জলপাইতলী আক্রমণ
দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি থানার অন্তর্গত জলপাইতলী বিওপিটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় জলপাইতলী ইপিআর ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প দখল করার জন্য ভারতের অভ্যন্তরস্থ কাটলা মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পে পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনা। মােতাবেক এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা মাে. মােজাফফর আলী ও মাে. আবদুল জলিল নেতৃত্ব প্রদান করেন। আনুমানিক ৬০-৭০জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল বিওপিকে চারদিক থেকে গােপনে ঘেরাও করে এবং দুপুর ৩টায় ১টি এলএমজি দিয়ে ২০০ গজ দূর থেকে প্রথমে ফায়ার করা হয়। সংকেতের সাথে সাথে অবরুদ্ধ শক্রর উপর চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে মিত্র বাহিনীর ২০-২৫জন সদস্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। আনুমানিক ১ ঘন্টা যুদ্ধের পর বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ঘাটিটি মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর মােয়াজ্জেম হােসেনসহ মােট ২জন শহিদ হন।
ত্রিশালের যুদ্ধ
দিনাজপুর জেলার সদর থানার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ত্রিশাল অবস্থিত। এখানে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। ক্যাম্পটি একটি বড় পুকুর পাড়ে অবস্থিত। পুকুর পাড়ের চারদিকে বাংকার। ক্যাম্পের সামনে ৪০০ গজ দূরে আত্রাই নদী। এ নদীটিই ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্ত নির্ধারণ রেখা। নদীর পাড় ঘেঁষে সমান্তরালভাবে চলে গেছে ডাঙ্গারহাট-বালুরঘাট পাকা রাস্তা। ত্রিশাল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে অবস্থিত ডাঙ্গারহাট বাজার। বাজারের ওপারে আত্রাই নদীর পাড়ে অবস্থিত শত্রুর সীমান্ত ফাঁড়ি। ত্রিশাল ক্যাম্পের উত্তর দিক দিয়ে চলে গেছে দিনাজপুর-ফুলবাড়ি পাকা সড়ক। ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। সকাল থেকে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জামের হিসাবনিকাশ নিয়ে ব্যস্ত মুক্তিযােদ্ধারা। সকাল ৯টার সময় ভারতীয় ক্যাপটেনের তাঁবুতে অধিনায়ক এ টি এম হামিদুল হােসেন তারেকের ডাক পড়ে। তাবুতে ঢুকেই দেখতে পেলেন আরও ৩জন সেনাবাহিনীর অফিসার বসে আছেন। ক্যাপটেন থাপা সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে পূর্বের অপারেশন সম্বন্ধে তাদের ব্যাখ্যা করলেন। তারপর তিনি যা বললেন তা হলাে, আর ভিতরে যাওয়ার প্রয়ােজন নেই। কারণ, একটি স্পেশাল অপারেশন করতে হবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযােগিতায়। আগামীকাল দল বাছাই শুরু হবে এবং ঐ অপারেশনে প্রায় ১৫০জন মুক্তিযােদ্ধার প্রয়ােজন হবে। রাতেই আবার ডাক পড়ল ক্যাপটেন থাপার তাঁবুতে। “তারিক, ডু ইউ নাে দ্য পাকিস্তানি পজিশন অ্যাট ত্রিশাল?” “ইয়েস স্যার, ইট ইজ অন দ্য হােম ব্যাংক অব রিভার আত্রাই অ্যাডজাসূন টু ডাঙ্গারহাট।”
“ইয়েস ইউ আর রাইট, ওয়ান প্লাটুন অব পাঞ্জাব রেজিমেন্ট উইথ এ প্লাটুন অব রাজাকার আর ডিপ্লয়েড দেওয়ার। ইউ হ্যাভ টু অ্যাটাক দ্যাট ক্যাম্প অ্যান্ড ডেস্ট্রয় ইট।” তারেক একটু হকচকিয়ে গেলেন, কারণ সম্মুখযুদ্ধ বা কনভেনশনাল ওয়ারে তার ও দলের কোনাে অভিজ্ঞতা নেই। ক্যাপটেন ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “ইউ ডােন্ট হ্যাভ টু ওরি, ইন্ডিয়ান আর্মি উইল বি উইথ ইউ অ্যান্ড দেওয়ার অফিসারস উইল গাইড ইউ। দে আর কামিং টুমরাে।” পরদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপটেন পদমর্যাদার ৩জন অফিসার এসে পুরাে অপারেশনটা কীভাবে হবে তারেককে বুঝিয়ে দিলেন। আক্রমণের পরিকল্পনা করা হলাে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে। বর্তমান অবস্থান, বড়হর ক্যাম্প থেকে অ্যাসেমব্লি এরিয়া মানে সমাবেশ এলাকায় যেতে হবে। সমাবেশ এলাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান থেকে পশ্চিমে ভারতীয় ডাঙ্গারহাট সীমান্ত ফাড়ির পূর্ব কোণের গ্রামের ভিতরে। ওখানে অবস্থানের পর মুক্তিযােদ্ধারা যাবেন এফইউপি বা ফর্মিং আপ প্লেসে। ওখান থেকে সারিবদ্ধভাবে আক্রমণ করা হবে। আক্রমণ করতে হবে ঠিক প্রথম প্রহরে। এর পরের প্ল্যান অধিনায়ক ছাড়া। আর কাউকে বলা নিষেধ ছিল গােপনীয়তার জন্য। ২ দিনে পুরাে দলটাকে নিয়ে রিহার্সেল করলেন তারেক। ক্যাম্প থেকে একটু দূরের একটা গ্রামকে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের সহায়তায় পুরােপুরি রিহার্সেল চালিয়ে গেলেন তিনি। অবশেষে রাতের বেলায়ও কী ভাবে নিজ অবস্থান থেকে অ্যাসেমব্লি এরিয়ায় যেতে হয়, কীভাবে ফর্মআপ করতে হ ভাব চূড়ান্ত রিহার্সেল করা হলাে।
এর মধ্যে অনেকে প্রশ্ন করেছে, কোথায় এবং পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর কোন ক্যাম্প আক্রমণ করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু গােপনীয়তার খাতিরে কাউকে কিছু জানানাে হয় নি। অবশেষে ৮ নভেম্বর এলাে কাঙ্ক্ষিত দিনটি। সকালে তারেককে বিশেষভাবে নির্দেশ দেওয়া হলাে কী করতে হবে। ইতােমধ্যে ভাবতীয় সেনাবাহিনীর তরফ থেকে তিনি যােগাযােগের জন্য ১টি ওয়্যারলেস সেট পেয়েছেন। পুরােপুরি সামরিক কায়দায় দলকে সাজানাে হয়েছে আসন্ন আক্রমণের জন্য। দুপুরে খাওয়ার পর সবাইকে পুরাে পরিকল্পনাটা জানানো হলাে। মাটিতে একটি মডেল তৈরি করে তার উপরই সবাইকে বিস্তাবি_7: বলা হলাে, কার কী কাজ এবং কী করতে হবে। | পাকিস্তানি সৈন্যদের ত্রিশাল ক্যাম্পটি আক্রমণ করা হবে পূর্ব দিক থেকে। প্রথমে উত্তরে সমাবেশ এলাকায় যাবে, ওখান থেকে পূর্বে এসে এফইউপি বা বিন্যাসভূমিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে জয় বাংলা হুংকারে ঝাপিয়ে পড়বে শত্রুর অবস্থানের উপর। সন্ধ্যায় সবাই তৈরি। প্রত্যেকের হাতের অস্ত্র, গােলাবারুদ। পরীক্ষা করে নিলেন অধিনায়ক নিজে। রাত ৯টায় সবাই সিঙ্গেল লাইনে। সমাবেশ এলাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। গ্রামের পায়ে চলা মেঠো পথ। নিঝুম রাত, ঝিঝি পােকার একটানা সুরের গান, দূর গ্রাম থেকে ভেসে আসছে কুকুরের চিঙ্কার। নভেম্বরের রাতের শিশিরে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যানভাসের জুতাে ভিজে গেছে। সারিবদ্ধভাবে অন্ধকারে। মুক্তিযােদ্ধার দল। হাতে রাইফেল, বুকে অদম্য সাহস, দেশ স্বাধীনের প্রতিজ্ঞা। নিঃশব্দে একটানা হাঁটার পর মুক্তিযােদ্ধারা পৌছেন সমাবেশ এলাকায়। সমাবেশ এলাকার করণীয় কাজগুলাে ঝটপট করার জন্য আদেশ দিলেন অধিনায়কদের।
সমাবেশ এলাকায় কাজগুলাে ছিল নিম্নরূপ: লােকাল প্রােটেকশন বা সমাবেশ এলাকার প্রতিরক্ষা; • চূড়ান্তভাবে সবার হাতিয়ার ও গােলাবারুদ পরিষ্কার করা; • কে কার পরে যাবে; • অর্ডার অব মার্চ পুনরায় চেক করা; ওয়্যারলেস সেট চেক করা, যাতে কমিউনিকেশন ঠিক হয় চূড়ান্ত সময়ে; • সবাইকে নির্দেশ দেওয়া পরবর্তী কাজের জন্য এবং • হালকা খাবার যা তাদের সঙ্গে ছিল, তা বিতরণ। রাত সাড়ে ৩টায় সমাবেশ এলাকা থেকে ওঁরা রওনা দিলেন বিন্যাসভূমির উদ্দেশ্যে। কোনাে শব্দ না করে অতি সাবধানে হাঁটছেন সবাই। এফইউপিতে পৌছার আগেই যদি শত্রু টের পেয়ে যায় মুক্তিযােদ্ধাদের উপস্থিতি, তবে ক্ষতিসাধন করতে ওরা তৎপর থাকবে এবং সব আক্রমণের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাবে। ভাের সাড়ে ৪টার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা বিন্যাসভূমিতে পৌছে সবাই এক লাইনে, যাকে বলে অ্যাসল্ট লাইনে দাড়িয়ে গেলেন। সামরিক কৌশল মােতাবেক বিন্যাসভূমিতে ১০-১৫ মিনিটের বেশি থাকা চলে না। সবাই আদেশের অপেক্ষায় রইলেন। হাতের রাইফেল সমান্তরালভাবে সম্মুখে ধরা, ট্রিগারে আঙুল। সরাসরি একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর উপর আক্রমণ। পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পটি মাত্র ৪০০ গজ দূরেই। আদেশ এল আক্রমণের। ‘জয় বাংলা’ চিকারে মুক্তিযােদ্ধারা দৌড়ে চললেন শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে। অনবরত লক্ষ্যবস্তুর উদ্দেশ্যে রাইফেল গর্জে উঠছে। হঠাৎ করে এভাবে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না পাকিস্তানি সৈন্যরা। মুক্তিযােদ্ধারা যখন ৩০০ গজ দূরে, তখন ওরা বাংকার থেকে এলএমজি দিয়ে ফায়ার করল। আবারও জয় বাংলা বলে চিৎকার করে মুক্তিযােদ্ধারা ছুটে গেলেন বাংকারের দিকে এবং অনবরত গুলি করতে থাকেন। | এ যুদ্ধে ৩জন শক্র নিহত হয়, কিন্তু আহতের সংখ্যা জানা যায় নি। অন্যরা পালিয়ে যায়। যুদ্ধের স্থান থেকে ১টি ওয়্যারলেস সেট, ১টি চাইনিজ ভারী মেশিনগান, ১টি এসএমজি, ৯টি .৩০৩ রাইফেল এবং বিভিন্ন অস্ত্রের প্রচুর গুলি উদ্ধার করা হয়। এ যুদ্ধে কোনাে মুক্তিযােদ্ধা শহিদ না হলেও ১জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন।
বহলা গ্রামে আক্রমণ
দিনাজপুর জেলার বিরল থানার একটি গ্রামের নাম বহলা। দিনাজপুর সদর থেকে পশ্চিমে বিরল থানার টাঙন নদীর তীরে এ গ্রামের অবস্থান। বিরল থানায় বারবার হানা দিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানকে নিয়ে বিরল থানার গ্রামগুলাে শক্ররা ঘুরে গেছে, কয়েকবার। হুমকি ধমকি দিয়েছে বহুবার। বিরলের বহু ছেলে তখন মুক্তিযুদ্ধে। বহলার তরুণেরা তখন দুর্ধর্ষ জর্জ গ্রুপে। বিরলের মাটিতে শত্রু পা ফেলেছে, নিমেষে মুক্তিদের গােপন ডেরায় খবর পৌঁছে গেছে। বিনা এনকাউন্টারে কোনাে দিন শত্রু বেরােতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর বিরলে মারা পড়ল ২জন পাকিস্তানি সৈন্য। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মােহাম্মদ হােসেন ২জন পাকিস্তানি সৈন্যসহ মুক্তিযােদ্ধাদের খোঁজে আসে। কিন্তু খুঁজে না পেয়ে ৭ দিনের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের খবর না দিলে বিরলে কেউ বেঁচে থাকতে পারবে না বলে তারা চলে যায়। ভীত না হয়ে আবার আঘাত হানলেন মুক্তিযােদ্ধারা। এভাবে বিরল এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে বার বার মার খেয়েছে শক্র। এ এলাকায় গাড়ি চলাচল করার মতাে রাস্তাঘাট না থাকায় শত্রুকে পায়ে চলাচল করতে হতাে এবং গ্রামের লােকেরা দ্রুত ওদের চলাচলের খবর পৌছে দিত মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে। বাঁশের ঝাড়, ঝোপজঙ্গল, কলাগাছের ফাক থেকে ছুটে আসত জর্জ গ্রুপের মুক্তিযােদ্ধারা। এভাবে বহুবার হতাহত হয়েছে শক্র। শক্রর সবচেয়ে বেশি হতাহত হয়েছে যে বহলা গ্রামে, সেখানে তারা কোনাে মুক্তিযােদ্ধাকে দেখতে পায় নি কোনাে দিন। বহলার কাউকে জিজ্ঞেস করে কোনাে মুক্তিবাহিনীর সন্ধান জানতে পারে নি। ১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা বহলা গ্রামের ৪৬জন মানুষকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। বহলা গ্রামের মুক্তিযােদ্ধাদের চোরাগােপ্তা হামলায় বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়েছে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড