You dont have javascript enabled! Please enable it! কুড়িগ্রাম আক্রমণ - মাদারগঞ্জে অ্যামবুশ - সংগ্রামের নোটবুক
কুড়িগ্রাম আক্রমণ
রংপুর ও লালমনিরহাট জেলার পূর্বে এবং গাইবান্ধা জেলার উত্তর দিকে উত্তরপূর্ব কোণে সীমান্তবর্তী জেলা শহর কুড়িগ্রাম।  ১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার যােশীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী যৌথভাবে কুড়িগ্রাম শহরে বর্বর পাকিস্তানি অবস্থানে ভারী ও দূরপাল্লার কামান দিয়ে আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তেমন মােকাবিলা না করেই কুড়িগ্রাম থেকে সরে পড়ে। মিত্র ও মুক্তিবাহিনী ১০ ডিসেম্বর কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করে। মুক্তিযােদ্ধারা কুড়িগ্রাম নতুন শহরে উঁচু পানির ট্যাংকে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। শত্রুর ঘাটিগুলাে ছিল:
১. রিভারভিউ হাই স্কুল (ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং গােলন্দাজ গ্রুপ)
২. কুড়িগ্রাম ধরলা নদীর ঘাট
৩. কুড়িগ্রাম সিঅ্যান্ডবি অফিস গােডাউন।
৪. নতুন টাউন কোর্ট বিল্ডিং
৫. শান্তি কমিটি ও রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (সঞ্জীবের গােডাউন ও কুড়িগ্রাম কলেজ)।
মাদারগঞ্জে অ্যামবুশ
গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ি থানার উত্তরে ঢাকা-রংপুর সড়কের পূর্ব পার্শ্বে সাদুল্লাপুর থানায় মাদারগঞ্জ এলাকা অবস্থিত। ১ এপ্রিল থেকেই ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে বিদ্রোহ করে নিজেদের পুনর্গঠন করার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সর্বশক্তি দিয়ে এ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে চেষ্টা চালায়। ফলে বিভিন্ন স্থানে ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় ৩ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্ল্যাটুন আকারের ১টি দল সুবেদার আফতাবের (সে সময় এ আফতাব, আলতাফ নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন) নেতৃত্বে পলাশবাড়ির উত্তরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের পরিদর্শন বাংলাের পূর্ব পার্শ্বের গ্রামে ঢাকা-রংপুর সড়কের উপর রংপুরের দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। আগে থেকেই গাইবান্ধায় প্রায় শতাধিক ছাত্র-জনতা আনসারদের জন্য সংরক্ষিত অস্ত্র ট্রেজারি থেকে কর্তৃপক্ষের সহায়তায় প্রশিক্ষণরত ছিলেন। তারাও সুবেদার আলতাফের দলে যােগ দিয়ে যুদ্ধে সম্পৃক্ত হন। এ ব্যাপারে স্থানীয় ব্যক্তিত্ব অ্যাডভােকেট হাসান ইমাম (টুলু) বিশেষ ভূমিকা রাখেন। রংপুর সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বড়ােদরগাসাদুল্লাপুর-গাইবান্ধা সড়ক দিয়ে অগ্রসর হয়ে গাইবান্ধা শহরের দিকে আসছিল।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় এ পরিস্থিতিতে সুবেদার আফতাবের দল বড়দরগা-সাদুল্লাপুর-গাইবান্ধা সড়কের মাদারগঞ্জ এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। তাদের সঙ্গে ছিল ১টি ৩.৫ ইঞ্চি ব্লেন্ডিসাইড। এটি মূলত ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র। ল্যান্স নায়েক মজিদ এটি চালাতেন এবং চাইনিজ এলএমজি ছিল সিপাহি তাহেরের কাছে। শত্ৰু ঐ সময় ট্যাংক নিয়ে এ রাস্তা ধরে গাইবান্ধা শহরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মাদারগঞ্জ এলাকায় পৌছালে সুবেদার আফতাবের দল আচমকা পাকিস্তানি সৈদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে এবং ল্যান্স নায়েক মজিদ তার ব্লেন্ডিসাইড থেকে পর পর ৩টি গােলা বর্ষণ করেন। শত্রু এ পরিস্থিতির জন্য মােটেও তৈরি ছিল না। গ্রাম এলাকায় ঘন গাছপালার কারণে দৃষ্টি সীমিত। ব্লেন্ডিসাইডের ফায়ার ট্যাংক ধ্বংস করার জন্য যথেষ্ট। ট্যাংক হারানাের ভয়ে শত্রু অগ্রাভিযান থামিয়ে দেয়। মুক্তিবাহিনীও কল্পনা করে নি যে, শত্ৰু ট্যাংকসহ এত বিপুল শক্তি নিয়ে এ পথে আসবে। বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলি চলার পর শত্রু পিছু হটে এবং রংপুর-ঢাকা সড়ক ধরে পুনরায় গাইবান্ধার দিকে অগ্রসর হয়। অল্পসংখ্যক সৈন্য দ্বারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে যুদ্ধে টিকে থাকা সম্ভব হবে না, এ চিন্তা করে সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকেরা গাইবান্ধা হয়ে পূর্ব দিকে চর এলাকায় পশ্চাদপসরণ করে। ১৭ এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধাদের গাইবান্ধা শহর ত্যাগের ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে শত্রু শহরে প্রবেশ করে। মাদারগঞ্জ যুদ্ধে নুরুল আমিন নামে ১জন সৈনিক গুরুতর আহত হন। তাকে গাইবান্ধা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত তাঁকে হাসপাতাল থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে হত্যা করে। শত্রুর নিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতি হয়, তবে সংখ্যা নিরূপণ করা যায় নি।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড