্ন সুস্পষ্ট। করিডোরটা তেমনি আছে শুধু নেই কর্নেল হাই ও ক্যাপ্টেন শেখের বুক থেকে নিংড়ে পড়া উষ্ণ রক্তের দাগটুকু।লেঃ আমিনকেও ফিরে এসে আর পেলাম না। যুদ্ধের সময় যখন তিনি শহীদ হন তখন তার বাচ্চার বয়স মায়ের পেটে তিন মাসের। লাবনীর বয়স এখন প্রায় ১২ বৎসর। সেই শিশুকাল থেকেই অনেক প্রশ্ন আর কৌতূহল তার মনে। তার আব্বু কি আর কোনোদিনও ফিরে আসবে? এ প্রশ্ন আরও লাখো শহীদের শিশুদের প্রিয়জনদের।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আর্মি মেডিকেল কোরের কর্নেল হাই, কর্নেল জাহাঙ্গির, কর্নেল জিয়া, কর্নেল বদিউল আলম চৌধুরী, মেজর আসাদুল হক, মেজর জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন এনামুল হক, লেঃ এ কে এম ফারুক , লেঃ আমিনুল হক, লেঃ খন্দকার নুরুল ইমাম, সুবেদার/মেঃ/এ্যাঃ এ কে এ হক, সুবেদার/জিপিএ এমদাদ ইমাম হাঃ/ করনিক আব্দুল জব্বার, নায়েক/এমপি মোস্তফা, সিপাহি/জিপিএ আব্দুল জব্বারের প্রমুখসহ সর্বমোট প্রায় ১৩০ জন বিভিন্ন সেনানিবাসে দেশমাতৃকার বেদীমূলে আত্মহুতি দিয়ে এদেশের প্রতিটি মানুষের সত্তায় হয়ে রয়েছেন উজ্জ্বল ও ভাস্বর। এছাড়া কর্নেল এম আর চৌধুরী, মেজর মুস্তাক, ক্যাঃ/শেখ, ক্যাঃ হুদা , ক্যাঃ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, লেঃ আনোয়ার, লেঃ বদিউজ্জামান, সিপাহী মোস্তফা, সিপাহী হামিদুর রহমানসহ হাজারও শহীদের রক্তে লেখা ইতিহাস যুগে যুগে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মহান শহীদদের আত্মোৎসর্গের দৃষ্টান্ত হোক সমগ্র মানুষের কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠার অনুপ্রেরণার উৎস।