You dont have javascript enabled! Please enable it! কুলাঘাট অ্যামবুশ - বাউড়া প্রতিক্ষায় আক্রমণ - দুরাকুটির আক্রমণ - সংগ্রামের নোটবুক
কুলাঘাট অ্যামবুশ
লালমনিরহাট জেলার সদর থানার নদীতীরের একটি ঘাটির নাম কুলাঘাট। পাকিস্তানি সৈন্যরা মাঝেমধ্যেই লালমনিরহাট থেকে কুলাঘাট এসে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করে এবং স্থানীয় গ্রামে ঢুকে সাধারণ জনগণের উপর নানাপ্রকার নির্যাতন ও অত্যাচার চালায় এবং অনেক নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে যায়। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় ফুলবাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক সিরাজ ধরলা নদী পার হয়ে কুলাঘাটের উজানে ২টি  গ্রামকে মাঝে রেখে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে অবস্থান নেয়। সকাল ১০টার সময় শক্রর ২৫-৩০জনের ১টি দল গ্রামে ঢুকে নদী বরাবর আসতে থাকে। নদীর কাছাকাছি আসার পর মুক্তিযােদ্ধারা পিছনসহ তিন দিক থেকে তাদের ঘিরে প্রচণ্ড আক্রমণ ও গুলিবর্ষণ শুরু করেন। প্রায় আধা ঘন্টার গুলিবিনিময়ে ১০-১২জন শত্রু নিহত এবং ১জন শত্রু মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। ধৃত পাকিস্তানিকে ফুলবাড়ি নিয়ে আসা হয়। এ অভিযানের কয়েকদিন পর ৫০-৬০জন পাকিস্তানি কুলাঘাট থেকে বড়া। ২টি নৌকায় করে নদী পার হতে থাকে এবং কিছু সৈন্য নদীর ঘাটে ভারি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কভারিং দেওয়ার জন্য নদীর কিনারায় অবস্থান গ্রহণ করে। এদিকে মুক্তিযােদ্ধারা নদীর পাড় ঘেঁষে চরের মধ্যে কাশবন, ঝাউগাছ ও জঙ্গলের ভিতর অবস্থান গ্রহণ করে অপেক্ষায় থাকে। শত্রু নদীর মাঝ বরাবর আসার পর মুক্তিযােদ্ধারা রাইফেল, এসএলআর, এলএমজি ও ২ ইঞ্চি মর্টার দিয়ে শক্র সেনাদের উপর গুলি বর্ষণ করে নৌকা ২টি ডুবিয়ে দেন। ধরলা নদীর বুকে প্রায় ৫০-৬০জন শত্রুর সলিলসমাধি হয়।
বাউড়া প্রতিক্ষায় আক্রমণ
অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের সময় লালমনিরহাটের ভারতসংলগ্ন মুক্তাঞ্চল পাটগ্রামের ভৌগােলিক অবস্থান ছিল একটু ব্যতিক্রমী। এটি লম্বায় ২২ মাইল এবং কিছুটা লাউয়ের আকৃতি। এ এলাকার তিন দিকে ভারতীয় সীমানা। এ লাউ আকৃতির স্থানটির চওড়া ছিল আড়াই মাইল এবং এ স্থানে অর্থাৎ বাউড়ায় (০০৩০, ম্যাপ শীট নম্বর ৭৮এফ/৩) মুক্তাঞ্চল পাটগ্রামকে রক্ষার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা ৫টি কোম্পানি। নিয়ে প্রতিরক্ষা নিয়েছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতিরক্ষা ছিল হাতিবান্ধাতে। বাউড়া ও হাতিবান্ধার মধ্যে দূরত্ব সাড়ে ৩ মাইল। এ সময় বর্ষাকাল থাকায় রেললাইনের উপর ছাড়া যানবাহন চলাচল সম্ভব ছিল না। পরিকল্পনা ও বর্ণনা রেললাইনকে কেন্দ্র করে এর আশপাশে বিভিন্ন গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রামকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা গড়ে উঠেছিল। এ প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী যেন কোনােভাবেই একবারে প্রতিরক্ষা দখল করতে না পারে অর্থাৎ পাকিস্তানি বাহিনী একটি গ্রামকে আক্রমণ করলে মুক্তিযােদ্ধারা যেন পরবর্তী গ্রামে গিয়ে অবস্থান নিতে পারে। পাকিস্তানি বাহিনী হাতিবান্ধার মূল অবস্থান থেকে এসে প্রায়ই মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাতাে। এলাকাটির অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনা করে মুক্তিযােদ্ধাদের পিছনে পরবর্তী। সময় বিএসএফ-এর ১টি ব্যাটালিয়নসহ, ভারতীয় আর্টিলারির ১টি ব্যাটারিও ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা বাউড়া প্রতিরক্ষায় বারবার আক্রমণ চালিয়েও কখনােই দখল করতে পারেনি। তবে পাকিস্তানিদের আর্টিলারি ব্যাটারি মুক্তিযােদ্ধাদের বেশ ক্ষতি করেছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের লক্ষ্য ছিল বর্তমান অবস্থান থেকে ক্রমাগত সামনে এগিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের মূল অবস্থানে অর্থাৎ হাতিবান্ধায় হানা দেওয়া। 
এভাবে অগ্রসর হয়ে মুক্তিবাহিনী সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানি সেনাদের থেকে মাত্র ৪০০ গজ দূরে অবস্থান নেয়। কিন্তু এ যুদ্ধ থেকে মুক্তিযােদ্ধারা সুনির্দিষ্ট কোনাে সফলতা অর্জন না করায় তাদের মনােবল থাকে নিচু মূলত প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতার অভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর বার বার আক্রমণ চালিয়েও মুক্তিযােদ্ধারা কোনাে সফলতা আনতে ব্যর্থ হন। বরং শত্রুর স্থাপিত মাইনে অনেক মুক্তিযােদ্ধা হতাহত হন। তাই মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বৃদ্ধি এবং বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এ প্রতিরক্ষা অবস্থানের উল্লেখযােগ্য সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত দলের সাহায্যে তিস্তা নদীর অপর পাড়ে রৌমারীর অন্তর্গত সুঠিবাড়ি নামক স্থানে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে অপারেশনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। সুঠিবাড়িতে মুক্তিযােদ্ধারা সফল অপারেশন পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেন। একই সাথে মুক্তিযােদ্ধারা অর্জন করেন বিশাল এক অভিজ্ঞতা এবং তাঁদের মনােবলও হয় উচু। উল্লেখ্য, রৌমারীতে পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে সাহসিকতাপূর্ণ একটি সফল রেইড পরিচালনা করায় ক্যাপটেন মতিউর রহমানকে ‘বীরবিক্রম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।
দুরাকুটির আক্রমণ
অবস্থান
বৃহত্তর রংপুর জেলার তৎকালীন লালমনিরহাট মহকুমার উত্তর প্রান্তে লালমনিরহাট থেকে ৯ কিলােমিটার দূরে মােগলহাট রেলওয়ে জংশন (৪১৯৯, ম্যাপ শীট নম্বর ৭৮জি/৫) অবস্থিত। একটি ব্রডগেজ রেললাইন লালমনিরহাট থেকে মােগলহাট হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে। মােগলহাট থেকে ভারতের সীমান্তের দূরত্ব ৬০০ গজের কম। জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় ভুরুঙ্গামারী, লালমনিরহাট, বড়খাতা প্রভৃতি বড়াে ঘাঁটিতে চোরাগােপ্তা হামলার পাশাপাশি মুক্তিবাহিনী বড়াে ধরনের আক্রমণও শুরু করে। দখলদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর এসব আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সীমান্তের নিকটবর্তী গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােয় সৈন্য মােতায়েন করে। এ সময়ই মােগলহাটে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১টি ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মােগলহাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের জন্য প্রতিদিন সকালে লালমনিরহাট থেকে ট্রেনে করে রসদ আসতাে। এ ছাড়া এখানে কর্তব্যরত প্রহরীদের ডিউটি বদল হতাে প্রতিদিন সকালে ও সন্ধ্যায়। উল্লেখ্য, এ বদলিকৃত সৈনিকদের প্রতিদিন ট্রেনে করে লালমনিরহাট থেকে মােগলহাটে আনা-নেয়া করা হতাে। অর্ডন্যান্স কোরের ক্যাপটেন দেলােয়ার হােসেন শিয়ালকোট সেনানিবাস। থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। ২২ আগস্ট তাকে ৬ নম্বর সেক্টরে পােস্টিং করা হয়। প্রাথমিকভাবে তিনি কিছুদিন মেজর নওয়াজেশের ভুরুঙ্গামারী সাব-সেক্টরে অবস্থান করেন। এ সময় তিনি মূলত প্যাট্রলিং, ছােটোখাটো রেইড, অ্যামবুশ এবং মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কাজে নিয়ােজিত ছিলেন। মেজর নওয়াজেশের পরামর্শে তিনি লালমনিরহাট থেকে। মােগলহাটগামী শত্রুর রসদবাহী ট্রেনে অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করেন।
পরিকল্পনা
ক্যাপটেন দেলােয়ার অ্যামবুশের জন্য লালমনিরহাট মােগলহাটের মধ্যবর্তী। দুরাকুটি (৪৮৯৫, ম্যাপ শীট নম্বর ৭৮জি/৫) গ্রামটি নির্বাচন করেন। এখানে এক্সপ্লোসিভের সাহায্যে রেললাইন উড়িয়ে দিয়ে ট্রেন অ্যামবুশের পরিকল্পনা করা হয়। দুরাকুটি একটি পাহাড়ি গ্রাম। এখানে রেললাইনের পশ্চিম দিকে প্রায় সমান্তরালভাবে অবস্থিত পাহাড়ি টিলার সারি। আর পূর্ব দিকে রেললাইনের প্রায় সমান্তরাল একটি কাঁচা রাস্তা দুরাকুটির উপর দিয়ে লালমনিরহাটকে। মােগলহাটের সাথে সংযুক্ত করেছে। কাঁচা সড়কের সাথে রেললাইনের দূরত্ব প্রায় ৩০০ গজ। পরিকল্পনা মােতাবেক ক্যাপটেন দেলােয়ার তাঁর দল নিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর ভােরে দুরাকুটিতে রেললাইনের উপর এক্সপ্লোসিভ কাঁচা সড়কের পূর্বে অবস্থান নেবেন। মূল আক্রমণের সময় পিছন থেকে মেজর নওয়াজেশের দল। মর্টার ফায়ার দেবে।
বর্ণনা
১৯৭১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ভােররাতে ক্যাপটেন দেলােয়ারের নেতৃত্বে ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা দুরাকুটি পৌছান। বিকাল ৫টার মধ্যে তারা রেললাইনের উপর অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন বসান। তারপর জিলেটিন, প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ এবং অন্যান্য বিস্ফোরক বসিয়ে দূরে সুইচ লাগিয়ে কাঁচা সড়কের আড় নিয়ে শত্রুর ট্রেনের অপেক্ষা করতে থাকেন। ঠিক সময়মতাে ১ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে ট্রেনটি এগিয়ে আসতে থাকে। ট্রেনের সামনের কয়েকটি বগিতে বালি ছিল। উল্লেখ্য, শত্রুরা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ বিশেষ করে বিস্ফোরক ও আকস্মিক হামলার ভয়ে ট্রেনের সামনের দিকে বালিভর্তি ওয়াগন নিয়ে চলাচল করতাে। পিছনের বগিগুলােতে অন্যান্য রসদের সাথে ছিল শত্রু সৈন্য। দুরাকুটি পৌছানাের সাথে সাথে অ্যান্টি-ট্যাংক মাইনের আঘাতে ট্রেনের ইঞ্জিনসহ সামনের কয়েকটি বগি বিধ্বস্ত হয়। মুক্তিবাহিনী একই সাথে ট্রেনের উপর গুলি ছুড়তে শুরু করে। পাকিস্তানি সেনারাও তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গােলাগুলির জবাব দেওয়া শুরু করে। তারা ট্রেন থেকে দ্রুত নেমে মুক্তিবাহিনীকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। অবস্থা বেগতিক দেখে ক্যাপটেন দেলােয়ার মুক্তিযােদ্ধাদের পিছু হটে যাওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি নিজে ১টি হালকা মেশিনগান (এলএমজি) নিয়ে শত্রুর উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। এর ফলে মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদে পিছনে সরে যেতে সক্ষম হন।
 এ অপারেশনে ২জন সাহসী মুক্তিযােদ্ধা শহিদ এবং ৪জন আহত হন। ক্যাপটেন দেলােয়ার নিজেও বাম হাতে গুলিবিদ্ধ হন। সে অবস্থাতেও তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত্রু নিধন এবং মুক্তিবাহিনীর নিরাপদে পিছু হটা নিশ্চিত করেন। এ দুঃসাহসিক অভিযান সফল করে তােলার জন্য পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সরকার তাকে ‘বীরপ্রতীক’ উপাধিতে ভূষিত করে। এ অভিযানে ৫জন শত্রু সৈন্য নিহত এবং অনেকে আহত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতারে এ অপারেশনের খবর প্রচারিত হলে অন্যান্য স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বেড়ে যায়।
শিক্ষণীয় বিষয়
অ্যামবুশ করার পরও শত্রুর দ্রুত পালটা আক্রমণ হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সেনারা অ্যামবুশে পড়া সত্ত্বেও দ্রুত মুক্তিযােদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। তাই, অ্যামবুশ শুরু হলে শত্রুর উপর তীব্র ফায়ারের মাধ্যমে আধিপত্য বজায় রাখা উচিত।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড