You dont have javascript enabled! Please enable it!
মির্জাগঞ্জ রেলসেতু ধ্বংস
নীলফামারী জেলার ডােমার থানায় ডােমার-চিলাহাটি রেললাইনে মির্জাগঞ্জ রেলসেতুর অবস্থান। চিলাহাটি হাই স্কুলে পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প ছিল। শত্রু সৈয়দপুর থেকে জনবল ও রসদ পরিবহনের জন্য এ রেললাইনটি ব্যবহার করতাে বিধায় ব্রিজটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ২২ জুলাই পাকিস্তানি সৈন্যরা রসদ নিয়ে সৈয়দপুর থেকে চিলাহাটি স্কুল ক্যাম্পে যাচ্ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা সংবাদ পেয়ে শক্র পৌছার পূর্বেই মির্জাগঞ্জ রেলসেতু ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। কোম্পানি অধিনায়ক হামিদুল হকের নেতৃত্বে ২২জন মুক্তিযােদ্ধা ১১জন করে ২ দলে বিভক্ত হয়ে ব্রিজের কাছে পৌছেন। তারা দেখতে পান যে, শত্রুরা গ্রামবাসীদের জোর করে ব্রিজটি পাহারায় নিয়ােজিত করেছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধারা পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে ব্রিজের উত্তর পার্শ্বে রেললাইন উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর গ্রামবাসীর সহায়তায় এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে রেললাইন উড়িয়ে দেন। অপারেশন শেষে সবাই হিমকুমারী মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার দরুন পথিমধ্যে ভাজিনি নামক ছিটমহলের এক বাড়িতে সবাই আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
ঐ বাড়িতেই মুক্তিযােদ্ধারা চিলাহাটি শক্রর ক্যাম্প আক্রমণের নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ২৩ জুলাই রাত ১০টায় হামিদুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এ দলটি চিলাহাটি শক্রর ক্যাম্প আক্রমণ করে। একই সময় জি এম রাজ্জাকের নেতৃত্বে অপর ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল চিলাহাটি শত্রুর ক্যাম্পে আক্রমণ করে। এক দল অপর দলের পরিকল্পনা ও আক্রমণের সময় সম্পর্কে। জানত না। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে কাক্সিক্ষত সফলতা আসে নি। তথাপিও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ২-৩জন শত্রু নিহত এবং ৫-৭জন গুরুতর আহত হয়।
দেওয়ান বাড়ি রেইড
নীলফামারী জেলার ডােমার থানার উত্তরে চিলাহাটি একটি সীমান্তবর্তী স্থান। হেমকুমারী ক্যাম্পের সােজা দক্ষিণ ও পূর্ব পাশ দিয়ে যে রাস্তাটি চিলাহাটি হয়ে আমবাড়ির দিকে চলে গেছে, তার পাশেই শত্রুরা অবস্থান নিয়েছিল। স্থানটি ছিল চিলাহাটি থেকে এক-দেড় মাইল পূর্ব দিকে। স্থানের নাম কেতকিবাড়ি সীমান্ত। এটাই ছিল দেওয়ান বাড়ি শত্রুর ক্যাম্প। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় ক্যাপটেন নজরুল ইসলাম হেমকুমারী হয়ে শত্রুর ক্যাম্পে আক্রমণ চালানাের নির্দেশ দেন। কিন্তু আক্রমণের আগেই মুক্তিযােদ্ধারা নিজেরাই আক্রান্ত হন। হঠাৎ এক ঝাঁক গুলির। আওয়াজে হতভম্ব হয়ে যান তারা। নিজেদের সামলে নিয়ে তারাও পালটা জবাব দিতে শুরু করেন। পার্শ্ববর্তী চন্দখানা নামক স্থান থেকে শত্রুর আর্টিলারি গােলা নিক্ষেপের ফলে মুক্তিযােদ্ধারা হতভম্ব হয়ে পড়েন। মুক্তিযােদ্ধা আহমেদুল অবস্থান পরিবর্তন করে সরে যাওয়ার জন্য সামান্য মাথা উচু করতেই পর পর. ২টি গুলি এসে তার বক্ষ ও গলা ভেদ করে। মুনশি ইয়াকুবের চোখে পড়ে আহমেদুলের ঘাতক অন্যত্র সরে যাচ্ছে। প্রতিশােধের তীব্র উন্মাদনায় অস্ত্র তাক করে। ঘাতককে লক্ষ্য করে শেষ সম্বল ২টি গুলি ছুড়ে দিতেই ঘাতকের পিঠ ভেদ করে গুলি চলে যায়।  তিনি দেখতে পান যে, ১জন পাকিস্তানি সৈন্য তার দিকে বেয়নেট চার্জ করতে এগিয়ে আসছে। ইয়াকুবের কাছে কোনাে গুলি মজুত নেই এবং বেয়নেটও অস্ত্রের সাথে সংযুক্ত নেই। শত্রু কাছে আসতেই এসএলআর-এর মাথা ধরে বাট তুলে শত্রুর রাইফেলের মাথার উপরের অংশে মারতেই শক্রর চাইনিজ রাইফেল ছিটকে পড়ে গেল। শত্রুর চিবুক লক্ষ্য করে দ্বিতীয় আঘাত করতেই শত্রু লুটিয়ে পড়ল ধানক্ষেতের কাদার মধ্যে। মুনশি ইয়াকুব সহযােদ্ধা আহমেদুলের মৃতদেহ তুলে নিয়ে আসেন। হেমকুমারী বিএসএফ ক্যাম্পের পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
বােরাগাড়ি অ্যামবুশ এবং ডােমার দখল
নীলফামারী জেলার ডিমলা এবং ডােমার থানা একটি কাঁচা রাস্তা দ্বারা সংযােগ তৈরি করেছে। শুকনা মৌসুমে গাড়ি চলে। রাস্তার প্রায় মাঝামাঝি স্থানে তিস্তার শাখানদী বাঙালি (যা স্থানীয়ভাবে চারালকাঠা নদী নামেও পরিচিত)। এ নদীর উপর প্রায় ১৫০ ফুট লম্বা ব্রিজ। এলাকাটির নাম বােরাগাড়ি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ডিমলা, ডােমার, চিলাহাটি, জলঢাকা, দেবীগঞ্জ ইত্যাদি স্থানে চলাচলের জন্য বিশেষ করে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও রসদ বহনের জন্য এ রাস্তাটি ব্যবহার করত। ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা বােরাগাড়ির প্রায় ৫ মাইল উত্তরে গােমনাতি গ্রামে কার্টু চেয়ারম্যানের বাড়িতে অবস্থান নেন। প্রায় ৪২৫জন মুক্তিযােদ্ধা ৩টি কোম্পানিতে বিভক্ত ছিল। রাতে নেতৃস্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা (তাজুল, রাজ্জাক, হামিদ, নজরুল, মনির, সামসুল প্রমুখ) ডােমার থানা দখলের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করার জন্য আলােচনায় বসেন। ৩টি কোম্পানি ৩টি ভিন্ন পথে অগ্রসর হবে। তারা সিদ্ধান্ত নেন যে, যেহেতু বােরাগাড়ি ব্রিজটি ডিমলা ও ডােমারের একমাত্র সংযােগকারী সড়কের উপর অবস্থিত এবং যেহেতু শত্রুরা ব্রিজটি পাহারা দেয়, সেহেতু রণকৌশলগত ব্রিজটি দখল করা। অত্যাবশ্যক। ইতােমধ্যে শক্ররা মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সম্বন্ধে অবগত হয়ে রাতের শেষ দিকে তারা ৩ ইঞ্চি মর্টারের গােলা বর্ষণ করতে থাকেন। ক্রমেই এ গােলাবর্ষণ বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩টি ভিন্ন পথে ডােমার থানার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হয়।
যে কোম্পানিটি ডিমলা-ডােমার সড়কে এগিয়ে যাচ্ছিল, তারা আবিষ্কার করে যে বােরাগাড়ি ব্রিজটি শক্ররা বিস্ফোরক দিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। শক্রর পরিত্যক্ত বাংকার খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় যে, ১জন শত্রু সৈন্য রাইফেল হাতে বাংকারের ভিতর ঘুমিয়ে আছে। তার নাম বশির খান। পাকিস্তানি সৈন্যরা মর্টার ফায়ারের কভারে পিছিয়ে যায়। বাংকার থেকে প্রচুর গােলাবারুদ দখল করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা যখন ডােমার পেীছেন, ততক্ষণে পাকিস্তানি সৈন্যরা নীলফামারী, রংপুর ও সৈয়দপুরের দিকে বিচ্ছিন্নভাবে পশ্চাদপসরণ করে। এ অভিযানে শক্রর তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি বলে ধারণা করা হয়। ১জন যুদ্ধবন্দি, ১টি রাইফেল এবং প্রচুর গুলি দখল করে মুক্তিযােদ্ধারা।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!