You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিব বাহিনীর জন্ম 

নেতৃস্থানীয় সংগঠকদের দাবি

সর্বত্র, সব সময়- দু’ ধরনের ইতিহাস চালু আছে। একটিকে বলা যায়। অফিসিয়াল ইতিহাস- মিথ্যার ভাগই বেশি থাকে সেখানে। আরেকটি হলাে, একই অধ্যায়ের গােপন ইতিহাস- যেখানে আপনি ঘটনাবলির আসল কার্যকারণের হদিস পাবেন।

-Honore de Balzac (১৭৯৯-১৮৫০), ফরাসি ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার

মুজিব বাহিনীর প্রধান চার নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক১৯ ও তােফায়েল আহমেদ২০। ভারতীয়রা এই নেতাদের বলতেন অবিচ্ছেদ্য চার। মুক্তিযুদ্ধের পর শেখ মণি জীবিত ছিলেন চার বছর। আবদুর রাজ্জাক মারা গেছেন ২০১১-এর ২৩ ডিসেম্বর। বাকি দুজন এখনও জীবিত। কিন্তু চার জনের কেউই এই বাহিনীর জন্ম ও কার্যক্রম নিয়ে ক্ষুদ্র। আয়তনের সাক্ষাৎকার ব্যতীত কোথাও আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত কিছু লিখেননি, বলেননি। বিশেষত মুজিব বাহিনীর প্রধান এক সংগঠক সিরাজুল আলম খান বরাবরই এ বিষয়ে কোনাে আনুষ্ঠানিক মতামত দিতে অনিচ্ছুক। তবে তার একটি ‘অফিসিয়াল ওয়েবসাইট রয়েছে- যেখানে তাঁকে মুজিব বাহিনীর পূর্ববর্তী

………………………………………….

১৯। ১৯৪২ সালের ১ আগস্ট শরীয়তপুরে জন্ম। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে শতকোত্তর উত্তীর্ণ। ১৯৬৭-৬৮ সালে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে প্রথমে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। ‘বাকশাল’-এর তিন জন সম্পাদকের একজন তিনি। পরিশ্রমী সংগঠক হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

২০। জন্ম ১৯৪৩-এর ২২ অক্টোবর ভােলায়। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৃত্তিকাবিজ্ঞানে লাতকোত্তর অধ্যয়ন শেষ করেন। ১৯৬৬-৬৭ মেয়াদে ইকবাল হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি এবং ১৯৬৮ সালে ডাকসুর সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৯-৭০ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি হন। ১৯৭২ সালের ১৪ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব লাভ করেন। মুজিব বাহিনীর এই সংগঠক এখনও জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়।

Page 35

সাংগঠনিক কাঠামাে ‘স্বাধীনবাংলা নিউক্লিয়াস’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং বাংলাদেশের ‘স্থপতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।২১

সঙ্গতকারণেই এইরূপ বর্ণনা ও দাবি খুবই সংক্ষিপ্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। শেখ ফজলুল হক মণি’রও একইভাবে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত কোনাে বর্ণনা পাওয়া যায় না। যদিও যুদ্ধোত্তর সময়ে দৈনিক বাংলার বাণীতে নানান বিষয়ে বিস্তর লিখেছেন তিনি। এমনকি রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৫ খণ্ডে মুক্তিযুদ্ধের যেসব দলিলপত্র প্রকাশিত হয়েছে- একটি খণ্ড তার পুরােপুরি সাক্ষাৎকার বিষয়ে হলেও তাতে মুজিব বাহিনীর সংগঠকদের কারও বক্তব্য সংরক্ষিত হয়নি। এসবই বিস্ময়কর।

তবে একাত্তরে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমর কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই এই ছাত্র ও যুবনেতাদের সম্পর্কে এবং তাদের যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধপূর্ব সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম সম্পর্কে গুরুত্বের সঙ্গে মতামত দিয়েছেন। এরূপ মতামত প্রদানকারীদের মধ্যে বিশিষ্ট অনেকে এও দাবি করেছেন, সিরাজুলআলম খান ও তার ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযােগীরা মুক্তিযুদ্ধকালে মূলধারার সশস্ত্র সংগ্রামে খুব ক যই যুক্ত হতে পেরেছিলেন। এ প্রসঙ্গে মুক্তিবাহিনীর উপ-প্রধান। এবং ২০০৯ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এ কে খন্দকারের মন্তব্য বিস্ময়করভাবে অনেক তীব্র এবং সরাসরি : ‘মুজিব বাহিনীর বড় অংশ যুদ্ধ করেছে বলে বলে আমার জানা নেই। মুজিব বাহিনীর নেতৃত্ব পর্যায়ের খুব কম সদস্যই যুদ্ধ করেছেন।২২ অন্যদিকে মুজিব বাহিনীর প্রথম ব্যাচের একজন সদস্য সারােয়ার হােসেন মােল্লা, যিনি পরবর্তীকালে রক্ষীবাহিনীর পরিচালক হয়েছিলেন- বলেন, আমাদের প্রধান কাজ ছিল লিডারশিপ দেয়া, গাইড করা,..পলিটিক্যাল কর্মকাণ্ড। তবে শুধু পলিটিক্স দিয়ে তাে আর মানুষ ধরে রাখা যায় না, যদি না তাদের শেল্টার দিতে পারি। এই কারণে তখন কিছু কিছু অ্যাকশানে যেতে হয়েছে।২৩ পদমর্যাদার রকমফের থাকলেও যুদ্ধসংশ্লিষ্টদের এসব বিপরীতমুখী ভাষ্যে মুজিব বাহিনীর যুদ্ধ’ ও ‘অ্যাকশন’ সবকিছুকে ঘিরে ধূম্রজালই কেবল বেড়েছে।

মুজিব বাহিনীর প্রথম সারির সংগঠকদের মধ্যে কেবল প্রয়াত কাজী আরেফ আহমেদ ১৯৯৫ সালে তাদের যুদ্ধকালীন কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্যবহুল একটি লেখা

…………………………………………..

২১। দেখুন, http://www.serajulalamkhan.co.uk/prson.htm (retrived on 20th January 2013.)

২২। এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর, প্রথমা প্রকাশন, ডিসেম্বর ২০০৯, ঢাকা, পৃ. ১১৮। উল্লেখ্য, যুদ্ধকালীন সামরিক বাহিনীর উপ-প্রধান ছাড়াও যুদ্ধোত্তর বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন এ কে খন্দকার; বাকশালেরও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৯ পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। তার আগে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক সরকারের মন্ত্রী হিসেবেও কাজ করেছেন।

২৩। আমি সারােয়ার বলছি, বাংলাদেশ প্রতিদিন, প্রথম কিস্তি, ১ নভেম্বর ২০১২, ঢাকা।

Page 36

লিখেন দৈনিক জনকণ্ঠে।২৪ তার বক্তব্য অনুযায়ী, পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬২ সাল থেকে ছাত্রলীগে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে গােপন একটি ‘নিউক্লিয়াস’ কাজ করত- যে নিউক্লিয়াসের অপর দুই সদস্য ছিলেন আবদুর রাজ্জাক এবং কাজী আরেফ আহমেদ নিজে। পরে আরও অনেকে এই নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত হন। ঐ ‘গােপন’২৫ রাজনৈতিক নিউক্লিয়াসেরই একটি পরিবর্ধিত সংস্করণ হচ্ছে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী। তিনি লিখেছেন, ১৯৬৫ সাল থেকে নিউক্লিয়াসের তরফ থেকে আবদুর রাজ্জাক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক। পরে সাধারণ সম্পাদকও হন।

কাজী আরেফের উল্লিখিত বক্তব্য যে সময়কে নির্দেশ করছে তার আরেকটি।গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যময় দিক রয়েছে। কাজী আরেফের বক্তব্যের পাশাপাশি রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলা (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে

…………………………………………………..

২৪। কাজী আরেফ আহমেদ, ইতিহাসের নির্মোহ গতিধারা (ধারাবাহিক রচনা), দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৮-২৯ মার্চ ১৯৯৫, ঢাকা। সিরাজুল আলম খানদের ‘নিউক্লিয়াস’-এর অন্যতম সদস্য কাজী আরেফ আহমেদের জন্ম ১৯৪৩ সালের ৮ এপ্রিল কুষ্টিয়ার সদর থানার ঝাওদিয়া গ্রামে। ঢাকায় ১৪/৩ অভয়দাস লেনে পৈতৃক বাড়িতেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন কাটে সংগঠক হিসেবে বিকাশ মূলত ঢাকা মহানগরীতে। ওবায়দুর রহমান ও সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে তিনি এই সংগঠনের ঢাকা মহানগরীর সভাপতি হন (১৯৬৩ সালে)। ছয়দফার আন্দোলনে তিনি ঢাকা মহানগর।ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে বিশেষ সক্রিয় ছিলেন। শিক্ষা জীবনের শেষপর্যায় সমাপ্ত হয় তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগােল বিভাগে। ১৯৭৭ সালে তিনি ছাত্রলীগের সুপরিচিত নারী সংগঠক রওশন জাহান সাথীকে বিয়ে করেন। মিসেস সাথী ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ থেকে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে এমপি হন। ১৯৭৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি রওশন জাহান সাথীর পিতা জাসদের অন্যতম সহ-সভাপতি এডভােকেট মােশারফ হােসেন।গুপ্তহত্যার শিকার হলে দলের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগকেই ঐ হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করা হয়েছিল। কাজী আরেফ ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’রও অন্যতম সংগঠক। এই কমিটিতে তিনি ছাড়াও বিএলএফ’র বহু নেতৃস্থানীয় সংগঠক জড়াে হন- যাদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, আবদুল মান্নান চৌধুরী প্রমুখ।

২৫। বারবার ‘গােপন’ বলা হলেও আলােচ্য এই নিউক্লিয়াস এবং এর রাজনৈতিক বিশেষত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলও যে অবহিত ছিল তার প্রমাণ মেলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের গােপন নথিতেও। ১৯৭১-এর ২৯ জানুয়ারি দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঢাকার দূতাবাস থেকে প্রেরিত গােপন নথি থেকে দেখা যায়- ‘notoriously difficult’ এই ‘group’ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যেহেতু এই গ্রুপই হলাে আওয়ামী লীগের সমাবেশ শক্তির মেরুদণ্ড সে কারণে দলটির নেতৃত্ব এদের দাবি কতটা উপেক্ষা করতে পারবে তার ওপরই পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আরও দেখুন, The American Papers: Secret and Confidential, India-pakistan-Bangladesh Documents 1965 to 1973, Compiled and selected by Roedad “Khan, Oxford, 1999, p. 459.

Page 37

যা খ্যাত, যদিও মামলায় উত্থাপিত অভিযােগ পুরােটাই যে সত্য ছিল সে সম্পর্কে অভিযুক্তরাই সম্প্রতি স্বীকার করছেন)২৬-এর বিষয়বস্তুকে যৌথভাবে বিবেচনায় নিলে দেখা যায় শেখ মজিবর রহমান স্বাধীন পূর্ববাংলার জন্য শিক্ষাঙ্গনে সিরাজ-রাজ্জাক-আরেফদের যে সময়ে ‘নিউক্লিয়াস’ বা ‘বিপ্লবী পরিষদ গঠন করতে উৎসাহ যােগাচ্ছেন এবং নিজে তাতে শরিক হচ্ছেন- ঠিক সে-সময়ে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি অফিসাররা সশস্ত্র পন্থায় সামরিক কু’র আদলে পূর্ববাংলার ক্যান্টনমেন্টগুলাে দখল করে দেশের এ অঞ্চলকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে যে ‘বিপ্লবী সংস্থা বা সেল গঠন করে তাতেও তিনি নিজেকে যুক্ত করছেন।

১৯৬৮ সালে দায়েরকৃত রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য মামলার বিবরণী থেকে দেখা যায়, ১৯৬৪ সাল থেকে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন২৭-এর নেতৃত্বে বাঙালি সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তারা একযােগে সেনা ছাউনিগুলাে দখল করে পশ্চিম পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের বন্দি করার মাধ্যমে পূর্ববাংলাকে স্বাধীন করার জন্য কাজ করছিলেন। তাঁদের উদ্যোগে স্থানীয় ভারতীয় দূতাবাসের নিয়মিত সহযােগিতা ছিল। উপরিউক্ত বিপ্লবী পরিষদ।ভারতীয়দের সঙ্গে দীর্ঘ যােগাযােগের ভিত্তিতে দু’জন সদস্যকে প্রতিশ্রুত অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারত নিয়ন্ত্রিত আগরতলাও পাঠিয়েছিল ১৯৬৭ সালের ১২ জুলাইয়ে।২৮ এসবই হচ্ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের জ্ঞাতসারে। সশস্ত্র সামরিক

……………………………………………………

২৯। দেখুন, কর্নেল (অব.) শওকত আলী, সত্য মামলা আগরতলা, প্রথমা, ২০১১, ঢাকা। এই গ্রন্থ প্রকাশকালে তিনি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার ছিলেন। উল্লিখিত মামলার ৩৫ জন আসামীর একজন তিনি।

২৭। মােয়াজ্জেম হােসেন আগরতলা মামলার ২নং আসামী ছিলেন। ১৯৩২ সালে পিরােজপুরে জন্ম। ১৯৫০ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীতে যােগ দিয়েছিলেন। ১৯৬৫ সালে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হন। বাঙালি সৈনিকদের সংগঠিত করে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীতে একটি গুপ্ত সংগঠন গঠন করেছিলেন। পরে এই সংগঠনের তৎপরতার বিষয় ফাঁস হয়ে যায়। ১৯৬৭ সালের ৯ ডিসেম্বর আটক হন এবং তাকে আগরতলা মামলার আসামি করা হয়। মুক্তি পান। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ ঢাকার এলিফ্যান্ট রােডে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন। সামরিক পরিমণ্ডলে ব্যাবহারিক অর্থে তাকেই বাংলাদেশের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে অভিহিত করা যায়। বিশেষ করে ‘৬৯-এর ফেব্রুয়ারির পর থেকে পূর্ব-পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে মাঠ পর্যায়ে একদফার আন্দোলন শুরু করেছিলেন তিনি এবং ১৯৭০-এর ২৮ মার্চ এ লক্ষ্যে লাহাের প্রস্তাব বাস্তবায়ন কমিটি’ নামে একটি সংগঠনও গড়ে তােলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাঁর রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে কোনাে উল্লেখ্যযােগ্য অনুসন্ধান হয়নি, যা বিস্ময়কর।

২৮। ১৯৬৭-এর জুলাইয়ের এই যােগাযােগপর্ব সম্পর্কে বিস্তারিত এক বিবরণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের লে. জে. কামাল মতিনুদ্দীনের লেখা ‘Tragedy of Errors’ (Wajidalis, Lahore, Pakistan, 1994, p. 262-64) গ্রন্থে। সেখানে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এই কর্মকর্তা জানাচ্ছেন, ভারতীয় যে দূতাবাস কর্মকর্তা ঐ সময় পূর্ববাংলার রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন তিনি হলেন দূতাবাসের চট্টগ্রামস্থ ফাস্ট সেক্রেটারি Mr. P. N Ojha, ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে লােকসভা নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর বিজয়ে এই যােগাযােগ বেগবান হয়।

Page 38

অফিসারদের এই বিপ্লবী সংস্থার সঙ্গে মাঝে মাঝে করাচি, ঢাকা ইত্যাদি নানান স্থানে বৈঠক করতেন মুজিবুর রহমান। এ থেকে লক্ষ্য করা যায়, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির বাইরে ১৯৬২-৬৩-এর পর থেকে মুজিবুর রহমান জ্ঞাতসারে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার জন্য একাধিক গােপন তৎপরতায়ও যুক্ত ছিলেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে তা ভারতীয় সহযােগিতার মাধ্যমেই এগােচ্ছিল । উপরে আরেফ আহমেদের দেওয়া ছাত্রলীগকেন্দ্রিক নিউক্লিয়াসের যে বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে তার পরবর্তী বিকাশকে ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলার আলােকে মনােযােগসহ লক্ষ্য করলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক নতুন অধ্যয়ন-সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য মামলার অভিযােগনামা এবং উপস্থাপিত অভিযােগ সম্পর্কে অন্যতম অভিযুক্ত কর্নেল শওকত আলীর বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যবহ। তিনি স্পষ্টত জানাচ্ছেন, অভিযােগনামায় উল্লিখিত ঘটনা সত্য ছিল।২৯

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আরেকজন অভিযুক্ত বেসামরিক কর্মকর্তা আহমেদ ফজলুর রহমানও তাঁর সাক্ষাৎকারে অনুরূপ সাক্ষ্য দিয়েছেন। পাকিস্তানে প্রথম মার্শাল ল’র সময় থেকে স্বাধীনতার চিন্তাটা শুরু। আমরা কয়েকজন- রুহুল কুন্দুস, মােয়াজ্জেম হােসেন চৌধুরী মিলে…শেখ মুজিবও আসতেন। অধিকাংশ মিটিং হয়েছে আমার শশুরবাড়ি ১০ আগামসি লেনে।…তখন থেকে আমরা বাংলাদেশকে আলাদা করার কথা ভাবছি। আমরা তখন ভারতের সাহায্য গ্রহণের চেষ্টা করি। ইন্ডিয়ার সঙ্গে প্রথম যােগাযােগ আমিই করেছি। আমাদের যেসব মিটিং হতাে সেখানে ইন্ডিয়ার হাইকমিশনের ফাস্ট সেক্রেটারিও আসতেন। …ভারতীয় গােয়েন্দাদের সঙ্গে আলােচনায় স্বাধীনতার ব্যাপারে সাহায্য চাইতাম । দরকার ছিল আর্মস।…শেখ সাহেব সব জানতেন। তাঁকে আগরতলায়ও পাঠানাে হয় ।৩০

১৯৬২ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলা যাত্রার অন্তরঙ্গ সেই বিবরণ পাওয়া যায় তার ফুফাতাে ভাই মমিনুল হক খােকা’র তরফ থেকেও। মমিনুল হক খােকা তখন মুজিব পরিবারের সঙ্গে একই বাসাতে থাকতেন। তিনি বিস্তারিত জানিয়েছেন, কীভাবে দুই সিএসপি প্রয়াত রুহুল কুদুস ও আহমেদ ফজলুর

………………………………………..

২৯। শওকত আলী, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩৫।

৩০। সাক্ষাৎকারের বিস্তারিত দেখুন, আফসান চৌধুরী, বাংলাদেশ ১৯৭১, চতুর্থ খণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, ‘ঢাকা, ২০০৭, পৃ. ১৮০-১৮১। এই বিষয়ে আরও আলােকপাত করা হয়েছে পরবর্তী উপ-অধ্যায়ে।

Page 39

রহমান এবং সিলেটের চা বাগান মালিক মােয়াজ্জেম হােসেন চৌধুরী মুজিবের ঐ যাত্রার আয়ােজন করেছিলেন। ঢাকার ফুলবাড়িয়ার পরিবর্তে কুর্মিটোলা থেকে মুজিবুর রহমান সেবার ট্রেনে করে প্রথমে কুলাউড়া যান এবং সেখান থেকে পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন। মমিনুল হক খােকাই তাঁকে ট্রেনে তুলে দিয়েছিলেন।৩১

তারপরও অবশ্য ‘আগরতলা মামলা’কে ষড়যন্ত্র হিসেবেই চিহ্নিত করেছিল পূর্ব-পাকিস্তানের তখনকার রাজনীতি এবং সেই রাজনীতি মােকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়েই পাকিস্তান সরকার ঐ মামলায় অভিযুক্তদের ছেড়ে দেয় ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। আর মুজিবুর রহমান আগরতলা মামলার আটকাবস্থা থেকে মুক্ত হওয়ার পর- কাজী আরেফ জানাচ্ছেন, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তাঁকে নিয়ে একটি ‘ফোরাম’ গড়ে তােলা হয়। পরবর্তীকালে, ১৯৭০ সালের নভেম্বরের কোনাে এক সময় ছাত্রলীগের মধ্যে যারা সিরাজুল আলম খানের নিউক্লিয়াসে জড়িত ছিলেন না তাদের মধ্য থেকে আরও দু’জনকে (শেখ ফজলুল হক মণি ও তােফায়েল আহমেদ) ঐ ফোরামে যুক্ত করা হয়। এটা ঘটেছিল একই সঙ্গে মুজিবের আগ্রহ এবং নিউক্লিয়াস’ সংগঠকদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে।৩২ মুজিব বাহিনীর নেতৃস্থানীয় সংগঠক হওয়া ছাড়াও একই সঙ্গে মুজিব বাহিনীর উৎস সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’-এরও প্রাথমিক তিন সদস্যের একজন ছিলেন বিধায় কাজী আরেফের মুজিব বাহিনী সম্পর্কিত উপরিউক্ত বক্তব্যকে বর্তমান অনুসন্ধানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হিসেবে নেয়া হয়েছে।

ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কথিত ঐ নিউক্লিয়াস সম্পর্কে সাংগঠনিকভাবে আরও বিস্তৃত এবং কিছুটা ভিন্নতর বিবরণ দিয়েছেন পরবর্তীকালে নিউক্লিয়াসভুক্ত তত্ত্বালীন আরেক ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব।৩৩ ১৯৬৯-৭০ পর্যায়ের

…………………………………………………….

৩১। মমিনুল হক খােকা, অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল : বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০০, পৃ. ৮৪-৮৭।

৩২। কাজী আরেফ আহমেদ-এর এ ভাষ্যটি এ কারণেও গুরুত্বপূর্ণ যে, তাঁর দাবি থেকে স্পষ্ট, ১৯৭১-এর অন্তত নয় বছর আগে থেকে পাকিস্তান ভেঙে পূর্ববাংলায় একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করছিলেন তারা এবং আওয়ামী লীগের বয়ােজ্যেষ্ঠ অন্যান্য নেতাদের অজ্ঞাতেই শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন। পরের আলােচনায় আমরা দেখবাে, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে কোনাে এক পর্যায়ে ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থার সম্পৃক্তি মুজিবের মাধ্যমেই ঘটে, যদিও আরেফ আহমেদ তা অস্বীকার করেছেন।

৩৩। আ স ম আবদুর রব, মুক্তিযুদ্ধে উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ভূমিকা, কালের কণ্ঠ, ২৪ জানুয়ারি ২০১৩, ঢাকা। অপর এক সাক্ষাৎকারে আবদুর রব নিউক্লিয়াসের শুরু সম্পর্কে নিম্নোক্ত বক্তব্য দেন: সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ-এই তিনজন নিউক্লিয়াস ওপেন করেন। পরে আমি, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, আবুল কালাম আজাদ, আমিনুল হক বাদশা, শাজাহান সিরাজ, স্বপন চৌধুরী যুক্ত হই।’

Page 40

ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আ স ম রবের মতে, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফের বাইরে আরাে দুজনকে পরে নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। তারা হলেন ছাত্রলীগ নেতা আবুল কালাম আজাদ ও এম এ মান্নান।৩৪ ১৯৬৮ নাগাদ এই নিউক্লিয়াস সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানের স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়গুলােতে ৩০০ ইউনিট গঠন করে। প্রতি ইউনিটে ৯ জন করে সদস্য ছিল। প্রতি মহকুমায় ৪-৫ জন সদস্য থাকতেন। মহকুমার বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঁচ জন সদস্য নিয়ে গােপন কমিটি গঠিত হতাে। ১৯৬৮-৭০ নাগাদ নিউক্লিয়াসের সদস্য দাড়ায় সাত হাজার । আ স ম আব্দুর রব অবশ্য তাঁর ভাষ্যে ‘শেখ মুজিবুর রহমান’-এর অনুরােধে কেবল ফজলুল হক মণিকে নিউক্লিয়াসভুক্ত করা হয় বলে উল্লেখ করেন; তবে এও বলেন, “নিউক্লিয়াসের সবাই ভারতে ট্রেনিং নিয়েছিলেন।”

কাজী আরেফ আহমেদ পূর্বে উল্লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছেন, শেখ মুজিবুর রহমান সে সময়ই (অর্থাৎ একাত্তরের আগেই) চার যুব নেতাকে (সিরাজ, মণি, রাজ্জাক ও তােফায়েল) পাকিস্তানি সামরিক শক্তির সম্ভাব্য আঘাত মােকাবেলার প্রস্তুতি হিসেবে ছাত্র-যুবকদের জঙ্গী বাহিনী গড়ে তােলার নির্দেশ দেন এবং এভাবেই প্রতিষ্ঠা ঘটে বিএলএফ-এর। এই সংগঠনের সঙ্গে ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সংশ্লিষ্টতা আষাঢ়ে গল্প মাত্র।’ কাজী আরেফ আরও লিখেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চের আগে (তাজউদ্দীনের উপস্থিতিতে) ঐ চার যুব নেতাকে কলকাতার ভবানীপুরস্থ একটি ঠিকানা দিয়ে সশস্ত্র লড়াই-সংগ্রামের দায়িত্ব ও সামরিক সহায়তার সূত্র দিয়েছিলেন এবং মুজিবের নির্দেশ ছিল পাকিস্তানী আগ্রাসনের মুখে যেন রাজনৈতিকভাবে একটি বিপ্লবী কাউন্সিল’ গঠন করা হয়। আরেফ আরও দাবি করেছেন, ‘চার নেতা ও বিএলএফ-এর উপরিউক্ত বিষয়াদি সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদ সবই জানতেন।…এবং মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধানে ভারতীয়দের কোন রকম হস্তক্ষেপের সুযােগ ছিল না। সম্পূর্ণ স্বাধীন, স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও নিয়ন্ত্রণে মুজিব বাহিনী দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়।৩৫ তবে বিএলএফকে যে ভারতীয় জেনারেল উবান-ই প্রশিক্ষণ দেন এটা কাজী আরেফ স্বীকার করেছেন!

বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী সম্পর্কে প্রায় অনুরূপ বক্তব্য রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাকের এক ক্ষুদ্র সাক্ষাৎকারে৩৬ এবং তােফায়েল

……………………………………………………

৩৪। আবুল কালাম আজাদ সদস্য হন ১৯৬৩ সালে; অন্যদিকে এম এ মান্নান সদস্য হন ১৯৬৫ সালে । এম এ মান্নান পরে শেখ মণি’র অনুসারী হয়ে পড়ায় তাকে নিউক্লিয়াস প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়। আবুল কালাম আজাদও একপর্যায়ে বাদ পড়েন- আদর্শগত কারণে।

৩৫। কাজী আরেফ আহমেদ, পূর্বোক্ত, ৩০ মার্চ ১৯৯৫।

৩৬। দেখুন, মাসুদুল হক, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘র’ এবং সিআইএ, গণপ্রকাশন, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ. ১২৪ ।

Page 41

আহমেদের এক ক্ষুদ্রায়তনের লেখায় ।৩৭ তােফায়েল আহমেদ সেখানে বলেন,

“একাত্তরের ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের চার জন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল

আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে বঙ্গবন্ধু ডাকেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে।

বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, ‘পড়াে, মুখস্থ কর। আমরা মুখস্থ করলাম, একটা

| ঠিকানা- ২১ রাজেন্দ্র রােড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। বলেছিলেন,

| ‘এইখানে হবে তােমাদের জায়গা।…আক্রান্ত হলে এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ

সংগঠিত করবে। বঙ্গবন্ধু সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। চিত্তরঞ্জন সুতারকে

আগেই কলকাতায় প্রেরণ করেছিলেন। ডাক্তার আবু হেনা প্রাদেশিক পরিষদ

সদস্য। তাকেও বঙ্গবন্ধু আগেই পাঠিয়েছিলেন অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে ।

| যে পথে আবু হেনা গিয়েছিলেন, সেই একই পথে তিনি মনসুর আলী,

কামরুজ্জামান, মণি ভাই ও আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাজেন্দ্র রােডে আমরা

অবস্থান করতাম। ৮ থিয়েটার রােডে অবস্থান করতেন জাতীয় চার নেতা।

| নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার নিয়মিত যােগাযােগ হতাে।”

| বিএলএফ-এর প্রতিষ্ঠা বিষয়ে কিছুটা ভিন্ন আরেকটি ভাষ্য পাওয়া যায়

মুজিব বাহিনীর আরেক সুপরিচিত সংগঠক অধ্যাপক আফতাব আহমাদ-এর তরফ

থেকে। তার মতে, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রলীগের সমাজতন্ত্র

| অনুরাগী র্যাডিক্যাল ধারার কর্মীরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের অনুপ্রেরণা থেকে সেখানকার

| ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের আদলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মুক্ত করার জন্য

| বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করার চিন্তা করতেন। কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের

আরেকজন বিএলএফ সংগঠক ডা. মাহফুজুর রহমান দাবি করেছেন, সশস্ত্র যুদ্ধের

| মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে এই চিন্তা থেকে বঙ্গবন্ধু নিউক্লিয়াসের

| দুইজন ও শাসনতান্ত্রিক গ্রুপের দুইজন মােট চারজনকে নিয়ে যুদ্ধ শুরুর আগেই

বাংলাদেশে বসে বিএলএফ গঠন করেন। নিউক্লিয়াস গ্রুপ ও শাসনতান্ত্রিক

গ্রুপ বলতে এখানে সিরাজুল আলম খান ও শেখ মণি গ্রুপের কথা বলা হচ্ছে।

বিএলএফ সম্পর্কে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্র-যুব নেতাদের এসব ভাষ্যের

| সাধারণ সমর্থনসূচক বক্তব্য পাওয়া যায় প্রান্তিক জেলাগুলােতে অবস্থানকারী

তােফায়েল আহমেদ, জাতীয় চার নেতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, দৈনিক প্রথম আলাে, ৩

নভেম্বর ২০১২, ঢাকা।

প্রয়াত আফতাব আহমাদের মতে, বিএলএফ সম্পর্কিত ঐরূপ চিন্তাকারীদের মধ্যে ছিলেন

ছাত্রলীগের চিশতী হেলালুর রহমান, নজরুল ইসলাম, আ ফ ম মাহবুবুল হক, রায়হান

ফেরদৌস মধু, বদিউল আলম, একরামুল হক প্রমুখ। ১৯৬৯ সালের পর ঢাকার বিভিন্ন

দেয়ালে বিএলএফ-এ যােগ দিন’ শ্লোগানও লেখা হয়েছিল। কিন্তু তা খুব বেশি গুরুত্ব

পায়নি। দেখুন, দুঃসময়ের চালচিত্র ‘সরাসরি, দৈনিক ইনকিলাব, ১৫ এপ্রিল ২০০০, ঢাকা ।

ডা, মাহফুজুর রহমান, বঙ্গবন্ধু: ছাত্রলীগ-নিউক্লিয়াস, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম,

২০১৩, পৃ. ১৭৩।

Page 41

আহমেদের এক ক্ষুদ্রায়তনের লেখায় ।৩৭ তােফায়েল আহমেদ সেখানে বলেন, “একাত্তরের ১৮ ফেব্রুয়ারি আমাদের চার জন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও আমাকে বঙ্গবন্ধু ডাকেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন, ‘পড়াে, মুখস্থ কর। আমরা মুখস্থ করলাম, একটা ঠিকানা- ২১ রাজেন্দ্র রােড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা। বলেছিলেন, ‘এইখানে হবে তােমাদের জায়গা।…আক্রান্ত হলে এখান থেকেই মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করবে। বঙ্গবন্ধু সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। চিত্তরঞ্জন সুতারকে আগেই কলকাতায় প্রেরণ করেছিলেন। ডাক্তার আবু হেনা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। তাকেও বঙ্গবন্ধু আগেই পাঠিয়েছিলেন অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে । যে পথে আবু হেনা গিয়েছিলেন, সেই একই পথে তিনি মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, মণি ভাই ও আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। রাজেন্দ্র রােডে আমরা অবস্থান করতাম। ৮ থিয়েটার রােডে অবস্থান করতেন জাতীয় চার নেতা। নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আমার নিয়মিত যােগাযােগ হতাে।”

বিএলএফ-এর প্রতিষ্ঠা বিষয়ে কিছুটা ভিন্ন আরেকটি ভাষ্য পাওয়া যায় মুজিব বাহিনীর আরেক সুপরিচিত সংগঠক অধ্যাপক আফতাব আহমাদ-এর তরফ থেকে। তার মতে, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্রলীগের সমাজতন্ত্র অনুরাগী র্যাডিক্যাল ধারার কর্মীরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের অনুপ্রেরণা থেকে সেখানকার ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের আদলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করার চিন্তা করতেন।৩৮ কিন্তু চট্টগ্রাম অঞ্চলের আরেকজন বিএলএফ সংগঠক ডা. মাহফুজুর রহমান দাবি করেছেন, সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে এই চিন্তা থেকে বঙ্গবন্ধু নিউক্লিয়াসের দুইজন ও শাসনতান্ত্রিক গ্রুপের দুইজন মােট চারজনকে নিয়ে যুদ্ধ শুরুর আগেই বাংলাদেশে বসে বিএলএফ গঠন করেন।৩৯ নিউক্লিয়াস গ্রুপ ও শাসনতান্ত্রিক গ্রুপ বলতে এখানে সিরাজুল আলম খান ও শেখ মণি গ্রুপের কথা বলা হচ্ছে। বিএলএফ সম্পর্কে তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্র-যুব নেতাদের এসব ভাষ্যের  সাধারণ সমর্থনসূচক বক্তব্য পাওয়া যায় প্রান্তিক জেলাগুলােতে অবস্থানকারী

………………………………………..

৩৭। তােফায়েল আহমেদ, জাতীয় চার নেতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, দৈনিক প্রথম আলাে, ৩ নভেম্বর ২০১২, ঢাকা।

৩৮। প্রয়াত আফতাব আহমাদের মতে, বিএলএফ সম্পর্কিত ঐরূপ চিন্তাকারীদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের চিশতী হেলালুর রহমান, নজরুল ইসলাম, আ ফ ম মাহবুবুল হক, রায়হান ফেরদৌস মধু, বদিউল আলম, একরামুল হক প্রমুখ। ১৯৬৯ সালের পর ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে বিএলএফ-এ যােগ দিন’ শ্লোগানও লেখা হয়েছিল। কিন্তু তা খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি। দেখুন, দুঃসময়ের চালচিত্র ‘সরাসরি, দৈনিক ইনকিলাব, ১৫ এপ্রিল ২০০০, ঢাকা ।

৩৯। ডা. মাহফুজুর রহমান, বঙ্গবন্ধু: ছাত্রলীগ-নিউক্লিয়াস, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম, ২০১৩, পৃ. ১৭৩।

Page 42

তাদের সহযােগীদের কাছ থেকেও। ছাত্রলীগে সিরাজপন্থীরা যে সম্ভাব্য মুক্তিযুদ্ধে ভিন্ন কোনাে অবস্থান নিতে যাচ্ছে এবং সে বিষয়ে তারা যে দেশব্যাপী দূরবর্তী জেলার ছাত্র সংগঠকদেরও পরিকল্পিতভাবে নেটওয়ার্কভুক্ত করছিল তার স্পষ্ট সাক্ষ্য মেলে সেই সময়কার বৃহত্তর সিলেটের একজন ছাত্রনেতা মাহবুবুর রব সাদীর বক্তব্যে। সাদী সেসময় ছাত্রলীগে সিরাজপন্থী হলেও তিনি এইরূপ পরিকল্পনার বিরােধিতা করে মুজিব বাহিনীর পরিবর্তে চতুর্থ সেক্টরে যুদ্ধে যােগ দেন।৪০ তবে সবাই সাদীর মতাে ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন এক্ষেত্রে স্বল্প ব্যতিক্রমদের একজন। সিরাজুল আলম খানের পৃথক কাঠামাের আহ্বানে তার অধিকাংশ অনুসারী ইতিবাচকভাবেই সাড়া দিয়েছে।৪১

উপরে মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ সম্পর্কিত কাজী আরেফ আহমেদের বক্তব্য এবং তার বক্তব্যের সমর্থনসূচক অন্যান্য (আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব, আফতাব আহমাদ, মাহবুবুর রব সাদী প্রমুখের) যেসব বক্তব্যের উল্লেখ করা হলাে তার সারসংকলন থেকে নিম্নোক্ত দাবিসমূহ উত্থাপিত হয় :

………………………………………………………….

৪০। মাহবুবুর রব সাদী পরে জাসদ গঠনকালে সিরাজ অনুসারীদের মাঝে ফিরে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে ভিন্নভাবে সক্রিয়তার পটভূমি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি জানান, ২৫ মার্চের পর সিরাজ গ্রুপের পক্ষ থেকে আমার কাছে স্বপন চৌধুরীকে পাঠানাে হলাে। তার মাধ্যমে জানতে পারলাম, মূল কমান্ডের বাইরে ভিন্ন এক কমান্ডে আমরা প্রশিক্ষণ নেব। আমাদের ব্যবস্থাপনা থাকবে আলাদা। আমি যেন সেভাবে অন্যদের প্রস্তুত করি। কিন্তু মুজিবের নেতৃত্ব ছাড়া ভিন্ন কমান্ডে যাওয়াকে আমার কাছে তখন মনে হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধকে দ্বিধাবিভক্ত করা। তাই স্বপন চৌধুরীকে সেটা জানিয়ে দিলাম। আমার এই বক্তব্য অবশ্য বৃহত্তর সিলেটে ছাত্রলীগের সিরাজপন্থী কেউ গ্রহণ করলাে না। ওরা স্বপন চৌধুরীর নির্দেশনা অনুযায়ী চললাে। আমিও ভিন্ন পথে ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে চতুর্থ সেক্টরে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে জকিগঞ্জ-কানাইঘাট এলাকায় যুদ্ধে যােগ দিলাম। উল্লেখ্য, বৃহত্তর সিলেটে মুজিব বাহিনী গঠনে নেতৃত্ব দেন আখতার আহমদ (বালাগঞ্জ)। তিনি ছিলেন সিরাজুল আলম খানদের নিউক্লিয়াসের সদস্য এবং জেলা ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক (‘৬৫-‘৬৬); পরে সভাপতিও হন (‘৬৬-‘৬৭)। জাসদ গঠনকালে তাকে কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদক হিসেবে দেখা যায়। পরে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। ১৯৮৬ সালের ৫ আগস্ট মারা যান তিনি।

৪১। এরূপ আরেকজন আঞ্চলিক নেতা সিরাজগঞ্জের আবদুর রউফ পাতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘মুক্তিবাহিনীর বাহিরে পৃথক একটি বাহিনীতে যােগ দেয়ার এরূপ আহ্বান নিয়ে আপনাদের মনে কোনাে প্রশ্ন ওঠেনি তখন? উত্তরে বর্তমান লেখককে তিনি বলেন, প্রশ্ন ওঠেছিল । কিন্তু ‘দাদা’র ওপর আমাদের প্রচণ্ড আস্থা ছিল। আমরা ভাবতাম উনি যা করছেন নিশ্চয়ই তা কোনাে সুপরিকল্পনার ধাপ মাত্র। আমরা আসলে প্রশ্নহীনভাবে ওনাকে অনুসরণ করতাম।’ উল্লেখ্য, আবদুর রউফ পাতা পরে জাসদেও যােগ দিয়েছিলেন। ‘দাদা’ বলতে এখানে তিনি সিরাজুল আলম খানকে বুঝিয়েছেন।

Page 43

প্রথমত, মুজিব বাহিনী বা বিএলএফ গঠিত হয়েছে ২৫ মার্চের আগেই; আরও স্পষ্টভাবে বললে, এ হলাে ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ নিউক্লিয়াস নামক গােষ্ঠীরই ধারাবাহিক বিকাশ এবং সম্ভাব্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার ভার মুখ্য নেতা শেখ মুজিব নিজেই এ বাহিনীর ওপর অর্পণ করেছিলেন।৪২

দ্বিতীয়ত, মুজিব বাহিনীর কার্যক্রমের সূচনাতেই সিরাজুল আলম খানদের নিউক্লিয়াসের৪৩ পাশাপাশি তাতে ছাত্রলীগের মণি-তােফায়েল-মাখনদের নেতৃত্বাধীন অংশের সমন্বয় ঘটেছিল।

তৃতীয়ত, নিউক্লিয়াসের একাংশ একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন দেখতেন।

চতুর্থত, বিএলএফ বা মুজিব বাহিনীর সঙ্গে মুজিবের সম্পর্ক বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদ ওয়াকিবহাল ছিলেন।

………………………………………………

৪২। কাজী আরেফ আহমেদের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে না থাকলেও অন্যান্য সূত্রে এও সমর্থিত হচ্ছে যে, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ এসময় একটি সশস্ত্র শাখার গােড়াপত্তন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘৭১-এর শুরু থেকে ইকবাল হলে, বর্তমানে যা জহুরুল হক হল, রাতে নকল রাইফেল নিয়ে ট্রেনিং হতাে । দেখুন, শামসুদ্দিন আহমেদ-এর সাক্ষাঙ্কার, আফসান চৌধুরী, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪২। অর্থাৎ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ একাত্তরের বহু পূর্বে ছাত্রদের মাঝে সশস্ত্র কার্যক্রমের সূচনা ঘটিয়েছিল। কেবল ঢাকায় নয়, অন্যান্য অনেক জেলাতে ২৫ মার্চের পূর্বে এরূপ প্রশিক্ষণের কথা জানা যায়। যেমন কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের মুজিব বাহিনী সদস্য জিয়ারুল ইসলাম ২৫ মার্চের পূর্বে ছাত্রাবস্থায় তার খুলনার বিএল কলেজের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সেখানে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ছাত্রলীগের তত্ত্বাবধানে রাতের আঁধারে ছাত্রদের সামরিক প্রশিক্ষণ হতাে এবং তাতে এক পর্যায়ে সত্যিকারের অস্ত্র নিয়েই প্রশিক্ষণ চালু হয়। একজন অবসরপ্রাপ্ত সিপাহি এখানে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ২০১৩ সালের ১১ অক্টোবর ঢাকার মােহাম্মদপুরে নিজ বাসায় তাঁর এই সাক্ষাৎকার নেয়া হয়।

৪৩। সিরাজুল আলম খানদের নিউক্লিয়াসের একটি সমাজতান্ত্রিক আকাক্ষা ছিল বলে বিভিন্ন উৎস থেকে শক্তিশালী সাক্ষ্য মেলে। তারপরও কেন খান নিজস্ব নিউক্লিয়াসে ছাত্রলীগের সমাজতন্ত্র বিরােধী গ্রুপের পুরােধাদের অন্তর্ভুক্তি মেনে নিলেন তার ব্যাখ্যা হিসেবে মনে করা হয়- মুজিবের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার এবং তার মাধ্যমে প্রাপ্তব্য সম্ভাব্য ভারতীয় সহযােগিতা ব্যবহারের স্বার্থে তা ঘটেছিল। অন্যদিকে মুজিব সমাজতন্ত্রের অনুসারী না হওয়া সত্ত্বেও যুবনেতা শেখ মণি ও তােফায়েল আহমেদকে এই নিউক্লিয়াসে অন্তর্ভুক্ত করিয়েছিলেন আন্দোলনের ঐ ভরকেন্দ্রে তার কর্তৃত্ব বাড়াতে। লক্ষ্যণীয়, ইতিহাসের এই সময়টিতে ‘সমাজতন্ত্রী এবং সমাজতন্ত্র বিরােধী উভয়ে পরস্পর যুথবদ্ধ হচ্ছে কেবল প্রভাববলয় বিস্তৃতির প্রয়ােজনে, মতাদর্শিক বিবেচনা থেকে নয় । আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, সেসময় দেশের মূলধারার সমাজতন্ত্রীরা তাদের আদর্শ বপনের জন্য প্রথাগতভাবে শিল্পাঞ্চল ও কৃষক সমাজকে বেছে নিলেও সিরাজুল আলম খান কর্মএলাকা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ইকবাল হল, এস এম হল, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আহসানউল্লাহ হল, ক্যাফেটিরিয়া ইত্যাদি স্থানকে । তিনি তখন ছাত্রদের নিকট-ভবিষ্যতের রাজনীতির স্ট্রাইকিং ফোর্স’ মনে করতেন । তার এ অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।

Page 44

পঞ্চমত, মুজিব বাহিনী ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ এন্ড এনালিসিস উইং (Research and Analysis Wing- RAW)-এর সৃষ্টি এ তথ্য সঠিক নয়। যদিও শেখ মুজিবুর রহমান একটি সুনির্দিষ্ট ঠিকানা দিয়ে ছাত্রনেতাদের সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে বলেছেন এবং এক্ষেত্রে দু’জন মধ্যবর্তী ব্যক্তি ছিলেন চিত্তরঞ্জন সূতার ও ডা. আবু হেনা।৪৪

ষষ্ঠত, মজিব বাহিনীর সঙ্গে প্রবাসী সরকারের মুখ্যব্যক্তিদের বৈরিতার বিষয়টি একেবারেই ঠিক নয় বরং তারা এই সংস্থাটি সম্পর্কে পূর্বাপর অবহিত ছিলেন।

মুজিব বাহিনী বিষয়ে উপরিউক্ত প্রতিটি দাবি বা মতকেই পরবর্তী অধ্যায়গুলােতে প্রাসঙ্গিক সূত্র ও বাস্তব তথ্যের আলােকে যাচাই করা হবে এবং আমরা দেখবাে, এসব অভিমতে সত্য ও মিথ্যার বিপজ্জনক মিশ্রণ ঘটে গেছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সিরাজুল আলম খানদের নিউক্লিয়াসের গঠন এবং তার পরবর্তী কাঠামাে হিসেবে ‘মুজিব বাহিনীর উপরে উল্লিখিত বিকাশকে এ পর্যায়ে পূর্ববাংলার তৎকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলনের পটভূমিতেও বিবেচনা করা জরুরি। কারণ যুদ্ধকালে এবং যুদ্ধের পরপর দ্রুত ব্যাপকভাবে মুজিব বাহিনীকে দেশের বামপন্থী বলয়ে মতাদর্শিকভাবে এবং শারীরিকভাবেও এক নতুন চরিত্র। হিসেবে আবির্ভূত হতে দেখা যাবে। ইতিহাসের ঐ সময়টিতে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত বামপন্থীরা যখন ‘শ্রেণি বৈষম্য’ হিসেবে দেখছিল ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে সিরাজুল আলম খানদের উল্লিখিত ‘নিউক্লিয়াস’ তখন একে ‘জাতিগত বৈষম্য হিসেবে ব্যাখ্যা করে। যে কারণে কথিত নিউক্লিয়াসকে এর উদ্যোক্তারা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে অভিহিত করতেন।

পূর্ববাংলায় এসময় অন্তত একটি মস্কোপন্থী (মনি সিংহয়ের নেতৃত্বাধীন) এবং পাঁচটি পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বা গ্রুপ সক্রিয় ছিল। এসব উপদলের নেতা ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুল হক, দেবেন শিকদার, আবুল বাশার, আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন, কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনাে এবং সিরাজুল হক সিকদার (সিরাজ সিকদার)। মস্কোপন্থী দল দীর্ঘ মেয়াদে শান্তিপূর্ণ সংসদীয় পথে সমাজতন্ত্রে

…………………………………………..

৪৪। চিত্ত সূতার সম্পর্কে এই লেখার অন্যত্র (৩.খ) বিস্তারিত আলােচনা করা হয়েছে। তাঁর মতােই ডা. আবু হেনা ছিলেন মুজিব ও ভারতীয় বিভিন্ন সংস্থার মধ্যকার যােগাযােগ মাধ্যম। সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থেকে ডা. হেনা সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মননােয়ন পান এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হন। তবে তাঁর রাজনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্র ছিল ময়মনসিংহ। ময়ময়সিংহ জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ময়মনসিংহে লেখাপড়া করেন। গ্রাজুয়েশন করেন ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে। ছাত্রলীগে তিনি ছিলেন শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনের রিক্রুট এবং ওবায়দুর রহমানের ঘনিষ্ঠ। একাত্তরের মার্চের পূর্বে ভারতের সঙ্গে মুজিবের ‘যােগাযােগ’-এর ক্ষেত্রে ডা. আবু হেনার ভূমিকা সম্পর্কে পরবর্তী উপ-অধ্যায়ে আরও আলােচনা রয়েছে।

Page 45

পৌছানাে এবং স্বল্পমেয়াদে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-সামন্তবাদ বিরােধী একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য যৌথ আন্দোলন গড়ে তােলা এবং পিকিংপন্থীরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে পৌছাতে কৃষক প্রলেতারিয়েতের সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে বলছিলেন। সশস্ত্র ‘লাইন’-এর কারণে পিকিংপন্থীরা সত্তরের নির্বাচন বর্জন করে।

আপাতদৃষ্টিতে ৫০ থেকে ৬৫ সময়ে উভয় ধারার কমিউনিস্টদের সদস্য সংখ্যাই বাড়ছিল পূর্ববাংলায় । ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় পূর্ববাংলায় যেখানে অবিভক্ত কমুনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা নেমে এসেছিল মাত্র কয়েক শ’তে সেখানে ১৯৬৬ সালে মস্কো-পিকিং বিরােধ ও ভাঙনের আগে তাদের সংখ্যা দাঁড়ায় অন্তত তিন হাজারে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ঠিক এই সময়টিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলেও কমিউনিস্ট শক্তির উত্থান ঘটছিল। বাংলাদেশে অবশ্য শেষপর্যন্ত জাতীয়তাবাদী উচ্ছাসে ক্যুনিস্ট বিপ্লবীদের প্রভাব বিস্তৃত হওয়ার সুযােগ বাধাগ্রস্ত হয়। ইতিহাসের এ পর্যায়ে পূর্ববাংলায় জাতীয়তাবােধের নির্ধারক ভূমিকা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় প্রায় উভয় ধারার বামপন্থীরাই। সিরাজুল আলম খানদের ‘নিউক্লিয়াস এবং সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে তরুণ মাওবাদীদের ক্ষুদ্র এক কেন্দ্র এক্ষেত্রে ছিল বিশেষ এবং মনােযােগ আকর্ষণী ব্যতিক্রম।

বাংলাদেশে গত চার দশকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উচ্ছ্বাসপূর্ণ অনেক গ্রন্থ ও ইতিহাস রচনা হলেও একাত্তর-পূর্ব সময়ে যে কেবল উপরিউক্ত দুটি গ্রুপই ‘স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নিয়ে এসেছিল সে বিষয়ে স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া যায় কম। নিউক্লিয়াস’ অনুসারীরা এক্ষেত্রে কিছুটা স্বীকৃতি পেলেও সিরাজ সিকদার অনুসারীদের প্রতি সমকালীন ঐতিহাসিকরা পুরােদস্তুর বৈরি হয়েই থেকেছেন। অথচ রাজনীতির এই ধারাটি রণনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের অসামান্য নজির রেখেছিল সেসময়।

যতদূর জানা যায়, ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সিরাজ সিকদার ১৯৬৬ সালে মাও সেতুও চিন্তাধারা গবেষণা কেন্দ্র এবং পরের বছর পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন’ নামে দুটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। সিরাজ সিকদার ও তাঁর অনুসারীরা ১৯৭১ সালের মার্চের বহু আগে প্রকাশ্যে পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানী শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতার ডাক দেয় এবং নিজেরা সে কাজে নেমে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীসহ বাংলাদেশের মূলধারার মুক্তিযােদ্ধারা দেশ স্বাধীন করতে ভারতের ওপর নির্ভরতাকে যখন অলঙ্ঘনীয় নিয়তি ধরে নিয়ে এগােচ্ছিলেন তখন সিরাজ সিকদার ও তাঁর অনুসারীরা সফলতার সঙ্গে নিজস্ব শক্তিতে দেশেই একাধিক ‘মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে সফল হন (বরিশালে এইরূপ এক মুক্তাঞ্চলেই একাত্তরের ৩ জুন তাঁর নেতৃত্বাধীন পুর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন পরিবর্তিত হয়ে

Page 46

প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টি) এ দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার শক্তিশালী উদ্যোগগুলাে মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে সিরাজ সিকদারের তাত্ত্বিক ও রণনৈতিক উপরিউক্ত অগ্রসরতাকে সব সময় যেমন নীরবতার চাদরে ঢেকে রাখতে পেরেছে। তেমনি দেশের অভ্যন্তরে থেকে অন্যান্য যেসব দেশপ্রেমিক শক্তি প্রতিরােধ গড়ে তােলায় উদ্যোগী ছিল (নরসিংদীর বেলাবাে, শিবপুর; কিশােরগঞ্জের বাজিতপুর; যশােরের নড়াইল-শালিখা-মােহাম্মদপুর-কালীগঞ্জ; নােয়াখালীর হাতিয়া ও লক্ষ্মীপুর, বাগেরহাটের বিষ্ণুপুর ইত্যাদি স্থানে) তাদের অভিজ্ঞতাও মনােযােগ পেয়েছে কমই।৪৫

২. খ. উত্তাল মার্চে ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াস :

যুদ্ধ যেভাবে পূর্ববাংলার নিয়তি হয়ে উঠল

ইতিহাসে বরাবরই সকল যুদ্ধের পেছনে ছিল ‘বিজয়ী’র লুণ্ঠনগত স্বার্থ…কিন্তু সকল যুদ্ধেই বাস্তব লড়াইয়ে থেকেছে শ্রমজীবী শ্রেণী। তাদেরই সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অকৃপণভাবে সকল রণক্ষেত্রে এই শ্রেণীকেই রক্ত ঝরাতে হয়েছে। তারাই ছিল ‘বিজয়ী’ বাহিনীর মূল সৌন্দর্য। কিন্তু কখনাে, কোথাও, যুদ্ধ ঘােষণা বা শান্তি স্থাপন- কোন পর্যায়ে তাদের মতামতের কোন সুযােগ ছিল না। সবাইকে যুদ্ধে নামানাে এবং আবার শান্তিতে ফিরিয়ে আনা দুটোই করেছে শাসক শ্রেণী। ব্যতিক্রমহীনভাবে সর্বত্র এটা ঘটেছে। আর এসব করতে গিয়ে অবিরামভাবে নিজেদের ‘দেশপ্রেমমূলক ভূমিকা’-এর কথা বলতে থাকে তারা। তাদের এই কথিত ‘দেশপ্রেম’ কখনাে তাদের গােলাগুলির সামনের কাতারে ঠেলে দেয় না। পরিখার ভেতরে থেকে ‘শত্রু’পক্ষের গােলার খােরাক হতেও দেখা যায় না তাদের।

-Eugene V. Devs (১৮৫৫-১৯২৬), যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত শ্রমিক সংগঠক, সমাজতন্ত্রী।৪৬

বর্তমান অধ্যায়ের শুরুতে (২.ক) মুজিব বাহিনী সম্পর্কে তােফায়েল আহমেদ, কাজী আরেফ আহমেদ, আ স ম আব্দুর রব প্রমুখের যেসব বক্তব্য তুলে ধরা

……………………………………………………..

৪৫। একাত্তর-পূর্ব সময়ে পূর্ববাংলায় বামপন্থীদের রাজনৈতিক ভূমিকার উপর বিস্তৃত আলােচনার জন্য দেখুন, তালুকদার মনিরুজ্জামান, বামপন্থী রাজনীতি ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়, অনুবাদ: মাে. সাহেব আলী ও এ কে এম কুতুবউদ্দিন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৭। বিশেষভাবে মাওবাদী দলগুলাের বিকাশ ও পরিণতির জন্য দেখুন, Md. Nurul Amin, Maoisna in Bangladesh: The Case of the East Bengal Sarbohara Party in Asian Survey, Vol. 26, No. 7. (July, 1986), pp. 759-773.

৪৬। যুদ্ধবিরােধী ভূমিকার জন্য নিজদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যায়িত হয়েছিলেন Eugene V. Devs. তার বিখ্যাত গ্রন্থ Walls and Bars, তাঁর সম্পর্কে আরও জানতে দেখুন, en.wikipedia.org/wiki/Eugene_V_Devs (retrived on 15th Feb. 2013).

Page 47

হয়েছে সে বিষয়ে অন্যান্য ঐতিহাসিক ভাষ্যের তুলনামূলক আলােচনায় যাওয়ার আগে সত্তর-একাত্তরের উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে, বিশেষত একাত্তরের মার্চে, ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস’-এর ভূমিকা সম্পর্কে কিছু তথ্য উপস্থাপন এ পর্যায়ে সম্ভবত প্রাসঙ্গিক হবে।

একাত্তরের মার্চে এসে ছাত্রলীগের কথিত ‘নিউক্লিয়াস’-এর রাজনৈতিক তৎপরতা এক চূড়ান্ত ও সিদ্ধান্তসূচক রূপ নেয়। সংক্ষেপে সেই সময়কার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা যায় এভাবে, মুজিবুর রহমান তখন প্রকাশ্যে ছয়দফা ভিত্তিক এমন একটি পাকিস্তানের কথা বলছিলেন, যেখানে পূর্ব-পাকিস্তান হবে একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ, যার হাতে পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষার দায়িত্ব ছাড়া আর প্রায় সব প্রশাসনিক বিষয় থাকবে। যার মধ্যে রয়েছে পৃথক মুদ্রা ব্যবস্থা, কর ধার্য ও আদায় এবং প্যারামিলিটারি গড়ে তােলার অধিকারও। অর্থাৎ তার দাবি অনুযায়ী মূলত পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন এবং তার আওতায় পূর্ব-পাকিস্তান হবে একটি স্বশাসিত প্রদেশ। ছয়দফা বাস্তবায়িত হলে পূর্ব-পাকিস্তান তার সুবিধামত যে কোন দেশের সঙ্গে পৃথকভাবে বাণিজ্যিক সম্পর্কও করতে পারত।৪৭

সত্তরের নির্বাচনে জনগণ মুজিবুর রহমানের এসব দাবির প্রতি সরাসরি সমর্থন দিয়েছিল বলেই প্রতীয়মান হয়। যদিও নির্বাচনে দ্রব্যমূল্য কমানাের মতাে নানান চিত্তাকর্ষক প্রতিশ্রুতিও ছিল তাঁর। বস্তুত মুজিবের ছয়দফার মাঝে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানরা দেশটির পশ্চিম অংশের সঙ্গে অসমতা হাসের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছিল।৪৮ বিশেষভাবে পূর্ববাংলার উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি মনে

………………………………………………….

৪৭। ‘ছয়দফা’র এই বিশেষ দফাটি (৫ নং দফা) ভারতকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে। এর মধ্যে সে তার জন্য বিশাল এক বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখতে পায়। ঐসময় পশ্চিমবঙ্গের পাটকলগুলাে কাচাপাটের অভাবে ধুকছিল। অথচ পূর্ব-পাকিস্তান থেকে অঢেল পাট বিদেশে রপ্তানি হতাে। ভারত ভেবেছিল মুজিব ছয়দফা আদায় করার মানেই হলাে তার পাটশিল্পের পুনরুত্থান। তাদের সেই ভাবনা ছিল সঠিক। একাত্তরের পর বাংলাদেশ সরকারের পাটনীতি ভারতকে তাদের প্রত্যাশার চেয়েও অধিক সুযােগ এনে দেয়। উল্লেখ্য, ছয়দফার ঘােষণা হয় ১৯৬৬-এর ফেব্রুয়ারিতে।

৪৮। এই অসমতা বাঙালিদের মাঝে বঞ্চনার একটি বােধ সৃষ্টি করে। বিশেষত যখন তারা দেখতে পায়, পশ্চিমের নাগরিকরা তাদের চেয়ে ভালাে খায়, ভালাে পরে, উন্নত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা সুবিধা পায় এবং উন্নত যানবাহন ও যােগাযােগ অবকাঠামাের মধ্যে থাকে। যদিও দেশটির পূর্ব অংশের চেয়ে পশ্চিমে বাজারের আকার ছিল বড় এবং বাঙালি মুসলমানদের বৃহৎ আয়তনের অর্থনৈতিক উদ্যোক্তা হিসেবে অবাঙালি মুসলমানদের চেয়ে অভিজ্ঞতা, যােগ্যতা ও মেধার ঘাটতি ছিল- ফলে এখানে অর্থনৈতিক বিকাশের গতি ছিল অপেক্ষাকৃত ধীর। কিন্তু যখনি তারা দেখেছে, দেশটির বিত্তবান ৪৩টি শিল্প গােষ্ঠীর মাঝে মাত্র একটি বাঙালি (এ কে খান গ্রুপ-চট্টগ্রাম) তখন তারা নিজেদের ‘কোণঠাসা’ ভেবেছে; বিশেষ করে যখন তারা দেখে, সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও (৫৬ শতাংশ) রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভরকেন্দ্রগুলােতে তাদের প্রতিনিধি কম এবং আঞ্চলিক অসমতা কমাতে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকরা যথেষ্ট আন্তরিকও নন। বঞ্চনার এই বােধ দানা বাঁধাতে ষাটের দশকে পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি অর্থনীতিবিদদের মূল্যায়ন ও মতামত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এবং তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্রনেতারাও একে সফলতার সঙ্গে রাজনীতির প্রধান ইস্যুতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। দেশটির দু’অঞ্চলের ভৌগােলিক বিচ্ছিন্নতা, দুর্বল সাংবিধানিক বিকাশ এবং সীমিত রাজনৈতিক স্বাধীনতাও বঞ্চনার উপরােক্ত বােধের তিন সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে এবং পূর্বের বাসিন্দারা এক পর্যায়ে ভাবতে শুরু করে, আঞ্চলিক রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন হয়তাে তাদের বঞ্চনার সদুত্তর হয়ে উঠতে পারে। ছয়দফার জনপ্রিয়তার মূলে ছিল উপরােক্ত মনােভঙ্গি। এ বিষয়ে আরও বিশ্লেষণী আলােচনার জন্য দেখুন, রেহমান সােবহান, বাংলাদেশের অভ্যুদয়: একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য, মাওলা ব্রাদার্স, ১৯৯৮, ঢাকা, পৃ. ১৫-৭২।

Page 48

করেছিল আওয়ামী লীগ ‘ছয়দফা আদায়’ করতে পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে পশ্চিমের মধ্যবিত্তের পাশাপাশি তারও বিকাশের কিছু বাড়তি পরিসর তৈরি হবে। নির্বাচনের পর উঠতি মধ্যবিত্তের সেই আকাক্ষা বাস্তবায়নের সংগ্রামেই লিপ্ত ছিলেন মুজিবুর রহমান। জনপ্রিয়তার অতি উচ্চশিখরে তিনি তখন । তাঁর সমগ্র সংগ্রাম ও দরকষাকষি একাত্তরের মার্চে এক উত্তেজক ক্রান্তি কালে প্রবেশ করে। লক্ষ্যণীয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামােতেই পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য মুজিবুর রহমান যখন লড়ছেন তখন। শিক্ষাঙ্গনে তার প্রধান শক্তিভিত ছিল ছাত্রলীগ এবং তাদের ভরকেন্দ্র ছিল সংগঠনটির অভ্যন্তরীণ উপরিউক্ত ‘নিউক্লিয়াস’।

‘ছয়দফা’য় আঞ্চলিক বৈষম্য হাসের সম্ভাবনা ছাড়াও সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে ইশতেহার প্রকাশ করে তাতে ‘সাম্রাজ্যবাদ-ঔপনিবেশিকতা- বর্ণবাদ বিরােধী বক্তব্য থাকায় তরুণদের মাঝে দলের ছাত্র শাখা ছাত্রলীগ’-এর আবেদন বেড়ে গিয়েছিল । ১৯৬৯-৭০ সময়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, পূর্ব- পাকিস্তানের সবগুলাে বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৪২টি কলেজের মধ্যে ১৩২টিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ সমর্থিত প্যানেল জয়লাভ করে।৪৯ স্বভাবত সংগঠনটির আত্মবিশ্বাস ও আকাক্সক্ষা তখন তুঙ্গে। পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের সঙ্গে বােঝাপড়ায় নিজের অবস্থান শক্তিশালী করতে মুজিবুর রহমানও ছাত্রলীগকে ব্যবহার করছিলেন সর্বোতভাবে। এসময় তিনি ছয়দফার কথা বললেও এবং তার পক্ষ থেকে আইন উপদেষ্টা ড. কামাল হােসেনসহ অন্যরা ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টাদের কাছে ২৩ মার্চও (১৯৭১) পূর্ব-পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমন্বয়ে কনফেডারেশনের প্রস্তাব৫০ পেশ করলেও ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস তখন-

………………………………………………………………

৪৯। Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh revolution and its aftermath, Bangladesh Books International Ltd, 1980, Dhaka, p. 29.

৫০। দেখুন, মিজানুর রহমান খান, দুনিয়া কাঁপানাে ছাব্বিশ দিন, সাপ্তাহিক বিচিত্রা, স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা ১৯৯৭, ঢাকা, পৃ. ২৭-৫৫।

Page 49

– শ্লোগান দিচ্ছে, “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ (১ মার্চ)৫১;

– তারা বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের পতাকায় অগ্নিসংযােগ করছে এবং সম্ভাব্য ‘স্বাধীন বাংলা’র পতাকা তৈরি ও তা উত্তোলন করছে (২ মার্চ);

– ‘স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করছে শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে পল্টন ময়দানে (৩ মার্চ);

– উর্দু সিনেমা প্রদর্শন বন্ধের জন্য হল মালিকদের ও উর্দু বই বাজার থেকে তুলে নেয়ার জন্য বইয়ের দোকানগুলাের প্রতি নির্দেশ সম্বলিত বার্তা প্রচার করছে (৮ মার্চ);

– ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি থেকে বােমা তৈরির রাসায়নিক লুট ও দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্দুকের দোকান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে (১০ মার্চ);

– বাংলাদেশের জন্য পৃথক জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করে নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের জাতীয় সংগীতের পরিবর্তে সেটাকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হচ্ছে (১১ মার্চ);

– উর্দুভাষীদের আবাসস্থল ত্যাগ ও পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচল নিয়ন্ত্রণে ঢাকার পাঁচটি স্থানে চেকপােস্ট বসানাে শুরু করেছে (১৪ মার্চ);

– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাইফেল চালানাের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের সূচনা করেছে (১৭ মার্চ);

– ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’-এর মানচিত্র দিয়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে; দেশব্যাপী আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন দেশের পতাকা উত্তোলন করছে ( ২৩ মার্চ);

– পল্টনে গণবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান করছে। দশ প্লাটুন সদস্য কর্তক স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান প্রদর্শন এবং মুজিবের হাতে সেই পতাকা তুলে দেওয়া হয় (২৩ মার্চ)৫২;

……………………………………………

৫১। সেই সময়কার ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা এবং ডাকসুর ভিপি আবদুর রব এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন, স্বাধীন বাংলাদেশ’ ধারণাটি প্রথম তারা পেয়েছেন বিচারপতি ইব্রাহিমের কাছ থেকে। আবদুর রাজ্জাকের মাধ্যমে ছাত্রলীগের সঙ্গে বিচারপতি ইব্রাহিমের বিশেষ যােগাযােগ ছিল। দেখুন, আ স ম রব, কোথায় যাবে বাংলাদেশ, সাপ্তাহিক ঠিকানা, ১৯ আগস্ট ২০১২, নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।

আওয়ামী লীগের গণপরিষদ সদস্য ডা. আবু হেনাও বর্তমান লেখককে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, বিচারপতি ইব্রাহিমই তাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিশেষ অনুপ্রাণিত করতেন। বৃহত্তর নােয়াখালী অঞ্চলের অন্যতম বিএলএফ সংগঠক আ ও ম শফিক উল্লাহও সাক্ষাৎকারে অভিমত দিয়েছেন, সিরাজুল আলম খান ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযােগিদের স্বাধীনতাকেন্দ্রিক অনুপ্রেরণার বিশেষ উৎস ছিলেন বিচারপতি ইব্রাহিম। ১৮৯৪ সালে ফরিদপুরের সদরপুরে জন্মগ্রহণকারী মােহাম্মদ ইব্রাহিম ১৯৫৮ সাল থেকে জেনারেল আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য ছিলেন। ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে আইয়ুব খানের সঙ্গে নীতিগত মতবিরােধের কারণে তিনি মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করেন। এর পর থেকে তিনি তৎকালীন আওয়ামী ঘরানার তরণ রাজনীতিক কর্মীদের সঙ্গে সক্রিয় যােগাযােগ গড়ে তুলেছিলেন। ১৯৬৬ সালের ১৩ নভেম্বর তিনি মারা যান।

৫২। মার্চের ১ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত ছাত্রলীগ কী কী কর্মসূচি পালন করেছে তার পুরাে বিবরণের জন্য দেখুন, মিজানুর রহমান খান, পূর্বোক্ত এবং ডা. মাহফুজুর রহমান, বঙ্গবন্ধু : ছাত্রলীগ-নিউক্লিয়াস, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকেন্দ্র, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ২০১৩, পৃ. ৮৪-১১২।

উপরােক্ত সব কর্মসূচিতে বাঙালির জন্য নতুন রাষ্ট্রের আবেগকে প্রধান প্রবণতা হিসেবে দেখা যায়। তবে সেই রাষ্ট্রের রূপ কী হবে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কোনাে স্পষ্ট ছবি ছিল না। এক্ষেত্রে ভারতের জন্য বিশেষ স্বস্তিদায়ক ঘটনা ঘটে ছাত্রলীগ কর্তৃক স্বাধীন পূর্ববাংলার পতাকার নকশা প্রকাশের পর । পতাকায় সুনির্দিষ্টভাবে পূর্ববাংলা তথা পূর্ব-পাকিস্তানের মানচিত্র সবুজের উপরে স্থাপিত দেখে এটা স্পষ্ট হয়, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ পশ্চিমবঙ্গের অখণ্ডতার জন্য মােটেই কোনাে বিপদ ডেকে আনছে না। ছাত্রলীগের সেই সময়কার একজন কর্মী, যিনি বর্তমানে জাসদের সঙ্গে কাজ করছেন- বর্তমান লেখকের কাছে পতাকার নকশা তৈরির কাহিনী বর্ণনাকালে মন্তব্য করেন, “ঐ পতাকার মধ্য দিয়েই

আসলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ-এর চিরায়ত ধারণার মৃত্যু ঘটানাে হয়। কারণ পতাকা তৈরির ঐ অধ্যায়ের পর’বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণাটি স্পষ্টত খণ্ডিত হয়ে পড়ে।

Page 50

ছাত্রলীগের উপরিউক্ত মার্চ-কর্মসূচি শেখ মুজিবুর রহমানকে দরকষাকষির প্রক্রিয়ায় এমন এক চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে ঠেলে দেয়, যেখানে পাকিস্তানের কাঠামােতে ছয়দফাভিত্তিক সমাধানের সুযােগ অনেকাংশে কমে যায়। ছাত্রলীগের সিরাজুল আলম খানদের অদৃশ্য ভরকেন্দ্রটি ঠিক এটাই চাইছিল । এসময় পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করার মতাে সিদ্ধান্তগুলাে তারাই নিচ্ছিল- মুজিবুর রহমান তা অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছিলেন কেবল। এমনিতে ছয়দফা থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতার দূরত্ব ছিল খুবই কম । তারপরও ২৩-২৪ মার্চ পুরাে সময় জুড়ে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে নিবিড়ভাবে আলােচনা চলছিল এবং অন্যতম আলােচক ড. কামাল হােসেন সেই আলােচনার ফলাফলের ইতিবাচক আভাসও দিয়ে যাচ্ছিলেন মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু মুজিবের হাতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিয়ে ছাত্রলীগ আলােচনার প্রক্রিয়ায় তার অবস্থানকে নিঃশেষ করে দেয় এবং ছয়দফা ও স্বাধীনতার মাঝের স্বল্প ব্যবধানটুকুও লুপ্ত করে দেয়। ছাত্রলীগের এসব কর্মসূচিতে মুজিবের অমত রয়েছে বলেও মনে হয়নি। পরিণতিতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এ নামে তখন নিজ বাসভবনে বসে থাকা ছাড়া মুজিবের আর একটাই করণীয় ছিল, ভারতে চলে যাওয়া। কিন্তু তা হতাে, ভারতীয় গােয়েন্দাদের সঙ্গে তিনি ও তার সহযােগীদের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে পাকিস্তানিদের এতদিনের অভিযােগকে সরাসরি সত্যতা দান।

সিরাজুল আলম খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী ছাত্রলীগ নেতারা যেভাবে নানান উদ্ভাবনী তৎপরতার মাধ্যমে মুজিবের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রামকে স্বাধীনতার সংগ্রামে ঠেলে দিয়েছিলেন তেমনি পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বও ২৫ মার্চ তাদের বর্বর অপারেশনের মাধ্যমে সমঝােতা’র সকল সুযােগ ধ্বংস করে দিয়েছিল। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক দলিলপত্র এও সাক্ষ্য দিচ্ছে, একাত্তরে ক্ষমতা হস্তান্তরকেন্দ্রিক সংকটের অন্যতম চরিত্র জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার জেনারেল বন্ধুরাও চাইছিল পূর্ব-পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাক । বিশেষ করে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান অন্তত সেরকমই সাক্ষ্য দিচ্ছেন।

Page 51

মৃত্যুর ২৭ বছর পর প্রকাশিত তার গােপন এফিডেভিটে৫৩ ইয়াহিয়া বলছেন, ‘একাত্তরে ভুট্টো যেসব কথা বলেছেন, যেসব গােয়ার্তুমি করেছেন পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্টে নিঃসন্দেহে তা ছিল শেখ মুজিবের ছয়দফার তুলনায় অনেক বেশি আত্মঘাতী ।… নির্বাচনের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে মুজিবুর রহমানকে মেনে নিতে ভুট্টো মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না। পাকিস্তানকে আলাদা করার জন্য ভুট্টো সিজিএস লে. জে. গুল হাসান খান ও বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম খানকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন- যা আমি অনেক পরে জানতে পারি। ভুট্টো চাইছিল দ্বিখণ্ডিত পাকিস্তানের ক্ষমতা। এক পর্যায়ে ভুট্টো এক পাকিস্তানে দুই প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্ব নিয়ে জেদ ধরেন। ভুট্টো যখন এ ধরনের আচরণ দেখান, তখনও ঢাকায় প্রকাশ্য জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানের ঘােষণা ছিল পাকিস্তানের একতা ও সংহতির পক্ষে ।… ছয়দফা নিয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের অবস্থানও ছিল নমনীয়।…তবে বরাবরই আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে একটি উগ্রবাদী গােষ্ঠীও সক্রিয় ছিল।’

ইয়াহিয়ার উপরিউক্ত ভাষ্য এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, মুজিব ও ভুট্টোর সঙ্গে মার্চের উত্তাল দিনগুলােতে তিনিই দরকষাকষি করছিলেন। তাঁর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয়, মুজিবুর রহমান যেমন তার তরুণ অনুসারীদের একাংশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি তেমনি ইয়াহিয়াও তার জেনারেলদের বাঙালি বিদ্বেষী একাংশের সঙ্গে জুলফিকার আলী ভুট্টোর সংযােগের বিধ্বংসী ফলাফল থামাতে পারেননি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঐ জেনারেলরা পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালিদের উদীয়মান জাতীয়তাবােধের মীমাংসা করতে চেয়েছিলেন গােলাগুলির মাধ্যমে; মার্চ- আন্দোলনের গণভিত্তি সম্পর্কে তারা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন বলে মনে হয় না। অন্যদিকে মুজিবুর রহমান যে তীব্র দরকষাকষির মাঝেও মর্যাদাপূর্ণ একটি

………………………………………………

৫৩। ২০০৫ সালে পাকিস্তান সরকার এই এফিডেভিট প্রকাশ করে। বস্তুত এটাই হলাে একাত্তরের ঘটনাবলি সম্পর্কে ইয়াহিয়ার একমাত্র পূর্ণাঙ্গ জবানবন্দি। উল্লেখ্য, একাত্তরের যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণ করে ইয়াহিয়াকে গৃহবন্দি করেন। প্রথমে তাকে দেশটির খাড়িয়া এলাকায় বনবিভাগের একটি রেস্টহাউসে রাখা হয়। তার পেশােয়ারের বাড়িটি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কখনােই সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হতাে না তাকে। ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক পাকিস্তানে ক্ষমতাসীন হলে ইয়াহিয়া মুক্তি পান এবং আলােচিত এই এফিডেভিট লিখেন। লাহাের হাইকোর্টের আইনজীবী মনজুর আহমদ রানার মাধ্যমে ৫৭ পৃষ্ঠার গােপনে লিখিত এই ভাষ্যের প্রতিটি পৃষ্ঠায় স্বাক্ষর শেষে ইয়াহিয়া এটি কোর্টে নথিভুক্ত করেন ১৯৭৯ সালে এবং পরের বছরই তিনি মারা যান। এ সম্পর্কে বিস্তারিত দেখুন, Secret Affidavit of Yahya Khan, Edited by Abu Rushed, Bangladesh Defence .Journal Publishing 2009, Dhaka. এখানে ইয়াহিয়ার যেসব বক্তব্য উদ্ধৃত হয়েছে। সেগুলাে নেয়া হয়েছে আবু রুশদ সম্পাদিত উপরােক্ত গ্রন্থ থেকে যেখানে সম্পাদক ইয়াহিয়ার এফিডেভিটের মূল ইংরেজি ভাষ্যের পাশাপাশি উল্লেখযােগ্য কিছু অংশ নিয়ে আটটি ছােট ছােট ধারাভাষ্য তৈরি করেছেন। দেখুন, পৃ. ১৪-৩৫.

Page 52

সমঝােতার বিষয়ে চেষ্টারত ছিলেন, যেমনটি ইঙ্গিত পাওয়া যায় ইয়াহিয়ার উপরিউক্ত ভাষ্যে- তার সমর্থন মিলে মুজিবের অন্যতম আলােচক ড. কামাল হােসেনের তরফ থেকেও। সামরিক শাসন প্রত্যাহার, নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে একাত্তরের মার্চের নাটকীয় সেই দরকষাকষির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লিখিত ‘স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা : ১৯৬৬-১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থের শেষপ্যারাটি শেষ করেছেন ড. কামাল হােসেন এভাবে :

২৫ মার্চে ভয়াবহ রাতের আগে সারাক্ষণ আমি একটি টেলিফোন পাওয়ার অপেক্ষা করলাম। এমনকি ২৫ মার্চ রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ আমি যখন শেখ মুজিবের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিলাম তখনও শেখ মুজিব আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি ঐ টেলিফোন পেয়েছি কি না। ঐ টেলিফোন কখনােই আসেনি।৫৪

উল্লিখিত টেলিফোন আসার কথা ছিল দরকষাকষির আলােচনায় যারা ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিলেন- লে. জে. পীরজাদা, বিচারপতি কর্নেলিয়াস প্রমুখের কাছ থেকে। কিন্তু টেলিফোন যে আসেনি সেটা তাে এখন ইতিহাসের অংশ। আর ঐ টেলিফোন না আসার মধ্য দিয়ে শুরু হয় পূর্ব-পাকিস্তান। সংকটের দ্বিতীয় পর্যায় এবং পূর্ব-বাংলার ইতিহাসের সবচেয়ে বিপজ্জনক অধ্যায় । সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলাের নানান বিপরীতমুখী আচরণে যুদ্ধই তখন পূর্ববাংলার নিয়তি হয়ে ওঠে। বস্তুত ইয়াহিয়ার প্রতিনিধিরা যখন মুজিবের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনায় বসে সমঝােতার পথ খুঁজছেন তখন আবার নিজেদের মতাে করে সংঘাতের জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এক্ষেত্রে আলােচনার আড়ালে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও পাকিস্তানি জেনারেলদের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সামরিক অপারেশনের পূর্বপ্রস্তুতি এবং তাদের তরফ থেকে নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ কর্মী-সমর্থকদের রাষ্ট্র পরিচালনার ন্যায্য আকাক্ষাকে আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসেবে দেখার গুরুতর ভ্রান্তির বিষয়টি রাজনৈতিক সাহিত্যে বেশ ভালােভাবে আলােচিত; কিন্তু মুজিবের পক্ষ থেকেও একই সময়ে, এমনকি মার্চের প্রথম সপ্তাহ

…………………………………………………….

৫৪। দেখুন, ড. কামাল হােসেন, স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা: ১৯৬৬-১৯৭১, অংকুর প্রকাশনী, ১৯৯৪, ঢাকা, পৃ. ৭৩। ড. কামাল হােসেনের বিবরণ থেকে দেখা যায়, ইয়াহিয়া এবং মুজিবের সম্মতিতেই আওয়ামী লীগের একদল আলােচক, যার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন তিনি নিজেও ক্ষমতা হস্তান্তর সংক্রান্ত আপসমূলক একটি খসড়া প্রস্তাব নিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্ববর্তী ২-৩ সপ্তাহ ধরে ‘দিন-রাত কাজ করছিলেন। একেবারে শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানকে একটি কনফেডারেশন’ বা ‘ইউনিয়ন’ হিসেবে দেশটির ভবিষ্যৎ সংবিধানে উল্লেখের বিষয়েও তারা প্রায় চূড়ান্ত সমাধানে পৌছেছিলেন। তবে ২৪ মার্চ এসে আলােচনা থেমে যায়। এসময় পাকিস্তানের শাসক এলিটদের মাঝে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় বলপ্রয়ােগের দৃষ্টিভঙ্গিই প্রাধান্য বিস্তার করে।

Page 53

থেকে স্থানীয় ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যে নিবিড়ভাবে যােগাযােগ করা হচ্ছিল সেই বিষয়ে বর্তমানে বহু সূত্র থেকে নির্ভরযােগ্য সাক্ষ্য মেলে। যেমন ভারতের পেশাদার কূটনীতিবিদ চন্দ্রশেখর দাসগুপ্ত সেদেশের খ্যাতনামা ‘দ্য হিন্দু পত্রিকায় ২০১১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ‘Was there an Indian plot to break up Pakistan in 1971’ শীর্ষক লেখায় স্পষ্ট জানাচ্ছেন, ১৯৭১ সালে মার্চের প্রথম দিকেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের পূর্ববাংলার সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতার বিষয়ে আলােচনা হয়। তিনি লিখেছেন,

In early March, Tajuddin Ahmad met secretly with Deputy High Commissioner K.C. Sen Gupta, on Mujib’s instructions, to explore whether India would provide political asylum and other assistance in the event of a liberation war. After consulting Delhi, Sen Gupta gave a response that was insufficiently specific to satisfy Sheikh Mujib. In mid-March, the latter repeated his appeal for assistance at this critical hour for his country…

অত্যন্ত নির্ভরযােগ্য অপর সূত্র৫৫ থেকে এটাও এখন প্রকাশ্য যে, ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে সি সেনগুপ্তের সঙ্গে সেসময় মুজিবের পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন সুজাত আলীও যােগাযােগ রাখতেন; আর মুজিবের দ্রুত সিদ্ধান্ত’-এর অন্তত একটি আর্জি ইন্দিরা গান্ধীর দপ্তরে পৌছে ১৯ মার্চ।

মার্চের শুরুতে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের তরফ থেকে ভারতীয়দের সঙ্গে নিবিড় যােগাযােগের আরও শক্ত সাক্ষ্য মেলে খােদ আওয়ামী সূত্র থেকেও। তাজউদ্দীন আহমদের ১৯৭৩ সালের ২৯ আগস্টে গৃহীত সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক তালকুদার মনিরুজ্জামান জানাচ্ছেন,

‘At the Government level, some of the AL leaders contracted a top official of the Indian Deputy High Commissioners office at Dacca in the first week of March…. The official concerned then went to Delhi, on the pretext of his daughter’s illness, and came back on 8 after having consulted the appropriate authority.’ He assured the AL leaders that some help Srinath Raghavan, Ibid, p. 54.

………………………………………..

৫৪। শ্রীনাথ রাঘবন এখানে ১৯৭১-এর ১৪ মার্চ ভারতের বিদেশ সচিবকে লেখা ঢাকার ডেপুটি হাইকমিশনারের চিঠি উদ্ধৃত করেছেন নয়াদিল্লির নেহেরু মেমােরিয়াল মিউজিয়াম এন্ড লাইব্রেরিতে রক্ষিত হাকসার পেপার’স থেকে।উল্লেখ্য, গবেষক Gary J, Bass-ও একই সূত্র থেকেই তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

Page 54

in terms of food-supply at the border and political asylum would be available.৫৬

শেষােক্ত বৈঠকটি হয়েছিল ৫ ও ৬ মার্চ।৫৭ এইরূপ যােগাযােগ যে সম্ভবত আরও পুরানাে বৈঠকগুলাের ধারাবাহিকতা তার স্বীকৃতি রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রকি সাম্প্রতিক একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণায়। যেমন সাংবাদিক Gary J. Bass Os The Blood Telegram : India’s Secret War in East Pakistan’-এ নয়াদিল্লির নেহেরু মেমােরিয়াল মিউজিয়াম এন্ড লাইব্রেরিতে রক্ষিত ‘হাকসার পেপার (সাবজেক্ট ফাইল ২২০) থেকে উদ্ধৃত করে জানাচ্ছেন, একাত্তরের ২ মার্চ, (২৫ মার্চের অন্তত তিন সপ্তাহ আগে) মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তার মুখ্য সচিব হাকসার এবং র প্রধান আর এন কাও-কে জানাচ্ছেন, তিনি ‘বাঙালিদের কেবল ওষুধ এবং খাদ্যই নয় ভারতের অভ্যন্তরে সীমান্তজুড়ে দ্রুত। চলাফেরার জন্য হেলিকপ্টার ও ছােট এরােপ্লেন দিয়েও সহায়তার বিষয় বিবেচনা করছেন। পাশাপাশি এ সহায়তার মধ্যে থাকবে মেশিনগান, মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্র এবং গােলাবারুদও৫৮ উল্লেখ্য, এসময় (মার্চ ১৯৭১) ভারতীয় কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ যােগাযােগে নিয়মিতভাবেই পূর্ব-পাকিস্তান’ শব্দের জায়গায় ‘বাংলাদেশ’ শব্দদ্বয় জায়গা করে নেয়। স্পষ্টত, যা ছিল তাৎপর্যবহ। এ রকম এক যােগাযােগে ডি পি ধর, যখন তিনি মস্কোতে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত- ইন্দিরা গান্ধীর। মুখ্য সচিব হাকসারকে লিখছেন, ‘This resistance must not be allowed to collapse.৫৯ এ পর্যায়ে এও বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশকে যথার্থ উপায়ে সাহায্য প্রদানের বিষয় নজরদারি করার জন্য ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ক্যাবিনেট সেক্রেটারি কে স্বামীনাথন, স্বরাষ্ট্রসচিব গােবিন্দ নারায়ণ, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হাকসার, বিদেশ সচিব কাউল, বৈদেশিক গােয়েন্দা প্রধান কাওকে নিয়ে নীতিনির্ধারণী যে কমিটি করেছিলেন তাও গঠিত হয় ঢাকায় ২৫ মার্চের

……………………………………………..

৫৬। বিস্তারিত দেখুন, Talukder Maniruzzaman, The Bangladesh revolution and its aftermath, Bangladesh Books International Ltd, 1980, Dhaka, p. 107.

৫৭। Srinath Raghavan. Ibid.

৫৮। দেখুন, Gary J, Bass, Ibid, p. 47-48. উল্লেখ্য, মিসেস গান্ধী যে এপ্রিলেই তাঁর সেনাবাহিনীকে পূর্ব-পাকিস্তানে ঢুকে পড়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন তা ইতােমধ্যে একাধিক আন্তর্জাতিক গবেষণায় স্বীকৃত । জেনারেল শ্যাম মানেকস ‘সম্ভাব্য যুদ্ধে নিশ্চিত বিজয়ের লক্ষ্যে প্রস্তুতির জন্য আরও সময় নেয়ার পক্ষে ছিলেন- ‘অন্তত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত এবং ইন্দিরা গান্ধী শেষপর্যন্ত এই মতটি মেনে নিয়েছিলেন। বিস্তারিত দেখুন, Gary J. Bass, Ibid, p. 93. 99 Srinath Raghavan, Ibid, p.67.

৫৯। Gary J. Bass, Ibid, p. 95

Page 55

সামরিক অভিযানের অন্তত তিন সপ্তাহ আগে- ২ মার্চ। এই কমিটিতে পরে শুধু প্রতিরক্ষা সচিব কে বি লালকে সংযুক্ত করে নেয়া হয়েছিল ।

চন্দ্রশেখর দাসগুপ্ত, তাজউদ্দীন আহমদ, Gary J. Bass, Srinath Raghavan প্রভৃতি সূত্রগুলাে থেকে পাওয়া উপরিউক্ত তথ্য-উপাত্ত ও মতামতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাষ্য মেলে ডা. আবু হেনার কাছ থেকেও। তাকে যে একাত্তরের ২৫ মার্চের বহু আগে ভারতে পাঠিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান সেটা ইতঃপূর্বে তােফায়েল আহমেদের জবানিতে আমরা জানতে পেরেছি। বাস্তবে ডা. আবু হেনা। কী ভূমিকা পালন করেছিলেন সেটা জানতে তার সাক্ষাৎকার নেয়া হয় ২০১৩ সালের ১ মে তার মিরপুরের (১০ নম্বর এলাকার) বাসায়। সেখানে বর্তমানে ৭১ বয়সী এই প্রবীণ জানান, ১৯৭১ সালের জানুয়ারিতে প্রথমে শেখ ফজলুল হক মণি এবং পরে শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরােধে তিনি পাসপাের্ট ছাড়াই ভারতে যান। সফরটি ছিল ভারতীয়দের অনুরােধে । ভারতীয়রা মুজিবের কাছে অনুরােধ করেছিলেন একজন নির্ভরযােগ্য প্রতিনিধি পাঠাতে ভবিষ্যৎ সহযােগিতা নিয়ে কথা বলার জন্য। সেই সত্রেই তাকে পছন্দ করে পাঠানাে হয়। বিশেষ করে ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি ইত্যাদি ভাষা জানা এবং গােপণীয়তার সংস্কৃতিতে বিশেষ দক্ষতার কারণে তাঁকে এই কাজের জন্য নির্বাচিত করা হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। ঐ সফরকালে ভারতীয় গােয়েন্দারা রাজনৈতিক প্রয়ােজনে সীমান্ত খুলে দেওয়া, আগতদের প্রশিক্ষণ প্রদান, রেডিও স্টেশন তৈরি ইত্যাদি কয়েকটি বিষয়ে সহায়তার আশ্বাস প্রদান করেছিল।

ডা. আবু হেনা আরও জানান, সফরকালে তাঁকে চিত্ত সূতারের ঠিকানাতেই পাঠানাে হয়। মুজিবুর রহমান সূতারকে আগে থেকে কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে ভারতীয়দের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। মুজিব জানতেন, সূতারের সঙ্গে ভারতীয়দের যােগাযােগ ছিল। কিন্তু ভারতীয়রা শুধু সূতারের সঙ্গে কথা বলে সন্তুষ্ট হতে পারছিল না। তারা মুজিবের প্রতিনিধি কারও সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চাইছিল। তাই আমাকে পাঠানাে হয়। সূতার আমাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের গােয়েন্দা প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করিয়ে দিয়েছিলেন ।…২৫ মার্চের পর আমি মনসুর আলী, কামরুজ্জামান হেনা ও যুবনেতাদের চিত্ত সূতারের ঠিকানাতে নিয়ে যাই। পরে সিরাজুল আলম খান ও আবদুর রাজ্জাকও সেখানে আসেন। সূতার অবশ্য সেখানে ভিন্ন নামে অবস্থান করতেন।’ ডা. আবু হেনা সাক্ষাৎকারে আরও জানান, তাঁর মাধ্যমে সৃষ্ট এই যােগাযােগ ছাড়াও ‘তাজউদ্দীনের সঙ্গে ভারতীয়দের পৃথক যােগাযােগ ছিল’- সেটা তিনি যুদ্ধ শুরুর পর জানতে পারেন।৬০

…………………………………………………………….

৬০। উল্লেখ্য, ডা. আবু হেনা যুদ্ধের পূর্বে মুজিবের পক্ষ থেকে ভারতীয়দের সঙ্গে উপরােক্ত গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগে ভূমিকা পালন করলেও যুদ্ধ শেষে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি মুজিব কর্তৃক গণপরিষদ সদস্যপদ হারান। তার ভাগ্য বিপর্যয়ের শুরু আসলে যুদ্ধক্ষেত্র থেকেই। ‘নিউক্লিয়াস’সংশ্লিষ্ট যুবনেতাদের চিত্ত সূতারের ঠিকানায় পৌছে দিলেও ডা. হেনা মুজিব বাহিনীতে যােগ দেননি এবং মুজিব বাহিনী গঠনেরও বিরােধিতা করেন। ফলে চার যুবনেতা যে বাড়িতে অবস্থান করতেন সেখান থেকে ২০ দিন পরে চলে আসেন বা চলে আসতে হয় তাকে। এ ছাড়া তিনি যুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক ধারায় দেশ পুনর্গঠনেরও বিরােধিতা করেন। তার মতে ‘ঐ পরিস্থিতিতে এটা ছিল ভুল পথ’- ফলে মুজিব বাহিনীর দুই গ্রুপের কোনােটিতেই তাঁর ঠাই হয়নি। এই দুই কারণে আওয়ামী লীগে আমার ভাগ্য বিপর্যয়ের শুরু’ বলে ভা, হেনা বর্তমান লেখকের কাছে তাঁর অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছেন। গণপরিষদ সদস্যপদ থেকে অপসারিত হওয়ার পরও দলে তাজউদ্দীন আহমদ ও খন্দকার মােশতাক আহমদের সঙ্গে ডা. হেনার যােগাযােগ ছিল । বিশেষ করে শেষােক্তজনেরসঙ্গে সেই যােগাযােগ দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল।

Page 56

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিবিধ সূত্রে ভারতীয়দের এরূপ ‘যােগাযােগ’ যে ১৯৭০ সালে এসে হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি সে বিষয়ে পূর্ববর্তী উপ-অধ্যায়ে (২.ক) একদফা বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রচুর ভারতীয় দলিল- দস্তাবেজসহ সম্প্রতি প্রকাশিত ‘Contribution of India in the war of liberation of Bangladesh’ শীর্ষক গ্রন্থে তৎকালীন ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার এ কে রায়-এর সাক্ষাৎকার থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়৬১, ঐরূপ যােগাযােগ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে ভারতীয় সহায়তা অন্তত ১৯৬৫ থেকে সক্রিয়। খােদ তখনকার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনক্রমে যে এইরূপ যােগাযােগ ও সহায়তা চালু হয় সেই বিবরণও বিস্তারিত আকারে পাওয়া যায় এ কে রায়ের আগে উল্লিখিত বিবরণীতে। অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের আগরতলা যাত্রা সম্পর্কে তাদের পরিবারের কেয়ারটেকার- তার ফুফাত ভাই মমিনুল হক খােকার ইতােমধ্যে উল্লিখিত বিবরণ থেকেও প্রমাণ মেলে ১৯৬২ সালের আগে থেকেই ভারত পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতিতে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বলা বাহুল্য, এসব যােগাযােগ পূর্ববাংলার রাজনীতিবিদদের তরফ থেকে ‘স্বাধীনতার জন্য সহায়তার লক্ষ্যে পরিচালিত হলেও, ভারতীয়দের কাছে তা হাজির হয়েছিল পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার সুযােগ’ আকারে।।

মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের অন্যতম সহযােগী মঈদুল হাসান এক্ষেত্রে আরেকটি ‘যােগাযােগ অধ্যায়ের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে :

…………………………………………….

৬১। Salam Azad, Ibid, p. 283. একই বিষয়ে এ কে রায় ভারতীয় পত্রিকা আউটলুক-এও ২০০৪ সালের ৪ জুন তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায়ও বিস্তারিত আলােকপাত করেছেন। তার এই শেষােক্ত বিবরণে এ কে রায় দাবি করেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম’-এ সব ধরনের সহায়তা দানের উদ্যোগে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর অনুমােদন সম্পর্কে কেবল তাদের পররাষ্ট্র সচিব C.S. Jha অবহিত ছিলেন। কূটনীতিক ভাষায় এই কর্মসূচির নাম ছিল ‘politico-geographic orientations”, ১৯৬৫ সালের আগস্টের চতুর্থ সপ্তাহ থেকে এই politico-geographic, orientations’ শুরু হয়। বিস্তারিত দেখুন, http://www.outlookindia.com. (retrived on 25th Feb, 2013).

Page 57

“১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর শেখ সাহেব জেল থেকে বেরােন। ওই বছর অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে ইয়াহিয়ার শাসনামলে তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। ঠিক একই সময়ে ইন্দিরা গান্ধীও লন্ডনে যান। লন্ডনে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে শেখ সাহেবের দেখা হয় হামস্টেড হিথের একটি বাড়িতে। সেখানে ছিলেন আই সিং নামে এক পাঞ্জাবী ভদ্রলােক। আই সিং ছিলেন লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসের কাউন্সিলর। তিনি আসলে ছিলেন লন্ডনে ‘র’-এর প্রধান। শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠকের ব্যবস্থা করেছিলেন আই সিং নিজের বাড়িতেই। ১৯৭২ সালে আমি যখন লন্ডনে যাই, তখন আই সিং আমার সম্পর্কে জানতেন। হয়তাে পিএন হাসার বা ডি পি ধরের সুবাদে। ডি পি ধর তখন ভারতের পরিকল্পনামন্ত্রী এবং পি এন হাকসার প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপল সেক্রেটারী । আই সিং নিজেই একদিন এসে আমাকে তার পরিচয় দেন। তাঁকে কথা বলতে উৎসুক দেখি। পুরাতন দিনের কথা প্রসঙ্গে আই সিং আমাকে জানান, সেই ১৯৬৯ সালের বৈঠকে তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন। কেননা এটা একটা সৌজন্য সাক্ষাৎ হিসেবেই শুরু হয়। সেই বৈঠকেই শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমরা জানি, নির্বাচনে আমরা বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতবাে। কিন্তু ওরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না। ঠিক ১৯৫৪ সালের মতাে হবে। আবার কেন্দ্রীয় শাসন জারি করবে। ধরপাকড় করবে। শেখ সাহেব আরাে বলেন, “কিন্তু এবার আমি তা হতে দেব না। আমার কিছু ছেলেকে তােমাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আর একটা বেতারযন্ত্র দিতে হবে, যেখান থেকে তারা যাতে প্রচার করতে পারে যে, বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘােষণা করা হয়েছে। আই সিংয়ের এই তথ্য আমি বিশ্বাসযােগ্য মনে করি, কেননা হুবহু একই ধরনের গেম-প্ল্যানের কথা আমি শুনেছিলাম ১৯৬২ সালে…।”৬২

ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসনের সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও সামরিক কর্মকর্তাদের দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা উপরিউক্ত বিবিধ যােগাযােগের পটভূমিতে ১৯৭১ সালের মার্চে এসে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যে ভারতের নিজস্ব যুদ্ধে পরিণত হবে সেটা প্রায় নিয়তি-নির্দিষ্ট হয়েছিল। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দীর্ঘ বঞ্চনার বােধ। থেকে উৎসারিত পূর্ববাংলার নিরস্ত্র মানুষের দুর্বার এক গণআন্দোলনকে তার যৌক্তিক পরিণতি দিতে জাতীয়তাবাদী সংগঠকরা দেশের অভ্যন্তরে কোনাে ধরনের টেকসই রণনৈতিক প্রস্তুতিই নেননি- কেবল ধারাবাহিকভাবে ভারতীয়

………………………………………………………..

৬২। এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৩২-৩৩।

Page 58

নেতৃত্ব ও তাদের দূতাবাসে যােগাযােগ রক্ষা করা ছাড়া। ২৬ মার্চ সকাল থেকে সংগ্রামমুখর নিরস্ত্র মানুষ চরম অসহায়ত্বের সঙ্গে দেখতে পায় এশিয়ার দুর্ধর্ষ এক সেনাবাহিনীর মুখােমুখি তারা। ইতােমধ্যে সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় নিজ বাড়িতে গ্রেফতারবরণ করেছেন। আর তার মূলশক্তি ছাত্র ও যুবনেতারা কয়েকটি কথিত ‘ঠিকানা’ ‘মুখস্থ করে পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে পথে- যদিও মুজিবের নির্দেশ ছিল- ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলার সমকালীন বিশ্ব ইতিহাসে জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের এরূপ হতবিহ্বল ভূমিকার৬৩ দৃষ্টান্ত বিরল। যুদ্ধের সংকল্পে জাতিকে উদ্বুদ্ধ করে, কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতি না নিয়ে বরং কামানের গােলার মুখে ঠেলে দেওয়া হলাে তাদের। অসহায়, কিংকর্তব্যবিমূঢ় প্রতিরােধ যুদ্ধ দ্রুতই হুমড়ি খেয়ে পড়ল সীমান্তের ওপারে। এরপর সম্ভাব্য স্বল্প সময়ে আওয়ামী লীগকে পূর্ববাংলায় ক্ষমতাসীন করতে পরিস্থিতির ওপর পুরাে নিয়ন্ত্রণ নিল ভারত।৬৪ সবই যেন ছক কাটা ছিল ।

তবে স্বাধীনতা যুদ্ধের আগের ও শুরুর মুহূর্তের অসঙ্গতিপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে মুখ্য নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারণ বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রটির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য এসময় ভিন্ন এক তাৎপর্য নিয়েও হাজির হয়েছিল- যার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ইতিহাসবি ড. আহমেদ কামাল।৬৫ তাঁর মতে, একাত্তরের ২৫ মার্চ পূর্ববর্তী দু’ সপ্তাহে পাকিস্তান

……………………………………………………….

৬৩। এরূপ স্ববিরােধী ভূমিকার বড় এক বিরণ পাওয়া যায় একাত্তরের যুদ্ধকালীন পাকিস্তানি জেনারেল খাদিম হােসেন রাজার সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘A stranger in Ray o4/7 country: East Pakistan. 1969-1971, UPL, 2012, p.6k). তে। সেখানে জেনারেল রাজা বিবরণ দিচ্ছেন, একাত্তরের সাতই মার্চ ঐতিহাসিক সেই বক্তৃতার আগের দিন শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন ঢাকার জেনারেল অফিসার কমান্ডিংয়ের কাছে দূত পাঠিয়েছেন এই বলে যে, দলের চরমপন্থীদের চাপের মুখে পরের দিনের জনসভায় তাঁকে স্বাধীনতার ঘােষণা দিতে হতে পারে; তাই তাকে যেন অনতিবিলম্বে নিবর্তনমূলকভাবে গ্রেফতার করা হয়। জেনারেল রাজা মুজিবের ঐ দূতকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এই ভেবে যে, ঘটনাটি একটা রাজনৈতিক চালও হতে পারে। কিন্তু মধ্যরাতে মুজিব আবার একই অনুরােধ করে দ্বিতীয়বারও দূত পাঠান। ঘটনার সাক্ষী হিসেবে জেনারেল রাজা আরও অন্তত তিনজন পাকিস্তানি সামরিক অফিসারের নাম লিখেছেন- যারা তখন তার অধীনস্ত ছিল। একই ধরনের বিবরণের জন্য দেখুন, Hasan Zaheer, The Separation of East Pakistan: The Rise and Realization of Bangali Muslim Nationalism, Oxford University Press. Karachi, 1994, p. 488. তবে এরূপ বিবরণ এখনও বাংলাদেশের কোনাে সূত্র দ্বারা সমর্থিত হয়নি।

৬৪। এ বিষয়ে বিস্তৃত আলােচনার জন্য দেখুন, আহমদ ছফা, শেখ মুজিবুর রহমান, যুক্তাক্ষর, মে ১৯৯৬, কলকাতা। মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকার বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ছফার এই লেখাটিকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীতার অন্যতম অগ্রসর প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য করা যায়। ঢাকায় পাক্ষিক চিন্তা পত্রিকায় ১৮.০৮.২০১২ তারিখে লেখাটি পুন:প্রকাশিত হয় ।

৬৫। আহমেদ কামাল, কালের কল্লোল, সংহতি, ঢাকা, ২০০৮, পৃ. ৮৭-৯১।

Page 59

সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতি সম্পর্কে মুজিবুর রহমান নানান সূত্রেই সংবাদ পাচ্ছিলেন। এ রকম পরিস্থিতিতে করণীয় হিসেবে তিনটি বিকল্প ছিল তার জন্য : এক. জনযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ; যে যুদ্ধের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে স্থানীয় প্রতিরােধ সংগ্রামগুলাে ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। দুই. ভারতে আশ্রয় নেয়া, এবং তিন. পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতারবরণ । মুজিবুর রহমান নিজের ও আওয়ামী লীগের শ্রেণি অবস্থান সম্পর্কে পূর্ণওয়াকিবহাল ছিলেন। ফলে ফিদেল কাস্ত্রোর মতাে কোনাে ভূমিকার প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ এড়িয়ে গেছেন তিনি। আর দ্বিতীয় বিকল্পও বেছে না নেয়ার মধ্য দিয়ে একদিকে পাকিস্তানের শাসক এলিটদের সঙ্গে বােঝাপড়ার ক্ষীণতম একটি সম্ভাবনা জিইয়ে রেখেছিলেন এবং উপরন্তু, ভারতের শাসক এলিটদের সেই বাসনাকেও অনিশ্চয়তায় ফেলে রেখেছিলেন- যার বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের মর্যাদা হতাে অঙ্গরাজ্যতুল্য।

একাত্তরের ২৫ মার্চের আগে বহু বছর ধরে বিভিন্ন পরিসরে ভারতের সঙ্গে মুজিবুর রহমান ও তাঁর রাজনৈতিক ও সামরিক সহযােগীদের যে বােঝাপড়া এগিয়েছে এবং যার কিছু কিছু বিবরণ ইতােমধ্যে এ লেখায় তুলে ধরা হয়েছে সে আলােকে পূর্ব-পাকিস্তানকে ঘিরে ভারত যে রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে এগােচ্ছিল- ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে মুজিবের ধরা দেওয়া তাকে ভয়ানক অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। এ সম্পর্কে ড. আহমেদ কামাল লিখেছেন :

…শেখ মুজিবের পাকিস্তান সেনানায়কদের হাতে ধরা পড়ার ঘটনাটি ভারতের রাজনৈতিক পরিকল্পনার বিরাট ব্যর্থতা। শেখ মুজিবের মতাে একজন জনপ্রিয় নেতা-যিনি তখন জাতির কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন- ভারতের আয়ত্তে না থাকাতে তাদের স্বার্থে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসার পথে একটি অনিশ্চয়তা সার্বক্ষণিকভাবে বিরাজ করতে থাকে। এটা দুই কারণে ঘটে : প্রথমত শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে ভারতে আশ্রিত আওয়ামী লীগ নেতারা দেশটির সঙ্গে এমন কোন সম্পর্কে যেতে পারছিলেন না- যেটা শেষপর্যন্ত মুজিবের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না; দ্বিতীয়ত ভারতীয় শাসকশ্রেণীর তরফ থেকেও মুজিবের কাছে অগ্রহণযােগ্য হবে এমন কোন বাড়তি সুবিধা আদায় করার লােভ সংবরণ করতে হচ্ছিলাে। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতি ও পাকিস্তানী শাসকদের হাতে তাঁর অবস্থান ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে নিয়ে…ভারতের স্বপ্নের জন্য ছিল বিরাট অনিশ্চয়তা।…৬৬

…………………………………………………..

৬৬। পূর্বোক্ত। মুজিব ভারতে গিয়ে ‘অবাধ্য হলে তার কীরূপ পরিণতি হতে পারত তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন ড., আহমেদ কামাল ভারতে মাওলানা ভাসানীর যুদ্ধকালীন গৃহবন্দি দশার উদাহরণ দিয়ে। অন্যদিকে ২৫ মার্চ মুজিবের গ্রেফতারবরণকে মুজিব বাহিনীসংশ্লিষ্ট ছাত্র-যুবনেতারা কীভাবে প্রচার করছিলেন সে বিবরণ দিয়েছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে। দীর্ঘ হলেও নিম্নোক্ত সেই বিবরণ বর্তমান গ্রন্থের পরবর্তী অধ্যায় ও উপ-অধ্যায়গুলাে অধ্যয়নের একটি পূর্বপাঠ হিসেবে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

..মণি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ছাত্র ছিল। পরস্পরের মতামত সম্পর্কে আমরা অপরিচিত ছিলাম না। (সীমান্ত ফেনাের কিছু দিন পর তার সঙ্গে দেখা হতে সে আমাকে সাইকেল-রিকশায় তুলে নিল, তারপর যেতে যেতে অনেকক্ষণ আলাপ। বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ গ্রেফতার হয়েছেন, এ কথা নিশ্চিতভাবে মণিই বলে। সে আরাে বলে, ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় বােঝা গিয়েছিল, পাকিস্তান আর্মি ক্র্যাকডাউন করতে যাচ্ছে। সন্ধ্যার আগেই ইয়াহিয়া যে গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেছেন- সে খবর ও বঙ্গবন্ধু পেয়েছিলেন । মণি অনেক রাত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন। স্থির হয়েছিল তিনি আত্মগােপন করবেন। প্রস্তুতি হিসেবে একটি গাড়িতে স্যুটকেসও ভােলা হয়। তারপর কোন বিশ্বস্ত ব্যক্তির কাছ থেকে একটা ফোন পেয়ে বঙ্গবন্ধু মত বদলে বাড়িতে থেকে যান এবং সেখানে পাকিস্তানিরা তাকে ধরে নেয়। ফোনটা কে করেছিল, স্বভাবত তা জানতে চাই। মণি কারাে নাম বলেনি; তবে আকারে-ইঙ্গিতে যাকে বুঝিয়েছে তিনি তাজউদ্দীন আহমদ। বঙ্গবন্ধু না থাকলে তাজউদ্দীনের নেতৃত্ব নিরঙ্কুশ হয়-এ ধরনের একটি ধারণার ইঙ্গিতও সে দিয়েছিল।…একটা ভয়ংকর অস্বস্তি ও দুর্ভাবনা নিয়ে সেদিন ঘরে ফিরেছিলাম ।… দেখুন, আনিসুজ্জামান, আমার একাত্তর, সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৭, ঢাকা, পৃ. ৫৮-৫৯।

Page 60

বলা বাহুল্য, এরূপ ‘অনিশ্চয়তা’রই ফল হলাে তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা সরকার এবং ওসমানীর অধীনস্ত মুক্তিবাহিনীর বিস্তৃতির পরও মুজিব বাহিনীর সৃষ্টি। এরূপ অনিশ্চয়তা’ যে বিপুল উৎকণ্ঠা’র জন্ম দিয়েছিল তার সরাসরি ছাপ পড়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম সাক্ষাৎকারে । তাজউদ্দীন আহমদের সহকারী মঈদুল হাসানের বিবরণ থেকেই দেখা যাক ভারতীয় সেই উৎকণ্ঠার বাস্তব স্বরূপ :

(একাত্তরের ৩ এপ্রিল রাতে) তাজউদ্দীন আহমদকে ১ সফদর জং রােডের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। তাজউদ্দীন আহমদের ভাষ্য অনুযায়ী, তিনি যখন পৌছান, মিসেস গান্ধী তখন দীর্ঘ বারান্দায় হাঁটছিলেন হন হন করে। তাকে দেখতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম প্রশ্ন ছিল-“শেখ মুজিব কোথায়? এবং উত্তরের অপেক্ষা না করেই তার দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেন কেন? তাজউদ্দীন আহমদ তবু তাকে বলেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন; সরকার গঠন করেছেন; তারপর একটা বিভ্রাটে পড়ে তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। কিন্তু তার এই কথায় ইন্দিরা গান্ধীর সংশয় কাটেনি।৬৭

উপরিউক্ত ‘সংশয়’ ও ‘অনিশ্চয়তা’ মুক্তিযুদ্ধে ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কীভাবে দীর্ঘ ছায়া ফেলেছিল তারই বিবরণ পরবর্তী আলােচনায় ধাপে ধাপে।

……………………………………………

৬৭। এ কে খন্দকার, মঈদুল হাসান, এস আর মীর্জা, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৪।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!