You dont have javascript enabled! Please enable it! রতনপুর অ্যামবুশ - উড়িয়া অপারেশন - ফুলছড়ি স্টিমার অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
রতনপুর অ্যামবুশ
গাইবান্ধা থেকে দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে ফুলছড়ি থানার একটি ছােট গ্রামের নাম রতনপুর। গ্রামটির অবস্থান বাঁধ ও নদের মধ্যবর্তী এলাকায়। ব্রহ্মপুত্রের একটি ধারার পূর্ব দিকের চরের নাম চর রতনপুর। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ছিল। এখানে আরও পূর্ব দিকে মােল্লার চরে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের মূল ক্যাম্প। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহ চর রতনপুরে তখন অধিনায়ক রঞ্জুর নেতৃত্বে ২০জন মুক্তিযােদ্ধা অবস্থান করছিলেন। তারা গাইবান্ধা সদর এলাকার কোনাে সুবিধাজনক কোনাে শত্রু অবস্থানের উপর রেইড পরিচালনা করার পরিকল্পনা করেন। একদিন সকাল ১০টার দিকে খবর আসে যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাকারদের সাথে নিয়ে রতনপুর গ্রামে লুটতরাজ করছে। মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে গিয়ে খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তারা শত্রুকে অ্যামবুশ করার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন।
তারা লক্ষ্য করেন যে, শত্রু সব একত্রে নেই, তারা বিক্ষিপ্তভাবে। গ্রামে ছড়িয়ে আছে। মুক্তিযােদ্ধারা গ্রাম অবরােধের মাধ্যমে শত্রুকে ঘায়েল করার পরিকল্পনা করেন। তারা ফায়ার করতে করতে শত্রুকে প্রায় ঘিরে ফেলেন। শত্রুর নিকটস্থ ক্যাম্প ছিল উত্তরে বাঁধের উপর রসুলপুরে। এ সময় ১জন মুক্তিযােদ্ধা অস্ত্রসহ ১জন রাজাকারকে জীবিত ধরে ফেলেন। এতে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল আরও বেড়ে যায়। পাকিস্তানিরা সংখ্যায় আনুমানিক ১০-১২জন কিছুক্ষণ পাল্টা গুলি চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয়ে উল্লসিত গ্রামবাসীও যােগ দেয় তাদের সাথে। এ অপারেশনে মােট ১৬জন রাজাকার অস্ত্রসহ ধরা পড়ে মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসীর হাতে। প্রতিশােধ স্পৃহায় এদের ২জনকে গ্রামবাসী হত্যা করে, ২জন পালিয়ে যায় ভিড়ের মধ্যে। ১২জন রাজাকার এবং ১৬টি রাইফেল হস্তগত হয় মুক্তিযােদ্ধাদের। এ এলাকায় সশস্ত্র রাজাকার বন্দি করার ঘটনা এটাই প্রথম। ক্ষুদ্র অপারেশন হলেও এ ফলাফলে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ধৃত রাজাকারদের মােল্লার চর হয়ে ভারতের মানকারচরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এ অভিযানে জুবের, ফজলু, ছানা, মেহেদী, কামু, ধীরু শাহজাদা প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধারা অংশ নেন।
উড়িয়া অপারেশন
গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানায় ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব পাড়ে চর এলাকায় উড়িয়া অবস্থিত। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিকে ফুলছড়ি থানাস্থ রতনপুর অপারেশনের পর মুক্তিযােদ্ধারা ধারণা করেন যে, পরের দিন হয়ত পাকিস্তানিরা। আবার একই স্থানে আসবে। মুক্তিযােদ্ধাদের ধারণাই সঠিক প্রমাণিত হয়। পরদিন তারা গ্রামে এসে ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, চাল-ডাল ও দামি মালপত্র লুণ্ঠন করে নৌকাযােগে নিয়ে যেতে থাকে। গ্রাম থেকে ৪জন যুবতীকেও জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। মাহবুব এলাহী রঞ্জুর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা নদীর অপর পাড় থেকে শত্রুর নির্যাতন প্রত্যক্ষ করে তারা নদীর সমান্তরালভাবে শত্রুকে অনুসরণ করে চলতে থাকেন। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখ পথে একটি খাল থাকায় প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। শক্র তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে বাধ্য। হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ করেন। শক্রও পাল্টা গুলি বর্ষণ আরম্ভ করে। উভয় পক্ষে তুমুল গুলিবিনিময় হয়। পাকিস্তানি সৈন্যদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। অতঃপর লুণ্ঠনকৃত মালামাল ও ৪জন যুবতীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় এবং গ্রামের লােকজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।  এ যুদ্ধে অন্তত ৮-১০জন শত্রু নিহত হয়। পরদিন লাশগুলাে ভেসে ওঠে। ১টি চাইনিজ এসএমজি এবং ৩টি চাইনিজ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের বিশেষ কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
ফুলছড়ি স্টিমার অপারেশন
ফুলছড়ি গাইবান্ধা জেলার একটি থানা। এ থানার পাশেই উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের রেলওয়ে ফেরিঘাট এ ফুলছড়ি। তা ছাড়া শত্রু নদীপথে এখান। থেকে বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করতাে। এ উদ্দেশ্যে প্রায়ই ফুলছড়ি ঘাটে কয়েকটি নৌযান নােঙর করা থাকতাে। আগস্ট মাসের শেষের দিকের ঘটনা। নােঙর করা স্টিমারগুলাে ধ্বংস করার জন্য বিশেষ নৌ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা আলমগীর, সামছু, ও জিলু এবং অপর ১জন, মােট ৪জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্টিমার ধ্বংস করার জন্য মূল পরিকল্পনা তৈরি করেন মাহবুব এলাহী রঞ্জু ও রুস্তম আলী। মুক্তিযােদ্ধারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে স্টিমারের গায়ে মাইন। স্থাপন করতে যান কিন্তু তারা শত্রুকে ফাকি দিতে পারেন নি। শত্রু তাঁদের দেখে তৎক্ষণাৎ ফায়ার করে। ফলে ২জন মুক্তিযােদ্ধা ঘটনাস্থলে শহিদ হন। পরদিন এ লাশগুলাে নদীর ভাটিতে পাওয়া যায়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড