You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাগভাণ্ডার অ্যামবুশ
কুড়িগ্রাম জেলার সদর থানার একটি ইপিআর ফাঁড়ির নাম বাগভাণ্ডার। বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায় যে, শক্রর ১টি টহল দল প্রায়ই সকাল-দুপুর বাগভাণ্ডার (কুড়িগ্রাম) ইপিআর ফাড়ির পশ্চিমে ফুলকুমার নদের পাড় এবং উত্তরে কাচা রাস্তা পর্যন্ত টহল দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের এ টহল দলকে প্রতিহত করে ক্ষত্রিস্ত করার পরিকল্পনা করে।  ১৯৭১ সালের ১২ জুলাই মধ্যরাতে মুক্তিযােদ্ধারা ইপিআর ফাড়ির দক্ষিণপশ্চিম ও উত্তরে জঙ্গলের মধ্যে তিন দিক থেকে অ্যামবুশ পেতে অপেক্ষা করতে থাকেন। সকাল ৮টার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৫-২০জনের ১টি টহল দল পাকা রাস্তা ধরে হেঁটে পশ্চিম দিকে এগিয়ে আসার পর মুক্তিবাহিনী এলএমজি ও রাইফেলের গুলি বর্ষণ শুরু করে জঙ্গলবেষ্টিত খালের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সুবিধাজনক ছিল। ৫ মিনিট গুলিবিনিময় হওয়ার পর ৬জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। নিহতদের ফেলে রেখে অন্যরা পালিয়ে যায়। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধা। আকতারুজ্জামান মণ্ডল নেতৃত্ব দেন।
আন্ধারীঝাড় অভিযান
কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারীর মাঝামাঝি একটি স্থানের নাম আন্ধারীঝাড়। স্থানটি ভুরুঙ্গামারী থানার অন্তর্গত। এ স্থানের উপর দিয়েই একটি রাস্তা নাগেশ্বরী ও ভুরুঙ্গামারীকে সংযােগ করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রায়ই গাড়িযােগে এ রাস্তার উপর টহল দেয় অথবা বিভিন্ন সামগ্রী পরিবহণের জন্য যাতায়াত করে। সাের্সের মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া যায় যে, শেষ রাতে পাকিস্তানি কয়েকজন অফিসার কুড়িগ্রাম মহকুমার আওতাধীন নাগেশ্বরী থেকে ভুরুঙ্গামারী আসবে মুক্তিযােদ্ধারা পাকা রাস্তা কেটে মাইন স্থাপন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। উদ্দেশ্য ছিল মাইন স্থাপন করে শত্রুর গাড়ি উড়িয়ে দেওয়া। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী আন্ধারীঝাড়ের উত্তর দিকে বাঁশঝাড়ের কাছে পাকা রাস্তা কেটে মাইন বসানাে হয়। এ জায়গাতে মাইন বসানাের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এ জন্য যে, বাঁশঝাড় থেকে ফুলকুমার নদী। কোয়ার্টার মাইল পশ্চিমে। প্রয়ােজনে দ্রুত নদী অতিক্রম করে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নেওয়া যাবে। অপারেশনে গমনের পূর্বে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্রিফ দেওয়া হয়। দলকে ৪টি ভাগে বিভক্ত করা হয়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দলে ২০জন করে এবং চতুর্থ দলে ১০জন, মােট ৭০জন মুক্তিযােদ্ধা এ অপারেশনে অংশ নেবেন বলে স্থির করা হয়।
আখতারুজ্জামান মণ্ডল এ অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। প্রথম দল বাশঝাড়ের ৫০০ গজ উত্তরে, দ্বিতীয় দল ৫০০ গজ দক্ষিণে অবস্থান নেয়। তৃতীয় দল রাস্তা কেটে মাইন স্থাপন করে ৪র্থ দল তৃতীয় দলের সােজা পশ্চিমে ফুলকুমার নদের পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করে সার্বিক তত্ত্বাবধান করতে থাকে প্রতিটি দলের কাছে ওয়্যারলেস সেট, প্রথম ও দ্বিতীয় দলের কাছে ৪টি এলএমজি, বাকি সব অস্ত্র এসএলআর তৃতীয় দলের কাছে শুধু মাইন এবং রাস্তা কাটার কোদাল। ৪র্থ দলের কাছে ২টি এলএমজি, এসএলআর ও এসএমজি রাত ১১টার মধ্যে মাইন স্থাপনের কাজ আরম্ভ করে মাত্র ১ ঘণ্টার মধ্যে ৬টি মাইন স্থাপন করা সম্পন্ন হয় এবং পূর্ব পরিকল্পনা মােতাবেক তৃতীয় দলটি চতুর্থ দলের সাথে এবং প্রথম ও দ্বিতীয় দল একসাথে ৫০০ গজ দূরত্বের ব্যবধানে অবস্থান গ্রহণ করে। ভাের ৪টার দিকে রায়গঞ্জের দিক থেকে ১টি গাড়ি রায়গঞ্জ পুল পার হয়ে উত্তরে আন্ধারীঝাড়ের দিকে আসছে দেখে। মুক্তিযােদ্ধারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। হঠাৎ গগনবিদারী বিকট আওয়াজ কানে ভেসে আসে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সবাই ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। দেখা যায় যে, রাস্তার মধ্যে বিরাট এক খালের সৃষ্টি হয়েছে। পাকিস্তানি জিপের কোনাে অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নি। রাস্তার কিছু দূরে ১টি টুপি, ক্যাপ্টেনের ব্যাজ লাগানাে শার্টের হাতাসহ একটি হাত পড়ে রয়েছে। বিলম্ব না করে মুক্তিযােদ্ধারা এগুলাে নিয়ে নিজ অবস্থানে ফিরে যান।
দুর্গাপুর রেললাইন অপসারণ
কুড়িগ্রাম জেলার সদর থানার একটি রেল স্টেশনের নাম দুর্গাপুর পাকিস্তান সেনাবাহিনী রংপুর থেকে কুড়িগ্রাম, উলিপুর ও চিলমারী পর্যন্ত ট্রেনে যাতায়াত করতাে, রসদপত্র ও মালামাল আনা-নেয়ার জন্য রেলপথই ব্যবহার করতাে বস্তুত এসব এলাকায় যুদ্ধ চলাকালে যােগাযােগের কোনাে ভালাে পাকা রাস্তা ছিল না। তা ছাড়া নিরাপত্তার যথেষ্ট অভাব থাকায় সড়ক পথে যাতায়াত বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য রেললাইন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। বিকালে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আকরামের নেতৃত্বে কুড়িগ্রাম ও উলিপুর মধ্যবর্তী স্টেশনের কাছে রেললাইনের নিচে মাইন স্থাপন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। দুর্গাপুর স্টেশনের উত্তর পাশে লাইনের নিচে মাইন স্থাপনের উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত হয়। কারণ মাইন স্থাপন শেষে অতি সহজে পূর্ব দিকে ধরলা নদী অতিক্রম করা যাবে কোম্পানি অধিনায়ক আকরামের নেতৃত্বে ২০জনের ১টি দল মােগলবাছার দক্ষিণ দিকে নদী পার হয়ে দুর্গাপুর স্টেশনের উত্তরে বাঁশঝাড়ের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করে এবং অতি দ্রুত রেললাইনের কাঠের স্লিপারের নিচে ৪টি অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন যথাযথভাবে স্থাপন শেষে স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে আসতে সক্ষম হয়। ভােররাতে শক্ররা কুড়িগ্রাম থেকে উলিপুর যাওয়ার পথে দুর্গাপুরের কাছে দানবীয় শব্দে মাইন বিস্ফোরিত হয়। ইঞ্জিনসহ ২টি বগি মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে পাশের খাদে পড়ে যায়। মাইন পেতে রাখা স্থানে বিরাট গর্তের সৃষ্টি হয়। প্রায় ২০-২৫জন পাকিস্তানি। সেনা নিহত এবং প্রচুর রসদ ধ্বংস হয়। এ সাফল্যের খবর স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!