You dont have javascript enabled! Please enable it!
হাতিবান্ধা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্প আক্রমণ
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হাতিবান্ধা (০৫০৫, ম্যাপ শীট নম্বর ৭৮এফ/৪) অপারেশন ছিল আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সমগ্র ৬ নম্বর সেক্টরে এটা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে শক্তি পরীক্ষার সবচেয়ে বড়াে ঘটনা। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে এ যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন ক্যাপটেন মতিউর রহমান। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়
অবস্থান
পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান ছিল লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা থানা সদরে। আধা মাইল দূরে সিংমারী (০৬০৭, ম্যাপ শীট নম্বর ৭৮এফ/4) বিওপিতে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের ডিফেন্স। গড়িমারি ও সাওতরার পশ্চিম পার্শ্ব এবং তিস্তার পশ্চিম পার্শ্বে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের ২টি কোম্পানি। সিংমারী বিওপিতে ছিল সুবেদার ফজলুর রহমানের কোম্পানি, এর পশ্চিম পার্শ্বে সুবেদার মেজর বােরহান উদ্দিন ও তার বাহিনী, তার পশ্চিমে মাে. মেজবাহ উদ্দিন ও তার নিয়মিত বাহিনী এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মিলিত বাহিনী, তার পাশে সুবেদার মেজর আবদুল মালেক ও তার বাহিনী এবং তার পশ্চিমে নিজ বাহিনী নিয়ে সুবেদার মেজর গােলাম মােস্তফা তিস্তার ওপারে প্রােটেকশন দেওয়ার জন্য সুবেদার মেজর নজমুল হকের নেতৃত্বে ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের আরও ১টি কোম্পানি।  পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল হাতিবান্ধা কলেজে, সিওডেভ অফিস এবং চিন্তাপাড় বরাবর বাংকারে। ২ কোম্পানি পাকিস্তানি নিয়মিত সৈনিক ছাড়াও তাদের সাথে ছিল ২ কোম্পানি ইপিসিএএফ (ইপিআর-এর অনুরূপ বাহিনী) এবং ১৪০০-এর বেশি রাজাকারের ১টি বিরাট বাহিনী। তাদের কভারিংয়ে ছিল ১টি সম্পূর্ণ আর্টিলারি ব্যাটারি এবং অন্যান্য অস্ত্রের মধ্যে ছিল কামান, হেভি মেশিনগান, ৩ ইঞ্চি মর্টার, ২ ইঞ্চি মর্টার, রকেট লঞ্চার, এলএমজি প্রভৃতি। মুক্তিযােদ্ধাদের পিছনে ছিল মিত্রবাহিনীর ১ট আর্টিলারি ব্যাটারি। ৩ ইঞ্চি মর্টার, এলএমজি, এসএলআরসহ ৩ শতাধিক যােদ্ধা নিয়ে গঠিত মুক্তিবাহিনী। অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপটেন মতিউর রহমান।
বর্ণনা
২৭ সেপ্টেম্বর ভােররাতে শুরু হয় গােলাগুলিবিনিময়। সারাদিন গােলাগুলির পর বিকালে উভয়পক্ষের গােলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। সন্ধ্যার আগে সুবেদার মেজর ফজলুর রহমান তার গ্রুপকে নিয়ে নিঃশব্দে অ্যাডভান্স করে পাকিস্তানি সৈন্যদের ডিফেন্স লাইনের দিকে কয়েক’শ গজ নিয়ে যান এবং পজিশন নিয়ে সন্ধ্যার দিকে ফায়ার ওপেন করে দেন। দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদাররা। ক্যাপটেন মতিউর রহমান গােটা বাহিনীকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সামনে অগ্রসররত মুক্তিবাহিনীর গতিরােধ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষে। যুদ্ধের পরিস্থিতি মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে চলে আসে সন্ধ্যার দিকে সন্ধ্যা ৭টা ২৫ মিনিটের দিকে পাকিস্তানি আর্টিলারি সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর অগ্রগামী ট্রুপগুলাের উপর ক্ষিপ্রগতিতে গােলা ফেলতে শুরু করে। ক্যাপটেন মতিউর রহমান অতি কষ্টে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাহিনীকে রক্ষা করেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্তি বৃদ্ধি হয়ে যাওয়ার পরও এবং তাদের দিকে ফায়ার বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও কোনাে মুক্তিযােদ্ধা বাংকার ত্যাগ করেননি। কেউ যেন মনােবল না হারায় সে জন্য তিনি এক বাংকার থেকে আরেক বাংকারে যান। বাংকারে যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের ভরসা দিয়েছেন, আশায় উদ্দীপ্ত করেছেন। মুক্তিযােদ্ধারা অধিনায়কের কথা রেখেছেন। হাতিবান্ধা ফ্রন্টে ২৭ সেপ্টেম্বরের রাতের লড়াই ছিল মাতৃভূমির জন্য। আত্মদানের লড়াই প্রচুর সমরাস্ত্রসহ বিপুলসংখ্যক পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে টিকে থাকাই যেখানে কষ্টকর, সেখানে বীরবিক্রমে লড়াই করেছেন তারা। বাংকারে বসে ডিফেন্স লাইন থেকে শত্রুর প্রতিটি গুলির জবাব দিয়েছে। রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে শক্রর মুখােমুখি বাংকার থেকে ওয়্যারলেসে। সুবেদার ফজলুর রহমান জানালেন যে, তিনি নিজে বাংকারে আহত হয়েছেন। সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে আরও ১জন শহিদ। হয়েছেন। অন্যরা বীরবিক্রমে শত্রুর সাথে লড়াই করেছেন। অধিনায়ক।
ক্যাপটেন মতিউর রহমান জেনে নিলেন ফ্রন্ট লাইনের কোন স্থানে ফজলুর রহমানের বাংকার। ঐ মুহূর্তে ৬০০ গজ পিছনে ছিলেন ক্যাপটেন মতিউর রহমান। ১জন সহযােদ্ধার কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে মতিউর রহমান সুবেদার ফজলুর রহমানের বাংকারের দিকে যান। কিছুক্ষণের মধ্যে ক্যাপটেন মতিউর রহমান সুবেদার ফজলুর বাংকারের। কাছে পৌছে যান। তবে বাংকারে পৌছানাের আগেই শক্রর গুলিতে লুটিয়ে পড়েন ক্যাপটেন মতিউর রহমান। হাতিবান্ধার বুকে সে রাতে শহিদ হলেন আরও ৬জন মুক্তিযােদ্ধা এবং আহত হলেন ৩০জনের বেশি। তবু পিছু না হটেননি মুক্তিযােদ্ধারা হাতিবান্ধায় শহিদ মুক্তিযােদ্ধারা শায়িত আছেন হাই স্কুল প্রাঙ্গণে রাতে আহতদের পাঠানাে হলাে বুড়িমারী ফিল্ড হাসপাতালে এবং তার। পরদিন শিলিগুড়ি আর্মি হাসপাতালে। আরও ২ দিন পর মুক্তিযােদ্ধারা হাতিবান্ধা দখল করে নেন এবং ৯০০জনেও বেশি রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। তাদের কাছে জানা যায় যে, পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে গত ৩ দিনে বহু নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। পাকিস্তানি সেনারা ২টি ট্রাকে করে তাদের মৃতদেহ নিয়ে গেছে বলে রাজাকাররা জানায়।
শিক্ষণীয় বিষয়
আক্রমণে গতি বজায় রাখা একান্ত জরুরি। অনেক সময় গতি মন্থর হয়ে গেলে তা বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তখন প্রয়ােজন প্রতিটি স্তরের অধিনায়কের প্রত্যক্ষ সাহস ও উদ্দীপক আচরণ।
কাকিনা ও আদিতমারী আক্রমণ
লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ থানায় কাকিনা রেল স্টেশন অবস্থিত। একই জেলার আদিতমারী থানার কাছে অপর একটি রেল স্টেশন আদিতমারী । লালমনিরহাট থেকে রেললাইনটি আদিতমারী, কালিগঞ্জ, হাতিবান্ধা হয়ে পাটগ্রামের বুড়িমারীতে শেষ হয়। এ রেললাইনের উভয় পাশে পাকিস্তানি সৈন্যদের অনেক ক্যাম্প ছিল। লালমনিরহাট থেকে শত্রু তার প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, রসদ ও জনবল ক্যাম্পগুলােয় পরিবহন করে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করত। শত্রুর শক্তি, মনােবল ও যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা কাকিনা ও আদিতমারীতে আক্রমণের পরিকল্পনা করে। নভেম্বর মাসের ঘটনা। মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল কাকিনার নামুরী নামক স্থানের উত্তরে বাঁশঝাড় ও গাছের আড়ালে অবস্থান নেয়। মুক্তিযােদ্ধাদের অপর দলটি আদিতমারী রেল স্টেশনের একটু উত্তর-পশ্চিমে অবস্থান নেয়। প্রথম দলের নেতৃত্ব দেন আ. মান্নান এবং দ্বিতীয় দলের নেতৃত্ব দেন মাে. তাজুল ইসলাম। পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে রেলগাড়িটি আদিতমারী রেল স্টেশন অতিক্রম করার সাথে সাথেই মুক্তিযােদ্ধার দ্বিতীয় দলটি অতর্কিত আক্রমণ করে। দুই পক্ষের তুমুল গুলিবিনিময় হয়। পাকিস্তানিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে রেললাইনের দক্ষিণ পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে দক্ষিণে লালমনিরহাটের দিকে এবং উত্তরে কাকিনার দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা কাকিনায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম দল কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানিদের অপর দলটিও মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বিতীয় দল দ্বারা আক্রান্ত হয়ে উল্টো দিকে ফিরে আসে। অতঃপর পাকিস্তানিরা একত্র হয়ে পুনরায় রেলগাড়িতে উঠে লালমনিরহাট ফেরত আসে। এ যুদ্ধে ৫জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
হাতিবান্ধা আক্রমণ
লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ থানা ও সীমান্তবর্তী পাটগ্রাম থানার মধ্যবর্তী থানা হাতিবান্ধা। হাতিবান্ধায় পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা ইতঃপূর্বে বেশ কয়েকবার হাতিবান্ধা দখলের চেষ্টা করেও সফল হতে না পেরে পুনরায় হাতিবান্ধা আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।  মুক্তিযােদ্ধারা ২০-২১ নভেম্বর সকাল ৮টার দিকে হাতিবান্ধা আক্রমণ করে। ঈদের দিন শত্রু প্রস্তুত থাকবে না বিধায় মুক্তিযােদ্ধারা ৪টি কোম্পানি নিয়ে দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। উল্লেখ্য, ঐ সময় শত্রুদের ১টি কোম্পানি বদলি হচ্ছিল এবং নতুন কোম্পানি ঐ এলাকার দায়িত্ব গ্রহণ করছিল। হস্তান্তর বা গ্রহণের সময় মুক্তিযােদ্ধাদের এ আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি কোম্পানি অধিনায়ক নিহত হয় এবং তারা বিশৃঙ্খলভাবে পিছু হটে নিজস্ব আর্টিলারি অবস্থানে প্রতিরক্ষা নেয়। পরবর্তী সময় ভারতীয় আর্টিলারির সহযােগিতায় মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের পিছু হটতে বাধ্য করে। ইতঃপূর্বে হাতিবান্ধা ছাড়া এ এলাকায় এত মারাত্মক যুদ্ধ আর হয়নি। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা লেফটেন্যান্ট ফারুক অত্যন্ত  বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রদর্শন করেন। এ যুদ্ধে ৬ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক উইং কমান্ডার এম কে বাশার নিজেও প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিলেন। ২২ নভেম্বর এ যুদ্ধের একপর্যায়ে পাকিস্তানিদের ডান দিকের পজিশন মুক্তিযােদ্ধারা দখল করলেও বাম দিকে ইপিআর-এর সিংমারী বিওপি’র অবস্থান। ছিল খুবই সুসংহত।
এ অবস্থানটি ছিল আশপাশের এলাকার চেয়ে বেশ উঁচু। মুক্তিযােদ্ধাদের উচিত ছিল প্রথমে বাম দিকের পজিশন দখল করা। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা ভুল পরিকল্পনার জন্য প্রথমে ডান এবং পরে বাম দিকে আক্রমণ  চালান এবং পরবর্তী সময় নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বাম দিকের অবস্থান দখলের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। এদিকে শত্রু প্রচণ্ড আর্টিলারি গােলা বর্ষণ শুরু করে। এ গােলা বর্ষণের মাঝেও মুক্তিযােদ্ধারা অসীম সাহসিকতার সাথে শত্রুর বাংকারগুলাে চার্জ করে দখল করতে থাকেন। এক পর্যায়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শক্রর আর্টিলারি গােলার আঘাতে ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন পরবর্তী সময় তাদেরকে বাউরা বাজারের নিকটস্থ জমগ্রাম মসজিদের আঙিনায় সমাধিস্থ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক পরবর্তী সময় তাদেরকে ‘বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত করা হয়। এ যুদ্ধে বহু পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। কোম্পানি অধিনায়ক সুবেদার ফজলুর রহমান এবং তাঁর সঙ্গী হাবিলদার রংগু মিয়া শহিদ হন। তাদের সাথে। এএফএস নাছির আহম্মদ নামে আরও ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!