You dont have javascript enabled! Please enable it!
নাগেশ্বরী রেইড
কুড়িগ্রাম জেলার উত্তরে সীমান্তবর্তী থানা ভুরুঙ্গামারী। নাগেশ্বরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল কুড়িগ্রাম জেলার উত্তরে দুধকুমার নদ থেকে বেশ কিছুদুর পশ্চিমে। নাগেশ্বরী থানার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে ভুরুঙ্গামারী ক্যাম্পে সড়কপথে তাদের সৈন্য, রসদ, অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ইত্যাদি বহন করে ভুরুঙ্গামারী ক্যাম্পের শক্তি অটুট রাখত। তাই নাগেশ্বরী শত্রু ক্যাম্পে আঘাত করে তাদের মনােবল হ্রাস করা এবং ভুরুঙ্গামারী ক্যাম্পের সহায়তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মেজর নওয়াজেশ উদ্দিনের নির্দেশে সুবেদার মেজর আরব আলীর নেতৃত্বে নাগেশ্বরী পাকিস্তানি ক্যাম্প রেইড করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা অনুসারে পাকিস্তানিদের নাগেশ্বরী ক্যাম্পে রেইড করা হয়। উভয়পক্ষে ১ ঘণ্টার মতাে গুলিবিনিময়ের পর মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদ স্থানে ফিরে আসেন। এ রেইডে ৫জন শত্রু সৈন্য নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
এফাজ হাজির বাড়িতে হামলা
কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী থানার পশ্চিমে সােনাতলী বাজার। এরই পাশে দেওয়ানের খামার এলাকায় এফাজ হাজির বাড়ি। এফাজ হাজি মুসলিম লীগের নেতা এবং যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সৈন্যদের দালালের ভূমিকা নিয়ে সব ধরনের সাহায্য-সহযােগিতা করতাে। শত্রু নিয়মিত এফাজ হাজির বাড়িতে এসে বিশ্রাম নেয়া, খাওয়া-দাওয়া করা এবং খবরদারি করতাে। মুক্তিযােদ্ধারা। এমন একটি সুযােগের অপেক্ষা করতে থাকেন। তারা পরিকল্পনা করেন, এফাজ হাজির বাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা উপস্থিত হলে আক্রমণ চালাবেন। সেপটেম্বর মাসের প্রথম দিকে এমন একটি সুযােগ পেয়ে যান মুক্তিযােদ্ধারা। তারা জানতে পারেন যে, শত্রু এফাজ হাজির বাড়িতে এসে মধ্যাহ্নভােজন করবে। মুক্তিযােদ্ধার দল এফাজ হাজির বাড়ির অনতিদূরে ঝােপঝাড়ে অপেক্ষা করে এবং শক্রর গতিবিধি লক্ষ্য করতে থাকে দুপুরের খাবার নিয়ে এফাজ হাজির বাড়ির বাইরের উঠানে শক্ররা খেতে বসে, এ দুর্বল সময়টাকে কাজে লাগান মুক্তিযােদ্ধারা। তারা অতর্কিতে আক্রমণ করেন। অপ্রস্তুত শক্র হতভম্ব হয়ে পড়ে। খাবার ফেলে আত্মরক্ষা করার আগেই মৃত্যুমুখে পতিত হয় কয়েকজন শত্রু সৈন্য। পরে জানা যায় যে, প্রায় ৬-৭জন। শত্রু মারা যায় ঐ আক্রমণে।
চিলমারী যুদ্ধ
চিলমারীর অবস্থান চিলমারী ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে অবস্থিত একটি বন্দর। ময়মনসিংহের উত্তরাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদের পূর্ব ও পশ্চিম দুই দিকের দুই পাড়ে কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমান জেলা) অন্তর্গত ২টি থানা – চিলমারী ও রেীমারী। রেীমারী থানার বিপরীতে ভারতের মেঘালয় রাজ্য অবস্থিত। চিলমারীর কয়েক মাইল দক্ষিণে তিস্তা নদী ব্রহ্মপুত্রের সাথে মিলিত হয়েছে। নৌপথে সারা দেশের সাথে এবং রেল ও সড়কপথে উত্তরবঙ্গের সাথে এ নদী বন্দরের যােগাযােগ। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে চিলমারীর গুরুত্ব বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের একমাত্র নিরাপদ এলাকা ছিল মেঘালয় সীমান্তবর্তী রৌমারী থানা। ফলে মুক্তিবাহিনীর জন্য রৌমারীকে নিরাপদ ও মুক্ত রাখার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। রৌমারী ছিল ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন। ভারতের মেঘালয় সীমান্ত বর্তী হওয়ার ফলে রৌমারী মুক্তিযােদ্ধাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত হয়। রৌমারীর অবস্থানগত কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যতম দায়িত্ব ছিল এ অঞ্চলকে সার্বক্ষণিক নজরে রাখা। রৌমারীর বিপরীতে চিলমারীকে ঘিরে পাকিস্তানি বাহিনী গড়ে তুলেছিল শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর জন্য চিলমারী দখল করা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রৌমারী এলাকা প্রথমে ছিল ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন, পরবর্তী সময় ‘জেড’ ফোর্সের এবং সর্বশেষ সেক্টর এলাকা বণ্টনে এলাকাটি ১১ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান চিলমারীতে এ সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি, ইপিসিএএফ-এর ১টি কোম্পানি, ই কোম্পানি রাজাকার এবং ২ প্ল্যাটুন পুলিশ মােতায়েন ছিল। ওয়াপদা ভবন ও চিলমারী রেলস্টেশন এলাকায় নিয়মিত সেনার ২টি প্লাটুন, ইপিসিএসএফ-এর ১টি কোম্পানি সুদৃঢ় ঘাঁটি স্থাপন করে।
তাদের মূল অবস্থানগুলাে ছিল চিলমারী হাই স্কুল, রেলস্টেশন এলাকা এবং হাই স্কুলের একটি অংশে স্থাপিত ওয়াপদা অফিস। এটি ছিল এ এলাকায়। পাকিস্তানি বাহিনীর মূল অবস্থান (এ এলাকা বর্তমানে নদীগর্ভে নিমজ্জিত)। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রধান অবস্থানের উত্তরে রাজভিটা মাদ্রাসা এলাকায় ছিল একটি রাজাকার ক্যাম্প। একই উদ্দেশ্যে প্রধান ক্যাম্পের দক্ষিণে জোড়গাছ জুনিয়র স্কুল এলাকায় স্থাপন করা হয় আরেকটি রাজাকার ক্যাম্প। চিলমারী-কুড়িগ্রাম রেলপথ এবং এর সমান্তরাল সড়ক পথ রক্ষার জন্য নিয়মিত বাহিনীর ১টি প্লাটুন বালাবাড়ি রেল স্টেশনে সুদৃঢ় বাংকার তৈরি করে অবস্থান নেয়। এ অবস্থানে ১টি এইচএমজি ছিল। প্রয়োজনে। ব্যবহারের জন্য কয়েকটি আর্টিলারি পজিশনও তৈরি করা হয়। ২০জন পুলিশের সাথে আরও ৪০-৪৫জন রাজাকার সমন্বয়ে গঠিত ১টি বাহিনী দিয়ে চিলমারী থানা অবস্থানকে সুদৃঢ় করা হয়। এ ছাড়া মূল অবস্থানের পিছন দিকে উলিপুর পর্যন্ত রেলপথ, রাস্তায় বিভিন্ন সেতু ও কালভাটে নিরাপত্তা চৌকি স্থাপন করে রাজাকার নিয়ােগ দেওয়া হয়।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান
১১ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন এ অঞ্চলে বিভিন্ন সাব-সেক্টরে প্রায় ১৪৫টি এফএফ ও এমএফ কোম্পানি গড়ে ওঠে। এ সেক্টরের অধীন দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা সুবেদার মেজর আফসার ও কাদের সিদ্দিকীর কোম্পানিগুলােও এর অন্তর্ভুক্ত। সমগ্র সেক্টরকে মােট ৭টি সাব-সেক্টরে ভাগ করে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ােজিত করা হয়। চিলমারী যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল মুক্ত এলাকা রৌমারী থেকে। রৌমারী এমনই একটি এলাকা, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে কখনাে পাকিস্তানি বাহিনী দখল করতে পারেনি। রৌমারীকে ঘিরে, রৌমারী ছাড়াও ভুরুঙ্গামারী থানার অংশবিশেষ নিয়ে প্রায় ৬০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্তাঞ্চল হিসেবে পরিগণিত ছিল। এ রৌমারী ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের অবাধ বিচরণভূমি। বাংলাদেশের প্রথম সামরিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রৌমারীতে। এখানে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় ১৮ হাজার মুক্তিযােদ্ধা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের অধিকাংশই ছিল রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের পােড় খাওয়া মানুষ। চিলমারী যুদ্ধের সময় রৌমারী ছিল ১১ নম্বর সেক্টরের মানকারচর সাব-সেক্টরের অধীনে। এর অধিনায়ক ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খান। এ রৌমারীতে অবস্থান করেছেন ‘জেড’ ফোর্স অধিনায়ক কর্নেল জিয়াউর রহমান, মেজর আমিন আহমেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট এসআইএম নূরুন্নবী খান ও লেফটেন্যান্ট মােদাচ্ছের প্রমুখ। বিশেষত লেফটেন্যান্ট নূরুন্নবী খান ও লেফটেন্যান্ট মােদাচ্ছেরের প্রচেষ্টায় এ রৌমারী অঞ্চল মুক্ত থাকে।
যুদ্ধ পরিকল্পনা
মুক্তাঞ্চল রৌমারীকে নিরাপদ রাখা, মেঘালয় থেকে দেশের উত্তরাঞ্চল তথা গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, রংপুরের পথে মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচল পথকে মুক্ত রাখা, শক্রর শক্তি খর্ব ও মনােবল নষ্ট করা এবং অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখলের উদ্দেশ্যে চিলমারীতে শক্র অবস্থানের উপর অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা করা হয়।
তথ্যসংগ্রহ
লক্ষ্যবস্তুর বিস্তারিত তথ্যসংগ্রহের উদ্দেশ্যে ১১ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর অধিনায়ক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খানের নির্দেশে ঐ এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে চিলমারী ও উলিপুর এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য অনুসন্ধান চালানাে হয়। প্রায় ১ মাস ধরে মুক্তিযােদ্ধার দেওয়া তথ্য, গােপন তথ্যসংগ্রহ, শত্রুর প্রাত্যহিক গতিবিধি অনুসরণ, ভারী। অস্ত্রের অবস্থান এবং অন্যান্য অভ্যাস পর্যবেক্ষণ করে বিস্তারিত রেকি রিপাের্ট তৈরি করা হয়। চিলমারীতে পাকিস্তানি সৈনিকদের অবস্থানের উপর সার্বিক তথ্যসগ্রহের কার্যক্রম পরিচলনা করেন বিমানবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার শফিক উল্লাহ। তিনি ছিলেন ১১ নম্বর সেক্টরের গােয়েন্দা অফিসার। ওয়ারেন্ট অফিসার শফিক উল্লাহ সব তথ্যসংগ্রহ শেষে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে চিলমারী। শত্রু অবস্থানের বিস্তারিত বিবরণ এবং হুবহু চিত্র মাটির নকশা তৈরি করে। বুঝিয়ে দেন। চিলমারী এলাকার মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আবুল কাশেম চাদও বিভিন্ন মাধ্যমে অনেক তথ্য সংগ্রহ করে শফিক উল্লাহর সাথে বিনিময় করেন।
আক্রমণের প্রস্তুতি
সামগ্রিকভাবে তথ্যসংগ্রহ সম্পন্ন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামগ্রিক অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর ১১ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর থেকে চিলমারী আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। চিলমারী আক্রমণের দিন ধার্য করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর। এইচ আওয়ার নির্ধারিত হয় ভাের ৪টা।
দায়িত্ব বণ্টন
এ অভিযানে প্রধানত মুক্তাঞ্চলে প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধাদের কাজে লাগানাের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আক্রমণকারী দলকে ২টি প্রধান দলে বিভক্ত করা হয়। ইপিআর-এর নায়েব সুবেদার আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে পরিচালিত দলে ৩০৩৫জন ইপিআর এবং ২০জন মুক্তিযােদ্ধা (এফএফ) ছিলেন। এ দলের উপঅধিনায়ক ছিলেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ টি এম খালেক দুলু। এ দলের দায়িত্ব ছিল চিলমারী রেল স্টেশন, ওয়াপদা ভবন এলাকা ও জোড়গাছ এলাকায় রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও দখল করা। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অধিনায়ক আবুল কাশেম চাদের নেতৃত্বে পরিচালিত দলে ছিল ৩ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা। এ দলের দায়িত্ব ছিল থানাহাট পুলিশ স্টেশন, বালাবাড়ি রেল স্টেশন ও রাজারভিটা মাদ্রাসায় রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ ও দখল করা। অধিনায়ক খায়রুল আলমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর উলিপুর কোম্পানির ১টি দলের উপর কাট অফ পার্টির দায়িত্ব অর্পিত হয়। আক্রমণের সময় কাট অফ পার্টির অধিনায়ক নিযুক্ত হন বিমানবাহিনীর ওয়াবেন্ট অফিসার শফিক উল্লাহ। তার অধীনস্ত দলে ছিলেন ১৪০জন মুক্তিযােদ্ধা। কাট অফ পার্টির দায়িত্ব ছিল চিলমারী ও উলিপুরের মাঝামাঝি ঘাটি স্থাপন করে গােপনে অবস্থান নেয়া এবং পাকিস্তানি বাহিনী যাতে চিলমারী ও উলিপুরের মাঝে কোনােপ্রকার যােগাযােগ করতে না পারে, তার জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। চিলমারীর ২ মাইল দক্ষিণে গাজীরপাড়া চরে আরভি বা চূড়ান্ত মিলনস্থল নির্ধারিত হয়।
যুদ্ধ পরিকল্পনায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, নদীপথে আক্রমণকারী ২টি মূল দল এখানে এসে মিলিত হবে। এ জন্য স্থানীয় জনগণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তায় দেশীয় নৌকা সংগ্রহ করে যাত্ৰাস্থানে পৌছার পদক্ষেপ নেওয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর এ সেক্টরের কাছে যে ৪টি আর্টিলারি গান ছিল, সেগুলাে আক্রমণকে ফায়ার সাপাের্ট দেওয়ার জন্য চালিয়াপাড়া চরে। স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যুদ্ধের বিবরণ ১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর রৌমারীতে সেক্টর অধিনায়ক মেজর আবু তাহের মূল আক্রমণের জন্য নির্বাচিত প্রতিটি দলকে বিস্তারিত ব্রিফ করেন। এর পর পরই বিভিন্ন দল তাদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় যাত্রা করে। ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর মূল অভিযানের পূর্বেই বিভিন্ন দল অবস্থান নেয় পূর্বনির্ধারিত জায়গায়। কাট অফ পাটি ১৫ অক্টোবর নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। অধিনায়ক আবুল কাশেম চাদের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধা দল থানাহাট পুলিশ স্টেশন, বালাবাড়ি রেল স্টেশন ও রাজারভিটা আক্রমণের জন্য ৩টি মুক্তিযােদ্ধা প্লাটুন নিয়ে (প্রতি প্লাটুনে ৩০-৩৫জন) রৌমারী ত্যাগ করে ১৬ অক্টোবর দুপুর ২টায়। ৩-৪টি বড়াে দেশি নৌকায় করে নদীপথে এ দল সন্ধ্যা ৭টায় ঘুঘুমারী পেীছে। রাত ২টার সময় দলটি বনগ্রামের হাইড আউটে অবস্থান গ্রহণ করে। ইপিআর সুবেদার আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে পরিচালিত দল চিলমারী রেল স্টেশন, ওয়াপদা ভবন ও জোড়গাছা এলাকা আক্রমণের উদ্দেশ্যে ১৬ অক্টোবর দুপুর ২টায় রেীমারী ত্যাগ করে রাতেই তারা গাজীরপাড়া পৌছে।
এ অবস্থান থেকে সুবেদার আবদুল মান্নান তাঁর দলকে ২ ভাগে বিভক্ত করে আক্রমণ স্থলের দিকে প্রেরণ করেন। | সাব-সেক্টর অধিনায়ক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহর নেতৃত্বে আরভি। স্থাপনকারী দলটিও ১৬ অক্টোবর দুপুর ২টায় রৌমারী ত্যাগ করে রাতে এসে গাজীরপাড়া চরে পৌছে নিজ অবস্থান শক্তিশালী করে। সেক্টর অধিনায়ক মেজর আবু তাহের ১৬ অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১টায় আক্রমণ পরিচালনার জন্য চালিয়াপাড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে রাত ১টায় গাজীপাড়া চরে পৌছে সদর দপ্তর স্থাপন করেন। মূল আরভি স্থাপনকারী দলটির সাথে ১টি ক্ষুদ্র মেডিক্যাল টিম গাজীরপাড়া চরে অবস্থান নেয়। ওষুধপত্রসহ এ দলের দায়িত্বে ছিলেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সাজেদুল ইসলাম। ৪টি ফিল্ড গানসহ আর্টিলারি দলটি আক্রমণকারী মুক্তিযােদ্ধা দলকে ফায়ার সাপাের্ট দেওয়ার জন্য রৌমারী থেকে ১৬ অক্টোবর সকাল ১০টায় রওনা হয়েছিল। তারাও রাতের বেলা চালিয়াপাড়া পৌছে আর্টিলারি কামানগুলাে স্থাপন করে। ভারী কামানগুলােকে নৌকাযােগে অত্যন্ত গােপনে টেনে নিয়ে মূল জায়গায় স্থাপন করতে হয়। আর্টিলারি কামান নিয়ে প্রায় ৩ মাইল প্রশস্ত ব্রহ্মপুত্র নদ নৌকাযােগে পার হওয়া এবং লক্ষ্যস্থলে পৌছানাে ছিল একটি দুঃসাহসী ও । কষ্টসাধ্য কাজ। ১৬ অক্টোবর মধ্যরাতের আগেই চালিয়াপাড়ায় বেতার যােগাযােগ সুবিধাসহ কমান্ড পােস্ট স্থাপন করা হয়। রাত সাড়ে ৩টার মধ্যে আক্রমণের। পুরাে প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে যায়। আক্রমণকারী সমস্ত দল সময়মতাে তাদের। অবস্থান গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১৭ অক্টোবর ৪টায় গাজীরপাড়া চর থেকে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খানের উপস্থিতিতে ভেরি লাইট পিস্তল ফায়ারের সাহায্যে অভিযান শুরু করার সংকেত দেওয়া হয়। সাথে সাথে চালিয়াপাড়া হতে আর্টিলারি কামানগুলাে শক্ত অবস্থান ও চিলমারী ঘাটে শত্রুর গানবােটের উদ্দেশ্যে গােলা বর্ষণ শুরু করে।
রাজার ভিটা আক্রমণকারী দলটি ভাের ৪টার কিছু পূর্বে লক্ষ্যবস্তুর ১০০ গজ উত্তরে একটি নালার পাশে অবস্থান নেয়। এর পর দলটি ৩ ভাগ হয়ে ১টি দল মাদ্রাসার দক্ষিণ-পূর্বে রাস্তার পাশে অবস্থান নেয়, ১টি দল উত্তর-পূর্বে রাস্তার পাশে এবং অন্য দলটি মাদ্রাসার উত্তর-পশ্চিমে বাঁশঝাড়ের কাছে অবস্থান গ্রহণ করে। মাদ্রাসার পশ্চিম পাশে ছিল বিল। আক্রমণ শুরুর সংকেত পেয়ে ৩টি দলই একযােগে শত্রুর উপর ফায়ারিং শুরু করে। মাদ্রাসা ভবন থেকে রাজাকাররাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। ১ ঘণ্টার মতাে এ গুলিবিনিময়ের পর রাজাকাররা পশ্চিমের বিল দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনীর। সদস্যরা তাদের পিছু ধাওয়া করে। কিছুসংখ্যক রাজাকার এখানে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং কিছু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। সকাল ৬ টায় এ অভিযান সমাপ্ত হয়। এ অভিযানে প্রায় ৪৫টি .৩০৩ রাইফেল দখলে আসে। গ্রেপ্তার হয় শান্তি কমিটির সভাপতি কুখ্যাত পঞ্চু মিয়া। শত্রুপক্ষের ১২জন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হয়। মুক্তিবাহিনীর এ দলটি ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় বনগ্রাম হয়ে। সব বন্দি ও দখলকৃত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সরাসরি রেীমারীতে ফেরত আসে। জোড়গাছ প্রাইমারি স্কুলটি তৎকালীন চিলমারী রেল স্টেশন থেকে ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত ছিল। (বর্তমানে স্কুলসহ এলাকাটি নদীগর্ভে)। এখানে ছিল একটি রাজাকার ক্যাম্প। প্রায় ৫০জন রাজাকার ছিল এ ক্যাম্পে। পাশেই ছিল কুখ্যাত রাজাকার অধিনায়ক ওয়ালি মােহাম্মদের বাড়ি। মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি ৪টার কিছু আগে এসে উত্তর, পশ্চিম ও দক্ষিণ- তিন। দিকে অবস্থান নেয়। অভিযান শুরুর সংকেত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৩টি দল একই সাথে শত্রুর উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে।
রাজাকাররাও পাল্টা গুলিবর্ষণ করে। প্রায় ৪৫ মিনিট গােলাগুলির পর কিছুসংখ্যক রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। রাজাকার ওয়ালি মােহাম্মদ পালিয়ে গেলেও আহত অবস্থায় ধরা পড়ে এ অভিযান সমাপ্ত হয় ৬টায়। মুক্তিবাহিনী এখানে ৩২টি .৩০৩ রাইফেল দখল। করে। শত্রুপক্ষের ২-৩জন আহত হয়। অভিযান শেষে বন্দি রাজাকারদের গাজীরপাড়া চরে আরভিতে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের প্লাটুনের একটা উল্লেখযােগ্য অংশ এ যুদ্ধ শেষে ওয়াপদা ভবন এলাকায় গিয়ে আক্রমণরত অন্য মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে মিলিত হয়।  চিলমারী পুলিশ স্টেশনটির অবস্থান চিলমারী স্টেশন থেকে ৩ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে। পুলিশ স্টেশন থেকে থানাহাট ৫০০ গজ দক্ষিণে অবস্থিত পুলিশ স্টেশন ও থানাহাট আক্রমণকারী প্লাটুনটি ভাের ৪টায় নির্ধারিত স্থানে পৌছাতে পারেনি। শুধু কোম্পানি অধিনায়ক চাদ ২জন মুক্তিযােদ্ধাসহ থানার ঠিক পূর্বে অবস্থান গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে আক্রমণ শুরুর সংকেত পাওয়ায় অন্য অবস্থানগুলােয় গােলাগুলি শুরু হয়ে যায়। গুলির শব্দে থানার দারােগা। বারান্দায় বের হলে অধিনায়ক চাদ চিৎকার করে তাঁকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “মুক্তিবাহিনী থানা ঘিরে ফেলেছে। দারােগা, আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন।” এ ঘটনার মধ্যে প্লাটুনের অধিনায়ক নূর মােহাম্মদ আলাে ও সহকারী অধিনায়ক সােলায়মান অন্য মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে থানা এলাকায় পৌঁছে। অবস্থান গ্রহণ করেন। ভাের সাড়ে ৪টার মধ্যেই থানায় উপস্থিত ২০জন পুলিশ ও ৪০-৫০জন রাজাকার কোনােরকম গুলিবিনিময় ছাড়াই মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে। আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা তখন থানাহাট পর্যন্ত এলাকা দখল করে নেন। এ অভিযানে ৬৭টি ৩০৩ রাইফেল ও প্রচুর গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।
এ অভিযান শেষে অধিনায়ক চাদ ৪-৫জন সহযােদ্ধাসহ বালাবাড়ি আক্রমণকারী প্লাটুনের খোঁজে রেললাইন ধরে এগিয়ে যান। ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় দখলকৃত অস্ত্র ও বিপুল গােলাবারুদসহ আত্মসমর্পণকারী পুলিশ ও রাজাকারসহ প্লাটুনটি গাজীপাড়া হয়ে রৌমারী ফেরত আসে। বালাবাড়ি রেল স্টেশন চিলমারী থেকে ১২০০ গজ উত্তর-পশ্চিমে কিছুটা উঁচু ভূমিতে অবস্থিত। স্টেশন ভবনের উত্তরে ৩টি স্টাফ কোয়ার্টার রয়েছে। স্টেশন থেকে ৬০০ গজ দক্ষিণে রয়েছে একটি কালভার্ট। স্টেশনে প্রায় ১ কোম্পানি নিয়মিত পাকিস্তানি সেনা ডিউটিরত ছিল। মেশিনগান, লাইট মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত ছিল বাহিনীটি। রেকিতে জানা গিয়েছিল। যে, রাতে স্টেশনে শত্রু সৈন্য অবস্থান করে না। শুধু ৮-৯জন রাজাকার। কালভার্টটি পাহারা দেয়। এ তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ অবস্থানের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় নি। আক্রমণকারী মুক্তিযােদ্ধা প্লাটুনটি রাত ২টায় ঘুঘুমারী হতে বনগ্রাম হয়ে বালাবাড়ি বাজারের পূর্ব দিকে এসে পৌছে রাতের অন্ধকারে প্লটুনটি বিভিন্ন দলে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আক্রমণের সংকেত প্রদানের কিছু পর মাত্র ৮জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল থানারােড ও রেলপথের কাছে পৌছাতে সক্ষম হয়। প্লাটুন অধিনায়ক জব্বারের নেতৃত্বে দলটি রেলপথ বরাবর দ্রুত কালভার্টের দিকে এগিয়ে যায়। এদিকে থানা পতনের পর কোম্পানি অধিনায়ক চাদ ৪-৫জন সহযােদ্ধা নিয়ে রেলপথ ধরে কালভার্টের দিকে অগ্রসর হয়ে অধিনায়ক জব্বারের দলটির সাথে মিলিত হন।
এ সম্মিলিত দলটি কালভার্টের কাছে এসে কোনাে গােলাগুলি ছাড়াই রাজাকারদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করিয়ে তাদের সদ্যমুক্ত পুলিশ স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি কালভার্টের উভয় পাশের ২টি বাংকারে অবস্থান গ্রহণ করে। এদিকে রেল স্টেশন থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল রাজাকারদের গালি দিতে দিতে কালভার্টের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানা ছিল না। শত্রু সৈন্য কালভার্টের নিকটবর্তী হতেই অধিনায়ক আলাে ফায়ার শুরু করেন। এ আক্রমণে ২জন পাকিস্তানি সেন্য নিহত হয়। অন্যান্যরা ক্রলিং করে স্টেশনে ফিরে যায় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে অধিনায়ক আলাে আহত হন। অধিনায়ক চাদ অধিনায়ক। জব্বারকে তার দলসহ কালভার্টের অবস্থানে রেখে আরও সৈন্যের জন্য পুলিশ। স্টেশনের দিকে রওনা হলে পথিমধ্যে সেক্টর অধিনায়ক মেজর তাহেরের সাথে দেখা হয়। মেজর আবু তাহের এ সময় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য। চালিয়াপাড়া থেকে গাজীরপাড়া চর হয়ে থানার দিকে যাচ্ছিলেন। আবুল কাশেম চাদের কাছে ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে তিনি চাদসহ সদলবলে দক্ষিণ দিক থেকে রেল স্টেশনের দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। এ মুহূর্তে তিনি। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে চালিয়াপাড়ায় আর্টিলারি অবস্থানকে রেল স্টেশনে গােলাবর্ষণের নির্দেশ দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কার্যকরী দূরত্বে না থাকায় রেল স্টেশনকে কামানের গােলার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। তিনি রেল স্টেশনের দক্ষিণে একটি বাড়ির বাঁশঝাড়ের আড়ালে অবস্থান নিয়ে শত্রুর উপর আক্রমণের বিষয়টি পর্যালােচনা করেন। আর্টিলারি ফায়ার ছাড়া এভাবে গুলি। করে শত্রুপক্ষের মূল অবস্থানের কোনাে ক্ষতি করা যাবে না বিধায় মেজর তাহের মুক্তিবাহিনীকে কালভাট ও বাঁশঝাড় থেকে প্রত্যাহার করে নেন।
এ অভিযানে শক্রর ঘাটির পতন না হলেও শক্তিশালী এ ঘাটিকে অকার্যকর। করে দেওয়া সম্ভব হয়। ফলে শত্ৰু নিজ অবস্থান থেকে নিজ পক্ষের অন্যান্য অবস্থানের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেনি। বালাবাড়ি রেল স্টেশনের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৫জন শত্রু সৈন্য নিহত হয় এবং ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। পরে এ প্লাটুনের মুক্তিযােদ্ধারা থানা এলাকায় একত্র হন এবং অস্ত্র, গােলাবারুদ ও আটজন বন্দি রাজাকার নিয়ে গাজীরপাড়া হয়ে ১৮ অক্টোবর রাতে রৌমারী ফেরত আসেন। অন্যদিকে, ওয়াপদা অফিস ও চিলমারী আক্রমণকারী দলটি নায়েব সুবেদার মান্নানের নেতৃত্বে ১টি রকেট লঞ্চার, ১টি ২ ইঞ্চি মর্টার, কয়েকটি এলএমজি ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ভােররাত ৪টার আগেই লক্ষ্যবস্তুর দক্ষিণে ও পশ্চিমে অবস্থান গ্রহণ করে। অভিযান শুরুর সংকেত দেওয়ার সাথে সাথে দলটি শত্রুর উপর গােলাবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনীর পাল্টা গােলাবর্ষণ করে এর জবাব দেয়। দীর্ঘক্ষণ গুলিবিনিময় চলে। মুক্তিবাহিনী ক্রল করে ক্রমে ক্রমে দুই পাশ থেকে এগিয়ে যেতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের চাপে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের আউটার ডিফেন্স পেরিমিটার ছেড়ে ইনার ডিফেন্স পেরিমিটারে। আশ্রয় নেয়। মুক্তিবাহিনী এ পর্যায়ে গুলি বর্ষণের মাধ্যমে শত্রুকে তার নিজস্ব অবস্থানে আটকে রাখলেও শত্রু অবস্থানের পতন ঘটাতে পারে নি। 
জোড়গাছ দখলের পর সেখানকার মুক্তিযােদ্ধা প্ল্যাটুনের কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা এখানকার যুদ্ধে যােগ দিলেও পাকিস্তানি বাহিনী তাদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। শত্রুবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান খুব কাছাকাছি হলেও কার্যকরী ওয়্যারলেস ব্যবস্থার অভাবে শত্রুপক্ষের উপর আর্টিলারির গােলাবর্ষণ।করা সম্ভব হয়নি। ১৭ অক্টোবর পুরাে দিন গােলাগুলি চলার পর মেজর তাহের সন্ধ্যার অন্ধকারে দলটিকে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এ দলটি গাজীরপাড়া চর হয়ে নদীপথে রৌমারী ফেরত আসে। শত্রুপক্ষের ঘাঁটির পতন না ঘটলেও সামগ্রিক বিবেচনায় অভিযানটি সফল হয়। বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং অবরুদ্ধ শত্ৰু অন্যান্য অবস্থানে কোনাে সাহায্য পাঠাতে ব্যর্থ হয়। শত্রুপক্ষে অনেক হতাহত হলেও প্রকৃত সংখ্যা জানা যায়নি। তবে মুক্তিবাহিনীর ৬জন শহিদ এবং ২জন আহত হন। এদিকে ওয়ারেন্ট অফিসার শফিক উল্লাহর নেতৃত্বে যােগাযােগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। তারা শুধু সড়ক ও রেলপথের সেতুগুলাে ভেঙে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, স্থানে স্থানে রেললাইন তুলে এবং রাস্তা কেটে চলাচল অযােগ্য করে তােলে। পরবর্তী সময় বেশ কিছুদিন পাকিস্তানিরা এ রাস্তা ব্যবহার করতে পারে নি।
১৭ অক্টোবর বিকালের মধ্যেই চিলমারী অভিযানের পর মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন গ্রুপ ভিন্ন ভিন্ন রুটে মুক্তাঞ্চল রৌমারী ফিরে আসতে শুরু করে। সব দলই দখল করা অস্ত্র, গােলাবারুদ ও বন্দি নিয়ে নিরাপদে রৌমারী পৌছে। এ আক্রমণে শত্রুর এতটাই শক্তি ক্ষয় হয় যে, মুক্তিবাহিনী প্রত্যাবর্তনে তারা কোনাে বাধা সৃষ্টি করতে পারে নি।
চিলমারী যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধাগণ হলেন:
১. সেক্টর অধিনায়ক মেজর আবু তাহের
২. সাব-সেক্টর অধিনায়ক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খান
৩. অধিনায়ক আবুল কাশেম চাদ।
৪. বিমানবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার শফিক উল্লাহ
ইপিআর-এর নায়েব সুবেদার আবদুল মান্নান
ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এ টি এম খালেক দুলু ৭. অধিনায়ক খায়রুল আলম। ৮, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সাজিদুল ইসলাম ৯. নূর মােহাম্মদ আলী ১০. মােহাম্মদ সােলায়মান। ১১. প্লাটুন অধিনায়ক আবদুল জব্বার। ১২. আবদুল বারী ১৩. এলাহী বক্স ১৪. আবদুল আজিজ
১৫. শামছুদ্দিন
১৬. আবদুল মান্নান।
১৭. আবদুল হান্নান
১৮, শাফায়েত আহাম্মদ
১৯. আবদুল হাই-১
২০. আবদুল হাই-২
২১. আনােয়ার হােসেন
২২. হেলাল।
যুদ্ধের ফলাফল বিশ্লেষণ
পরিকল্পিত যুদ্ধ চিলমারী যুদ্ধ ছিল একটি পরিকল্পিত যুদ্ধ। সময় নিয়ে, পর্যবেক্ষণ করে, প্রাপ্ত তথ্যের বিশ্লেষণ করে এবং মডেল তৈরি করে তারপরই আক্রমণ পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তা ছাড়া দলের মুক্তিযােদ্ধারা সবাই তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ ছিলেন। সঠিক রেকি পরিচালনা প্রয়ােজনীয় সময় নিয়ে অনেক তথ্যসংগ্রহ করা হয়। তথ্যসংগ্রহে স্থানীয়। মুক্তিযােদ্ধাদের দায়িত্ব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে চিলমারীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান, রাজাকারদের অবস্থান, তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রভৃতি সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধারা ভালােভাবে অবহিত ছিলেন। ফলে আক্রমণ পরিকল্পনা তৈরি করা সহজ হয়। গােপনীয়তা ও আকস্মিকতা রক্ষায় সমর্থ। দীর্ঘ পথ গােপনে পাড়ি দিয়ে লক্ষ্যবস্তুতে পেীছে আকস্মিক আক্রমণ করে। মুক্তিবাহিনী শত্রুদের হতভম্ব করে দেয়। ফলে মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরােধ করা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়ে। গােপনীয়তা ও আকস্মিক আক্রমণ ছিল এ যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। জনগণের সহায়তা যুদ্ধের প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণ মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছে। রেকি থেকে শুরু করে প্রতিকূল আবহাওয়ায় নৌকায় ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দেওয়া, নৌকা জোগাড় করা, পথ দেখানাে প্রভৃতি ক্ষেত্রে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন যুদ্ধের গতিতে নতুন মাত্রা যােগ করেছিল  এটা ছিল মুক্তিবাহিনীর সফলতার একটি বড়াে কারণ।
যুদ্ধের নতুন কৌশল
অনেক অপ্রচলিত পন্থা অনুসরণ করা হয় এ যুদ্ধে। যেমন: ডিঙি নৌকা পাশাপাশি জোড়া দিয়ে নদীপথে চর এলাকার মতাে দুর্গম স্থানে কামান নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রচলিত যুদ্ধের ক্ষেত্রে এটা ছিল একটি দুঃসাহসী ও অসাধ্য পদক্ষেপ।
অধিনায়কদের উপস্থিতি
সঠিক ও উজ্জীবিত নেতৃত্ব যুদ্ধে জয় এনে দিতে পারে। মেজর তাহের, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খান, অধিনায়ক চাদ, অধিনায়ক খায়রুল আলম, নায়েব সুবেদার মান্নানসহ সব স্তরের অধিনায়কদের যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিতি, সময়ােপযােগী নির্দেশনা ও অনুপ্রেরণাই মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধের প্রতিটি স্তরে অনুপ্রাণিত করেছিল।
পূর্ণ বিজয়ের প্রতিবন্ধকতা
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল ঘাঁটি দখলের মতাে প্রয়ােজনীয় অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল না। ফলে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুবাহিনীর মূল ঘাঁটির পতন ঘটাতে পারে নি। এ ছাড়া শক্র দখলকৃত এলাকায় প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ও ফায়ার সাপাের্ট সমন্বয় করা সম্ভব হয় নি। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান বিশ্লেষণ চিলমারী যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের মূল অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও তাদের সহযােগী রাজাকার ও পুলিশ বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এটা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য একটি চরম নৈতিক পরাজয়। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মােকাবিলায় অসহায় পুলিশ ও রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আস্থা হারিয়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ যুদ্ধে উভয় বাহিনীর উল্লেখযােগ্য দিক বিশ্লেষণ মুক্তিবাহিনী আক্রমণের পূর্বেই পরিকল্পনা তৈরি করে সে মােতাবেক আক্রমণ পরিচালনা করে। তথ্য সংগ্রহে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা বিশ্লেষণপূর্বক পন্থা অবলম্বন করেন। আকস্মিকতা বজায় রাখা, যেটা যুদ্ধের জন্য জরুরি মুক্তিবাহিনী সেটা বজায় রেখেছিল। তা ছাড়া জনসমর্থন মুক্তিবাহিনীর কার্যক্রম বাস্তবায়নে মূল সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে। সর্বোপরি সঠিক নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা ছিল চিলমারী যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সফলতার মূল কারণ। অন্যদিকে, আঞ্চলিকভাবে হলেও এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর নৈতিক পরাজয় ঘটে। অত্যাধুনিক অস্ত্রের মুখে তারা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও তাদের সহযােগীরা আত্মসমর্পণ করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্বল মানসিক অবস্থা যুদ্ধের এ পর্যায়ে এটা লক্ষণীয় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে রাজাকার ও পুলিশের আত্মসমর্পণ থেকে এটাই প্রমাণিত হয়। এ কথা বলা যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনী নৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এমনকি তাদের অধীন মিলিশিয়া বাহিনীও তাদের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। যুদ্ধের সামগ্রিক মূল্যায়ন চিলমারী যুদ্ধ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ। ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে অনেকটা দুর্গম পথে এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর মূল অবস্থান দখল। করতে না পারলেও রাজাকার ও পুলিশ বাহিনীর আত্মসমর্পণ এ যুদ্ধের উল্লেখযােগ্য দিক। অন্যদিকে, যুদ্ধের ময়দানে সফলতা মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবলকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। যে কারণে এ যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে এ অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি বহুলভাবে বৃদ্ধি পায়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!