You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিচিত্রার ১৭টি প্রশ্ন

এদেশে ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব দিয়ে কাগজগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়

নির্মল সেন

সভাপতি

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন

শ্রী নির্মল সেন। দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি। বয়স—৪২/৪৩ বৎসর। অবিবাহিত। সাংবাদিকতার জীবন শুরু ১৯৫৯ সালে। ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হিসেবে। দৈনিক বাংলায় যোগদান করেছেন ১৯৬৪ সালে, তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তান আমলে। জেল খেটেছেন দু’বার। ছাত্র আন্দোলনের কারণে ১৯৫৯-১৯৬২ পর্যন্ত। আরেকবার ১৯৪৮-১৯৫৩ পর্যন্ত। আত্মগোপন করেছিলেন ১৯৫৪-৫৬ পর্যন্ত মূলত বিজ্ঞানের ছাত্র। অথচ বিএ পাস করেছেন জেল থেকে। অর্থনীতিতে এমএ পাস করেছেন ১৯৬৩ সালে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা এবং এতৎসম্পর্কীয় বিষয় সম্পর্কে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলো করা হয়েছিল তাকে।

প্রশ্ন ঃ আমাদের মত অনুন্নত/উন্নয়নশীল দেশগুলো সাংবাদিকদের ভূমিকা সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

উত্তর ঃ সর্বত্র সাংবাদিকদের ভূমিকা একই। কিন্তু আমাদের অবস্থা এগুলোর পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে সাংবাদিকদের সমাজের উত্থান পর্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকতে হয়। তারা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারে না এরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আসলে এদের ভূমিকা হচ্ছে চিন্তাযুক্ত ধারণা এবং যে সমাজের জন্ম হবে—তার সিনথেসিস অপছন্দ। সাংবাদিকরা কি সমাজ না বিবেকের কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়?

পরের দিকে আর পাওয়া যায়নি…

উত্তর ঃ নিশ্চয়ই সমাজের কাছে। সমাজ বিবেককে নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজের একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। বিবেক একটা আপেক্ষিক শব্দ। এদেশে সমাজের কাছেই অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া উচিত। অন্যান্য দেশের মত, এদেশে সমাজের বিবর্তন ঘটেনি বলেই, ফর্মলার সঙ্গে এর খাপ খাওয়ানো যায় না। এখানকার প্রগতি, অগ্রগতি বিশৃঙ্খল।

প্রশ্ন ঃ সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং সাংবাদিকের স্বাধীনতা, এর মধ্যে আপনি কোনটির সমর্থক?

উত্তর ঃ আসলে এগুলোর সর্বজন স্বীকৃত কোন সংজ্ঞা নেই, স্বাধীনতা নির্ভর করে সমাজ ব্যবস্থার এর শ্রেণী চরিত্রের উপর। মূলত কাগজগুলো কোন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে, তার উপর নির্ভর করে শ্লোগান। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আসলে, তার নির্ভর করবে মালিকানার চরিত্রের উপর। মার্কিন মুল্লুকে, সেখানে কর্পোরেশন সবকিছুর মালিক, সেখানে প্রেসিডেণ্ট-এর বিরুদ্ধে লেখা যায়, কর্পোরেশনের স্বার্থের বিরুদ্ধে লেখা যায় না। ভারতের আনন্দবাজার, কংগ্রেস বিরোধী, কিন্তু যে মহল ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে, তার বিরোধী নয়। অবিশ্যি বাংলাদেশের মালিকদের চরিত্র ভিন্ন প্রকৃতির।

প্রশ্ন ঃ তাহলে কি এদেশের সাংবাদিকদের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য শ্লোগান দেয়া উচিত?

উত্তর ঃ বর্তমান অবস্থায়, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার জন্য শ্লোগান দেয়া উচিত।

প্রশ্ন ঃ এদেশে যদি কখনো সবগুলো কাগজ বন্ধ করে দিয়ে একটি কাগজ রাখার প্রস্তাব করা হয় তাহলে ইউনিয়নের ভূমিকা কি হবে?

উত্তর ঃ বাস্তবে বিচার করতে হবে কোন প্রেক্ষিতে এই প্রস্তাব এসেছে। এদেশ সমাজতন্ত্রের নামে অনেক কিছু করা হয়। তাই বলে সমাজতন্ত্রের কামড় থাকবে, সুফল ভোগ করতে পারব না, সে অবস্থা মানতে রাজী নই।

প্রশ্ন ঃ এদেশে, সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ করা হয়।। তাহল সবগুলো পত্রিকা একই কথা বলে। এই অভিযোগ কি সত্যি? সত্যি হলে এর কারণ কি?

উত্তর ঃ এ অভিযোগ সত্যি। এর কারণ হলো, সহনশীলতার অভাব। এদেশে ক্ষমতা এবং অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব দিয়ে কাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাই ব্যক্তি মালিকানাধীন কাগজগুলোও সাহস দেখাতে পারে না। সাহসের ক্ষেত্রে অস্তিত্ব বিপ্ন্ন হয়ে পড়ে, অপর দিকে, আমরা যারা দীর্ঘদিন এ পেশায় এসেছি, তারা সাহস দেখাতে পারিনি। সত্য কথা বলার মতো সাহস আমাদের অনেকের নেই। সবচেয়ে বড় অসুবিধা হল সহনশীলতার অভাব। এর কোন ব্যাখ্যা নেই। এখানে যুক্তি অচল। স্বাধীনতার প্রথম দিন থেকে সাংবাদিকতা পেশার পর্বসরীরা যদি একটু সাহস দেখাতে পারতেন তাহলে এই  দুর্গতি হতো না।

প্রশ্ন ঃ সংবাদপত্রের স্বাধীনতার উপর হামলার একটা প্রতিক্রিয়া থাকে। ইউনিয়ন থেকে বলা হয়েছে, সংবাদপত্রের উপর হামলা চলছে। ভবিষ্যতে কি এর কোন প্রতিক্রিয়া হবে?

উত্তর ঃ প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই হবে। সংবাদপত্র সমাজের অঙ্গ। ক্রিয়া হলে প্রতিক্রিয়া হবে। বর্তমান সংবাদপত্রের প্রতি অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে।

প্রশ্ন ঃ সংবাদপত্রের প্রতি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও দলগুলোর কর্তব্য কি? আমাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কি তাদের দায়িত্ব পালন করছেন?

উত্তর ঃ পাকিস্তান আমলে, বিশেষ অবস্থার প্রেক্ষিতে সাংবাদিকরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা পালন করেছে। রাজনৈতিক নেতারা, তাই সংবাদপত্র রক্ষা করাকে গৌন দায়িত্ব বলে মনে করেছেন। তাই, এখনো আঘাত এলে তারা এগিয়ে আসছেন না। অথচ তারা জানেন না, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ হলে, তারাই সবচে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

প্রশ্ন ঃ আমাদের কাগজগুলোর প্রকাশিত কোন জিনিসগুলো সবচে বিরক্তিকর?

উত্তর ঃ নেতাদের বিবৃতি, ভাষণ এবং ছবি।

প্রশ্ন ঃ আপনি সমাজতান্ত্রিক ও পুজিবাদী, উভয় দেশের সংবাদপত্র দেখেছেন। কাগজগুলোর মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কোথায়?

উত্তর ঃ মালিকানার পার্থক্য। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর পত্রিকাগুলো যে দলীয় পত্রিকা তা দেখলেই বোঝা যায়। দলীয় সংবাদ এবং কর্মসূচীই বেশী থাকে। যার আদর্শগত মূল্য রয়েছে।

প্রশ্ন ঃ সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের চাকরি করে, ইউনিয়নের দায়িত্ব পালনে আপনি কি কখনো প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন?

উত্তর ঃ এই পর্যন্ত প্রতিকূলতার সম্মুখীন হইনি। কখনো আমার উপর কোন চাপ আসেনি।

প্রশ্ন ঃ আমেরিকানরা মনে করে সাংবাদিকতায় আসার পূর্বে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। ইংরেজরা মনে করে সাংবাদিকতায় আসার পর প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আপনি কোন মতবাদের সমর্থক?

উত্তর ঃ একটু জটিল প্রশ্ন। তবে যেকোন পর্যায়েই প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। আগে হোক পরে হোক।

প্রশ্ন ঃ অনেকে অভিযোগ করেন, সাংবাদিকরা পরিচয় দিয়ে ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য হাসিল করেন? এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

উত্তর ঃ অভিযোগ শুনেছি, তবে তদন্ত করে দেখিনি। মানুষ বিশ্বাস করে এসব অভিযোগ।

প্রশ্ন ঃ নিয়ন্ত্রণের মুখ সম্পাদকদের ভূমিকা কি? তাদের কি সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত?

উত্তর ঃ আমাদের সরকার চান না এমন কিছু ছাপা হোক যাতে সরকার বিব্রত হোক। ইচ্ছে বা উদ্যোগ থাকলেও অনেকে তাই সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন না। সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দিতে হলে সাহস দেখাতে হবে। নইলে এদেশ ছেড়ে দেয়া বাঞ্ছনীয়। তবে যারা সাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করতে পেরেছেন তারা প্রশংসনীয়।

প্রশ্ন ঃ বলা হয়ে থাকে, সরকারী নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি আমরা স্ব আরোপিত নিয়ন্ত্রণেরও শিকার। আপনি এ সম্পর্কে কি বলবেন?

উত্তর ঃ আমরা এখনো পাকিস্তানী আমলের স্ব আরোপিত নিয়ন্ত্রণের হাত থেকে মুক্তি পাইনি। আমাদের সঙ্গে এখনো অতীতের মতোই ব্যবহার করা হয়।

প্রশ্ন ঃ সংবাদপত্রশিল্পের যে সংকটের কথা বলা হয়ে থাকে, তার হাত থেকে মুক্তির পথ কি?

উত্তর ঃ মূলত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি যদি না পাল্টায় তবে এর হাত থেকে রেহাই নেই। পাল্টাবার দায়িত্ব সমাজের। এবং সাংবাদিকরা সে সমাজের অঙ্গ।

কিন্তু আমরা যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি এবং ছোটবেলাতে যেভাবে সংবাদপত্রর সাথে পরিচিত হয়েছি তার সঙ্গে এর পার্থক্য এ করেই স্পষ্ট। তাই স্বাভাবিকভাবেই সমাজতান্ত্রিক দেশের সংবাদপত্র আজকে আকর্ষণ করতে পারেনি।

প্রশ্ন ঃ সাংবাদিকতার জীবনে, আপনি এমন ঘটনার উল্লেখ করুন যা উল্লেখযোগ্য।

উত্তর ঃ অনেক ঘটনাই আছে। একটি ঘটনার কথা বলছি। রাতের পালায় কাজ করছি। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে। খবর এলো নাসের পদত্যাগ করেছেন। পত্রিকার হেডিং করলাম নাসের পদত্যাগ করেছেন। আবার খবর এলো নাসের পদত্যাগ স্থগিত রেখেছেন। আবার হেডিং বদলানো হল। সর্বশেষ খবর এলো নাসের পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করেছেন। পুনর্বার হেডিং বদলানো হল। এই বদলানোর মধ্য দিয়েই পরদিন কাগজ বের হলো।

প্রশ্ন ঃ আপনি প্রথম সাংবাদিক হিসেবে কোন কাগজে যোগদান করেন?

উত্তর ঃ ১৯৫৯ সালে প্রথম ইত্তেফাকে যোগদান করি সহকারী সম্পাদক হিসেবে। দেড় মাস পরে জেলে চলে যাই।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!