You dont have javascript enabled! Please enable it!

অনুসন্ধানের প্রাসঙ্গিকতা, পরিধি, পদ্ধতি, কাঠামাে ও সীমাবদ্ধতা

আমাদের ইতিহাস নেই। যেসব কথা শ্ৰতিস্মৃতিরূপে প্রচলন রয়েছে, তাকে ইতিহাসের কায়া তাে নয়ই, কঙ্কালই বলা চলে না। কেননা, তা বিচ্ছিন্ন, খণ্ড, মুত্র তথ্য মাত্র। ওতে ইতিহাসের ছায়া আছে, প্রাবাদিক তথ্য আছে, পল্লবিত কিংবদন্তি আছে, কিন্তু সঙ্গতি, সামঞ্জস্য কিংবা ধারাবাহিকতা নেই।

-আহমদ শরীফ, বাঙলার বিপ্লবী পটভূমি৩

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিশ্চয়ই একদিন কেউ না কেউ সঠিকভাবেই লিপিবদ্ধ করবে। হয়তাে শতবর্ষ পরে। তখন আজকের প্রগতিশীলরা থাকবেন না। প্রতিক্রিয়াশীল বলেও কেউ হয়তাে আর থাকবেন না। শুধু থাকবে ইতিহাসের কঠোর বাস্তবতার বলিরেখাযুক্ত মুখায়ব।

-আল মাহমুদ, কবির মুখ৪

বাংলাদেশের দু’জন খ্যাতনামা ব্যক্তির দুটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে এই অনুসন্ধানপর্বের শুরু হচ্ছে। প্রথমােক্ত ব্যক্তি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গদ্যকারদের একজন; দ্বিতীয়জনের ঠাই হয়েছে শ্রেষ্ঠ কবিদের সারিতে। দু’জনের বক্তব্যেই রয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা নিয়ে গভীর হতাশার ছাপ- যা এ মাধ্যমের যে কোনাে নবীন লেখকের জন্য বিশেষ চ্যালেঞ্জস্বরূপও বটে। উপরােক্ত দু’জনই জীবনের কোনাে এক সময়ে কোনাে না কোনােভাবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন; আহমদ শরীফ ছিলেন কর্নেল তাহের সংসদের সভাপতি; আল মাহমুদ ছিলেন জাসদের মুখপত্র ‘গণকণ্ঠ’-এর সম্পাদক। এই উভয় সাহিত্য-তারকার কারাে সঙ্গেই দলটির সম্পর্ক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি এবং সে সম্পর্ক এখন আর কোথাও স্মরিতও হয় না।

………………………………………….

৩। আহমদ শরীফ এই লেখাটি লিখেছিলেন কর্নেল তাহের স্মারক বক্তৃতা’ আকারে। এটি ছিল এরূপ প্রথম স্মারক বক্তৃতা। ১৯৮৯ সালে এটি মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। বর্তমান উদ্ধৃতিটি নেয়া হয়েছে কর্নেল তাহের সংসদ কর্তক ২০১২ সালে বীণা শিকদারের সম্পাদনায় প্রকাশিত এই বক্তৃতার দ্বিতীয় মুদ্রিত প্রকাশ থেকে, পৃ. ১।

৪। আত্মজৈবনিক গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল মাহমুদ এ মন্তব্য করেন। দেখুন, কবির মুখ, আদর্শ, ২০১২, ঢাকা, পৃ. ২২৮।

Page 20

বস্তুত স্বাধীনতা-উত্তর সমাজে জাসদ-এর ব্যানারে বাংলাদেশে যে নতুন বামপন্থী রাজনৈতিক ধারার অভ্যুদয় ঘটে- সামান্যই এখন অবশেষ আছে তার।৫

তবে জাসদের উত্থান ও অবক্ষয় বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি বিজ্ঞানের জন্য শিক্ষণীয় এক অধ্যায়। এমনকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির মনােযােগী পাঠকের জন্যও এ দলের ইতিহাস বিশেষ প্রাসঙ্গিক। ফলে আহমদ শরীফ উল্লিখিত ‘শ্রুতি ও স্মৃতি’ ঘেঁটে এবং আল মাহমুদ কথিত ‘ইতিহাসের কঠোর বাস্তবতা খুঁজতেই এই অনুসন্ধান।

সাধারণভাবে জাসদে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনটি পরস্পর বিচ্ছিন্ন। রাজনৈতিক স্রোতের সম্মিলন ঘটেছিল। সিরাজুল আলম খান, লে. কর্নেল আবু তাহের এবং মেজর এম এ জলিলকে এই তিন ধারার প্রতিভূ বলা যায়। ১৯৭১-এর আগে পরস্পরের কাছে প্রায় অপরিচিত এই তিন ধারার মধ্যে আবু তাহের তাঁর মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা ও অবদানের কারণে যুদ্ধকালে বিশেষ পরিচিতি পান৬। অন্যান্য সেক্টর কমান্ডারের পাশাপাশি যুদ্ধকালে তার রাজনৈতিক ও সামরিক স্বাতন্ত্র ছিল স্পষ্ট। তাহেরের সমাজতান্ত্রিক উচ্চাশা যুদ্ধের সময় কোন গােপন ব্যাপার ছিল না। ইতিহাসশাস্ত্রের যে কোনাে অনুসন্ধানকারীর পক্ষে ১৯৭৪-৭৫ সালের বিপ্লবী এই কর্নেলকে ১৯৭১ সালের রণাঙ্গনে৭ আবিষ্কার করা

…………………………………………….

৫। ২০১৩ সালে সমাপ্ত জাতীয় সংসদে এ দলের তিন জন সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু (কুষ্টিয়া), মইনউদ্দিন খান বাদল (চট্টগ্রাম) ও শাহ জিকরুল আহমেদ (বি. বাড়িয়া) ছিলেন এবং তারা সকলে নির্বাচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে এবং প্রত্যক্ষ সমর্থনে। ২০১৪-এর ৫ জানুয়ারি প্রধান প্রধান বিরােধী দলগুলাের বর্জন সত্ত্বেও প্রায় একতরফা যে সাধারণ নির্বাচন হয় তাতে জাসদের পাঁচ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও চারজনই ছিলেন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকে।

৬। মুক্তিযুদ্ধে আবু তাহেরের ভূমিকা সম্পর্কে দেখুন, আলতাফ পারভেজ, অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ, কর্নেল তাহের ও জাসদ রাজনীতি, পাঠক সমাবেশ, ১৯৯৬, ঢাকা, পূ, ৩৭-৪৬।

৭। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মেজর থাকাবস্থায় পালিয়ে এসে আবু তাহের যুদ্ধে যােগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধকালে এক পর্যায়ে ১১ নং সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সেক্টর গড়ে উঠেছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, রংপুর ও গাইবান্ধার কিছু এলাকা নিয়ে। সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল মহেন্দ্রগঞ্জে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক সেক্টরে বামপন্থী তরুণদের বাধা দেয়া হলেও তাহের ঐরূপ আদর্শের তরুণদের খুঁজে পেতে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন।’ লেখক কর্তৃক গৃহীত ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধা নঈম জাহাঙ্গীরের সাক্ষাৎকার, মে ২০১২, ঢাকা। এই লেখাতেই পরে (অধ্যায় ৬, খ) আমরা দেখবাে জাসদের সশস্ত্র রূপ হিসেবে গড়ে ওঠা বিপ্লবী গণবাহিনীর একটি শাখা হিসেবে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলাের অভ্যন্তরে সৃষ্ট বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’-এর কার্যক্রমের ক্ষেত্রে আবু তাহের মুখ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর তাঁর জন্ম । মুক্তিযুদ্ধে তিনি বীরউত্তম’ খেতাব পান। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম এডজুটেন্ট জেনারেল (এজি) ছিলেন।

Page 21

মােটেই দুরূহ হবে না। তবে একই সময়ে সিরাজুল আলম খানের৮ নেতৃত্বাধীন ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ নিউক্লিয়াস’-এর সমাজতান্ত্রিক অভিযাত্রা অতটা সরলরৈখিক নয় এবং মেজর এম এ জলিল”৯-এর নেতৃত্বাধীন গ্রামীণ

………………………………………………..

৮। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের খ্যাতনামা সংগঠক। ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি; তখন নাম ছিল পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ । সিরাজুল আলম খান ১৯৬৩-৬৪ এবং ১৯৬৪-৬৫ এই দুই মেয়াদে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকায় ছাত্রলীগের যে প্রাদেশিক সম্মেলন হয় তাতে ওবায়দুর রহমান সভাপতি ও সিরাজুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। আগের কমিটিতে (১৯৬০-৬৩) শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন ছিলেন সভাপতি এবং ফজলুল হক মণি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। পরের কমিটিতে (১৯৬৫-৬৭) মাজহারুল হক বাকী ছিলেন সভাপতি, আবদুর রাজ্জাক ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ১৯৪১ সালের ৬ জানুয়ারি নােয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামে সিরাজুল আলম খানের জন্ম । বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়ন করেছেন অংকশাস্ত্রে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার বিষয়ে তাঁর অনেক মৌলিক ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে মূলত একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে দেশে-বিদেশে কাজ করছেন। ১৯৭১- এর ২৫ মার্চ পূর্ববর্তী সময়ে স্বাধীনতার পটভূমি তৈরির মুখ্য চরিত্র।

৯। এম এ জলিল যুদ্ধকালে ছিলেন ৯ নং সেক্টরের অধিনায়ক। এই সেক্টর গড়ে উঠেছিল বৃহত্তর বরিশাল, যশাের, খুলনা এবং ফরিদপুরের কিছু এলাকা নিয়ে। যুদ্ধে যােগদানের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাভালরী রেজিমেন্টে ‘মেজর ছিলেন। যুদ্ধকালে সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে মতভিন্নতা এবং মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে ভারতীয় ভূমিকার বিরােধিতা করার কারণে একাত্তরের ৩০ ডিসেম্বর তাকে আটক করা হয়। তার বিরুদ্ধে সেই সময়কার খুলনার বেসামরিক প্রশাসনের তরফ থেকে নারী নিপীড়নেরও অভিযােগ তােলা হয়েছিল। তবে সামরিক আদালতে বিচার শেষে সব অভিযােগ থেকে নির্দোষ প্রমাণিত হয়ে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে আটকাবস্থা থেকে মুক্ত হন। যে সামরিক আদালতে তার বিচার হয় তার প্রধান ছিলেন লে. কর্নেল আবু তাহের। ধারণা করা হয়, এখানেই উভয় সেক্টর কমান্ডার নিজেদের রাজনৈতিক ও স্বদেশচিন্তার ঐক্য খুঁজে পেয়ে থাকবেন। ইতিহাসের বড় কৌতুক এই যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্তদের ঢাকা সেনানিবাসে যেখানে রাখা হতাে সেই “সিগনাল অফিসার্স মেসেই সেক্টর কমান্ডার জলিলকেও রাখা হয় “বিচারকালে । এসময় ৯ নং সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা ‘নির্ভীক সঙ্’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলে জলিলের মুক্তির দাবিতে ঢাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলে আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে। প্রাক্তন এমএনএ নূরুল ইসলাম মঞ্জুরসহ ৯ নং সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ সমর নেতৃবৃন্দ এ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন- যা যুদ্ধোত্তর সমাজে জলিলকে জনপ্রিয় করে তােলে। সামরিক আদালত থেকে খালাস পাওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জলিলকে বিডিআর-এর দায়িত্ব নিতে বা তাঁর দল করতে বলেন। জলিল সেসময় মুজিবকে সীমান্ত রক্ষায় একটি পরিকল্পনা দিয়েছিলেন যা প্রধানমন্ত্রীর একজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহযােগীর হস্তক্ষেপে বাস্তাবায়ন হয়নি। দেখুন, সাপ্তাহিক বিচিন্তা, বর্ষ ১, সংখ্যা ১৩, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭, ঢাকা।

মেজর জলিলের জন্ম ১৯৪২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বরিশাল জেলার উজিরপুরে। ১৯৭২ সালে ৩১ বছর বয়সে তিনি জাসদের প্রথম সভাপতিমনােনীত হন। ১৯৭৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ভােলা লঞ্চঘাটে তৎকালীন সরকার সমর্থকদের দ্বারা সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হলেও অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান । জাসদ ত্যাগ করার পর, আন্তর্জাতিক এক সম্মেলনে অংশগ্রহণরত অবস্থায় ১৯৮৯ সালের ২০ নভেম্বর পাকিস্তানে অসুস্থ হয়ে মারা যান তিনি। উল্লেখ্য, ভৌগােলিক দুর্গমতা ও মুক্তিযােদ্ধাদের মাঝে পল্লিসমাজের তরুণদের প্রায় একচেটিয়া প্রতিনিধিত্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নবম সেক্টর বিশেষ মনােযােগের দাবি রাখে।

Page 22

মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ঐ নিউক্লিয়াসভুক্ত অপেক্ষাকৃত শহুরেদের সম্মিলনও সহজবােধ্য নয়। ১৯৭২-এ উপরিউক্ত তিন ধারার সম্মিলন প্রক্রিয়াটির প্রস্তুতিপর্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল মুক্তিযুদ্ধের গর্ভজাত ‘মুজিব বাহিনী’-এর প্রথম সারির কেন্দ্রীয় সংগঠকদের দ্বারা জাসদের জন্ম। তারই পূর্বাপর খোঁজা হবে এই অনুসন্ধানে। বাংলাদেশে বহুল পঠিত ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’-এর আরেকপ্রস্ত পুনর্পাঠ বলা যেতে পারে একে ।

সুনির্দিষ্টভাবে বললে, মুজিবনগরের অস্থায়ী প্রবাসী সরকার মুক্তিসংগ্রাম এগিয়ে নেয়ার জন্য কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে ১১টি সেক্টরভিত্তিক যে মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলে তাতে যুক্ত হননি মুজিব বাহিনীর সদস্যরা। এরা সংগঠিত ও সশস্ত্র হয়েছিলেন মূলত বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট (বিএলএফ) নামের সংগঠনের পতাকাতলে। এই ফ্রন্টভুক্তরা আবার নিজেদের ‘মুজিব বাহিনী” নামে পরিচয় দিতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। এই পরিচয় প্রদানের মাধ্যমে যে নীরব বার্তাটি দেওয়ার চেষ্টা ছিল, তা হলাে- সংগঠন হিসেবে মুক্তিবাহিনীর চেয়ে তারাই বেশি মাত্রায় আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বাসভাজন ও নিকটের। এই মুজিব অনুসারী বা ভক্তদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই যুদ্ধ-পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান নিতে গিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর অভ্যুদয় ঘটান এবং তাতে শামিল হন মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডার আবু তাহের ও এম এ জলিল এবং যুদ্ধকালীন তাদের অনেক সশস্ত্র সহযােগী। জাসদের অভ্যুদয় এবং আবু তাহের ও এম এ জলিলের তাতে সামিল হওয়া ছিল যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ও সামরিক চমক। এই চমকের প্রধান এক কারণ হলাে- যুদ্ধকালে আবু তাহের, এম এ জলিলসহ প্রায় সকল সেক্টর কমান্ডারের কাছেই ‘মুজিব বাহিনী ছিল সন্দেহ, অবিশ্বাস ও রহস্যেঘেরা এক বাহিনী; অথচ এই সন্দেহ ও অবিশ্বাসের দুই দিকের বাসিন্দারাই যুদ্ধ শেষের মাত্র নয় মাসের মধ্যে যুক্ত হলেন জাসদ নামক রাজনৈতিক দলে! কেন এবং কী পরিস্থিতিতে এটা সম্ভব হলাে; বাংলাদেশের আর্থসামাজিক জীবনে তার কী ফল হলাে; এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধোত্তর সমাজে আবার নতুন কী ধরনের আশাবাদ ও অবিশ্বাস তৈরি হলাে এবং সেই সন্দেহ, আশা ও অবিশ্বাসের বাস্তব পরিণতি কী দাঁড়াল- এসব খতিয়ে দেখাই চলতি অনুসন্ধানে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হিসেবে ছিল।

Page 23

বাংলাদেশের গবেষণা সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ বহুভাবে অনুসন্ধানের শিকার। একাত্তর সালকে এখানে মুক্তি’র বছর এবং ১৬ ডিসেম্বরকে মহান বিজয়ের পূর্ণতা’ হিসেবেই দেখা হয়। সরকারিভাবে কয়েক দফায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখিত হয়েছে এখানে। কিন্তু যুদ্ধকালে এবং যুদ্ধ-পরবর্তী দিনগুলােতে দেশের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে মুজিব বাহিনী নিয়ে ব্যাপক আলােচনা ও বিতর্ক সত্ত্বেও তারুণ্যদীপ্ত এই সংগঠনের জন্ম, ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে এই সংগঠনের সম্পৃক্তি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের স্বার্থের সঙ্গে এর দূরবর্তী যােগসূত্র, এই সংগঠনকে ঘিরে অত্র অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিসমূহের স্বার্থের মেলবন্ধন, মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে মুজিব বাহিনীর লাগাতার বিরােধিতা, যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে মুজিব বাহিনী সংশ্লিষ্টদের দ্বারা কথিত ‘হত্যা চেষ্টা’, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টিতে মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দের একাংশের সচেতন ভূমিকা, একাত্তর পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামরিক পরিমণ্ডলে ‘মুজিব বাহিনী’র পর্যায়ক্রমিক কাঠামােগত বিকাশ ইত্যাদি প্রশ্ন আজও মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক সাহিত্যে গভীরভাবে মনােযােগ না পাওয়া বিস্ময়কর। বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদের কাছে সকল ধরনের covert action প্রলুব্ধকর এক বিষয় হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে ‘মুজিব বাহিনী’ কেন স্থানীয় সাংবাদিক ও গবেষকদের আকর্ষণ করতে পারেনি তা বােধগম্য নয়।

বর্তমান লেখায় শুরুতে ‘মুজিব বাহিনী সম্পর্কিত কয়েকটি বিবদমান ভাষ্য তুলে ধরা হবে এবং তার আলােকে যুদ্ধকালে এবং যুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে মুজিব বাহিনীর অভিযাত্রাকে বােঝার চেষ্টা করা হবে। স্বাধীনতা-উত্তর দেশে মুজিব বাহিনীর ওপর অনুসন্ধানের গুরুত্ব এ কারণে যে, মুজিব বাহিনীর একাংশ একদিকে যখন জাসদ গড়ে তুলেছিল, সেই সময়েই আরেক অংশ নিয়ে তৎকালীন সরকারের তরফ থেকে গঠন করা হয়েছিল রক্ষীবাহিনীর প্রথম দিককার কয়েকটি ব্যাচ, শেখ ফজলুল হক মণি১০ গড়ে তােলেন যুবলীগ’, আবদুর রাজ্জাক গড়ে

………………………………………….

১০। গােপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার পৈতৃক নিবাস। সিরাজুল আলম খানের মতােই পাকিস্তান ছাত্রলীগে দু’বার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন (১৯৬০-৬৩)। শেখ মুজিবুর রহমানের বড় বােনের বড় ছেলে। ১৯৬৪ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠান বয়কট আন্দোলনে নেতত্ব দিয়ে বিশেষ পরিচিতি পান। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার একজন ছিলেন শেখ মণি; অন্যদের মধ্যে ছিলেন রাশেদ খান মেনন, ওবায়দুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানকালে রিসালদার মুসলেহউদ্দিনের নেতৃত্বে একদল সৈনিক কর্তৃক ঢাকায় নিজ বাড়িতে সস্ত্রীক নিহত হন মণি। তাঁর বিশ্লেষণাত্মক লেখনী শক্তি ছিল প্রশংসনীয়। সাহসী ও বলিষ্ঠ সংগঠক ছিলেন।

Page 24

তােলেন ‘স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং পঞ্চম আরেক অংশকে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয় নতুন রাষ্ট্রের বেসামরিক প্রশাসনে।১১ সমকালীন বিশ্বে অন্যদেশে জাত ও পরিপুষ্ট কোনাে সশস্ত্র non-state actor-এর এভাবে নির্বিঘ্নে দ্রুতলয়ে state actor-এ পরিণত হওয়ার আর কোনাে দৃষ্টান্ত মেলে না- যেমনটি ঘটেছে মুজিব বাহিনীর ক্ষেত্রে।

উপরে উল্লিখিত পাঁচ অভিমুখে মুজিব বাহিনীর নবঅভিযাত্রা এবং তাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও মিলন পরবর্তী দশকগুলােতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এমন বহু টানাপােড়েনের জন্ম দিয়েছে- যা ক্ষতবিক্ষত করেছে দেশকে। আবার কারও কারও তরফ থেকে এইরূপ অনুমান করা হয়েছিল ১৯৭১ সালেই। এ প্রসঙ্গে যুদ্ধকালের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের উপদেষ্টা এবং আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মন্তব্যটি উল্লেখ করা যেতে পারে। মুজিব বাহিনীর প্রতিষ্ঠাকে তিনি এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করেছেন।১২ আমিরুল ইসলামের কথিত এই ‘বিপর্যয় থেকেই অন্য একাধিক সংগঠনের পাশাপাশি জন্ম হয় জাসদ ও তাদের সামরিক শাখা ‘গণবাহিনী’র, সে কারণেও বাংলাদেশের রাজনীতি বিজ্ঞানে এসব বাহিনী এবং তার আর্থসামাজিক পরিণতি নিয়ে আলােচনা বিশেষ জরুরি। মুজিব বাহিনীর জন্ম আদৌ কোনাে বিপর্যয় ছিল কি না এবং তার গর্বজাত স্বাধীনতা-উত্তর নতুন নতুন সংগঠনগুলাে কি সেই ‘বিপর্যয়’-এর ধারাবাহিকতা- না কি তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা সেটা বােঝাও জরুরি বিবেচনা করা হয়েছে এই অনুসন্ধানে। জাসদ পরিবারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পরবর্তীকালে দাবি করেছেন, ‘মুজিব বাহিনী গণবাহিনী সৃষ্টির কোনাে পশ্চাৎভূমি নয়।১৩ এরূপ দাবির যথার্থতা খতিয়ে দেখাও বর্তমান আলােচনার অন্যতম দায় হিসেবে থাকছে।

………………………………………..

১১। ..গণপ্রশাসনে, বিশেষত ১৯৭৩ সালে যাদের পাবলিক সার্ভিস কমিশন নির্বাচন করেছিল তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ মুজিব বাহিনীর ছিল’, লিখেছেন মুজিব বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক আবদুল মান্নান চৌধুরী (মুক্তিযুদ্ধ ও মুজিব বাহিনী, বৈশাখী প্রকাশনী, ১৯৯৮, ঢাকা, পৃ. ৪১)। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের এরূপ নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লােকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ও আরেকজন গবেষক শেখ আবদুর রশীদ তাঁদের গবেষণা গ্রন্থে। (Syed Giasuddin Ahmed, Bangladesh Public Service Commission, University of।Dhaka, Dhaka, 1990, p.103-105 3 Sheikh Abdur Rashid, Civil Service At the Cross-roads, Muktochinta Prokashona, Dhaka, 2008) বিস্তারিত আলােকপাত করেছেন। এ বিষয়ে এই লেখার পঞ্চম অধ্যায়ে (৫.খ) বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

১২। দেখুন, স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (১৫ শ’ খণ্ড), তথ্য মন্ত্রণালয়, ঢাকা, ১৯৮৫, পৃ. ১৩১।

১৩। মাহমুদুর রহমান মান্না, মিথ্যা ইতিহাসের ওপর জাতি দাঁড়াতে পারে না, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৯ জুলাই, ২০১৪, ঢাকা ।

Page 25

ভিন্ন আরেকটি কারণেও মুজিব বাহিনী বিষয়ে অনুসন্ধানের এই উদ্যোগ । এর মধ্য দিয়ে আমরা খুব প্রাসঙ্গিকভাবে বুঝতে চাইব মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় ‘সহযােগিতা’র তাত্ত্বিক কাঠামােটি । সাধারণভাবে বলা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তার মূলভিত্তি ‘মানবিক দায় এবং আদর্শগত চাপ।’ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় নিজ দেশের একাংশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত বর্বরতা ও গণহত্যা এবং পূর্ববাংলা জুড়ে তৎপরবর্তী ঘটনাবলি যেভাবে লাখ লাখ শরণার্থীকে ভারতে ঠেলে দিয়েছে সেটাই এই যুদ্ধে ঐ দেশের সংশ্লিষ্টতার প্রধান বাধ্যবাধকতা তৈরি করে। কেউ কেউ একে ‘…one of the world’s most successful cases of humanitarian intervention against genocide’ হিসেবেও অভিহিত করেছেন।১৪ দ্বিতীয়ত, (এও বলা হয়) পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বাংলা ভাষা-ভাষীদের বিপুল উপস্থিতির কারণে পূর্ব-পাকিস্তানের মুক্তিসংগ্রামে পাশে দাঁড়ানাের এক ধরনের আবেগগত দায়ও ভারতকে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করে।

ঐতিহাসিক স্মৃতির এসব বােঝায় বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক অধিকাংশ সাহিত্য ভারাক্রান্ত এবং তাদের তরফ থেকে তৃতীয় এমন দাবিও করা হয়,১৫ ‘আওয়ামী লীগ ও (ভারতীয় জাতীয়) কংগ্রেসের মধ্যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সাদৃশ্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ‘দোদুল্যমানতা কাটিয়ে উঠতে আদর্শিক চাপ হিসেবে কাজ করেছে ভারতের ওপর। পরবর্তী অনুচ্ছেদগুলাের আলােচনা থেকে আমরা দেখার চেষ্টা করবাে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সূচনা কতটা আবেগগত এবং কতটাইবা ‘জাতীয় স্বার্থ’ চালিত ছিল। পাশাপাশি এও লক্ষ্য করা হবে, পূর্ববাংলার স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করতে ভারত আদৌ “দোদুল্যমান ছিল কি না- নাকি একাত্তরের বহু পূর্ব থেকে বিপুল বিনিয়ােগসহ একাগ্রচিত্তে সে নিজেই এই মাহেন্দ্রক্ষণ সৃষ্টিতে সংশ্লিষ্ট ও সক্রিয় ছিল এবং মুজিব বাহিনীর জন্ম সেই সক্রিয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোনাে তাৎপর্য বহন করে কি না।

এ পর্যায়ে বাংলাদেশে একাত্তর-উত্তর সমাজে দৃশ্যমান ‘ভারত-নির্ভরতা’র ধারণা এবং প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে কীভাবে ভারত-নির্ভরতার চর্চা শুরু হয়

……………………………………………………….

১৪। 38 Gary J. Bass, The Blood Telegram, Random House, 2013 India, p. 334.

১৫। এরূপ দৃষ্টিভঙ্গির সুপকে বিস্তারিত আলােচনা দেখুন, মােহাম্মদ সেলিম, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৯, পৃ. ২৯-৪৪। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে আদর্শবাদিতার প্রত্যক্ষ প্রভাব’- এরূপ অভিমত তুলে ধরে রাষ্ট্রীয় প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থে বিপুল রেফারেন্সের সমাবেশ ঘটানাে হয়েছে। প্রায় একই ধরনের নীতিগত অবস্থান লক্ষ্য করা যায়, Salam Azad-এর Contribution of India in the war of liberation of Bangladesh, Ankur Prakashani, 2003, Dhaka শীর্ষক প্রকাশনায়।

Page 26

সে বিষয়ও খতিয়ে দেখা হবে। উপরন্তু, একাত্তর-উত্তর বাংলাদেশে অন্তত ৪-৫ বছরের জন্য দেশজুড়ে যে প্রায়-গৃহযুদ্ধ তুল্য পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তার পেছনে কীরূপ বহির্দেশীয় ঐতিহাসিক যােগসূত্র ছিল তাও খতিয়ে দেখা হয় এই অনুসন্ধানে। বাংলাদেশের ইতিহাসের উপরােক্ত কালপর্বে (১৯৭১-‘৭৫) গৃহযুদ্ধতুল্য পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ২-৩ জন রাজনৈতিক চরিত্রকে ঘিরে ‘অন্ধ আনুগত্যের সংস্কৃতি কীরূপ ভূমিকা রেখেছিল তারও মােটাদাগের নজির পাওয়া যাবে এ পুনর্পাঠ প্রক্রিয়ায়। পুরাে আলােচনা মুজিব বাহিনীকেন্দ্রিক হলেও প্রাসঙ্গিকভাবেই উপরােক্ত নানান বিষয়ে আলােকপাত ঘটেছে।

অনুসন্ধানের পদ্ধতি

তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বর্তমান গ্রন্থে সম্মিলিতভাবে অনেক ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর সময় এবং বিশেষত মুজিব বাহিনী, জাসদ ও রক্ষীবাহিনীর ওপর লিখিত দেশি-বিদেশি গ্রন্থ ও দলিলপত্র ব্যাপকভাবে পর্যালােচনা করা হয়েছে এখানে। যার বিস্তারিত উল্লেখ পাবেন পাঠক প্রাসঙ্গিক অধ্যায়গুলােতে। তবে ব্যবহৃত গ্রন্থাদি সম্পর্কে এ পর্যায়ে এটা বলে নেয়া জরুরি যে, সাধারণভাবে মুজিব বাহিনী নিয়ে ঐ বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা যে দু-তিনটি ক্ষুদ্র আয়তনের পুস্তক রচিত হয়েছে (যেমন আবদুল মান্নান চৌধুরী, শেখ মােহাম্মদ জাহিদ হােসেন প্রমুখ কর্তৃক) তাতে এই বাহিনীর কার্যক্রমের কিছু বিবরণ দেওয়া হলেও এর সৃষ্টির তাৎপর্যময় অনেক বিষয়ই বাদ পড়েছে তাতে । উপরন্তু যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এই বাহিনীর দ্বিতীয় প্রজন্মের বিকাশ সম্বন্ধেও ঐসব প্রকাশনা নীরব । উপরিউক্ত লেখকরা মুজিব বাহিনীর নেতৃস্থানীয় সংগঠক ছিলেন না- ফলে তারা হয়তাে তৎকালীন ঘটনাবলির সামান্যই জানতেন। আবার নেতৃস্থানীয়দের (যেমন আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমেদ প্রমুখ) কিছু প্রকাশিত সাক্ষাৎকার পাওয়া গেলেও তাতে মুজিব বাহিনী সৃষ্টির ক্ষেত্রে বহিঃশক্তির ভূমিকা প্রায় অনুল্লেখই রয়েছে বলা যায়। এক্ষেত্রে ভারতীয় জেনারেল উবান তার গ্রন্থে অনেক তথ্য হাজির করেছেন বটে; কিন্তু তিনি এই প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রের দূরবর্তী ভূমিকা একেবারেই উল্লেখ করেননি। ভারতীয় লেখক অশােক রায়না এবং বি. রমন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে ভারতীয় তৎপরতার কিছু কিছু তথ্য হাজির করলেও মুজিব বাহিনী সম্পর্কে তারা নীরব থেকেছেন বা এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যের স্বাধীন গবেষকরাও স্বতন্ত্রভাবে মুজিব বাহিনীর গঠন ও এর ভূ-রাজনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে আজও কোনাে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা করেছেন বলে লক্ষ্য করা যায় না। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলাে, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র’-এ এই বাহিনী সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রায় দুর্লভ। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে গবেষকদের মধ্যে মঈদুল হাসান (দুটি গ্রন্থে), মাসুদুল

Page 27

হক প্রমুখ এই বাহিনী সৃষ্টিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থার ভূমিকার বিষয়ে আলােকপাত করলেও সেই ভূমিকার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় না তাঁদের কাছ থেকে। তাদের বিবরণেও মজিব বাহিনী থেকে জাসদ ও রক্ষীবাহিনী সৃষ্টির বিষয়টি একেবারেই মনােযােগ পায়নি। অনেকেই এভাবে মুজিব বাহিনীকে একাত্তরকেন্দ্রিক একটি স্বল্পস্থায়ী অভিপ্রকাশ হিসেবে ধরে নিয়ে তাঁদের অনুসন্ধান ও আলােচনা শেষ করেছেন। যে কারণে স্বাধীনতা-উত্তর শাসন কাহিনী, বামপন্থী রাজনীতি ও বিশেষভাবে জাসদ রাজনীতি সম্পর্কেও যেসব গ্রন্থ রচিত হয়েছে (তালুকদার মনিরুজ্জামান, লরেন্স লিফসুলজ, মােহাঃ রােকনুজ্জামান প্রমুখ কর্তৃক) তাতে জাসদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে মুজিব বাহিনীসংশ্লিষ্ট ধারাবাহিকতা, মাঠ পর্যায়ে এর সশস্ত্র শাখা গণবাহিনীর কার্যক্রম, শেখ মণি’র নেতৃত্বাধীন মুজিব বাহিনীর অপর গ্রুপের সঙ্গে সিরাজুল আলম খান গ্রুপের রক্তাক্ত বৈরিতা ও তার তাৎক্ষণিক সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ফলসমূহ পূর্ণাঙ্গভাবে খতিয়ে দেখা হয়নি। অন্যদিকে রক্ষীবাহিনী’ ও ‘গণবাহিনী নিয়েও স্বতন্ত্র ও বস্তুনিষ্ঠ কোনাে রাজনৈতিক গবেষণা এখনও পাওয়া যায় না বাংলাদেশে। সম্প্রতি রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে এই বাহিনীর কর্মকর্তা আনােয়ার উল আলম একটি গ্রন্থ লিখেছেন। তবে এ থেকে নিরপেক্ষ ভাষ্য পাওয়া দুরূহ। কারণ গ্রন্থটি রক্ষীবাহিনীকেন্দ্রিক সামাজিক অভিযােগের বিপরীতে পুরােপুরি আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক একটি ভঙ্গি থেকে লিখিত। এটা অস্বাভাবিকও নয়। কারণ লেখক এই বাহিনীরই একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন।

অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল সম্পর্কে আলােচনা করতে গিয়ে রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে কিছু কিছু আলােচনা করেছেন মওদুদ আহমদ, আহমেদ মুসা প্রমুখ রাজনৈতিক গবেষক। কিন্তু প্রথমােক্ত লেখকের গ্রন্থে রক্ষীবাহিনীর মাঠ পর্যায়ের তৎপরতার বিবরণ পাওয়া যায় না, যদিও তিনি ওই বাহিনী সৃষ্টির আইনগত প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক বিস্তারিত আলােকপাত করেছেন। আবার শেষােক্তজন এই বাহিনীর দ্বারা মাঠ পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত ও নির্যাতিত বহু মানুষের কাহিনীর সন্নিবেশ করলেও ‘গণবাহিনীর ভূমিকা তাতে আড়ালে পড়ে গেছে। উপরন্তু, এই গ্রন্থসমূহে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের দুঃখজনক শেষ পরিণতির ক্ষেত্রে এবং বাংলাদেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব অভিমুখীন রাজনীতির বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে মুজিব বাহিনী, এর অভ্যন্তরীণ বিভেদ এবং তা থেকে সৃষ্ট অন্যান্য সংগঠনের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হয়নি। এক্ষেত্রে আগ্রহী পাঠকের জন্য বিশেষ সহায়ক হতে পারে দুই বরেণ্য সাংবাদিক- সাপ্তাহিক হলিডে ও ডেইলী স্টারের প্রয়াত সম্পাদক যথাক্রমে এনায়েতুল্লা খান ও এস এম আলী’র লিখিত গ্রন্থদ্বয়। তবে, পুরাে মুজিব শাসনামল জুড়ে এনায়েতুল্লা খান সাপ্তাহিক হলিডে’তে যে রাজনৈতিক কলামগুলাে লিখেছেন তাতে তৎকালীন শাসন-কাঠামােতে মুজিব বাহিনীর প্রভাব সম্পর্কে যথার্থই আলােকপাত করা হলেও

Page 28

প্রাসঙ্গিকভাবে জাসদের ভূমিকা মনােযােগ পায়নি সেখানে। একইভাবে এস এম আলী তাঁর গ্রন্থে শেখ মুজিব শাসনামলের এমন একটি অন্তরঙ্গ ও অনুসন্ধানী চিত্র তুলে ধরেছেন- যার তুলনা পাওয়া সমকালে বিরল; কিন্তু রক্ষীবাহিনী ও গণবাহিনী প্রায় অনুল্লেখ্য সেখানে। এনায়েতুল্লা খান ও এস এম আলীর পাশাপাশি আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক (নির্মল সেন, রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ, আমির হােসেন প্রমুখ)-এর আত্মজৈবনিক রচনা থেকে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের অনেক ঐতিহাসিক উপাদান গৃহীত হয়েছে এই পর্যালােচনায়।

খ্যাতনামা এই সাংবাদিকদের রচনাবলি স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশকে বােঝার ক্ষেত্রে অনেক প্রয়ােজনীয় ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান দিলেও সেগুলাে উপস্থাপিত হয়েছে খণ্ডিত, বিচ্ছিন্ন এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আকারে- মুজিব বাহিনীর সঙ্গে একাত্তর-উত্তর ঘটনাবলির পূর্বাপর কোনাে যােগসূত্র প্রতিষ্ঠাতা ছাড়াই। একইভাবে পঁচাত্তরের আগস্টে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু ও পরবর্তী ২-৩ মাসের মধ্যে সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যবর্তী মাসগুলােতে রক্ষীবাহিনীর অভ্যুত্থানধর্মী তৎপরতাও আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে স্পষ্টভাবে উল্লিখিত নয় আজও। মেজর জেনারেল মইনুল হােসেন চৌধুরী, মেজর জেনারেল ইব্রাহিম, মেজর নাসির উদ্দিন প্রমুখ সামরিক কর্মকর্তারা এক্ষেত্রে যেসব তথ্য উল্লেখ করেছেন তার সমন্বয় ও পর্যালােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাহিত্যে পঁচাত্তরের তেসরা নভেম্বরের অভ্যুত্থান সম্পর্কে বিদ্যমান বয়ানগুলাে স্পষ্টত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে দেখা যায় ।

নানাভাবে ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছড়িয়ে আছে উল্লিখিত সকল লেখনিতেই- এবং সেগুলাে থেকে প্রয়ােজনী সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে যথাযথ উল্লেখসহ । দেশের দুটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম দুই পণ্ডিত উপাচার্য- সৈয়দ আলী আহসান (জাহাঙ্গীরনগর) ও আবুল ফজল (চট্টগ্রাম)-এর শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লিখিত স্মৃতিচারণমূলক দুটি গ্রন্থও এক্ষেত্রে বিশেষ সহায়ক হয়েছে ঐ সময়ের বাংলাদেশের পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য।

তবে মুজিব বাহিনী, জাসদ ও রক্ষীবাহিনীসংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে উপরিউক্ত কোনাে গ্রন্থই পাঠককে বিশেষ সহায়তা করে না। এমনকি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে সবচেয়ে.সাড়া জাগানাে গ্রন্থগুলােতেও১৬ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চরিত্র হিসেবে মুজিব বাহিনীর

……………………………………………………………..

2 Gary J. Bass, The Blood Telegram. Random House, 2013 India; Richard sisson and Leo E. Rose, War and Secession: Pakistan, India and the Creation of Bangladesh, University of California Press, 1990; Srinath Raghavan, 1971: A Global History of the Creation of Bangladesh, Harvad Univercity press, 2013. ইত্যাদি। প্রথম দুটি গ্রন্থে বিস্ময়করভাবে মুজিব বাহিনী সম্পর্কে কোনাে তথ্যই উল্লিখিত হয়নি। দ্বিতীয় গ্রন্থটিতে এই বাহিনী সম্পর্কে বিচ্ছিন্নভাবে ২-৩টি লাইন মাত্র উল্লেখ রয়েছে।

Page 29

সৃষ্টি ও তার ভূ-রাজনৈতিক ও সামরিক তাৎপর্য সম্পর্কে অতি সামান্য আলােকপাত করা হয়েছে। কোন কোনাে ক্ষেত্রে একেবারেই আলােকপাত করা হয়নি।

উল্লিখিত শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে প্রয়ােজন ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক অনুসন্ধানের। সে লক্ষ্যে তৎকালীন ঘটনাবলির একটি বাস্তবভিত্তিক রাজনৈতিক চিত্র পেতে প্রাসঙ্গিক বহু ব্যক্তির সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে এখানে।১৭ সাক্ষাৎকারে প্রাপ্ত তথ্যাবলিকে আবার মুদ্রিত তথ্যাবলির সঙ্গে তুলনা করে দেখা হয়েছে। সাক্ষাৎকার প্রদানকারীদের দু-একজনের ছদ্মনাম উল্লেখ করা হয়েছে- তাদের মতামত নিয়েই। আবার কারাে কারাে নাম কোনােভাবেই উল্লেখ করা হয়নি; সেও তাদের অনুরােধেই। এইরূপ ব্যক্তিরা এখনও তাদের রাজনৈতিক ও পেশাগত অবস্থানে থেকে সত্য প্রকাশে শংকিত বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। বলা বাহুল্য, উল্লিখিত সময়কার দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকা, বিভিন্ন ধরনের সাময়িকী থেকে প্রাপ্ত তথ্যাবলিও এখানে ব্যবহৃত রয়েছে ব্যাপকভাবে। আলােচ্য সময়ের তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক শ্লোগানগুলােকেও ঘটনাবলির ফাঁকে ফাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে- যা সমকালীন সমাজতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্ব অনুধাবনে সহায়ক হতে পারে।

তথ্যাবলি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে বর্তমান গ্রন্থের কিছু প্রথাবিরােধী ধরন সম্পর্কেও এ পর্যায়ে সামান্য কৈফিয়ত দেওয়া প্রয়ােজন। প্রথমত, গবেষণা সাহিত্যে একটি অধ্যায়ে একটি বিষয় উপস্থাপনের যে গতানুগতিক রেওয়াজ তা এখানে অনুসরণ করা হয়নি। সাধারণত রাজনীতি ও সমাজ জীবনে একটি বিষয়ের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিকভাবে বহু বিচিত্র এবং অনিয়ন্ত্রিত পথে ধাবিত হয়। তার অনুরণন চলে বিবিধ ভঙ্গিতে। অনেকটা সে কারণেই এখানে একাধিক অধ্যায় জুড়ে বর্ণিত হয়েছে কোনাে একটি ঘটনা বা চরিত্রের নানান অভিপ্রকাশ- উত্থান, পতন, প্রতিক্রিয়া। ‘মুজিব বাহিনী ও এর দ্বিতীয় প্রজন্মের সাংগঠনিক বিকাশ ধারা বুঝতে পাঠককে তাই পরিভ্রমণ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধ ও শেখ মুজিবুর রহমান শাসনামলের পুরাে সময়ব্যাপী। অর্থাৎ বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি

…………………………………………………..

১৭। মুজিব বাহিনী, জাসদ ইত্যাদি সংগঠনের প্রধান এক উদ্যোক্তা সিরাজুল আলম খান সাধারণত সাংবাদিক ও গবেষকদের আনুষ্ঠানিক কোনাে সাক্ষাঙ্কার প্রদান করেন না। বারংবার চেষ্টার পরও বর্তমান লেখকের ক্ষেত্রেও এই নীতির কোনাে ব্যতিক্রম ঘটেনি। এইক্ষেত্রে তার সঙ্গে অতীতে এবং বর্তমানে রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ঘনিষ্ঠ ছিলেন বা আছেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে দীর্ঘদিন নিবিড় আলাপচারিতার ভিত্তিতে ঐতিহাসিক নানান মুহূর্তে সিরাজুল আলম খানের ভূমিকা সম্পর্কে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে।

Page 30

অধ্যায় বা উপ-অধ্যায় পড়ে চলতি অনুসন্ধানের মূল প্রাপ্তি সম্পর্কে ধারণা লাভ দুরূহ হবে। আপাতদৃষ্টিতে আটটি অধ্যায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ২৭টি উপ-অধ্যায়ে বিভক্ত হলেও পুরাে গ্রন্থটি আসলে একটি অধ্যায়ের মতাে করেই লিখিত । তারপরও কোনাে বিশেষ ব্যক্তি, ঘটনা বা স্থান সম্পর্কে দ্রুত ধারণা লাভে আগ্রহীদের ‘নির্ঘণ্ট’ কিছুটা পাঠ-সহায়তা দিতে পারবে বলে আশা করা যায়। তিনভাবে (ব্যক্তি-বিষয়-স্থান) নির্ঘণ্ট সাজানাে হয়েছে সে লক্ষ্যেই।

গ্রন্থের কাঠামাে

সময়ের বিস্তৃতিতে বর্তমান অনুসন্ধানের পরিধি সীমিত হলেও ঘটনার ব্যাপকতায় তা বহুমুখী ও বিচিত্র। সে কারণে এ পর্যায়ে বর্তমান প্রকাশনার কাঠামােগত কিছু বিবরণও দেওয়া প্রয়ােজন। সাধারণভাবে মুজিব বাহিনীর জন্ম, বিকাশ, গঠন ও কার্যক্রম সম্পর্কে আলােকপাত করা হয়েছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতে (২.ক ও ৩.ক)। তৃতীয় অধ্যায়ের অন্তত দুটি উপ-অধ্যায়ে (৩.খ ও ৩.ঘ) মুজিব বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বিশেষ সামরিক বাহিনী স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স (Special Frontier Force) বা এসএফএফ-এর সম্পর্ক এবং যুদ্ধের শেষলগ্নে সেই সম্পর্কের বাস্তব অভিপ্রকাশ সম্পর্কেও আলােচনা রয়েছে। ৫.ক উপ-অধ্যায়ে আলােকপাত করা হয়েছে মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ সম্পর্কে।

তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের সঙ্গে।মুজিব বাহিনীর সম্পর্ক ও তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি আলােচিত হয়েছে। তৃতীয় অধ্যায়ের ‘গ’ উপ-বিভাগে (৩.গ)। মুজিব বাহিনীতে শুরু থেকে শেখ ফজলুল হক মণি ও সিরাজুল আলম খান গ্রুপের দ্বন্দ্ব এবং সেই দ্বন্দ্বের মতাদর্শিক দিক ও একাত্তর-উত্তর সরেজমিন পরিণতি সম্পর্কে আলােকপাত করা হয়েছে একই অধ্যায়ের ‘ঙ’ বিভাগে (৩.ঙ)।

পরের অধ্যায়গুলােতে এসেছে মূলত যুদ্ধোত্তর রাজনৈতিক বিবেচনাসমূহ । চতুর্থ অধ্যায়ের শুরুতে (৪.ক) মুজিবুর রহমানের যুদ্ধোত্তর একান্ত বলয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সৃষ্ট ঘটনাবলির বিবরণ দিয়ে জাসদ গঠনে সে সবের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হয়। এ পর্যায়ে এও বলার চেষ্টা ছিল, জাসদের জন্ম ও মুজিব বলয়ে রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ মণি’র একচ্ছত্র উত্থান- উভয়ে ছিল মুজিব বাহিনীর দ্বিতীয় পর্যায়ের যাত্রা। ৪.গ উপ-অধ্যায়েও এই বিষয়ে আলােকপাত করা হয়েছে।।সেখানে মুজিব বাহিনীর দুই অংশের সংঘাতের সূচনাপর্বও দেখতে পাবেন পাঠক। ৪.খ উপ-অধ্যায়ে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের ব্যর্থ প্রচেষ্টার কারণ ও ফল সম্পর্কে বিবরণ দিয়ে দেখানাে হয়েছে- কীভাবে এই কাঠামাে ব্যবহার করেই রক্ষীবাহিনী গঠনের দিকে এগিয়েছে সেই সময়কার সরকার। এরপরই চতুর্থ অধ্যায়ের চারটি উপ-বিভাগ (ঘ, ঙ, চ, ছ) জুড়ে জাসদের গঠনপর্বের বিস্তারিত

Page 31

তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে ৪.চ উপ-অধ্যায়ে জাসদের উত্থানকালে শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের ভূমিকা খতিয়ে দেখা হয়েছে এবং তারপরের উপ-অধ্যায়ে ১৯৭২ সালে ছাত্রলীগের ভাঙনের সূচনাকালে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কীরূপ মতাদর্শিক বিতর্ক ও সংঘাতের জন্ম দিয়েছিল সেটা উপস্থাপন করা হয়েছে ।

পঞ্চম অধ্যায়ের তৃতীয় পর্যায়ে (৫.গ) জাসদের মুখপত্র হিসেবে দৈনিক গণকণ্ঠ এবং তার বিপরীতে মুজিব বাহিনীর অপরপক্ষের মুখপত্র হিসেবে দৈনিক বাংলার বাণীর গড়ে ওঠার ইতিহাস ও ভূমিকা খতিয়ে দেখা হয়। এসময় মুজিব বাহিনীর নতুন বিস্তৃতি হিসেবে রক্ষীবাহিনীর জন্ম, বিকাশ, আইনগত কাঠামাে, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সামরিক আমলাতন্ত্রে আত্তীকরণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে একই অধ্যায়ের খ, ঘ, ঙ, চ ও ছ উপ-অধ্যায়ে। পাশাপাশি ১৯৭৫ সালের তেসরা নভেম্বরের সামরিক অভ্যুত্থানে রক্ষীবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার ধারণা যাচাই করা হয়েছে ৫.ঘ উপ-অধ্যায়ে।

ষষ্ঠ অধ্যায়ের প্রথম পর্যায়ে বামপন্থী রাজনীতির জগতে জাসদের আবির্ভাব যে বিতর্ক, বিবাদ ও চ্যালেঞ্জের জন্ম দেয় তার পূর্বাপর অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং পরের উপ-অধ্যায়ে (৬.খ) ‘গণবাহিনী আকারে এই দলের সশস্ত্র রূপ ধারণের ইতিবৃত্ত তুলে ধরা হয়েছে। এ পর্যায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে রহস্যঘেরা ব্যক্তি ও বিষয় হিসেবে চিহ্নিত নেদারল্যান্ডের নাগরিক পিটার কাস্টার্সের ভূমিকারও বিবরণ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ আলাপচারিতার আলােকে। ইতিহাসের ঐ জটিল সময়টিতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রশাসক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের ভারসাম্যের নীতি এবং পাশাপাশি তার পরিকল্পনা কমিশনের বিধ্বংসী ভূমিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তাৎপর্য ও ফল খতিয়ে দেখা হয় একই উপ-অধ্যায়ে। উল্লেখ্য, পরিকল্পনা কমিশনের উপযুক্ত বিধ্বংসী ভূমিকার প্রধান দিক ছিল সমাজতন্ত্রের নামে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রীয়করণ। এ বিষয়ে পরবর্তী উপ-অধ্যায়েও (৬.গ) আলােচনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সেই সময়কার সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ও পদক্ষেপ কীভাবে জাসদের উত্থানে জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে সে বিষয়েও আলােকপাত করা হয়েছে।

সপ্তম অধ্যায়ের শুরুতে (৭.ক) রয়েছে একাত্তর পরবর্তী মাঠ পর্যায়ে গণসশস্ত্রতার চিত্র। দ্বৈবচয়ন আকারে দেশের মধ্যাঞ্চলের কয়েকটি জেলাকে বেছে নেয়া হয়েছিল অনুসন্ধানের জন্য এবং প্রাপ্ত ফলাফলকে অভিহিত করা হয়েছে। ‘আধা-গৃহযুদ্ধতুল্য পরিস্থিতি হিসেবে। আর এর উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিব বাহিনী ও এর যুদ্ধ-উত্তর প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন বিকাশধারাকে। পরের উপ-অধ্যায়ে (৭.খ) যুদ্ধোত্তর বিপর্যয়কর পরিস্থিতির শেষ পরিণতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘােষিত একদলীয়

Page 32

‘বাকশাল’ কর্মসূচির পটভূমি ও পরিণতি সম্পর্কে আলােকপাত করা হয়েছে। এসময় কীভাবে মুজিবুর রহমান প্রশাসন মার্কিন বলয়ে প্রবেশ করছিল তারও চুম্বক দৃশ্য রয়েছে এ পর্যায়ে যা ছিল তাঁর কৌশলগত মােড় পরিবর্তনের এক মরিয়া প্রচেষ্টার সূচক। কিন্তু যা ছিল একই সঙ্গে বিপজ্জনক নানান স্ববিরােধিতায় ভরা।

বর্তমান অনুসন্ধানের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু আইন, দলিলপত্র ও লেখা গ্রন্থের শেষে সংযুক্ত করা হয়েছে- যা পাঠককে সম্পূরক পাঠ হিসেবে গ্রন্থভুক্ত মূল আলােচ্য বিষয়ের আরও গভীরে যেতে এবং সেই সময়কে বুঝতে সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়। সংযুক্তিগুলাে (মােট ২৯টি) বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও এখানে।কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। মুখ্যত পাঁচটি বিষয়কে ঘিরে সংযুক্তিগুলাে। আবর্তিত : ক. মুজিব বাহিনী; খ. রক্ষীবাহিনী; গ. জাসদ রাজনীতি; ঘ. ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫-এর আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ঙ. মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশাসনে নিয়ােগ সংক্রান্ত।১৮

…………………………………..

১৮। সংযুক্তিতে মুজিব বাহিনী সম্পর্কে নেতৃস্থানীয় এক সংগঠক (আ ফ ম মাহবুবুল হক)-এর পাশাপাশি মুক্তিবাহিনীর একজন সেক্টর কমান্ডার (রফিকুল ইসলাম)-এর নিজস্ব লেখা সংযুক্ত করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে বিপরীতমুখী অবস্থান থেকে লিখিত হলেও এসব ভাষ্য থেকে মুক্তিযুদ্ধে এই বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে অনেক সিদ্ধান্ত গঠন সম্ভব।

রক্ষীবাহিনী সম্পর্কিত চারটি আইনই এখানে সংযুক্ত হয়েছে। রয়েছে এই বাহিনীর কর্মকর্তাদের একটি তালিকাও- যা সংগৃহীত হয়েছে এই বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার গ্রন্থ থেকে। পাশাপাশি রয়েছে এই বাহিনীর তৎপরতার ধরন আঁচ করার জন্য কমিউনিস্ট নারী সংগঠক অরুণা সেনের একটি বিবৃতি। অরুণা সেন তখন এই বাহিনীর হাতে আটক ও।নিগৃহীত হয়েছিলেন। ঐ সময়ের আধা-গৃহযুদ্ধতুল্য পরিস্থিতি ফল হিসেবে জাসদ ও আওয়ামী লীগের নিহত কর্মীদের দুটি তালিকাও তুলে ধরা হয়েছে গ্রন্থ শেষে । বলা বাহুল্য, তালিকা দুটি অপূর্ণাঙ্গ।

সংযুক্তির তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে জাসদ রাজনীতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দলিলপত্র। এই দলের জন্ম ও তার প্রথম তিন বছরের রাজনীতি বিকাশের ধারাবাহিকতা বােঝার সুবিধার্থে।।অনেকগুলাে সংযােজনী রয়েছে। যে তালিকায় আছে এই দলের ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়া বিদেশি ব্যক্তিত্ব পিটার কাস্টার্স-এর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার এবং সিরাজুল আলম খানের সংক্ষিপ্ত প্রােফাইল- যা প্রায় এক যুগ পূর্বে স্বল্প পরিচিত একটি ইংরেজি সাপ্তাহিকে প্রকাশিত হয়েছিল, প্রচুর অসম্পূর্ণতাসহ।

তৎকালীন সামরিক আমলাতন্ত্রের মনােভাব উপলব্ধির স্বার্থে লে. কর্নেল জিয়াউদ্দীন ও মেজর জলিলের ঐ সময়ের আলােচিত দুটি লেখা রয়েছে চতুর্থ ক্যাটাগরীতে। একই সময়ের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি উপলব্ধির স্বার্থে লেখক আহমদ ছফার একটি দীর্ঘ লেখা এবং রফিক আজাদের একটি কবিতাও সংযুক্ত হয়েছে। যে সব লেখায় ঐ সময়ের আশা-প্রত্যাশা-হতাশার কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া যাবে। সংযােজনীর সর্বশেষ দলিলগুলাে প্রশাসনে মুক্তিযােদ্ধা ও মুজিব বাহিনী সদস্যদের নিয়ােগ সংক্রান্ত।

Page 33

সীমাবদ্ধতা

সচেতন পাঠক মাত্রই এই অনুসন্ধানের অনেক সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি লক্ষ্য করবেন । একটি সীমাবদ্ধতার কথা শুরুতেই উল্লেখ করা প্রয়ােজন তা হলাে, এখানে একাত্তর থেকে পঁচাত্তর পর্যন্ত কালপর্বের রাজনৈতিক ঘটনাবলির ওপর সাধারণ মনােযােগ নিবদ্ধ করা হলেও বিশেষভাবে নজর দেওয়া হয় মুজিব বাহিনী ও এর বিকাশধারার ওপর। ফলে একই কালপর্বের অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও তাদের বিকাশধারা অনেকক্ষেত্রে মনােযােগ পায়নি। একইভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনেক অভ্যন্তরীণ উপাদান এখানে অনুল্লেখ থেকেছে বা যথেষ্ট বিশ্লেষিত নয়।

 দ্বিতীয়ত ১৯৭৫-এর মাঝামাঝি গিয়ে ইতিহাসের এই ‘পুনর্পাঠ’ থেমে গেছে- যদিও মুজিব বাহিনী, জাসদ ও গণবাহিনীর সক্রিয়তা তখনও চলমান ছিল এবং সে পর্যায়ের ওপর অনুসন্ধানী মনােযােগের প্রয়ােজনীয়তাও অস্বীকার করা যায় তৃতীয়ত, উল্লিখিত সময়ের ঘটনাবলির সঙ্গে যুক্ত বহু ব্যক্তির সাক্ষাৎকার এবং বহু দলিলপত্রের পর্যালােচনা এই গ্রন্থের অন্যতম উপাদান হলেও এমন অনেক অপরিহার্য ব্যক্তির মতামত ও দলিলপত্রের পর্যালােচনা এখানে নেই- যা থাকলে ইতিহাসের এই পুনর্পাঠ বাড়তি গ্রহণযােগ্যতা পেত। একইভাবে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হলেও এই গ্রন্থে আলােচ্য বিষয়সমূহের কোনাে ছবি সংযুক্ত করা হয়নিযা গ্রন্থের অসম্পূর্ণতা হিসেবেই চিহ্নিত হবে।

Source: মুজিব বাহিনী থেকে গন বাহিনী ইতিহাসের পুনর্পাঠ – আলতাফ পারভেজ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!