You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইয়াহিয়া একজনও মীরজাফর জোটাতে পারলেন না

শেখ মুজিবরের সঙ্গে আলােচনার জন্য ইয়াহিয়ার ঢাকায় আগমন। আলােচনা ভেঙে দিয়ে, বিশ্বাসঘাতকতা করে, বাংলাদেশে ইয়াহিয়া কর্তৃক নিজেদের সৈন্যদের লেলিয়ে দেওয়া তারপর হত্যা, সন্ত্রাস আর অত্যাচার-এ সব শুরু হওয়ার পর প্রায় দু মাস কেটে গিয়েছে। আমেরিকা, চীন এবং রাশিয়ার আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইয়াহিয়ার সাড়ে চার ডিভিশন জল্লাদ সৈন্য যথেচ্ছ তাণ্ডব চালিয়েছে। ইয়াহিয়া চার মাস ধরে এ সবের পরিকল্পনা করেছিলেন : ফলে তদনুসারে নিজের সৈন্য সমাবেশ, অন্য দিকে বাঙালী রেজিমেন্ট, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী এবং সশস্ত্র পুলিশদের নিরস্ত্র করার সুযােগ তিনি যথেষ্টই পেয়েছিলেন। তিনি বাঙালীদের মধ্যে বিদ্বেষের বিষ ছড়িয়ে দিয়ে তাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তােলার চেষ্টাও করেছেন। এ যাবৎ তিনি কতটা সাফল্য অর্জন করেছেন?

ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং যশােহরের মতাে গুরুত্বপূর্ণ। যে সব জায়গায় মার্চ মাসের শেষে তার সৈন্যরা শিবির গেড়ে বসে ছিল, তারা যে এখন প্রায় প্রতিটি মহকুমা। শহর পর্যন্ত দখল করে ফেলেছে সে কথা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করা অর্থহীন। বাঙালী রেজিমেন্ট, ই পি আর এবং সশস্ত্র বাঙালী পুলিশের যে সব পরস্পর বিচ্ছিন্ন বাহিনী প্রথমে বীরবিক্রম খান সেনাদের নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিল তারা এখন অনেক ঘাটি থেকেই সরে যেতে বাধ্য হয়েছে। তার ক্ষতির পরিমাণও বিপুল : কিন্তু, তবু ইয়াহিয়া তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে সক্ষম হয়নি।

সময়ে জ্ঞান বাড়ে। অনেকেই এখন বলছেন-বাংলা বাহিনীর প্রথম থেকেই গেরিলা যুদ্ধের কায়দা অনুসরণ করা উচিত ছিল; সম্মুখ সমরে তাদের নেমে পড়াটা ঠিক হয়নি। যারা এ কথা বলছেন তারা যুদ্ধ শুরুর সময়ের অবস্থাটা ভুলে যাচ্ছেন। মার্চের শেষে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়ােজনেই বাংলা বাহিনীকে যুদ্ধে নেমে পড়তে হয়েছিল, অন্য কিছু ভাবার সময় তখন ছিল না। তাছাড়া গেরিলা যুদ্ধের কলাকৌশলও তারা তখন জানত না। এ ব্যাপারে দোষ দিতে হলে আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়ার চতুর পদক্ষেপগুলি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, ফলে চরম কিছুর জন্য নিজের লােকদের তৈরি করতেও পারেনি। যুদ্ধের দিক থেকে পুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ বিশেষ সীমান্ত ঘটি দখলে আনতে পারলেও ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে অনেকটাই সুবিধা করে উঠতে পারেনি এদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ যে নিচ্ছিদ্র একতা দেখিয়েছেন তার নজির ইতিহাসে বিরল।

কিন্তু শুধু দেশপ্রেম দিয়ে তাে আর ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনীকে হটানাে সম্ভব নয়। তার জন্য যুদ্ধ-কৌশল জানা দরকার, প্রশিক্ষণ দরকার। বর্তমানে বাংলাদেশ বাহিনী সেই কাজেই মগ্ন। যে ধরনের যুদ্ধ বাংলাদেশকে চালাতে হবে তার কলা-কৌশল সম্পর্কে ক্রমশ বেশী করে মানুষকে শিক্ষিত করে তােলা হচ্ছে। বাংলাদেশের যা অবস্থান তাতে বিদেশ থেকে প্রচুর অস্ত্র সংগ্রহ করা খুব দুঃসাধ্য হবে না।

ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সব মানুষ একমন একপ্রাণ হলেও কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ চালানাে উচিত, কাকে নেতৃত্ব দেওয়া উচিত—এসব প্রশ্নে তাদের মধ্যে যে মতভেদ নেই তা নয়। আমাদের কংগ্রেস দল যেমন ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে বােঝাপড়ার দ্বারা ভারতের স্বাধীনতা এনেছিল, আওয়ামী লীগও অনেকটা সেভাবেই ইসলামবাদের সঙ্গে বােঝাপড়ার দ্বারাই নিজেদের দাবি…অনেকটা মিটিয়ে নিতে পারবে বলে আশা করেছিল। কংগ্রেসের মতই আওয়ামী লীগও যে অবস্থায় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়েছে সে অবস্থার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মত দৃঢ়তাসম্পন্ন নয়। তবে, আওয়ামী লীগের এখনাে শিক্ষা হয়নি বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের সব সদস্য লীগের প্রতিনিধি। দেশের ভিতরের এবং বাইরের অনেক সুপারিশ ও পরামর্শ সত্ত্বেও লীগ অন্যান্য দলের নেতাদের অন্তর্ভুক্ত করে সরকারকে সত্যিকারের জাতীয় চরিত্র দেবার কোন গরজ দেখাচ্ছে না; অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটাই দরকার। মৌলানা ভাসানি প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন যে যুদ্ধ জয় না করা পর্যন্ত তিনি আওয়ামি লীগের সঙ্গে তাঁর আদর্শগত পার্থক্যকে বিদায় দেবেন। অন্যান্য অনেক গ্রুপও অনুরূপ মনােভাব পােষণ করছে।

কিন্তু গত ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনের ফলের উপর নির্ভর করে আওয়ামী লীগ ওদের সরকারের বাইরে রেখে দিচ্ছে। লীগ একচেটিয়া ক্ষমতা ভােগ করার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারলে মুক্তি বাহিনীকে দারুণ সংকটে পড়তে হবে। সে ক্ষেত্রে সংগ্রামের নেতৃত্ব উগ্রপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে।প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের অবস্থা দেখার জন্য সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলি ঘুরে গিয়েছেন। উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পর্কে ভারত সরকারের উদ্বেগের পরিচয় এতে পাওয়া যাচ্ছে। এতে শুধু যে ভারতের আর্থিক সংকটই বাড়বে তাই নয়, সীমান্ত এলাকার সামাজিক, রাজনীতিক এবং অর্থনীতিক পরিস্থিতির উপরেও এই বিপুল মানবাগমন দারুণ প্রভাব ফেলবে। কিন্তু এ সমস্যার বিরুদ্ধে ঠিকমত লড়ার জন্য কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনা ভারত সরকারের আছে বলে মনে হচ্ছে না।  প্রধানমন্ত্রী বলেছেন-অবস্থার সঙ্গে তাল রেখে ভারতের নীতি স্থির করা হয়; ভারত অন্যের নীতির মুখাপেক্ষী নয়। ভালাে কথা। কিন্তু বিশ্ব-মতের ব্যাপারে ভারত যে যথেষ্ট স্পর্শকাতর সে কথাটাও অস্বীকার করা যাবে না। বাংলাদেশের ব্যাপারে ইউ এ আর সমেত সমগ্র মুসলীম জগৎ মুখে চাবি এঁটে দিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী সিংহল এবং ব্রহ্মদেশও নীরবতা ভাঙতে নারাজ।

চীন এ ব্যাপারে ভারতকে পথ দেখাবে-এমন আশা বাতুলতা। সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়াকে রাজনীতিক সমঝােতায় আসতে উপদেশ দিয়েছে। পাকিস্তান দু টুকরাে হয়ে যাওয়ার অর্থ এই উপ-মহাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য নাড়া খেয়ে যাওয়া। এই দুই বৃহৎ শক্তির কেউই যে তা চায় না নয়াদিল্লির সে কথা জানা উচিত। মসকো থেকে প্রকাশিত জারনাল নিউ টাইমসের মতে সাম্রাজ্যবাদীদের দালালরাই পাকিস্তান টুকরাে হয়ে যাওয়া অনিবার্য বলে চেচাচ্ছে। এ মন্তব্যের তাৎপর্য স্বম্প্রকাশ।  বিশ্বের অন্যান্য দেশ বাংলা দেশের উদ্বাস্তুদের জন্য কিছু কিছু সাহায্য হয়ত দেবে, কিন্তু আসল বইতে হবে ভারতকেই।

বিশ্বের নানা দেশ প্যালেসটাইনের উধ্বাস্তুদের বহু দিন ধরে সাহায্য দিয়ে আসছে; কিন্তু তাদের অদ্যাবধি স্বদেশে ফেরৎ পাঠানাে সম্ভব হয়নি। ভারত যদি ভেবে থাকে যে রাষ্ট্রপুঞ্জ উদ্বাস্তুদের ফেরৎ নেবার জন্য ইসলামাবাদকে প্ররােচিত করতে পারবে, তাহলে ভারতের কপালে দুঃখ আছে! ভারত সরকার সময়মত উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে যােগাযােগ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে পূর্বাঞ্চলীর রাজ্যগুলির তথা ভারতের সামনে বিপদজনক দিন অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশ থেকে সব খান সেনাকে তাড়িয়ে দিতে পারলে তবেই উস্বাস্তুদের সেখানে ফেরৎ পাঠানাে সম্ভব; কিন্তু সে কাজে অন্য কোন দেশ তাকে সাহায্য করবে না। ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলতেই চায়; কিন্তু শেষ পর্যন্ত উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়েই তাকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে না হয়।

Reference:

১৯ মে ১৯৭১, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!