দোলুয়া আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার উত্তরে লাহিড়ীহাট হয়ে আরও উত্তরে প্রায় সীমান্তবর্তী স্থান দোলুয়া। দোলুয়ায় পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল। অনতিদূর ভারত থেকে মুক্তিযােদ্ধারা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না। পারে, সেজন্যই তারা দোলুয়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৯৭১ সালের ২৯ অক্টোবর অধিনায়ক সাখাওয়াত হােসেনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর ১৫জনের ১টি শক্তিশালী দল রাইফেল, এসএলআর, স্টেনগান, গ্রেনেড নিয়ে শত্রু ও অবাঙালি রাজাকারদের যৌথ ক্যাম্পে হামলা চালায়। দিনের বেলায় এখানে বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈন্য অবস্থান করত, কিন্তু রাতে ২১জন শত্রু সৈন্যের নেতৃত্বে স্থানীয় অবাঙালি ও রাজাকার বাহিনীর কয়েকজন সদস্য পাহারা দিত। মুক্তিবাহিনীর দলটির উদ্দেশ্য ছিল অতর্কিত হামলা করে শত্রুদের বন্দি করে নিয়ে যাওয়া। গেরিলা দলটি রাতের অন্ধকারে লাহিড়ী থেকে দোলুয়া পর্যন্ত রাস্তার বিভিন্ন এলাকায় মাইন স্থাপন করে। এ সময় ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে তারা টেস্ট ফায়ার শুরু করে। ঐ দিন পাকিস্তানি সৈন্যরা বেশ ভারী অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পে অবস্থান করছিল। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান। উপলব্ধি করতে পেরে তারা প্রায় ১ ঘণ্টা অনবরত গুলি বর্ষণ করতে থাকে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে মুক্তিযােদ্ধারাও গুলি চালাতে থাকেন এবং এক সময় সব গুলি ফুরিয়ে যায়। কোনাে সাপাের্ট ফায়ার না থাকার কারণে মুক্তিযােদ্ধারা। আস্তে আস্তে পিছু হটতে বাধ্য হন। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তান বাহিনীর জানমালের কোনাে ক্ষতি হয় নি।
ধনতলার সংঘর্ষ
ঠাকুরগাঁও জেলার বালিয়াডাঙ্গী থানার অন্তর্গত ধনতলা। মুক্তিযােদ্ধাদের নতুন ক্যাম্প ধনতলা। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ ও মুক্তিযােদ্ধাসহ মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা ছিল ৩২জনের মতাে। তারা বাংলাদেশের পিলার নম্বর ৩৯৪-এর ১০০০ গজ সামনে বাংলাদেশের ভিতর প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। ২জন প্রহরী নিয়ােগ করে বাকি সৈনিকেরা বিশ্রামে ছিলেন। আনুমানিক ভাের ৫টার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি ফাইটিং দল মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষার সামনে এসে ২জন সেন্ট্রিকে মেরে ফেলে এবং বাকি সৈনিকদের ঘুমন্ত অবস্থায় বাস্ট ফায়ার করে মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্যকে পঙ্গু করে দেয়। মুক্তিযােদ্ধারাও পালটা আক্রমণ করে, কিন্তু তারা শত্রুর আক্রমণের সামনে বেশিক্ষণ টিকতে পারে নি। কিছুসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা ভারতে চলে যান। এ যুদ্ধে ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ এবং ৪-৫জন আহত হন।
টাঙন ব্রিজের আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল থানার অন্তর্গত টাঙন ব্রিজ। পীরগঞ্জ থানা থেকে মাত্র ৫ কিলােমিটার পূর্বে টাঙন নদের উপর এ ব্রিজ। পাকিস্তানি সৈন্যরা যেন দিনাজপুর থেকে পীরগঞ্জের দিকে না আসতে পারে সেজন্যই মুক্তিযােদ্ধারা এ ব্রিজ ভাঙার পরিকল্পনা করেন। অন্যদিকে, শত্রুর যােগাযােগ ব্যবস্থা যাতে কোনােপ্রকার ব্যাঘাত না ঘটে, সে উদ্দেশ্যে ঐ ব্রিজ রক্ষার জন্য তারা প্রহরী নিযুক্ত করে একটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে। টাঙন ব্রিজের কাছে চাপসা সীমান্ত এলাকার ইপিআর এবং আনসার ও মুক্তিযােদ্ধা সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী টাঙন ব্রিজের পাশে শত্রুর অস্থায়ী ক্যাম্প আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। | ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে টাঙন ব্রিজের যুদ্ধে ইপিআর-এর নায়েব। সুবেদার মাে. ইয়াকুব মােল্লা ও আনসার সহিদুল ইসলাম নেতৃত্ব প্রদান করেন। উভয়ের নেতৃত্বে শক্রর উপর আক্রমণ করা হয়। ঐ যুদ্ধে নায়েব সুবেদার ইয়াকুব মােল্লা ও আনসার সহিদুলকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়। ক্যাপটেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ঐ খবর পাওয়ার অব্যবহিতপরে ৩০০-৩৫০জন ইপিআর, আনসার এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্য নিয়ে পীরগঞ্জ থানা আক্রমণ করার জন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। পথিমধ্যে দৌলতপুর দিঘির পাড়ে শত্রুর সাথে উভয় পক্ষে প্রায় ৪ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ হয়। মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। তবে পাকিস্তানি সেনাদের গুপ্তচরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
শালবাগান আক্রমণ
ঠাকুরগাঁও জেলার রানীশংকৈল থানার অন্তর্গত চাপসা সীমান্ত এলাকায় শালবাগান অবস্থিত। এ বাগানের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যাতে মুক্তিবাহিনীর কোনাে সদস্য রানীশংকৈল থানার আশপাশে না আসতে পারে। ভারতের দিকে মুখ করে শত্রুর একটি ঘাঁটি শালবাগানের মধ্যে বাংকার করে অবস্থান নিয়েছিল। এক বাংকার থেকে অন্য বাংকারে যাতায়াতের ক্রলট্রেঞ্চ এবং ওভারহেড কভার ও ক্যামােফ্লাজ করা ছিল। ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে মুক্তিযােদ্ধারা ভারতের অপারেশন ক্যাম্প থেকে চাপসা বিওপি’র পাশ দিয়ে বাংলাদেশের মধ্যে প্রবেশ করে রানীশংকৈল থানার শালবাগান পাকিস্তানি ক্যাম্প আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ইপিআর সুবেদার মাে. সফিউল্লাহ, নায়েক সুবেদার আনিছুর ও হাবিলদার মাে. কালু মিয়াসহ ১০-১২জন ইপিআর, ২০-২৫জন আনসার এবং মুক্তিবাহিনীর সদস্য ছিল মােটামুটি ৩০-৩৫জন। এটা একটি শক্তিশালী যৌথ মুক্তিবাহিনীর দল। এ দলের অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার মাে. সফিউল্লাহ। রাত ৮টা নাগাদ রানীশংকৈলের দক্ষিণে শালবাগানের মধ্যে অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করা হয়। মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যরাও পালটা জবাব দেয়। সকাল ৭টা পর্যন্ত যুদ্ধ করার পর ৩জন শত্রু সৈন্য মারা যায়। ১জনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং ১টি মেশিনগান, ৭টি এসএলআর মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। মুক্তিবাহিনীর তেমন কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – পঞ্চম খন্ড