সােনাহাট ব্রিজ এলাকায় যুদ্ধ
রংপুর থেকে তিস্তা রেলজংশনে এসে একটি রেললাইন কুড়িগ্রাম, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে শেষ হয়। অপর একটি রেললাইন লালমনিরহাট, মােগলহাট ও ভারতীয় ভূখণ্ড অতিক্রম করে ভুরুঙ্গামারী ও পাটেশ্বরী হয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর শুধু মােগলহাট পর্যন্ত রেল। যােগাযােগ চালু থাকে। লালমনিরহাটের ভিতর দিয়ে যাওয়া এ খণ্ডিত রেললাইনটি ১৯৭১ সালে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। ফলে ভুরুঙ্গামারী ও পাটেশ্বরী রেল স্টেশন ২টিও অব্যবহৃত অবস্থায় ছিল। দুধকুমার নদ ভুরুঙ্গামারী ও পাটেশ্বরীর মাঝখান দিয়ে উত্তর দিক থেকে দক্ষিণে আঁকাবাঁকাভাবে প্রবাহিত হয়ে নাগেশ্বরী থানা এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদে এসে পতিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী। দুধকুমার অতিক্রম করে সােনাহাটসহ পূর্ব পাড় দখল না করতে পেরে পাটেশ্বরী রেললাইনে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, দুধকুমার নদের পূর্ব পাড়ে ছিল। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান। শক্ররা পাটেশ্বরী এবং দুধকুমার নদের পশ্চিম পাড় থেকে প্রতিনিয়তই মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর কামান ও অন্যান্য ভারি অস্ত্র দিয়ে গুলি বর্ষণ করতাে। মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের সাধ্যমতাে পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলি বর্ষণের জবাব দিতেন। মাঝেমধ্যে নদী অতিক্রম করে পাকিস্তানি অবস্থানে হানা দেওয়া হতাে। মুক্তিযােদ্ধারা একসময় জানতে পারেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাটেশ্বরী থেকে স্থান ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাচ্ছে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের গমন পথে অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করেন।
৭ আগস্ট শেষ রাতে কোম্পানি অধিনায়ক আবদুল কুদুস নানুর নেতৃত্বে ১টি প্লাটুন দুধকুমার নদ অতিক্রম করে পাটেশ্বরী রেল স্টেশনের পূর্বে পাকা রাস্তার ধারে এবং রেললাইনের উত্তর-দক্ষিণে, উত্তর পাশের খাল, নিচু স্থানের বটগাছতলা, বাঁশের ঝাড় ও জঙ্গলের মধ্যে অবস্থান নেয়। মকবুল, মহসীন, আজিজসহ ৬-৭জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি প্লাটুন পজিশন নিয়ে অপেক্ষায় থাকে। বেলা ১১টার সময় হঠাৎ দেখা যায় যে, ২৫-৩০জন পাকিস্তানি সৈন) রেললাইনের উত্তর পাশ দিয়ে পূর্ব দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তারা খুব কাছাকাছি এসে পড়ার সাথে সাথেই এসএমজি দিয়ে অতর্কিত ফায়ার করা হয় । পাকিস্তানি সৈন্যরাও রেললাইনের দক্ষিণ পাশে অবস্থান নিয়ে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। ঠিক এ সময় শত্রুরা পাকা রাস্তা দিয়ে ১টি জিপ ও ১টি লরিতে করে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করতে করতে পুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মহসীনরা পাল্টা গুলি করতে করতে পিছনে এসে পুলের কাছে আশ্রয় নেন। শত্রুরা বৃষ্টির মতাে মেশিনগান, মর্টার ইত্যাদি ভারি অস্ত্রের গুলি চালাতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারাও এ আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন।
মুক্তিবাহিনীর সীমিত গুলি শেষ হয়ে আসে। কিছুসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা দক্ষিণ দিকে সরে গিয়ে যে যার মতাে নদ অতিক্রম করে পূর্ব পাড়ে চলে আসেন। মহসীন, মকবুল, আজিজ ও প্লাটুন অধিনায়ক নানুসহ কয়েকজন সবার শেষে নৌকা দিয়ে নদ পার হতে থাকেন। শত্রুরা নদের পাড়ে এসে পুলে উঠে মুক্তিযােদ্ধাদের নৌকার উপর গুলি চালায়। নানুর কপালের চামড়া ঘেঁষে গুলি চলে যায় এবং তিনি সামান্য আহত হন। এ অবস্থায় সবাই পানিতে নেমে নৌকা ধরে নদ পার হতে থাকেন। ৩জন শত্রু পুলের উপর থেকে পড়ে যায়। যুদ্ধের এ পর্যায়ে হঠাৎ পাকিস্তানিদের গুলির আঘাতে খন্দকার মকবুল ও আজিজ শহিদ হন। কপাল ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মহসীন গুরুতর আহত হন।
পাটেশ্বরীর ব্রিজ এলাকার যুদ্ধ
কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানার পূর্ব দিকে সীমান্তবর্তী এলাকা পাটেশ্বরী। থানা সদর থেকে পূর্ব দিকে পাটেশ্বরী যাতায়াতের সড়কের উপর পাটেশ্বরী ব্রিজটি সীমান্তবর্তী এলাকাকে পাটেশ্বরীর সাথে সংযুক্ত করেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতায়াতের জন্য এ সড়ক ব্যবহার করতাে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত রাখার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা ব্রিজটির কাছে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নজরুল ইসলাম তার দল। নিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার পাটেশ্বরী ব্রিজের কাছে ডিফেন্স নেন। এখান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিভিন্ন ক্যাম্পে আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয়। এ খবরটি শত্রুর কাছে পৌছা মাত্র সকাল ৫-৬টার সময় পাকিস্তানি ও রাজাকার সমন্বয়ে শত্রু বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেন। প্রায় ১২ ঘণ্টা যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। এ যুদ্ধে অসংখ্য রাজাকার ও শত্রু হতাহত হয়। পক্ষান্তরে, মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে হাতিবান্ধা থানার আবেদ আলী, মজিদুল হক, মকবুল হােসেন ও মহসীন। আলী শাহাদতবরণ করেন।
জয়মনিরহাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্যাট্রলে হামলা
কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী থানার জয়মনিরহাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। শত্রুরা প্রায়ই এ ক্যাম্প থেকে জয়মনিরহাট-ভুরুঙ্গামারী রােডে রাতে টহল দিত। আগস্টের মাঝামাঝি সময় এক রাতে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল ইপিআর সদস্য হাবিলদার আনিস মােল্লার নেতৃত্বে ঐ ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করে। তাই জয়মনিরহাট ক্যাম্পকে ভুরুঙ্গামারীর সাথে টেলিফোন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য জয়মনিরহাটের উত্তর পার্শ্বে টেলিফোন লাইন কাটতে মতিউর রহমান ও সামছুল আলম ২টি পৃথক টেলিফোন পােস্টে ওঠেন। ইতােমধ্যে শক্রর প্যাট্রল দল ঐ ২জন মুক্তিযােদ্ধার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে কিছুদূর দক্ষিণে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ধারণা করে যে, যারা টেলিফোন লাইন কাটতে পােস্টের উপর উঠেছেন, তাঁদের ধরার জন্য শক্র এগিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং, কালবিলম্ব না করে মুক্তিযােদ্ধারা এলএমজিসহ অন্যান্য অস্ত্র দ্বারা ফায়ার করেন। সাথে সাথেই শত্ৰু টহল দলের ৬-৭জন গাড়ি থেকে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। টেলিফোন পােস্টের যে ২জন মুক্তিযােদ্ধা উঠেছিলেন তারা নিরাপদ স্থানে ফিরে আসতে সক্ষম হন। পরে জানা যায় যে, ৬জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা গেছে। এ হামলায় মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড