You dont have javascript enabled! Please enable it!
মােগলহাট আক্রমণ
মােগলহাট লালমনিরহাট জেলার সােজা উত্তরে ভারতের কাছাকাছি সীমান্ত এলাকার একটি রেল স্টেশন। এ অবস্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি শক্ত ঘাঁটি গড়ে ওঠে। এখান থেকেই শত্রুরা আশপাশের এলাকায় টহল দিত। লােকজনের উপর নানারকমের অত্যাচার করত। মুক্তিযােদ্ধারা এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য এবং শত্রুর অবস্থান উচ্ছেদ করতে আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ৪ জুলাই দুপুরে গীতালদহ থেকে ৫০জন মুক্তিযােদ্ধা ধরলা নদী পার হয়ে বিকাল ৫টায় তিন দিক থেকে মােগলহাট পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের আচমকা আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যরা মােগলহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়। এখানে শত্রুর ১০-১১জন সদস্য নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা জয়ােল্লাসে মােগলহাটে ঢুকে যখন বাদবাকি পাকিস্তানি সৈন্যদের খুঁজতে থাকেন, তখন শত্রুরা মুক্তিযােদ্ধাদের উপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়। শক্রর গুলিতে নীলফামারীর আব্দুর রশিদ ও আবু বকর শহিদ হন এবং মাইনের আঘাতে শামসুল কিবরিয়া গুরুতর আহত হন। আহত শামসুল কিবরিয়া ও শহিদ হওয়া সহযােদ্ধাদের লাশ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা গীতালদহে ফিরে আসেন। শামসুলকে কুচবিহার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং ২জন শহিদ সহযােদ্ধাকে মােগলহাট পুলের কাছে সমাহিত করা হয়। শামসুল কিবরিয়া ছিলেন নীলফামারী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।
পাটগ্রাম অ্যামবুশ
লালমনিরহাট থেকে উত্তর-পশ্চিমে বাউড়া রেল স্টেশনের পরেই ভারতের কাছাকাছি সীমান্ত এলাকায় পাটগ্রাম অবস্থিত। এটি একটি থানা সদরও বটে। এ এলাকাটি ছিল মুক্ত ও নিরাপদ এলাকা। পাকিস্তানি সৈন্যরা এখানে প্রবেশ করতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালায়। ১৯৭১ সালের ১০ জুলাই মুক্ত এলাকা পাটগ্রাম দখল করার জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা হাতিবান্ধা থেকে বুড়িমারী মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। ইপিআর সদস্য মােহন মিয়া ও অন্যান্য ইপিআর সদস্যসহ মুক্তিযােদ্ধারা সফলভাবে এ আক্রমণ প্রতিহত করেন। এ লড়াইয়ে ইপিআর সদস্য আনােয়ার বীরত্বপূর্ণ লড়াই করে শহিদ হন। শত্রুর গুলিবর্ষণ তীব্রতর হলে আনােয়ার এলএমজি নিয়ে ক্রলিং করে শক্রর অবস্থানের প্রায় কাছে গিয়ে মুখােমুখি ফায়ার করেন। ঠিক এ অবস্থায় শক্রর এক ঝাক গুলি মুক্তিযােদ্ধা আনােয়ারের দেহ ঝাঁঝরা করে দেয় এবং তিনি শহিদ হন। আরেকজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হলেও অকুতােভয় অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধার পালটা। আক্রমণে শত্ৰু পিছু হটে হাতিবান্ধায় চলে যায়। এ যুদ্ধে ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং ১৫-২০জন শক্র নিহত হয়। শহিদ আনােয়ার হােসেনকে পাটগ্রামের মুক্ত এলাকায় পূর্ণ মর্যাদায় সমাহিত। করা হয়।
বড়খাতা ব্রিজ ধ্বংস
ভূমিকা
লালমনিরহাট ও পাটগ্রামের মধ্যবর্তী এলাকায় ভারতীয় সীমান্তের নিকটবর্তী একটি গ্রামের নাম বড়খাতা (০৩২৪, ম্যাপ শীট নম্বর ৭৮এফ/৪)। এখানে তিস্তা নদীর উপর একটি রেলসেতু আছে। এ সেতুটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ সেতুর উপর দিয়েই রেলগাড়িতে করে পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, বড়খাতাসহ রংপুর জেলার উত্তর অঞ্চলে রসদ ও সমরাস্ত্র সরবরাহ করা হতাে।
মুক্তিবাহিনীর কাছেও এ সেতুটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এ সেতুটি ধ্বংস। করে, রংপুরকে বড়খাতার উত্তরাঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন করে হাতিবান্ধা থেকে। বাংলাবান্ধা পর্যন্ত ২২ মাইল এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।
শত্রুর অবস্থান
বড়খাতা সেতুর গুরুত্ব বিবেচনা করে সেতু রক্ষায় শত্রু এখানে ১টি কোম্পানি। মােতায়েন করে। তাদের অবস্থান ছিল সেতুর দুই প্রান্তে। এ ছাড়া সেতুর উপর । তাদের ১টি পােস্ট ছিল। শত্রুর কোম্পানিটি মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত। মুক্তিবাহিনীর ৩টি আক্রমণ প্রতিহত করে। মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা সেক্টর অধিনায়ক উইং কমান্ডার মােহাম্মদ খাদেমুল বাশার শত্রুর রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে মে মাসের শেষের দিকে বড়খাতা সেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। মে মাসের শেষ সপ্তাহে তার নির্দেশে ১টি কমান্ডাে গ্রুপ বড়খাতা সেতু আক্রমণে যায়। কিন্তু শক্রর প্রতিরােধের মুখে তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি অপর ১টি দলও এ অভিযানে ব্যর্থ হয়। ৪ আগস্ট ইপিআর বাহিনীর সৈন্যদের সমন্বয়ে গড়া আরেকটি দল বড়খাতা আক্রমণে যায়। কিন্তু সতর্ক শক্রর গুলির মুখে দলটি সফলতা লাভ করতে পারে নি। এ অভিযানের পর উইং কমান্ডার বাশার, পাটগ্রাম সাব-সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপটেন মতিউর রহমান ও কোম্পানি অধিনায়ক হারেস উদ্দিনকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। পূর্বের ভুলভ্রান্তির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে পুনরায় বড়খাতা সেতু অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়। এবারের অভিযানের নেতৃত্বে থাকবেন। ক্যাপটেন মতিউর রহমান। মূল দলকে কভারিং ফায়ার দেবেন লেফটেন্যান্ট মেসবাহ উদ্দিন ও সুবেদার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে ২টি মুক্তিবাহিনী কোম্পানি।
সেতু ধ্বংসের প্রস্তুতি
১২ আগস্ট রাত ৮টায় মুক্তিবাহিনী প্রস্তুতি শুরু করে। রাত ১০টার পর ক্যাপটেন মতিউরের নেতৃত্বে বাউরা স্টেশন থেকে ১২জন মুক্তিবাহিনী জিপে করে বড়খাতা সেতুর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এ দলের অন্য সদস্যরা ছিলেন কোম্পানি অধিনায়ক হারেস উদ্দিন সরকার, মুক্তিযােদ্ধা নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, আফজাল হােসেন, শওকত আলী প্রমুখ। | বাউরা থেকে বড়খাতা তিস্তা সেতুর দূরত্ব ৫ মাইল। শত্রুর সতর্ক প্রহরা ফাকি দিয়ে দুর্গম রাস্তায় গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে অতি ধীরে অগ্রসর হয় মুক্তিযােদ্ধরারা। কভারিং ফায়ার দেবার জন্য নির্ধারিত মুক্তিযােদ্ধা কোম্পানি ২টি মূল দলের পিছু পিছু অগ্রসর হচ্ছিল। শত্রুর অবস্থানের ২ মাইল দূরে মূল দলটি জিপ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে সেতুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। রাত তখন পৌনে ১২টা, আকাশে মেঘের ঘনঘটা। মুক্তিবাহিনীর এ ক্ষুদ্র দলটির কাছে এক্সপ্লোসিভ (বিস্ফোরক), ডেটনেটর, ১টি হালকা মেশিনগান (এলএমজি), ৩টি সাব-মেশিন কারবাইন বা স্টেনগান (এসএমজি) এবং ১টি ৩ ইঞ্চি মর্টার। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পা টিপে এগিয়ে চললেন মুক্তিযােদ্ধারা এমন সময় শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। গায়ের জামা খুলে এক্সপ্লোসিভগুলাে জামায় জড়িয়ে এগিয়ে চললেন তারা সেতুর কাছাকাছি আসতেই বৃষ্টির বেগ বেড়ে তীব্রতর। হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে এ মুষলধারার বর্ষণ ছিল যেন আশীর্বাদস্বরূপ।
বৃষ্টির ভয়ে পাকিস্তানি প্রহরীরা বাংকার থেকে বের হচ্ছিল না। ইতােমধ্যে সেতুর মুখে পৌছে গেল মুক্তিবাহিনী। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেতুর ২টি জায়গায় এক্সপ্লোসিভ বসানাের কথা। কিন্তু বৃষ্টির জন্য পাকিস্তানি সৈন্যরা যেহেতু সেতুর উপর নজরদারী করতে ব্যর্থ হচ্ছিল, সে সুযােগে সেতু ধ্বংস নিশ্চিত করার জন্য ৩টি স্থানে এক্সপ্লোসিভ স্থাপনের কাজ শুরু করে মুক্তিবাহিনী রাত ২টার আগেই এ কাজ সমাপ্ত করেন। এ কাজে কমপক্ষে ৩০ মিনিট লাগার কথা। কিন্তু পাহারায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শৈথিল্যের সুযােগে মুক্তিবাহিনী সবাই মিলে দ্রুত সেতুর উপর এক্সপ্লোসিভ স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করে।
ক্যাপটেন মতিউর অত্যন্ত সন্তর্পণে তিস্তার উপর থেকে ১২জন সহযােদ্ধাকে তুলে আনলেন। ৩০০ গজ দূরে এসে থামল দলটি। মুষলধারার বৃষ্টির মধ্যে রাত সােয়া ২টায় ডিটোনেটরে আগুন ধরালেন তারা। প্রচণ্ড শব্দে বৃষ্টির মধ্যে ভেঙে পড়লাে সেতুর একাংশ। জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে হালকা মেশিনগানের ফায়ার শুরু করেন ক্যাপটেন মতিউর। পিছন থেকে কভারিং ফায়ার এলাে লেফটেন্যান্ট মেজবাহ উদ্দিনের কোম্পানি থেকে। আক্রমণের আকস্মিকতায় সশস্ত্র হানাদার প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেলেও পর মুহূর্তেই শুরু করে পাল্টা গােলাবর্ষণ। বেশ কিছুক্ষণ গুলিবিনিময়ের পর ১৫টি লাশ ফেলে রেখে পিছু হটে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। ৩ বার যেখান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে, সেখানেই মুক্তিবাহিনী বিজয় অর্জন করে।
শিক্ষণীয় বিষয়
সুরক্ষিত ব্রিজ ধ্বংসের জন্য প্রয়ােজন সঠিক পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ। কয়েকবার ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও সঠিক পরিকল্পনা করে মাত্র ১২জনের দল নিয়ে বড়খাতা ব্রিজ ধ্বংস করা হয়। | প্রতিকূল আবহাওয়া সব সময় গেরিলা যুদ্ধের সহায়ক। বৃষ্টির কারণে পাকিস্তানি সেনারা ঐ রাতে ব্রিজকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে না পারায় মুক্তিযােদ্ধারা সহজেই বিস্ফোরক লাগাতে সক্ষম হন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!