You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স যেভাবে

পানছড়ির চাকমা গ্রামে এল :

বাংলাদেশের যুদ্ধ’-এ সিআইএ, ‘র’ এবং ইসরায়েল

৩. ক. মুজিব বাহিনী সম্পর্কে ঐতিহাসিক কিছু ভাষ্য

Once my family decides something, it doesn’t go back. Whether it’s about India’s freedom. dividing Pakistan or taking India to the 21st centuary.

– Rahul Gandhi৬৮

মুজিবুর রহমান ভারতে না গেলেও ২৫ মার্চের নির্মমতার পর তার সকল অনুসারীদের সেটা ছাড়া বিকল্প ছিল না। স্বাধীনতাসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক তৎপরতার এটা ছিল নতুন পর্যায়। এ পর্যায়ে আমরা কেবল মুজিবের যুব-শক্তিভিতের যুদ্ধকালীন ভূমিকার দিকেই নজর রাখবাে- যার আওতায় যুদ্ধকালে বিএলএফ-এর সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্পর্কে একে একে ভিন্নধর্মী অনেকগুলাে ভাষ্য তুলে ধরা হবে। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে (২.ক) উদ্ধৃত কাজী আরেফ আহমেদ, তােফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখের বক্তব্যের সঙ্গে তুলনা

…………………………………………….

৬৮। ২০০৭ সালের ১৫ এপ্রিল উত্তর প্রদেশে নির্বাচনী প্রচারকালে ইন্দিরা গান্ধীর নাতি এবং সেখানকার পার্লামেন্টের সদস্য ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সহ-সভাপতি রাহুল গান্ধী এই মন্তব্য করেন। তাঁর এই মন্তব্যে ভারত ও পাকিস্তান জুড়ে সমালােচনার ঝড় বয়ে গেলেও বাংলাদেশে সরকারের পক্ষ থেকে বা ভারতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতের কার্যালয় থেকে কোন প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়নি। তার এই বক্তব্যের স্পষ্ট দাবি, ১৯৭১-এ পূর্ববাংলার বিচ্ছিন্ন হওয়া ভারতের গান্ধী পরিবারের ইচ্ছার ফল। বাংলাদেশের অনেক নীতিনির্ধারকও যে সেরকমই মনে করেন তার প্রমাণ মেলে খােদ দেশটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নিম্নোক্ত প্রকাশ্য ভাষণে:

ইন্দিরা গান্ধী না থাকলে দেশ ৯ বছরেও স্বাধীন হতাে না –

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মােজাম্মেল হক ভারতের অবদান স্বীকার করতে গিয়ে বলেছেন, ভারত যদি আমাদের সহযােগিতা না করত আর ইন্দিরা গান্ধী না থাকত তাহলে আমরা ৯ মাস তাে দূরের কথা ৯ বছরেও স্বাধীন হতে পারতাম না। আর সেই কৃতজ্ঞতার কারণেই ভারত আমাদের বন্ধু।…আরও দেখুন, http://janatarnews24.com/details.php?sid=9&id=9553 (পর্যবেক্ষণ: ২৯ মার্চ ২০১৪)

করলে নিম্নোক্ত বিবরণগুলো থেকে বহুরূপ সত্যের সন্ধান পাওয়া যাবে। মিলবে অনেক অসত্যের সন্ধানও। এক্ষেত্রে  সিভিল-মিলিটারি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য তুলে ধরায় যৌক্তিক হবে। প্রথমে আমরা মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনিক সূত্রে অভিমত হিসেবে ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থ থেকে পাওয়া মঈদুল হাসানের বক্তব্য তুলে ধরবো। আর নেতৃস্থানীয় যোদ্ধাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে একজন সেক্টর কমান্ডার (রফিকুল ইসলাম, বীরউত্তম, ১ নম্বর সেক্টর)- এর বক্তব্য উপস্থাপন করবো।

ইতোমধ্যেই বর্তমান গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে (২.ক) মুজিব বাহিনীর উৎস কাঠামো হিসেবে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ নিউক্লিয়াস সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে এবং একাত্তরের মার্চে পাকিস্তানের দু’অংশের মাঝে বিচ্ছিন্নতাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে উপরিউক্ত নিউক্লিয়াসের তৎপরতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে (২.খ) উপ-অধ্যায়ে। রাজনৈতিক তৎপরতায় গোপনীয়তা ও নাটকীয়তার অনেক উপাদান পাঠক নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন উভয় আলোচনায়। তবে নিঃসন্দেহে তার আরো বিকশিত রূপ দেখা যাবে পরবর্তী বিবরণগুলোতে। যেমন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার রফিকুল ইসলাম তার বহুল পঠিত গ্রন্থ ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’তে মুজিব বাহিনী নিয়ে পুরো একটি অধ্যায়ই লিখেছেন– যার শিরোনাম ‘বিশেষ গোপন বাহিনী’ সেখানে তিনি বলেন,

          ‘… জুন মাস থেকে দেখা গেল, বিভিন্ন শিবির থেকে প্রশিক্ষণের জন্য অপেক্ষারত তরুণরা নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে। এই যুবকদের গোপনে অন্যধরনের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা এতই সুপরিকল্পিত ও বিস্তৃত ছিল যে, বিশেষ বিমানে কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা মাধ্যমে সেটা হত। ফলে ভাবতে বাধ্য হলাম, আমাদের বিশ্বাস করা হচ্ছে না। সেক্টর কমান্ডাররা সবাই এতে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। জানিয়ে দেওয়া হলো, এ ব্যাপারে নাক গলাবেন না। পরে জানতে পেরেছিলাম ‘র’ই ছিল এর মূল উদ্যোক্তা। … রাজনৈতিক দিক থেকে এটা ছিল এক সর্বনাশা সিদ্ধান্ত। এ ধরনের গোপন পরিকল্পনার কারণে যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে মারাত্মক ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। আমরা জানতে পেরেছিলাম, কিছু সুদূরপ্রসারি রাজনৈতিক বিবেচনাতেই এই পরিকল্পনা ঠিক গ্রহণ করা হয়েছিল। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ সরকারের কোনো অনুমতি ছিল না। তাদের যেসব মিশনে পাঠানো হতো তার কিছুই আমরা জানতাম না। শুধু শেখ মনি ও ভারত সরকারের অল্প কিছু লোক এসব জানতেন। এই বিশেষ বাহিনী সেসময় মুক্তিযুদ্ধে কোন বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি। ওরা ভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রথম

page – ৬৩

থেকে। ‘র’ এই পরিকল্পনার মাধ্যমে অদৃশ্য ও কাল্পনিক কোন এক শক্তির বিরুদ্ধে নতুন একটা ফ্রন্ট খুলে।…৬৯

মাঠ পর্যায়ের এই অভিজ্ঞতা মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনে কিভাবে প্রভাব ফেলে সেটা বোঝার জন্য এবার বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে বিশেষ আলোচিত মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ৭১’ গ্রন্থের সাহায্য নিতে পারি আমরা। সেখানে যুদ্ধকালীন প্রধান মন্ত্রীর এই বিশেষ সহকারি লিখেছেন, ‘(১৯৭১ সালের) ১৮ এপ্রিল নবগঠিত বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা দেশের ভেতর থেকে ছাত্র-যুব কর্মী সংগ্রহের দায়িত্ব দেয় শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল ইসলাম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ এর উপর। অজ্ঞাত কারণে অল্পদিনের মধ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি (সৈয়দ নজরুল ইসলাম) চার যুবনেতার ক্ষমতা সম্প্রসারিত করে তাদের রিক্রুটিং এর দায়িত্ব ছাড়াও সশস্ত্র বাহিনী গঠন ও পরিচালনার অধিকার প্রদান করেন। এ অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদানের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সম্মতি ছিল না। … ওসমানী নিজেও এ সম্পর্কে সংশয় মুক্ত ছিলেন না।… এদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম দল আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়, এ বাহিনী পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে কর্নেল ওসমানী তথা বাংলাদেশ সরকারের কোনো এখতিয়ার নেই।… কেবল প্রশিক্ষণ নয়, এদের অস্ত্রশস্ত্র ও যাবতীয় রসদ যোগান আসত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর বিশেষ উপ সংস্থা থেকে এবং ওই উপ সংস্থার প্রধান জেনারেল উবানছিলেন মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার দায়িত্বে।৭০

মঈদুল হাসান ‘মুজিব বাহিনী’র বিরুদ্ধে—

ক) স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিভক্ত করা;

খ) বামপন্থীদের বিরুদ্ধাচারণ করা;

গ) সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কেড়ে নিতে;

ঘ) মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হওয়া;

ঙ) মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং

চ) তাজউদ্দীন আহমেদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা ও প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন।

——————————————

৬৯ রফিকুল ইসলাম ‘মুজিব বাহিনী’ সম্পর্কে তার গ্রন্থের যে বিবরণ দিয়েছেন সেখান থেকে অতি সংক্ষেপে এই উদ্বৃতি দেওয়া হল। এর কিছুটা বাড়তি ভাষ্য রয়েছে সংযুক্তিতে। আলোচ্য গোপন বাহিনী সম্পর্কিত তার পুরো বিবরণের জন্য দেখুন রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, অনন্যা, ১৯৯৬, ঢাকা, পৃ. ২৭৬-২৮২।

৭০  মঈদুল হাসান, ‘মূলধারা ৭১’ ইউপিএল, ১৯৮৬, ঢাকা, পৃ. ৭৩, ১৩৯। উল্লেখ্য, মুজিব বাহিনীর উপরুক্ত নেতাদের প্রদত্ত রিক্রুটিং এর দায়িত্ব সংক্রান্ত অধিকারপত্র পরে প্রবাসী সরকার প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, কিন্তু তাতে তাদের কার্যক্রমের অতি সামান্যই ব্যত্যয় ঘটে। পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৪।

 page – ৬৪

মইদুল হাসান এর ভাষায়, ‘মুজিব বাহিনীকে স্বতন্ত্র কমান্ডে রাখার বিষয়ে ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল খুব জোরালো’… এবং তাজউদ্দিনের তরফ থেকে খোদ ইন্দিরা গান্ধীকে মুজিব বাহিনী শ্রেষ্ঠ ‘বিরম্বনা’ বন্ধে ভূমিকা রাখার জন্য অনুরোধ করা হলেও তা কার্যকর করা হয়নি। (৭১)

বিএলএফ সম্পর্কে মঈদুল হাসানের এসব বক্তব্যের আংশিক বা পূর্ণ সমর্থন মেলে রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, এম আর আখতার মুকুল, মনি সিংহ, এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার, কাজী জাফর আহমেদ, আমীরুল ইসলাম, আবদুল খালেক (প্রবাসী সরকারের স্বরাষ্ট্র সচিব ও আইজিপি) প্রমুখের লেখনিতে। (৭২) এর মধ্যে সেক্টর কমান্ডার রফিকের বক্তব্য এই গ্রন্থের শেষে সংযুক্ত রয়েছে।

আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, মঈদুল হাসান, রফিকুল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, এ কে খন্দকার, মনি সিংহ, কাজী জাফর আহমেদ, আমিরুল ইসলাম, আবদুল খালেক— এরা সবাই মুক্ত যুদ্ধকালীন ঘটনাবলী এবং একাত্তরের আগে পরে বাংলাদেশের সমাজ রাজনীতি ও প্রশাসনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তারা অনেকটা আকরগ্রন্থ তুল্য উৎস। আবার এও সত্য, কোন না কোন ভাবে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে এবং ভিন্ন ভিন্ন আদর্শ তাড়িত ছিলেন বিধায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে এদের বর্ণনায় আবেগ ও রাজনীতির অস্বাভাবিক নয়।

এরূপ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, বিএলএফ সম্পর্কে পূর্বোক্ত ভাষ্যকাররা প্রদত্ত বিবদমান ও বিরোধপূর্ণ তথ্যের কোনটিকে সঠিক বলে ধরে নেওয়া যাবে? এক্ষেত্রে মুজিব বাহিনী সম্পর্কিত তথ্যের একটি নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে জেনারেল এস এস উবানের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে– কারণ তিনি ছিলেন কার্যত এই বাহিনীর প্রশিক্ষক এবং সর্বাধিনায়ক। ভারতীয় এই গেরিলা যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ তার ‘ফ্যানটম অফ চিটাগাং : ফিফট আর্মি ইন বাংলাদেশ’ গন্থে ৭৩ মুজিব বাহিনী

———————————-

(৭১) মঈদুল হাসান, পূর্বোক্ত।

(৭২) দেখুন, রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, অনন্যা, ঢাকা, ১৯৯৬ এবং এম আর আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি, সাগর পাবলিশার্স, ১৯৮৫; মনি সিংহের সাক্ষাৎকার, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (১৫ শ’ খন্ড), তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮৫, পৃ. ৩১৬; এ কে খন্দকারের সাক্ষাৎকার, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (১৫শ’ খন্ড), তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮৫, পৃ. ৩৩; কাজী জাফর আহমেদের সাক্ষাৎকার, পূর্বোক্ত পৃ. ২০৩, আব্দুল খালেক এর সাক্ষাৎকার, পূর্বোক্ত, পৃ. ৫২।

(৭৩) বইটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে ‘ঘাস ফুল নদী’ আজিজ মার্কেট, ঢাকা ২০০৫। অনুবাদ করেছেন হোসাইন রিদওয়ান আলী খান। এই লেখার অন্যত্রও মূলত এই অনুবাদ থেকেই ওবানের বক্তব্যের উদ্বৃতি দেয়া হয়েছে। উবান কেন তার বইয়ের শিরোনামে মুজিব বাহিনীকে ‘ফিফথ আর্মি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তা এক গভীর বিস্ময়ের বিষয়। কারণ বর্তমানে রাজনৈতিক সাহিত্যে এবং ব্যবহারিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এই শব্দটি ধারা সাধারণ এমন ধারার বিশ্বাসঘাতকদের বোঝানো হয়– যারা স্বীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বা রাষ্ট্রের শত্রুদের সাথে কাজ করে। ফিফথ আর্মি বা পঞ্চম বাহিনী শব্দদ্বয়ের উৎপত্তি হিসেবে জানা যায় :

   ‘স্পেনের গৃহযুদ্ধে(১৯৩৬-৩৯)– এর সময় জেনারেল ফ্রাংকোর নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা চতুর্দিক থেকে যখন মাদ্রিদ আক্রমন করে তখন ফ্রাংকোর বিশ্বস্ত অনুচররা ক্ষমতাসীন রিপাবলিকানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে বিদ্রোহ গুপ্তচরবৃত্তি ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ সৃস্টির মাধ্যমে সরকারি শক্তিকে সরকারের অভ্যন্তর থেকে ধ্বংস করে দিতে থাকে। এই গোপন বাহিনী পঞ্চম কোলামিস্ট (Fifth Columnist) বা পঞ্চম বাহিনী নামে পরিচিত হয়।’ দেখুন, হারুনুর রশিদ, রাজনীতিকোষ, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৯, ঢাকা, পৃ.১৮৭।

Page – ৬৫

এবং এ বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মূলত ওই গ্রন্থ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূত্রের৭৪ ভিত্তিতে মুজিব বাহিনী সম্পর্কে এরূপ সাধারণ ধারণা প্রকাশ পায় যে, বিএলএফ মুজিব বাহিনী গঠন ছিল পূর্বপরিকল্পিত; ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং ‘র’ (Research and Analysis Wing- RAW)- এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে এই বাহিনীর গঠন ও বিকাশ এবং যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের প্রতি মুজিব বাহিনীর ছিল বৈরিতা ও আনুগত্যহীনতা। পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে ধাপে ধাপে বিএলএফ সম্পর্কিত এসব পর্যবেক্ষণের স্বপক্ষে উপস্থাপিত তথ্য ও উপাত্ত সমূহ তুলে ধরা হবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উপরে লিখিত জেনারেল ওবানের সংশ্লিষ্টতার বহু বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু কে এই জেনারেল উবান এবং কেনইবা তাকে মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার জন্য ‘র’ কর্তৃক বাছাই করা হয়েছিল সেই বিষয়ে কমই অনুসন্ধান করা হয়েছে। এ অধ্যায়ের বিভিন্ন আলোচনায় সে বিষয়ে কৌতূহলোদ্দীপক অনেক তথ্য পাওয়া যাবে; বিশেষত ‘র’ এর সেই সময়কার প্রধান রাম নাথ কাও সম্পর্কে– বহির্বিশ্ব যাকে ‘বাংলাদেশের স্রষ্টা’ হিসেবে জানে! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে  জেনারেল ওবানের সংশ্লিষ্টতা রাম নাথ কাও এর মাধ্যমে। যেহেতু ওবান ও তার যুদ্ধকালীন ভূমিকা সম্পর্কে পরবর্তী উপ-অধ্যায়গুলোতে (৩.খ ও ৩.ঘ) বিস্তারিত আলোকপাত করা হবে সে কারণে ওই আলোচনার পটভূমি হিসেবে এখানে রাম নাথ কাও সম্পর্কে সংক্ষেপে পরিচিতিমূলক কিছু তথ্য উপস্থাপন করা প্রাসঙ্গিক।

—————————

৭৪ মঈদুল হাসান, মূলধারা ৭১, ইউপিএল, ১৯৮৬, ঢাকা পৃ. ৭১, ১৩৯। উল্লেখ্য, মুজিব বাহিনীর উপরুক্ত নেতাদের প্রদত্ত রিক্রুটিং এর দায়িত্ব সংক্রান্ত অধিকারপত্র পরে প্রবাসী সরকার প্রত্যাহার করে নিয়েছিল, কিন্তু তাতে তাদের কার্যক্রমের অতি সামান্যই ব্যত্যয় ঘটে। পূর্বোক্ত, পৃ. ৭৪।

page – ৬৬

১৯৪৭ দুটি গোয়েন্দা সংস্থা ?(আইবি ও সামরিক গোয়েন্দা? দিয়ে যাত্রা হলেও উইকপিডিয়ায় ‘List of Indian Intelligence Agencies’–এ বর্ণিত তথ্য অনুযায়ী৭৫ ভারতে এখন চিরায়িত অর্থে গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে অন্তত ১১টি। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সর্বাধিক আলোচিত রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং RAW (‘র’) । ১৯৬৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর আইবি (IB) বা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো ভেঙ্গে এই সংস্থাটি ঘরে তোলা হয়– যার কর্ম এলাকা ‘বহির্বিশ্ব’। শেষোক্ত গোয়েন্দা সংস্থার প্রথম চীপ ছিলেন রামেশ্বর নাথ কাও বা রাম নাথ কাও।  আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছে তিনি রামজি  নামেও পরিচিত। ১৯৪০ সালে ভারতীয় পুলিশে যোগদানের মাধ্যমে তিনি গোয়েন্দা জীবন শুরু করেন। নেহেরু পরিবারের অতি নির্ভরযোগ্য এই ব্যক্তিকে দিয়ে রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং এর গোড়াপত্তন করেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। জন্ম পরবর্তী নয় বছর সংস্থাটির প্রধান ছিলেন কাও।

১৯৭১ সালেকা কাও এর আনুষ্ঠানিক পড়ছিল ক্যাবিনেট সেক্রেটারিয়েটে ‘(সেক্রেটারি গবেষণা)’।  সাধারণত রিসার্চ অ্যান্ড এনালাইসিস উইং এর চিফদের আনুষ্ঠানিক বা প্রকাশ্য পদ ওটিই হয়ে থাকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দিল্লির প্রশাসন মহলে এই সত্য সবাই মেনে নিতেন, ইন্দিরা গান্ধী যে চার ব্যক্তির সঙ্গে পরামর্শ শেষে তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন তাদের একজন হলেন কাও (অন্য তিনজন হলেন ডি পি ধর, পি এন হাকসার ও টি এন কাউল)। গান্ধীর শাসনামলে তার ঘনিষ্ঠজনরা এও জানতেন, প্রতিদিন অফিস ছাড়ার আগে তিনি শেষ সাক্ষাৎকারটি দিতেন কাওকে। মুজিব বাহিনী ও ওবানকে কাওই সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করতেন এবং তা ইন্দিরার সম্মতিতেই। ইন্দিরা ও ‘র’- এর মাঝে মুজিব বাহিনী বিষয়ে কাও ব্যতীত কারো প্রশাসনিক ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না।

উল্লেখ্য, কাও, ৫৭ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সফর করার কিছুদিন পর শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। ভারতীয় তরফ থেকে তখন বলা হয়েছিল, কাও এসেছিলেন রাষ্ট্রপতিকে সম্ভাব্য অভ্যুত্থান সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য। কাও কিভাবে জানতে পারলেন বাংলাদেশ অভুত্থান হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে একট কৌতূহল উদ্দীপক ভাষ্য রয়েছে ‘ইনসাইড’ ‘র’ গ্রন্থের লেখক অশোকা রায়মার বিবরণীতে। তিনি লিখেন, পঁচাত্তরের আগস্টের তিন মাস আগে ‘র’ এজেন্টরা জিয়াউর রহমানের বাসায় মেজর ফারুক, মেজর রশীদ ও ওসমানীর একটি সভার

———————————

৭৫  List of Indian Intelligence Agencies : National Technical Research Organisation, Research and Analysis Wing, Intelligence Bureau. Directorate of Revenue Intelligence, Defence Intelligence Agency Joint Cipher Bureau, All India Radio Monitoring Service, Signals Intelligence Directorate, Aviation Research Centre Directorate of Air Intelligence Directorate of Navy Intelligence. (retrived on 16th Jan, 2014.)

page – ৬৭

তথ্য লাভে সমর্থ হয়। তিন ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় একজন অংশগ্রহণকারী উদ্দেশ্যহীনভাবে কাগজে কিছু লিখে ফেলেন ও পরে তা অমনোযোগিতাবশত বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেন। সেই দুমড়ানো কাগজটি আবর্জনার স্তুপ থেকে একজন কেরানি (‘র’ এজেন্ট) সংগ্রহ করতে সমর্থ হয় এবং পরে তা দিল্লিতে সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। (ঢাকায়) অভ্যুত্থান আসন্ন বুঝতে পেরে কাও একজন রপ্তানিকারক এর ছদ্মবেশে ঢাকায় পৌছেন।… পূর্ব নির্ধারিত স্থানে মুজিবের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। এক ঘণ্টা স্থায়ী হয় আলোচনা। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত সন্দেহভাজনদের নাম উল্লেখ করার পরও মুজিব গুরুত্ব দিয়ে আমলে নেননি। ৭৬

চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহণের ২৫ বছর পর ২০০২ সালের ২০ জানুয়ারি ৮৪ বছর বয়সে দিল্লিতে মারা যান আর এন কাও। ভারতের এলিটরা দক্ষিণ এশিয়ার জনসমাজে তাদের প্রভাববলয় নির্মাণে অসামান্য অবদান রাখার জন্য প্রতিবছর আনুষ্ঠানিক এক মেমোরিয়াল লেকচার এর মাধ্যমে কাওকে স্মরণ করে থাকে। মোরারজি দেশাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর কাউকে ‘র’ থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে সংস্থাটির প্রধান হন দ্বিতীয় ব্যক্তি শংকরণ নায়ার। তার জীবনবৃত্তান্তেরও সবচেয়ে শক্তিশালী দেখছিল একাত্তরে পূর্বপাকিস্তানে দক্ষতা প্রদর্শন। ইন্দিরা গান্ধী দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতাসীন হলে কা আবার তার উপদেষ্টা হন। তাকে ক্যাবিনেট বিভাগের সিনিয়র উপদেষ্টা করা হয়।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্ব গোয়েন্দা জগতে কাওকে বাংলাদেশের স্রষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরূপ বিবেচনা বাংলাদেশীদের জন্য সুখকর নয়। আবার এই বিবেচনার সময় অনেকেই বিস্মিত হন, একাত্তরে পূর্ব-পাকিস্তানের কাও-এর সফলতার প্রধান স্থপতি ছিলেন আসলে শঙ্কর নায়ার (K. Sankaran Nair)– যিনি কাও থাকাবস্থায় ছিলেন ‘র’ এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি; আর ‘র’ সৃষ্টির আগে আইবি-এর পক্ষে আগরতলাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তান ডেস্কের ‘দায়িত্ব’ তিনিই পালন করেন। ১৯৭৭ সালে কাও-এর প্প্র ‘র’ -এর প্রধান হন তিনি। মাত্র কয়েক মাস তিনি এই দায়িত্বে ছিলেন। কাও ও নায়ার ‘র’ থেকে বিদায় নেওয়ার পর মোরারজি দেশাই শাসনামলে বাংলাদেশের শাসকদের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ব্যাপক উন্নতি ঘটে। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসার পর তা আবার ব্যাহত হয়। এই অভিজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশ-ভারত স্বাভাবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘র’ কে প্রধান দেয়াল মনে করেন প্রথমোক্ত দেশের কূটনীতিবিদরা এবং আওয়ামী লীগ বহির্ভূত রাজনীতিকরা।

—————————————–

৭৬  দেখুন, অশোকা রায়না, ইনসাইড র, অনুবাদ: লে. (অব) আবু রূশদ, মিলারস প্রকাশনী, ১৯৯৪, ঢাকা, পৃ.৭৩।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!