You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভাতুরিয়ায় আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার অন্তর্গত হরিপুর থানার সীমান্ত এলাকায় ভাতুরিয়া অবস্থিত। ভাতুরিয়ায় মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল, পাকিস্তানি সৈন্যরা গােপন সূত্রে এ খবর জানতে পেরে ভাতুরিয়া মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করে। অক্টোবর মাসে ইপিআর ও মুক্তিযােদ্ধার সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিযােদ্ধা মাে. হাসানুজ্জামান চৌধুরী, মাে, কেরামত আলী চৌধুরী ও মােঃ হামিদুর রহমান মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইপিআরএর হাবিলদার মাে. মােস্তাফিজুর রহমান ইপিআর-এর অধিনায়ক নিযুক্ত হন। তার সাথে হাবিলদার আনিস, হাবিলদার গনি, নায়েক নূর মােহাম্মদ ও পুলিশের হাবিলদার মান্নান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৯ নম্বর উইংয়ের ইপিআর হাবিলদার মাে. মােস্তাফিজুর রহমান কিছু সংখ্যক ইপিআর সৈনিক, আনসার ও মুক্তিযােদ্ধা সঙ্গে নিয়ে ভারতের অপারেশন ক্যাম্প থেকে চাপসা বিওপি’র পাশ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
ভাতুরিয়া গ্রামের পশ্চিম পার্শ্বে পুনর্গঠিত যৌথ মুক্তিবাহিনী সাময়িকভাবে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। উদ্দেশ্য, পাকিস্তানি সৈন্যদের যে-কোনাে তৎপরতাকে ধ্বংস করা। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক মাে. কেরামত আলী প্রতিরক্ষা বাংকারের। উপর উঠে শক্রর সন্ধান করার সময় লুক্কায়িত পাকিস্তানি সৈন্যরা তাকে ফায়ার করে। ফলে কেরামত আলী পড়ে যান, তৎক্ষণাৎ তাকে চিকিৎসার জন্য ভারতে পাঠানাে হয়। উভয় পক্ষে শুরু হয় প্রচণ্ড গােলাগুলি। শত্রু দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগানের ফায়ার করে। অল্প সময় ফায়ার করার পর পাকিস্তানি। সেন্যরা ফায়ার বন্ধ করে চলে যায়। কেরামত আলীর ভুড়ি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন। হয়ে যায়, তাকে ভারতের বিভিন্ন সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা করানাে হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়। অনেক সাধারণ মানুষ শহিদ এবং আহত হন।
মরিচপাড়া আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলায় বালিয়াডাঙ্গী থানার ভান্ডারদহ গ্রামে মরিচপাড়ার অবস্থান। অধিনায়ক সাখাওয়াতের নেতৃত্বে ২০-২৫জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল সম্ভাব্য সবরকম হালকা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন রাস্তায় মাইন পোঁতার কাজ শেষ করে মরিচপাড়া গ্রামের এক বাড়িতে ডিফেন্স নেয়। পার্শ্ববর্তী রাস্তা দিয়েই রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যদের যাতায়াত। এদিকে স্থানীয় রাজাকার আবদুল বারেক মুক্তিযােদ্ধাদের আগমন টের পেয়ে রাজাকার অধিনায়ক দবিরউদ্দিন, তার সহযােগী মুক্তারুদ্দিন ও ভিচাটু মােহাম্মদকে দ্রুত তা জানায়। গেরিলা দলটি এ কথা কোনাে অবস্থাতেই জানতে পারে নি। তারা বিভিন্ন জায়গায় মাইন পুঁতে এসে শারীরিক ক্লান্তি নিয়ে বেশ কয়েকজন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মাত্র ২-৩জন প্রহরী এলাকা পাহারা দিচ্ছিলেন। ১৯৭১ সালের নভেম্বরের প্রথম দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৪০-৪৫জনের সাঁজোয়া সৈন্য অতর্কিত আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা ভাবতেও পারেন নি যে, বালিয়াডাঙ্গী থানা সদর থেকে এত দূর সীমান্তবর্তী এলাকায় শত্রু সহসা হামলা করতে আসবে। তারা সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ছিলেন। তখন ডিফেন্স এলাকার বাইরে প্রহরায় ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা শরীফউদ্দিন। শত্রু তাকে গুলি করে হত্যা করে। অতর্কিত হামলায় শরীফউদ্দিন নিজেকে বাঁচানাের কোনাে ব্যবস্থাই করতে পারেন নি। তারপর শত্রু একের পর এক গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে থাকে, যেখানে মুক্তিযােদ্ধারা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
ফলে দেবেন সিংহ ও যতীন্দ্রনাথ সিংহ মৃত্যুবরণ করেন এবং সাখাওয়াত হােসেন, ফয়জুর রহমান, নিতাই সিংহ, মকবুল হােসেন, বিজয় কুমার ও মতিউর রহমানসহ কয়েকজন মারাত্মক আহত হন। অকস্মাৎ এমন আক্রমণে হতচকিত হয়ে যান মুক্তিযােদ্ধারা। তারা এরই মধ্যে পালটা গুলি ছােড়া শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধা সামছুল হক, বশিরউদ্দিন, জীতেন্দ্রনাথ, আমানউল্লাহ ও আবদুল কাদেরসহ অন্য মুক্তিযােদ্ধারা যতক্ষণ গুলি ছিল, ততক্ষণ গুলি ছুড়তে ছুড়তে যেদিকে পারেন পালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু সামছুল হক, বশিরউদ্দিন ও আমানউল্লাহ গুরুতর আহত অবস্থায় পালাতে পেরে শক্রর হাতে ধরা পড়েন। এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে প্রথমে কোনাে সাপাের্টিং পার্টি অথবা সাপাের্টিং ফায়ারের ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু পরে সাপাের্টিং পার্টি খবর পেয়ে পালটা আক্রমণ করতে এলে শত্রুরা আহত মুক্তিযােদ্ধাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে স্থান ত্যাগ করে লাহিড়ী হয়ে বালিয়াডাঙ্গী চলে যায়। সেখানে বন্দি মুক্তিযােদ্ধাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালানাে হয়। আমানউল্লাহকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। বাকি ২জনকে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থলে শহিদদের লাশ পরদিন সােবহানপাড়া নামক স্থানে নাগর নদীর পাড়ে দাফন করা হয়। আজও সেখানে তাদের সমাধি বিদ্যমান। এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন।
গনিরহাট আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল থানার অন্তর্গত চাপসা সীমান্ত এলাকায় গনিরহাট। গনিরহাটে ছিল শত্রুর ক্যাম্প। নভেম্বর মাসে ইপিআর, মুজাহিদ ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী গঠিত হয়। গনিরহাট যুদ্ধে ইপিআর-এর সুবেদার সফিউল্লাহ, সুবেদার আনিস ও হাবিলদার আবদুল মালেক নেতৃত্ব প্রদান করেন। মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল গনিরহাট রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে তাদের সমূলে ধ্বংস করা। সুবেদার সফিউল্লাহ, নায়েব সুবেদার আনিস ও হাবিলদার আ, মালেকসহ ইপিআর সদস্য ছিল প্রায় ১৫-২০জন। সঙ্গে আনসার ও কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ভারতের মুক্তিযুদ্ধের অপারেশন ক্যাম্প থেকে চাপসা সীমান্ত ফাড়ি হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৭টায় গনিরহাট রাজাকার ক্যাম্পের চারপাশে মুক্তিবাহিনী পজিশন নিয়ে একসাথে হামলা করেন। সে হামলার পালটা উত্তর দেওয়ার মতাে যােগ্য কোনাে রাজাকার ছিল না। তাই সেদিন বাধ্য হয়ে তারা অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পাকিস্তান বাহিনীর পরিকল্পনা ছিল যে, মারা যায় তাে রাজাকার বাহিনী। মারা যাক, তাই তারা গনিরহাটে ক্যাম্প করেছিল। রাজাকাররা মুক্তিবাহিনীর সংবাদ সংগ্রহ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে পীরগঞ্জে পৌছাবে, আর মুক্তিবাহিনীর প্রাথমিক আক্রমণ প্রতিহত করবে। রাজাকাদের নিরীহ জনগণ এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বাড়িঘরে অত্যাচার করে শত্রুকে খুশি করাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।  এ আক্রমণে ২৫জন রাজাকারকে অস্ত্রসহ হাতেনাতে ধরে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। এ মুক্তিবাহিনী আরও যেসব স্থান থেকে রাজাকার ধরে অথবা আটক করে, সেগুলাে হলাে: ৩০জন (ফকিরগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্প থেকে), ২২জন (যাবরহাট রাজাকার ক্যাম্প থেকে), ৩৫জন (কনাই স্কুল রাজাকার ক্যাম্প থেকে)।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!