You dont have javascript enabled! Please enable it!
মির্জাপুর ১৬ নম্বর ইউনিয়নে যুদ্ধ
রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার রাস্তার পূর্ব দিকে মির্জাপুর ১৬ নম্বর ইউনিয়নটি থানা থেকে পূর্বে অবস্থিত। ৭জন মুক্তিযােদ্ধা এ ইউনিয়নের একটি বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ৪৫জন রাজাকারসহ পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে হিন্দুদের বাড়িঘরসহ কয়েকটি গ্রাম লুণ্ঠন করার পর মাকড়া। বাজারের ক্লাবে অবস্থান নেয়। ৭জন মুক্তিযােদ্ধা এবং এলাকার কয়েকজন সাহসী যুবক একসাথে বেলা ১১টায় অতর্কিতে ক্লাবে অবস্থানকারী শত্রুর উপর আক্রমণ করেন। ঘটনাস্থলেই ৪-৫জন শত্ৰু নিহত হয় এবং অন্যান্য সবাইকেই জীবিত ধরা হয়। তাদের নাম ছিল হাফিজার, আবদুল কুদুস, হেলাল, নূরুল ইসলাম ও লুতু। পরবর্তী সময় ঘাঘট নদীর মজিদের ঘাটে ধৃত লােকদের হত্যা করা হয়। এর ফলে ২৪ নভেম্বর রাজাকারসহ পাকিস্তানি সৈন্য এসে গ্রামের বাড়িঘর লুণ্ঠন করে এবং প্রায় সব বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। এ যুদ্ধে আবুল হােসেন নামে ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং মজিদের। ঘাটেই তাকে সমাহিত করা হয়।
শঠিবাড়ির যুদ্ধ
ভূমিকা শঠিবাড়ির যুদ্ধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক, যুদ্ধের পরিচালনা কৌশল অত্যন্ত উন্নতমানের ছিল। অপেক্ষাকৃত কম আগ্নেয়াস্ত্র ও জনবল সজ্জিত একটি বাহিনীর অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় যুদ্ধ করে এ শঠিবাড়িতে আমাদের স্বাধীনতা আনে মুক্তিযােদ্ধারা। এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা তিস্তার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত শঠিবাড়ি বন্দর দখল করে যােগাযােগ ব্যবস্থা ও রসদ সরবরাহের পথ উন্মুক্ত করেন। উদ্দেশ্য শঠিবাড়ির যুদ্ধ সম্বন্ধে সম্যক ধারণা প্রদান করা। অবস্থান রংপুর জেলা সদরের সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা কাউনিয়া। এ উপজেলাতেই পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত বিখ্যাত তিস্তা নদী। তিস্তার গা ঘেঁষে শঠিবাড়ি বন্দরের অবস্থান। তিস্তার গড় প্রশস্ততা শঠিবাড়ি বন্দরের সামনে ছিল প্রায় ৪০০ গজ। পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ছিল নিমরূপ: ক. পাকিস্তান সেনাবাহিনী: পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা  অবস্থান ছিল শঠিবাড়ি বন্দরের দক্ষিণ-পশ্চিমে, যা প্রায় তিস্তা নদীর দক্ষিণ দিক ঘেঁষে উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করে ছিল। দীর্ঘ ৬ মাস ধরে প্রস্তুতকৃত সিমেন্টের মজবুত বাংকার ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষার প্রধান অবলম্বন। মুক্তিবাহিনী: মুক্তিবাহিনী তিস্তা নদীর অপর প্রান্ত অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব। দিকে আরও ৫০০ গজ দূরে অবস্থান নিয়েছিলেন। রণকৌশলগত গুরুত্ব। শঠিবাড়ি বন্দর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টরের লাইন অব কমিউনিকেশন (LOC) রক্ষা করার জন্য একই অবস্থান দখল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। রণকৌশলগত দিক বিবেচনা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মেজর হায়াত ৬ মাসে স্থানটিতে শক্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল।
রেকি
ভৌগােলিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ শঠিবাড়ি পাকিস্তানি বাহিনীর কবল হতে মুক্ত করার জন্য কোম্পানি ৭-এর অধিনায়ক হারেস উদ্দিন সরকার প্ল্যাটুন এবং সেকশন পর্যায়ের অধিনায়ক ও প্রতিনিধি নিয়ে ১টি শক্তিশালী রেকি দল গঠন করেন। তারা শঠিবাড়ি বন্দর এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পর্যবেক্ষণ চালিয়ে ভূমির কৌশলগত অবস্থান, শত্রুর গতিবিধি ও আচরণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করেন। যুদ্ধের সংগঠন | ক, পাকিস্তান সেনাবাহিনী: ১টি পদাতিক কোম্পানি, ২টি ইপিসিএএফ কোম্পানি, কোম্পানির ভারী অস্ত্র: ৬x২ ইঞ্চি মর্টার এবং ১x৩ ইঞ্চি মর্টার। খ. মুক্তিবাহিনী: ৩১৫জন মুক্তিবাহিনীর সদস্য।
যুদ্ধের অগ্রসরতা
পাকিস্তান সেনাবাহিনী সিমেন্টের তৈরি বাংকারে নিজেদের প্রতিরক্ষাকে ৬ মাস যাবৎ শক্তিশালী করে রেখেছিল এবং তাদের ধারণা ছিল যে, মুক্তিবাহিনী আদৌ তাদের প্রতিরক্ষা মােকাবিলা করতে সক্ষম নয়। মুক্তিবাহিনী অদম্য সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও সুপরিকল্পনার মাধ্যমে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখে। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা পাকা সিমেন্টের বাংকার গড়ে তােলেন। শঠিবাড়ি বন্দরের পূর্ব ও উত্তর দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০০০ গজ দূরে এসব বাংকার তৈরি করে মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের মনােবল বাড়িয়ে তােলেন। এ সময় মুক্তিযােদ্ধা ও পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের অবস্থান থেকে মাঝে মাঝে গুলি। বিনিময় করতে থাকে। ২ সেপ্টেম্বর রাত ৩টায় অধিনায়ক নিজে এসএলআর নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থানে ফায়ার শুরু করেন। শুরু হয় মরণপণ যুদ্ধ। হারেসের সহযােদ্ধারা প্রতিজ্ঞা করেন যে, শঠিবাড়ি বন্দর দখল না করে তারা পিছু ফিরবেন না।  শঠিবাড়ি হাই স্কুলের ভিতর নির্মিত দুর্ভেদ্য ঘাঁটি থেকে শেল বর্ষণ করে পাকিস্তানি সেনারা। শুরু হলাে তুমুল যুদ্ধ। পাকিস্তানি সৈন্যদের মুহুর্মুহু শেল ও রকেটের আঘাত এসে পড়ছিল মুক্তিবাহিনীর উপর। ভাঙছে বাংকার, আহত হচ্ছেন মুক্তিযােদ্ধারা। তাদের ধরাধরি করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পিছনে। সমান গতিতে যুদ্ধ চলছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটছে না। একদিকে কমান্ড করছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুর্ধর্ষ মেজর হায়াত, অন্যদিকে শ্যামল বাংলার এক তরুণ বীর হারেস উদ্দিন সরকার।
এক বাহিনী ছুড়ছে কামানের গােলা, রকেট ও শেল আর অন্য বাহিনী ২-১টি এলএমজি আর .৩০৩ রাইফেল দিয়ে তার জবাব দিচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। ৪ সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল থেকে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়ে গেলাে। হারেস উদ্দিন সরকার কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে পর পর কয়েকটি সম্মুখের বাংকার পার হয়ে অগ্রসর হয়ে গেলেন সামনের দিকে। এলএমজি’র নিখুঁত আঘাত হানলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান অবস্থান শঠিবাড়ি স্কুলের ভিতরের বাংকারে। দুপুর ১২টার দিকে চাঞ্চল্য দেখা গেল পাকিস্তানি সৈন্যদের বাংকারে ও প্রতিরক্ষা অবস্থানে। দ্বিগুণ শক্তিতে হারেসের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা ছুটে যেতে লাগলেন সম্মুখে। শঠিবাড়ি বন্দর আর কয়েক মিনিটের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের করায়ত্ত হবে। প্রতিটি বাংকারের মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুদের ফায়ার করে ব্যস্ত রাখছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের প্রতিরক্ষা লাইন ছেড়ে পিছনে হটে যাচ্ছে। হারেস ও তার দল বুকে .৩০৩ রাইফেল চেপে ধরে সম্মুখে গড়িয়ে। গড়িয়ে দখল করছেন সামনের ভূমি। মরিয়া হয়ে টিপে যাচ্ছেন ৩০৩ রাইফেলের ট্রিগার। এক তরুণ মুক্তিযােদ্ধার কমান্ডে এগিয়ে আসছে .৩০৩ রাইফেল হাতে বাঙালি তরুণ যােদ্ধারা। অব্যর্থ গুলি ছুড়ছেন শত্রুর বাংকারে। ৪ সেপটেম্বর সূর্য ডােবার আগেই শঠিবাড়ি বন্দর মুক্ত হয়ে যাবে, এ কথা কোম্পানি অধিনায়ক হারেস উদ্দিন ঘােষণা করে দিলেন। মুক্তিযােদ্ধারা গুলি চালিয়ে যাচ্ছেন শত্রুর প্রতিটি বাংকারে। শঠিবাড়ি বন্দর জয় করলেন। মুক্তিযােদ্ধারা। ৪ সেপ্টেম্বর শঠিবাড়ি বন্দরে যখন মুক্তিযােদ্ধারা স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের জন্য উদ্যোগ নিচ্ছেন তখন পশ্চিম গগনে সূর্য ঢলে পড়েছে, ঠিক সে সময় উড়ে এল ২টি হেলিকপটার। হারেস উদ্দিন ও তার বাহিনীর বাংকারের পজিশনে বৃষ্টির মতাে বােমা ফেলল তারা। আক্রোশে, ক্ষোভে মুক্তিযােদ্ধারা এলএমজি’র ফায়ার করলেন।
প্রায় ২ ঘণ্টা ধরে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন পজিশনে। বােমা বর্ষণ করে হেলিকপটার ২টি চলে গেল। ডান পায়ে, ডান হাতে ও কপালে বােমার আঘাতে আহত হলেন হারেস উদ্দিন, যিনি ছিলেন ৩১৫জন মুক্তিযােদ্ধার বীর নায়ক। আহত হলেন আরও অনেকে। নিমেষেই নিভে গেল। মুক্তিযােদ্ধাদের জয়ের আশা। রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত আহতদের ব্যান্ডেজ ও প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু হলাে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল ৬ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরের সাথে সকল যােগাযােগ। খাবার ও অন্যান্য সামগ্রীর উপর বােমা পড়ায় সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল। যদিও অস্ত্র ও গােলাবারুদের তেমন কোনাে ক্ষতি হয় নি। মুক্তিযােদ্ধাদের বাংকার ও ডিফেন্স থেকে গুলি বন্ধ হওয়ায় পাকিস্তান। সেনাবাহিনী নতুন উদ্যমে গুলি বর্ষণ শুরু করল। ৪ সেপটেম্বর রাতে অনেক মুক্তিযােদ্ধা যখন হতাশ হয়ে পড়ছিলেন তখন রক্তাক্ত কোম্পানি অধিনায়ক চিল্কার করে বললেন, “যুদ্ধ চলবে, মৃত্যু পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না। কাউকে যদি পিছনে তাকাতে দেখি, এ আহত অবস্থায় তার। উপর আমি গুলি চালাব। জন্মভূমির বুকে বীরের মতাে লড়ে প্রাণ দাও সবাই। সদর দপ্তর থেকে আমরা ৩০০জন বিচ্ছিন্ন, বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। ধরে নাও আমরা সবাই মরে গেছি।” তিনি সবাইকে অনুরােধ করে বললেন, “মৃত্যুর আগে একবার শেষ লড়াই লড়ে যাও। মুখে কলেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ বলে এসাে মাকে মুক্ত করার জন্য আমরা এখানে মরে যাই।” মুক্তিযােদ্ধারা প্রাণ ফিরে পেলেন। আবার ফিরে গেলেন বাংকারে। হাতে তুলে নিলেন ৩০৩ রাইফেল। এমনিভাবে পার হয়ে গেল ৪ সেপটেম্বর রাত। ৫ সেপটেম্বর সারাদিন যুদ্ধ চলল। সন্ধ্যায় দুই পক্ষের ফায়ার বন্ধ হলাে। সারারাত আহতদের সেবা শুশ্রুষা হলাে। | ৬ সেপ্টেম্বর ভােরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৬ ইঞ্চি মর্টার ও রকেট লঞ্চার দিয়ে তুমুল আক্রমণ শুরু করল। এদিকে খাবার নেই মুক্তিযােদ্ধাদের। আড়াই দিন পার হয়ে যাচ্ছে।
পানি খেয়ে ও লতাপাতা চিবিয়ে বেঁচে আছেন ৩১৫জন মুক্তিযােদ্ধা। শুধু ব্যান্ডেজ বেঁধে আহতরা পড়ে আছেন বাংকারে। সামনের দিক থেকে ছুটে আসছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কামানের গােলা, মেশিনগানের গুলি। সবকিছু অনিশ্চিত। সব দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন মুক্তিযােদ্ধারা লড়াই চালিয়ে গেলেন। সবকিছু অনিশ্চিত জেনেও জীবন বাজি রেখে লড়ে গেলেন শঠিবাড়ি বন্দরে। ৬ সেপ্টেম্বর রাত ৮টায় শঠিবাড়ির ডান দিকের মুক্তিযােদ্ধারা আকস্মিকভাবে ৩০০ গজ ছুটে গিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের কয়েকটি প্রতিরক্ষা অবস্থান দখল করে নেন। এটা ছিল একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপ। ঐ প্রতিরক্ষা লাইনে ছিল প্রায় ১৫০জন রাজাকার, তারা অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে। আহত কোম্পানি অধিনায়কের নির্দেশ মােতাবেক রাজাকারদের মুক্তিযােদ্ধাদের ফ্রন্ট লাইনে বসিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে গুলি চালানাের আদেশ দেওয়া হয়। ধৃত রাজাকাররা সে আদেশ পালন করলাে। এর ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল। বেড়ে যায়। চাঙা হয়ে ওঠেন তারা। ৬ সেপটেম্বর সারারাত গুলি আর পালটা গুলি চলতে থাকে। ৭ সেপটেম্বর ভােরে পাকিস্তানি সৈন্যরা অবস্থান ত্যাগ করে নীলফামারীর দিকে পালিয়ে যায়। ৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ২০ মিনিটে শঠিবাড়ি বন্দরের বুকে উঠল মুক্তির পতাকা।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয়ের কারণ
দুর্বল নির্দেশনা
যদিও মেজর হায়াত ৬ মাস ধরে শঠিবাড়ি বন্দর এলাকায় নিজস্ব বাহিনী নিয়ে অবস্থান করেছে, তারপরও সুপরিকল্পিত নির্দেশনার অভাবে পাকিস্তানি বাহিনীকে শঠিবাড়ি এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় মজবুত প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়।
ত্রুটিপূর্ণ রি-ইনফোর্সমেন্ট
মুক্তিযােদ্ধারা ২-৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর উপর অনবরত হামলা চালালে মেজর হায়াত পাকিস্তানি বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কাছে আরও অধিক সৈন্য শঠিবাড়ি বন্দরে প্রেরণের কথা জানান। কিন্তু যথাসময় প্রয়ােজনীয় রি-ইনফোর্সমেন্টের অভাবে তাদের পরাজয় বরণ করতে হয়।
জনগণের সহায়তার অভাব
৬ মাস ধরে অবস্থানের ফলে শঠিবাড়ি এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী নারী, শিশু ও সাধারণ জনগণের উপর অত্যাচার চালায়। এর ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর জনগণের বিরূপ মনােভাবের সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময় মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি বাহিনী স্থানীয় জনগণ থেকে কোনােপ্রকার সহায়তা লাভে ব্যর্থ হয়।
পূর্ব সতর্কতার অভাব
ভূমি সম্বন্ধে উপযুক্ত জ্ঞান, আবহাওয়া এবং মুক্তিবাহিনীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর মােকাবিলায় ব্যর্থ হয়।
নিচু মনােবল
স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার পিছনে পাকিস্তানি বাহিনীর কোনাে যুক্তিসংগত কারণ ছিল না। উপরন্তু অপরিচিত এলাকায় অবস্থানের ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল সব সময় নিচু ছিল যা যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ
উপযুক্ত কারণ
শঠিবাড়ি বন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ছিল দেশ ও জাতির জন্য একটি হুমকিস্বরূপ। নারী, শিশু এবং সাধারণ জনগণের উপর পাকিস্তানি বাহিনী যে অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচার চালিয়েছে, তার উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য এবং মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য মুক্তিবাহিনী হাতে অস্ত্র এবং গ্রেনেড তুলে নিয়েছিল। তাদের এ সংগ্রামের পিছনে ছিল একটি মহৎ, আন্তরিক ও সৎ উদ্দেশ্য, যা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় ছিনিয়ে আনতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
জনসাধারণের সহায়তা
দীর্ঘদিন যাবৎ অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের কারণে সাধারণ জনগণ মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আশা করেছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী যখন যুদ্ধ আরম্ভ করেছিল, তখন স্থানীয় জনগণ মুক্তিবাহিনীকে থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে সহযােগিতা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রণকৌশলগত গতিবিধিসহ যে-কোনাে ধরনের তথ্য প্রদান করে সহায়তা করেছিল। আবহাওয়ার অবস্থা আবহাওয়া মুক্তিবাহিনীর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছিল। সে সময় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিকে তারা নিজস্ব কভার হিসেবে ব্যবহার করেছিল। বৃষ্টির ফলে মুক্তিবাহিনীর চলাচলের শব্দ পাকিস্তানি বাহিনী শুনতে পারে নি, একই সাথে খুব কাছ থেকেও পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান বুঝতে ব্যর্থ হয়। সৈনিকদের মনােবল ও শৃঙ্খলা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেকটি সৈনিকের মনে ছিল একটি সৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য। মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য তারা ছিলেন বদ্ধপরিকর।
মাতৃভূমির জন্য নিজের জীবনও ছিল তাঁদের জন্য মূল্যহীন। যে-কোনাে পরিস্থিতিতে তাদের মনােবল ছিল পর্বতের ন্যায় অটল। যে-কোনাে আদেশ তারা সুশৃঙ্খল ও উঁচু মনবলের সাথে সম্পন্ন করেছিলেন। শিক্ষণীয় বিষয় উপযুক্ত কারণ। পৃথিবীর যে-কোনাে যুদ্ধে বিজয়ের পূর্ব শর্ত হলাে একটি যুক্তিসংগত কারণ। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন ও জুলুম থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য মুক্তিবাহিনী সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। অন্যদিকে, এ যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর কোনাে যুক্তিসংগত কারণ ছিল না। জনসাধারণের সহায়তা। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য স্থানীয় জনগণ মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল, যার ফলে মুক্তিবাহিনীর বিজয় সহজতর হয়েছিল। আবহাওয়ার অবস্থা সাধারণ জনগণের জন্য সুবিধাজনক না হলেও সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে শত্রুকে পরাজিত করার জন্য প্রতিকূল ও বিরূপ আবহাওয়া একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যুদ্ধ চলাকালীন বৃষ্টি মুক্তিবাহিনীর জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছিল।
ভূমির অবস্থান
নিজ ভুমিতে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় সম্ভব হয়েছিল। তাই যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য ভূমির অবস্থান অত্যন্ত জরুরি বিষয়। সুযােগ্য নেতৃত্ব ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি নিজ দেশমাতৃকার জন্য আল্লাহর নামে কসম খেয়ে অধিনায়ক সবাইকে বাংকারে ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেন বিধায় সবাই পূর্ণ জীবন লাভ করে পুনরায় যুদ্ধ শুরু করে। ফলে এ অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে যুদ্ধজয় সম্ভব হয়েছিল।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!