You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.11.10 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | দ্রুত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে গোটা জাতি কৃতজ্ঞ | পরীক্ষার খাতা বস্তাবন্দী | সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড় | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১০ই নভেম্বর, শনিবার, ১৯৭৩, ২৪শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

দ্রুত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণে গোটা জাতি কৃতজ্ঞ

জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক সরকারের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্বভাবতঃই ঔপনিবেশিক সরকারের মানসিকতা ও চরিত্রের সম্পূর্ণ পরিপন্থী হয়ে থাকে। দেশের আপামর মানুষের দুঃখ-সুখের প্রত্যক্ষ ভাগী হয় দেশপ্রেমিক সরকার। সেক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক মানসিকতা সম্পন্ন সরকারের কর্মতৎপরতা সব সময়ই জনকল্যাণের থেকে দূরে সরে থাকে। বিভিন্ন প্রক্রিয়া বা কৌশলে জনগণকে তারা নিষ্পেষণ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশে যে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার চরিত্র বা মেজাজ সম্পূর্ণ দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী। জনগণের কল্যাণে ব্রতী হওয়াই এদের বিপ্লবী চরিত্রের নীতি। এ ব্যাপারে কারো সন্দেহ থাকা উচিত নয়। গত কয়েকদিন ধরে নিশ্চিত ঘূর্ণিঝড় হওয়ার বিষয়টি সারাদেশে একটি মারাত্মক উদ্বেগ ও আশঙ্কার কারণ হয়ে দেখ দিয়েছিলো। দেশের সরকার ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে উপকূলীয় মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্যে যে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছিলেন তা গোটা জাতিকে আর একবারের জন্যে হলেও বিস্মিত করেছে। বিশেষ করে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ সারাদেশের মানুষ বিস্ময়াকুল হয়ে লক্ষ্য করেছে। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সচিবালয় গত কয়েকদিন ধরে যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা অবিস্মরণীয়। দেশের প্রত্যেকটি বিবেকবান মানুষ তা পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে আমরা মনে করি। এমনকি বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসগৃহে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে প্রতি দশ মিনিট অন্তর ঘূর্ণিঝড়ের গতি-প্রকৃতির সংবাদ জেনেছেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন। উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও প্রশাসন যন্ত্রের প্রতি বঙ্গবন্ধুর চারটি জরুরী নির্দেশ এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে। এছাড়া সরকারের অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতৃবৃন্দও তাঁদের স্ব-স্ব কর্মী ও অফিসের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের। মহা বিপদের আশঙ্কা দূরীভূত হলেও বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিটি বিভাগ ও উপকূলীয় প্রশাসন যন্ত্রের প্রতি সদাসতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ ত্বরান্বিত করা, নিরাপদ এলাকায় লোক সরিয়ে নেওয়া ইত্যাদির জন্যে অত্যন্ত বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। শেষ অবধি বঙ্গবন্ধু সেনা ও নৌবাহিনীর প্রতি প্রস্তুত থাকতে ও যে কোনো নির্দেশের জন্যে অপেক্ষা করতে আদেশ দিয়েছেন। জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায় এমন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘটনা ইতিপূর্বে বাংলাদেশে আর ঘটেনি। আর সে কারণেই দেশবাসী যেমন আশ্বস্ত তেমনি সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞও বটে।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ বহুকাল ধরে জলোচ্ছ্বাস ও গর্কির নির্মম আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়ে আসছে। বহু নিরীহ মানবাত্মার মৃত্যু ঘটেছে রাতের আঁধারে, ঘুমের ঘোরে। পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সরকার জলোচ্ছ্বাস রোধের কোনো ব্যবস্থা এতোকাল করেনি। মানুষকে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে মুক্তি দেবার কোনো প্রচেষ্টাই তাদের ছিলো না। উপকূলীয় অঞ্চলে বাঁধ ও অন্যান্য নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে এদেশের মানুষ বহুকাল ধরে ঔপনিবেশিক সরকারের সাথে সংগ্রাম করেছে। কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। বিগত সত্তর সালের ইতিহাসখ্যাত ঘূর্ণিঝড়ের সময়ও পাকিস্তানী সরকার তার ঘৃণ্য হীনমন্যতার পরিচয় প্রদান করেছিলো। সেদিনও বাংলার মানুষ বিদেশী পত্রিকা ও বেতারের সংবাদে জানতে পেরেছিলো বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রামে লক্ষ লক্ষ নিষ্পাপ আত্মা জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যু বরণ করেছে। অথচ ঔপনিবেশিক বর্বর পাক সরকার সম্পূর্ণ ঘটনাকেই চাপা দিতে চেয়েছিলো। সেদিনের সেই মহা বিপদের দিনে উদ্ধার কাজের জন্যে পাকিস্তানী শাসকচক্রের নিকট থেকে এতোটুকু আত্মীয়তাবোধের এমনকি মানবতাবোধেরও পরিচয় পাওয়া যায়নি। ঘূর্ণিঝড়ে আহত-নিহত মানুষের জন্যে সেদিন তারা বিমান বা হেলিকপ্টার পর্যন্ত দিতে চায়নি। অতীতের সেই দুঃখজনক ঘটনার কথা আজো মনে পড়ে। দেশের প্রতিটি মানুষ এবার মর্মে মর্মে তা উপলব্ধি করেছে বলে আমাদের বিশ্বাস। জলোচ্ছ্বাসের মর্মান্তিকতা বা ভয়াবহতা বঙ্গবন্ধু জানেন বলেই তিনি অত্যন্ত দূরদর্শীর মতো সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। দেশপ্রেমিক সরকারের এটাই সত্যিকার স্বরূপ। আমরা বঙ্গবন্ধুর ও তাঁর সরকারের এহেন দ্রুত সতর্কতামূলক বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে কৃতজ্ঞ, আমাদের বিশ্বাস দেশবাসীও তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবে।

পরীক্ষার খাতা বস্তাবন্দী

পরীক্ষা শেষ হয়েছে সেপ্টেম্বর মাসে। সে পরীক্ষার খাতা এখনো বস্তাবন্দী। বন্দী খাতাগুলো বোর্ড অফিসেই পড়ে আছে। বিতরণের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি—হচ্ছে না। কারণ প্রধান ও সহকারী প্রধান পরীক্ষক নিয়োগের জন্যে গঠিত উপদেষ্টা বোর্ড নাকি উক্ত পদের জন্যে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পাচ্ছেন না।–এ ছিলো গতকালকের স্থানীয় একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত খবর। পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার প্রায় দেড় মাস পরেও সে পরীক্ষার খাতা পরীক্ষার জন্যে পরীক্ষকদের কাছে প্রেরণ করা হয়নি।
খাতা পরীক্ষকের হাতে পৌঁছানোর পর পরীক্ষা করার জন্যে কমপক্ষে এক থেকে দেড় মাস সময় দিতে হবে। তারপর সেগুলো প্রধান ও সহকারী প্রধান পরীক্ষক কর্তৃক পুনঃ পরীক্ষার করার জন্যে অন্ততঃ আরো এক থেকে দেড়মাস সময় লাগবে। এবং এর পর স্ক্রুটিনী এবং ফলাফল প্রকাশের জন্যে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করতে আরো সময় লাগবে নিদেনপক্ষে দু’মাস। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে তাহলে গত সেপ্টেম্বরে যে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে সে পরীক্ষার ফল বেরুতে সময় লাগবে প্রায় ছ’মাসের মতো। এর অর্থ ১ লাখ ৮০ হাজার (৪টি বোর্ডের) পরীক্ষার্থীর ভাগ্য ছ’মাসের জন্যে অনিশ্চিত। আর এই অনিশ্চয়তার দরুণ একদিকে তারা ভবিষ্যতে জীবন সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুতি নেবার সুযোগ পাচ্ছে না, অপর পক্ষে দেশের ভবিষ্যত জনশক্তির এই বিপুল অংশের অপচয় ঘটছে।
পরীক্ষা অনুষ্ঠানের পূর্বেই পরীক্ষার সকল পরীক্ষক নিযুক্ত হয়ে থাকেন এবং এটাই নিয়ম। অথচ পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার দেড় মাস পরেও প্রধান ও সহকারী প্রধান পরীক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। কবে নাগাদ সম্ভব হবে তারও নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এই পরীক্ষার ফল প্রকাশের ব্যাপারও অনিশ্চিত। যথাসময়ে ফল প্রকাশ পেলে পরীক্ষার্থীরা হয়তো আগামী জানুয়ারী থেকে একটা সেশন পেতে পারতো। কিন্তু এক্ষণে পরবর্তী জুলাইয়ের আগে তারা কলেজে ভর্তি হতে পারবে কিনা সে বিষয়ে স্বভাবতঃই অভিভাবক এবং পরীক্ষার্থীদের মনে সংশয় দেখা দেবে। এবং দীর্ঘ সময় ধরে ভাগ্যের অনিশ্চয়তার দরুণ যুব মানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতেও বাধ্য। সে প্রতিক্রিয়া দেশ ও জাতির পক্ষে যে কত মারাত্মক ক্ষতিকর তা বলাই বাহুল্য।
প্রাসঙ্গিক ক্রমে বলা দরকার, মান্ধাতার আমলের এহেন অবৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতির দ্রুত অবসান অনস্বীকার্য। এস.এস.সি. পরীক্ষার্থীদের ভাগ্যের উদ্ভূত অনিশ্চিত অবস্থা দূরীকরণের জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ ত্বড়িৎ কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন বলে আমরা আশা করি।

সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়

সময় মতো না করলে কোনো কিছুতেই সুফল পাওয়া যায় না—এই মহাজন বাক্যটি স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে যতটা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করা গেছে, তার নজির সম্ভবতঃ আজকের দুনিয়ায় বিরল। কিন্তু তবুও যেন কারো শিক্ষা হচ্ছে না। আর হচ্ছে না বলেই এমনটি ঘটছে। গতকালকের বাংলার বাণীতে গ্রাম বাংলার অর্থনীতির পাতায় আলুবীজ সরবরাহ সংক্রান্ত যে খবর বেরিয়েছে, তা থেকে উপরোক্ত বক্তব্যের স্বপক্ষে যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যাবে। ঐ খবরে বলা হয়েছে যে, সময় মতো আলুবীজ সরবরাহের নিশ্চয়তা না পেয়ে কুমিল্লা জেলার প্রায় সকল এলাকার এবং খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার চাষীরা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। গ্রাম বাংলার আরো বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও এ জাতীয় খবর আসছে।
আগামী মাস থেকে গ্রাম বাংলার প্রায় সবখানেই আলুবীজ বপনের মৌসুম শুরু হবে। সেই মতে কৃষক সম্প্রদায় জমি চাষ করে তৈরী হতে শুরু করেছেন। অথচ সরকারী বীজ সংরক্ষণাগার তথা গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত কৃষি দপ্তরগুলোতে এখনো কোনো আলুবীজ গিয়ে পৌঁছায়নি—সারও পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া কবে নাগাদ এসব বীজ ও সার গিয়ে পৌঁছুবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এক সাধারণ হিসেব মতে জানা গেছে যে, একমাত্র কুমিল্লা জেলাতেই প্রতিবছর ১৯ হাজার ৭৪৫ একর জমিতে আলুর চাষ হয় এবং তার জন্যে কমপক্ষে ২০ হাজার মণ আলুবীজের প্রয়োজন হলেও এই বছর সেই জেলার জন্যে মাত্র ১৮ হাজার ৬শ’ মণ আলুবীজ সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ করা হয়েছে। অথচ সে বীজও এখনো কুমিল্লায় পৌঁছায়নি। অন্যদিকে প্রতিবছর সাতক্ষীরা মহকুমার জন্যে যেখানে কমপক্ষে ৫ হাজার মণ আলুবীজের প্রয়োজন, সেখানে এ যাবতকাল মাত্র ৫শত মন আলুবীজ পৌঁছেছে। তার মধ্যে আবার শতকরা ৫০ ভাগ বীজই পচা। ফলে ঐ এলাকায় এবার আলুর চাষ যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। অনেকেরই ধারণা সময় মতো আলুবীজ না পৌঁছালে আলুচাষ লাটে উঠবে।
এমতাবস্থায়, সময়মতো কাজ করাটা অবশ্যই কর্তব্য। কথায় বলে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়। মৌসুমের শুরুতেই চাষীরা যাতে আলুর চাষ করতে পারেন—যাতে আলুবীজ বপন করতে পারেন কৃষি দপ্তরকে অবশ্যই তার নিশ্চয়তা দিতে হবে। যে সব এলাকায় এখনো আলুবীজ ও সার গিয়ে পৌঁছায়নি সে সব এলাকায় এগুলো পৌঁছিয়ে দেবার জন্যে জরুরী ভিত্তিতে কার্যক্রম নিতে হবে। কেননা কৃষি অর্থনীতিনির্ভর বাংলাদেশের জন্যে আলুও একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন