You dont have javascript enabled! Please enable it!
মীরগঞ্জ ও কিশােরগঞ্জের অপারেশন
কিশােরগঞ্জ ও জলঢাকা নীলফামারী জেলার ২টি থানা। জলঢাকা থানার মীরগঞ্জ স্কুল, হাট ও ব্যবসা কেন্দ্রের জন্য প্রসিদ্ধ। ডিসেম্বরের প্রথম দিকে ডােমার থানা মুক্ত করার পর মুক্তিযােদ্ধাদের ৭টি কোম্পানি নীলফামারী ও জলঢাকা থানার দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের পরিকল্পনা ছিল যে, উত্তর দিক থেকে মূল লক্ষ্য সৈয়দপুর সেনানিবাস এবং অবাঙালিদের অধিকৃত অঞ্চলের সর্ববৃহৎ আবাসস্থল সৈয়দপুর দখল করা এবং সব অবাঙালি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা করা। এরই এক পর্যায়ে ভারতীয় বাহিনীর ঐ অঞ্চলের অধিনায়ক। ব্রিগেডিয়ার জোশী এবং ওঁদের ডিভিশনাল/বিভাগীয় অধিনায়ক (যিনি ১জন মেজর জেনারেল ছিলেন) কর্তৃক মােহাম্মদ তাজুল ইসলাম এবং ৬ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক উইং কমান্ডার এম কে বাশারকে জানানাে হয় যে, মুক্তিযােদ্ধাদের পূর্বে ভারতীয় বাহিনী সৈয়দপুরে অবরােধ ও দখল করতে অগ্রসর হবে। অন্যথায় সৈয়দপুরে মুক্তিযােদ্ধা কর্তৃক ইতিহাসের ভয়াবহ গণহত্যা সংঘটিত হতে পারে। ঠিক সে কারণেই ভারতীয় বাহিনীকে সৈয়দপুর অবরােধ ও দখলের। জন্য অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে পাঠানাের পরিকল্পনা করা হয়। 
মুক্তিযােদ্ধাদের ৭টি কোম্পানি ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে জলঢাকা, মীরগঞ্জ ও কিশােরগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। পাকিস্তানিরা নীলফামারী থেকে তাদের বাহিনী সৈয়দপুরের দিকে প্রত্যাহার করে নেয়, যার ফলে নীলফামারীতে ব্যাপক প্রতিরােধ না হওয়ায় মুক্তিবাহিনী সহজেই নীলফামারী দখল করতে সক্ষম হয়। কিন্তু শক্রর সৈয়দপুর সেনানিবাস ও রংপুর সেনানিবাসের সাথে সরাসরি যােগাযােগ থাকার কারণে তারা কিশােরগঞ্জে একটি শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তােলে। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধাদের ৭টি কোম্পানি ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে তিন দিক থেকে এলএমজি, ৩ ইঞ্চি মর্টার ও অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রের সাহায্যে কিশােরগঞ্জ আক্রমণ করে। ১৫ ডিসেম্বর মধ্যরাতে শক্ররা তাদের সহযােগীদের লাশসহ পশ্চাদপসরণ করে সৈয়দপুর সেনানিবাস ও রংপুর সেনানিবাসে চলে যায়। এ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা হলেন: জি এম এ রাজ্জাক, মনির, সামসুল, নজরুল এবং আরও অনেকে। এ আক্রমণে ৭জন পাকিস্তানি নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। বললেই চলে।
লালমনিরহাট-মােগলহাট রেললাইন অপসারণ
লালমনিরহাট জেলা সদরের লালমনিরহাট-মােগলহাট রেললাইন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যাতায়াত ও রসদ পরিবহনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা এ রেললাইনের রত্নাই রেলসেতু ও কাঠানদিঘির মধ্যবর্তী স্থানে রেললাইন অপসারণের মাধ্যমে শক্রর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা করেন। ১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময় ঐ পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য মুক্তিবাহিনী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। রেললাইন অপসারণের স্থানটি ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ কাঠানদিঘিতে শক্রর আর্টিলারি গ্রুপের অবস্থান এবং রত্নাই রেলসেতুতে মজবুত বাংকারের এমজি পােস্ট। পুরাে কোম্পানিকে ৪ ভাগে বিভক্ত করে কাট অফ পার্টির দায়িত্বে দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ রত্নাই ব্রিজ কভার করা এবং উত্তর দিকে কাঠানদিঘির এলাকাও কভারে আনা। রিজার্ভ পার্টিকে রাস্তার পশ্চিমে রেখে মূল দল অতি সাবধানে রেললাইনের নির্ধারিত স্থানে বিস্ফোরক ও অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন স্থাপন করে। অতঃপর নিরাপদ দূরত্ব অতিক্রমের পর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে রেললাইন অপসারণ করা হয়। সাথে সাথেই উত্তর ও দক্ষিণ দিকের পাকিস্তানি অবস্থান থেকে তুমুল গােলা বর্ষণ করা হয়। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা নিরাপদ স্থানে চলে যায়। পরে গ্রামবাসীর মাধ্যমে জানা যায় যে, বিস্ফোরণে রেললাইন উড়ে গিয়ে বিরাট গর্তের সৃষ্টি হয় এবং এতে কয়েকজন শত্ৰু নিহত হলেও মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
মােগলহাটের অ্যামবুশ
মােগলহাট লালমনিরহাট জেলার সােজা উত্তরে ভারতের কাছাকাছি সীমান্ত এলাকার একটি রেল স্টেশন। এ অবস্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। শত্রুরা মােগলহাট অবস্থান থেকে আশপাশের এলাকায় নিয়মিত। টহল দিত। মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর এ টহলের উপর আক্রমণ কিংবা অ্যামবুশ করে। ক্ষয়ক্ষতি করার প্রয়াস চালাতেন। ভুরুঙ্গামারী, সােনাহাট, পাটেশ্বরী, নাগেশ্বরী, উলিপুর, চিলমারী, বড়বাড়ি, মােগলহাট, লালমনিরহাট, পাটগ্রাম, বুড়িমারী, হাতিবান্ধা, জলঢাকা, ডােমার, ডিমলা, দেওয়ানগঞ্জ, হেমকুমারী, নীলফামারী, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, খানসামা ইত্যাদি রণাঙ্গনে জুন মাসের শেষে এবং জুলাই। মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ জোরদার করা হয়। ১৯৭১ সালের ২ জুলাই রাতে একদল মুক্তিযােদ্ধা গীতালদহ ঘাঁটি থেকে। মােগলহাট পুলের কাছ দিয়ে ধরলা নদী অতিক্রম করে পাকিস্তানি অবস্থান মােগলহাটের পাশে দুপিকর জঙ্গলের মধ্যে অ্যামবুশ পেতে শক্রর আগমনের অপেক্ষা করতে থাকে। ভােরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এ রাস্তায় বের হওয়ার সাথে সাথে আক্রমণ ও গুলিবর্ষণ শুরু হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরাও পাল্টা । আক্রমণের চেষ্টা চালায়। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। এ যুদ্ধে প্রায় ৭-৮জন শত্রু নিহত হয়। স্বল্প সময়ের এ অভিযান শেষে। তড়িঘড়ি করে ফেরার পথে নিকটবর্তী গােলক মণ্ডলের জঙ্গলের শেষ প্রান্তে পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা অ্যান্টি-পার্সোনাল মাইন বিস্ফোরিত হয়ে কাজী। জাকির হাসান চন্দনের ডান পা উড়ে যায় এবং তিনি মারাত্মক আহত হন। সাথী মুক্তিযােদ্ধারা জাকিরকে কাঁধে নিয়ে নদীর পাড়ে এসে নৌকাযােগে গীতালদহ আসার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীর জিপে দ্রুত তাকে কুচবিহার। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!